আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মদহন

প্রচন্ড চাপ যাচ্ছে গত কিছুদিন থেকে,দমটুকু ফেলার সময় পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠি, বিরক্তি ধরে যায়, মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকি অথবা দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। কিন্তু এটা ওই কল্পনা পর্যন্ত-ই, পারিনা, ব্যস্ততা এতই বেড়ে গেছে। দিনের বেশীরভাগ সময় কাটে অপারেশন থিয়েটারে ( পোষ্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং) আর বেশীরভাগ রাত কাটে প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করে (কামলা খেটে) নিজের খরচের টাকা যোগাড় করার জন্য। বি.এস.এম.এম.ইউ(পিজি)থেকে ধানমন্ডি এসে পায়ে হেটে হাসপাতালে যাচ্ছি।

শরীরে সারাদিনের ক্লান্তির ধকল,রিকশায় উঠতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু রিকশাওয়ালাদের ভাড়া চাওয়া শুনে আর উঠতে ইচ্ছা করেনা। দমকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, ক্ষণেক্ষণে আকাশের বুক চিরে বিদ্যুত চমকাচ্ছে,রাতে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। আজ আবার 'মড়ার উপর খাড়ার ঘা', আমার সাথে রাতের যে ডাক্তার থাকার কথা ছিলো,কি যেন একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে,ফোন দিয়ে আমাকে আজকের রাতটা ম্যানেজ করে নিতে বলেছে। তবে আশার কথা, ঈদের আগে বলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১০/১২ টার বেশী না আর ঝড়-বৃষ্টি হলে নতুন রোগী ভর্তিও কম হবে,খুব জরুরী না হলে।

সুতরাং রাতটা ভালই যাবে বলে মনে হয়। রাত ১১টার দিকে সব রোগী একবার দেখে, ফলো-আপ দিয়ে রুমে এসে আয়েশ করে বসলাম। ইতিমধ্যে বাইরে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে,যাকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি । গুনগুনিয়ে সতীনাথের গান গাচ্ছি- আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা এখনি নামবে অন্ধকার.... ক্লান্তি কাটানোর জন্য এককাপ চা আর একটা বেনসন ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম । পাঁচ মিনিটও যায় নাই বসছি,হঠাৎ নার্সের ফোন-'স্যার, ৫১৩ নম্বর কেবিনে নতুন রোগী এসেছে।

' বুঝলাম 'মানুষ ভাবে এক,আর বিধাতা করে আরেক' , যাই হোক, রাতটা ভাল কাটবে এই মধুর আশা জলাঞ্জলি দিয়ে, আধা পোড়া সিগারেটটা পা চাপা দিয়ে (এমন ভাব,যেন সব দোষ এই সিগারেটের) রোগী রিসিভ করতে গেলাম। নার্সকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম এটা গাঈনী কেস, সুতরাং একদিক দিয়ে আমার বেশী কিছু করার নাই আবার আরেকদিক দিয়ে প্যাড়া । নার্সকে কেবিনের দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকতে বললাম, পেছনে আমি। ঘরের ভেতর মৃদু আলো জ্বলছে,বিছানায় ২৪/২৫ বছরের একটা মেয়ে শুয়ে আছে,বলা যায় যন্ত্রনায় কুকড়ে আছে, হাসপাতালের সাদা চাদর দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা। মেয়েটার পাশে একজন মাঝ বয়সী মহিলা,মনে হয় মা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

হাল্কা আলোতেও বোঝা যাচ্ছে চোখ ভেজা। রোগী দেখবো বলে ওনাকে সরতে বলে রুমের আলো জ্বালিয়ে দিলাম আর মেয়েটাকে আমার দিকে ফিরতে বললাম। মেয়েটা আস্তে করে আমার দিকে ফিরলো আর আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেলো,আমার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেলো সুদুর অতীতে- আমরা দুজনেই 'সন্ধানী'র সদস্য ছিলাম। সেবার-ই প্রথম ও যোগ দিয়েছিলো আমাদের সাথে। মেয়েটির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো একুশের সাদা-কালো সকালে, প্রভাত ফেরী শেষে টিএসসিতে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসুচীতে।

প্রথম দেখাতেই ওকে ভালো লেগে যায়,বলা যায় 'প্রথম দর্শনেই প্রেম' । , হিমালয়ের তুষার শুভ্রতার অন্তরালে জন্ম নেয়া নাম না জানা এক ফুলের মতই স্নিগ্ধ লাগছিলো ওকে। মেয়েটা দেখতে কিন্তু খুব-ই সাধারন,আটপৌরে বাঙ্গালী নারীর প্রতিচ্ছবি যেন। কিন্তু ওর এই সাধারনত্ব-ই আমার চোখে অসাধারন হয়ে ধরা দেয় । মেয়েটার অসম্ভব মায়াময় একজোড়া চোখ ছিলো,যে চোখের দিকে তাকিয়ে সময় পার করে দিতে একটুও একঘেয়ে লাগবে না।

নাম জিজ্ঞেস করায় জানালো ওর নাম 'অথৈ'। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক আরো কথা হল আমাদের। যাই হোক, সারাটা দিন একসাথে থাকার ধকলটা খুব সহজে সামলাতে পারলাম না এরপর থেকে। নিজের অজান্তেই ওর ছবি, হাসি মনঃশ্চোখে ভেসে উঠতো এবং কুংফু ক্যারাট চেলে হৃদয়টাকে দুর্বল করে ফেলতো। এই অনুভুতির সাথে আমি পরিচিত নই।

প্রথম কয়দিন এই ভেবে সান্তনা নিলাম যে-এটা ক্ষনিকের মোহ, সময়ে কেটে যাবে। পড়াশোনা, আইটেম, কার্ড,টার্ম, ওয়ার্ড, রোগী এসব নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম। কিন্তু দিনশেষে ফলাফল শুন্য। যতই ভুলতে চাই,ততোই যেনো ওর কথা বেশী করে মনে পড়ে। আমার অবস্থা তখন ওই গানের মত-তোর জন্য আমি বন্যমাতাল অনুভব জুড়ে সব শুন্য...আমি ভেবে ভেবে মরি,তোর মনে আছে কিদিশেহারা আমি যে তোর প্রেমে পড়েছি ।

'তো এই যখন অবস্থা,তখন ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনোসিস থেকে কনফার্মেটরি ডায়াগনোসিস এ পৌছালাম যে -'আমিতো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে। ' 'স্যার,ম্যাডাম আপনার সাথে কথা বলবেন'- নার্সের কথায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। ম্যাডামের সাথে ফোনে কথা বলে জানতে পারলাম এটা হলো এ্যবোরশন এর কেস, সুতরাং জরুরী ভিত্তিতে রক্তের কিছু পরীক্ষা করতে হবে এবং রোগীর লোকজনকে ৪/৫ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে বলতে হবে। আর রোগী বেশি খারাপ হয়ে গেলে ম্যাডামকে আনার জন্য যেন অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়। শেষে কিছু সিম্পটমেটিক ট্রিটমেন্ট এর কথা বলে উনি ফোন রেখে দিলেন।

ওনার কথা মতো ব্যাবস্থা গ্রহন করে রুমে এসে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। মন বড় বিক্ষিপ্ত,বড্ড এলোমেলো। এখন একটাই চিন্তা-পালাতে হবে এখান থেকে,কোনোভাবেই আমি ওর মুখোমুখি হতে চাইনা, আসলে বর্তমান আমাকে যে অতীতের সামনে দাড় করিয়েছে তার মুখোমুখি হতে চাইনা। অতীত স্মৃতি যে বড় কষ্টের,বড় যন্ত্রনার। আবার ইচ্ছা করছে অথৈকে আরেকবার দেখে আসি, তারপাশে গিয়ে বসি,ওর হাতটা ধরে বলি-'দেখো, তোমার কিচ্ছু হবেনা, আমি হতে দিবোনা।

' হাসি পায়,পাগলের মত হাসতে ইচ্ছা করে- এসব কি ভাবছি আমি? এসব কথা ভাবা বা বলার অধিকার কি আমার আছে? অধিকার কি আমি নিজেই পায়ে ঠেলে অন্যের হাতে তুলে দেইনি? ধিক্কার হয় নিজের উপর, যে ভালবাসার অমর্যাদা একবার আমি করেছি, সেটা নিয়ে ভাবার অধিকার আমার আর নেই। আর এসব কথা চিন্তা করার সময় এবং বয়স দুটোই তো পেছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু সেই মানুষটা কই, অথৈ এর সবকিছুর উপর যার অধিকার? একবার ও তো দেখলাম না মানুষটাকে। নাহ, মনটাকে শান্ত করা দরকার। রুমের বাতি নিভিয়ে জানালার পাশে চেয়ার নিয়ে বসলাম।

বাইরে বৃষ্টির তেজ অনেকটা কমে এসেছে,কিন্তু পুরোপুরি থামেনি, চারদিকে মাটির কেমন জানি একটা সোঁদা গন্ধ। মুঠোফোন থেকে শ্রীকান্তের 'আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ' গানটা ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে অতীতের দরজাটা খুলে দিলাম- আমি খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলাম। কথা বলতাম কম, মানুষের সাথে মিশতেও কেমন জানি অনিহা। সেকারনে ২/১ জন ভাল বন্ধু ছাড়া বাকি সবার সাথেই হাই/হ্যালো সম্পর্ক। আর বয়েজ স্কুল ও কলেজে পড়ার কারনে মেয়েদের থেকে ১০০ হাত দুরত্ত্ব বজায় রাখার অলিখিত নিয়ম মেনে চলতাম,খুব দরকার না হলে তাই মেয়েদের সাথে কথা বলতাম না।

কিন্তু এখনতো আমার 'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে' দশা। প্রেম তো আমার উপর পড়লো,কিন্তু যার কারনে প্রেম আমার উপরেই পড়লো,তাকে তো ব্যাপারটা জানাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো-'বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবো কিভাবে?'কারন পৃথিবীর সব থেকে কঠিনতম কাজ হলো- যাকে ভালবাসা হয়, তাকে ভালবাসার কথা বলা। পৃথিবীতে খুব কম বীরপুরুষই আছে যারা সরাসরি ভালবাসার মানুষকে প্রোপজ করতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই আমার মতো, যারা ভালবাসার মানুষকে তাদের মনের আকুতি জানানোর জন্য বন্ধুমহলের সাহায্য নেয়।

আমিও এই সুত্র অনুসরন করে আমার দুই বিটলা বন্ধুর (কু)পরামর্শ নেয়ার জন্য তাদেরকে ব্যাপারটা জানালাম। ওরা তো প্রথমে হেসেই খুন-'ওই আমাগো আসিফ,যার মাইয়া দেখলে দুই ঠ্যাং কাপে,হ্যায় প্রেমে পড়ছে...দাড়া,আগে হাইস্যা লই...হাহাহাহা। ' এদের বিশ্বাস করাতেই আমার নাভিঃশ্বাস। পরে অবশ্য এদেরই যাবতীয় কুপরামর্শ সাথী করে আমার মিশন ইম্পসিবল ১ এ নামি। 'বাচতে হলে জানতে হবে' যেমন,তেমন-ই কাউকে জিততে হলে কথা বলতে হবে,তাই প্রথমেই মোবাইল নম্বরটা যোগাড় করি।

এ বিষয়ে ওদের পরামর্শ ছিলো-' ভুলেও দিনের বেলা কখনো ফোন দিবিনা। সব সময় রাতে ফোন দিবি কারন খোদার খেয়ালে রাতের বেলাতেই বঙ্গ ললনাদের ঘাড়ে কথা বলার ভুত চাপে। ' তো ফোন দেয়ার পর প্রথম দিকে তো কথাই বলতে চায়না, দু'একটা কথা বলার পর-ই ফোন রেখে দিলো। মন একটু খারাপ হলো,কিন্তু 'পরাজয়ে ডরে না বীর' এই মনোভাব নিয়ে ওকে ফোন করতেই থাকলাম। আর কলেজে তো প্রায়ই ওর সাথে দেখা হয়ে যেত ওয়ার্ডে, বেকুবের মতো তাকিয়ে দেখতাম ওকে,ওর কথা বলা,ওর হাসি,ওর চপলতা।

অনেক সময় ধরা পড়ে যেতাম ওর চোখে,তখন চোখ নামিয়ে নিতাম দুজন-ই, আর আমি হার্টের কয়েকটা বিট মিস করতাম। যেদিন ওকে দেখতাম সেদিন সবকিছুই ভালো লাগত, আইটেম এ ফেল করলেও গায়ে লাগতোনা,আর যেদিন ওর দেখা পেতামনা সেদিন আক্ষরিক অর্থেই কিছু ভালো লাগতোনা। এর ভেতর ফোনে কথা বলার পরিমান আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে,কথা হতো একদম দৈনন্দিন জীবন নিয়ে,কখনো ব্যাক্তিগত পর্যায়ে নামতে পারতাম না/দিতোনা। অবশেষে ৬ মাস পর বরফ গললো। সেদিন সে-ই প্রথম ফোন দিলো আমাকে।

বলতে গেলে গত দেড়মাস আমি ওকে তেমন একটা ফোনই দেই নাই কারন তখন আমার সেকেন্ড প্রফ চলছিলো আর এক একটা প্রফ যে কি ভয়াবহ হয়,তা একমাত্র যে মেডিকেলে পড়ে সে-ই বুঝতে পারে। আর এ সময়টাতেই নাকি সে বুঝতে পারে, ও আসলে আমাকে মিস করে। মনের অজান্তেই সে আমার ফোনের প্রতীক্ষা করতো প্রতিরাতে। কিন্তু আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে কখনোই ফোন দেয় নাই। তাই পরীক্ষা শেষ হবার পর আর এক মুহুর্ত দেরি না করে সমস্ত লজ্জা এবং আড়ষ্টতা ভেঙ্গে আমাকে ফোন করে।

এখনো মনে আছে,পরীক্ষা দিয়ে অনেক ক্লান্ত থাকার পরও ফজরের আজান পর্যন্ত কথা বলি আমরা। এরপর বলতে গেলে ও একপ্রকার জোর করেই আমাকে ঘুমাতে পাঠায়। সারাদিন মরার মতো ঘুমিয়ে রাতে ফোন দিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি-আজই ওকে প্রোপজ করবো,কিন্তু প্রথাগতভাবে 'আমি তোমাকে ভালবাসি' বলে প্রোপজ করতে ইচ্ছা করছিলনা। আমার বিশ্বাস ছিলো,আমার ভালোবাসার কথা বললে ও ফেলতে পারবেনা।

তাই ওকে একটু অন্যভাবে জানালাম আমার ভালোবাসার কথা। ফোন ধরেই জানালাম আজ শুধুমাত্র একটা গান শোনাবো। তারপর গিটার এনে Enrique এর একটা গান শোনালাম,যার কথাগুলো এরকম- You know I got this feelings,that I just cant hide I try to tell you how I feel but words don't come easily I wish I was your lover,I wish that you are mine Don't try to run away,there's many things I wana say-Let me be the one(সংক্ষিপ্ত) গানটা শোনার পর অনেকক্ষন ওপাশ থেকে কথা নাই। ভাবলাম ভুল হয়ে গেছে, হয়তো শুধু বন্ধু হিসেবেই মিস করে-এর বেশী কিছুনা। 'এখন রাখি,রাত তো অনেক হলো'- বলে ফোন রেখে দিলো।

নিজেকে তখন গালি দিচ্ছি হতাশায় আর স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায়। ফোন/এস.এম.এস দিলাম কিন্তু কোন জবাব নাই। নির্ঘুম রাত কাটে,সকাল হতেই বিটলা বন্ধুদের ফোন দিয়ে সব খুলে বলি এবং আমার কাহিনী শুনে ওরা রীতিমত গবেষনায় বসলো যে আমার মাথায় গ্রে ম্যাটার (মস্তিষ্কের বুদ্ধি বৃত্তীয় অঞ্চল) এর পরিমান কতটুকু আর যেটুকু আছে তা হোয়াইট ম্যাটার(মস্তিস্কের স্নায়ুবিহীন অঞ্চল) দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে কিনা। সারাদিনের প্রতীক্ষা শেষে মহারানী অবশেষে রাতে ফোন দিলেন এবং আমার গতরাতের ডায়লগগুলা ঝাড়লেন,যে উনিও আজকে একটা গান শোনাবেন আমাকে যা থেকে আমি আমার গানের উত্তর পেয়ে যাবো। আমিও সুবোধ বালকের মত রাজি হয়ে গেলাম।

গানের কথাগুলো এরকম- 'যখন থামবে কোলাহল,ঘুমিয়ে পড়বে ধরনীআকাশের ঊজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করে যখন জ্বলবে,বুঝবে আমি তোমায় ডাকছিসে রাতে তুমি জেগে থেকো প্রিয়,ঘুমিয়ে পড়োনা। ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ো আমি আসছি, আর যদি কোকিল ডাকে বুঝে নিয়ো আমি আর দূরে নেইআর হঠাৎ বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছিসে রাতে তুমি জেগে থেকো,ঘুমিয়ে পড়ো না প্রিয়। ' পরদিন ওকে দেখা করতে বলে ফোন রেখে দেই। সেদিনও আকাশ ছিলো মেঘলা। ও আসতে আসতে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।

অথৈকে সেদিন অপুর্ব লাগছিলো - সাদা রঙয়ের পাজামার সাথে আকাশী নীল জামা সাথে ম্যাচিং ছাতা আর চোখে কাজল। আর আমার হাতে ছিলো ২৩টা সাদা গোলাপ আর তার মাঝে একটা বড় লাল গোলাপ দিয়ে বানানো ফুলের তোড়া সাথে একটা কার্ড যাতে লেখা ছিলো- দু'হাত দিয়ে আগুন ধরার সাহস পেলে হাতটি ধরোদুঃখ সওয়ার সাহস হলেই মনের ঘরে কড়া নেড়োসব ছাড়িয়ে একলা চলার সাহস হলে সঙ্গে এসোঅথৈ জলে ডুবে মরার ইচ্ছে হলে ভালবেসো। সাদা গোলাপের তাৎপর্য হলো ওকে ছাড়া এই ২৩টা বছর সাদা গোলাপের মতোই বর্ণহীন ছিলো আর লাল গোলাপ তো ভালোবাসার প্রতীক। বৃষ্টির ভেতর ওকে যখন হাটুগেড়ে ফুলের তোড়াটা দিয়ে ভালোবাসার কথা বলি ওর চোখে তখন শ্রাবণের অশ্রুধারা। সেদিন থেকে শুরু হলো এক নতুন পথচলার,এক নতুন স্বপ্নযাত্রার।

হৈমন্তী গল্পের অপুর মতো আমিও বললাম-'পাইলাম,আমি ইহাকে পাইলাম। ' প্রতিদিনই আমাদের দেখা হতো-কখনো ওয়ার্ডে, কখনো লাইব্রেরী তে আবার কখনো ক্যান্টিনে। যান্ত্রিক জীবনে হাপ ধরে গেলে দুজনেই দূরে চলে যেতাম,হাত ধরে প্রকৃতির মাঝে হারাতে। লেখাপড়া, পরীক্ষা এসবের প্রতিও আমরা খুব কেয়ারিং ছিলাম। যেদিন যে বিষয়ের উপর আইটেম/কার্ড তার আগের দিন ব্রেক টাইমে অথবা কলেজ ছুটির পরে লাইব্রেরীতে পড়া বুঝিয়ে দিতাম আর রাতের বেলা পড়া নিয়ে তারপর ঘুমাতে পাঠাতাম।

অথৈও আমার পড়ার সময়ে ফোন দিতোনা,বেশী মিস করলে এস.এম.এস দিতো। রাতের বেলা আমরা সারাদিন কি করলাম তার গল্প করতাম অথবা ও নতুন কি রেসিপি শিখেছে তা বলতো আর আমি বলতাম নতুন কি মুভি/গান দেখেছি/শুনেছি। আঙ্গুলে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা খেয়ে তন্ময়তা ভাঙ্গলো। রাত প্রায় একটা। একবার যেয়ে দেখে আসা দরকার কি অবস্থায় আছে মেয়েটা।

কেবিনে নক করে ভেতর ঢুকলাম। মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরে আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে আমার পরীটা। আমার পরী? নাহ, ও তো এখন অন্যের। অনেক বেশী ফ্যাকাসে লাগছে। রক্ত পরীক্ষার কাগজগুলো হাতে নিয়ে আঁতকে উঠি, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান যে মাত্র ৬, এক্ষুনি রক্ত দিতে না পারলে তো পরে যমে মানুষে টানাটানি করতে হবে।

ওর মাকে জিজ্ঞেস করি- 'আন্টি, এখনো রক্তের ব্যবস্থা করেন নাই? ওর তো ইমিডিয়েট রক্তের প্রয়োজন। আপনাকে না বলে গেলাম তখন? আর আপনাদের আর লোকজন কোথায়? ওনার হাজব্যান্ড কই?' জবাবে ওর মা জানালো -'রক্তের খোজে ওর বাবা ব্লাড ব্যাংকে গেছে, কিন্তু ঈদের আগে বলে রক্ত বা ডোনার পাওয়া যাচ্ছেনা। ওর আর ওর ছোট ভাই এর রক্তের গ্রুপ এক কিন্তু ওর ছোট ভাই তো থাকে সিলেটে, সকালের আগে আসতে পারবেনা। ' 'কিন্তু ওনার হাজব্যান্ড,উনি কোথায়?' আমার প্রশ্ন শুনে ওনার মুখটা প্রথমে করুণ হলো, তারপর আঁচলে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। 'কাদবেন না মা,বলেন কি হয়েছে।

' নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে উনি বলতে শুরু করলেন- 'ছোটবেলা থেকেই অথৈকে যথেষ্ট স্বাধীনভাবে মানুষ করা হয়েছে যাতে করে ও বড় হলে নিজের পায়ে নিজেই দাড়াতে পারে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে। কখনো ও আমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি। ও যখন ফোর্থ ইয়ারে তখন ওর জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ পাই। ছেলে ইংল্যান্ড থেকে পড়া শেষ করে দেশে ভালো একটা চাকরী করে। যেখানে বেশীরভাগ মানুষ-ই বিদেশের মোহ কাটিয়ে দেশে ফেরেনা সেখানে ছেলেটা দেশের টানে, পরিবারের টানে ফিরে এসেছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনে ধরে খুব। যার কারনে ওর মতামত না নিয়েই এখানে ওর বিয়ে দিয়ে দেই। আর ও ও আমাদের সিদ্ধান্তের কোন প্রতিবাদ করে নাই। প্রথম দিকে সব-ই ভাল ছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো আথৈ MBBS পাশ করার পর।

প্রথমে মৃদু আপত্তি,তারপর বলা যায় একরকম জোর করেই ওকে চাকরী বা পোষ্ট গ্রাজুয়েশন থেকে বিরত রাখে ওর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সংসারের সুখের কথা চিন্তা করে অথৈ মেনে নেয় সব। কিন্তু এবার সমস্যা শুরু হয় যখন ওরা জানতে পারে অথৈর গর্ভের সন্তান মেয়ে। কাজী বংশের প্রথম সন্তান ছেলে হবে, এটাই ওদের বংশের রেওয়াজ। সুতরাং এই সন্তান নষ্ট করতে হবে।

অথৈ কোনভাবেই রাজী হয়না,মাঝে মাঝে গায়েও হাত উঠাতো রাজী করানোর জন্য। যখন কোনভাবেই রাজী করাতে পারেনা, তখন ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয় জানোয়ারটা। মোক্ষম আঘাতটাই করে এবার আমার মেয়েকে। নিজের সংসার বাচানোর জন্য, সমাজের নোংরা কথা থেকে বাঁচার জন্য ও রাজী হয়। যেদিন এম.আর (ক্রিমিনাল এ্যবোরশন এর ভদ্র/ডাক্তারী নাম) করা হয় সেদিন থেকেই প্রচুর ব্লিডিং হতে থাকে।

অথচ ওকে এই অবস্থায় রেখে কি এক কনফারেন্সের নাম করে ওই রাতেই ওর জামাই থাইল্যান্ড চলে যায়। অবস্থা বেশী খারাপ হয়ে গেলে তখন ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকজন আমাদের খবর দেয়। ম্যাডাম আমাদের পরিচিত,তাই উনি আমাদেরকে এখানে ভর্তি হতে বলেন। ' কথাগুলো বলে উনি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু এবার আমি আর কান্না থামানোয়া চেষ্টা করিনা।

কাঁদুক, কেঁদেকেঁদে বুকে জমানো কষ্টের বোঝা হাল্কা করুক। আর আমি হতভম্ব হয়ে বসে আছি,আর আছে একটা অক্ষম রাগ। একটা মানুষ কিভাবে এতটা পাশবিক হতে পারে? যাকে সবাই 'প্রগতিশীল' বলে ধরে নিয়েছিল,সে এতোটা 'গোঁড়া'? এইসব তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষের জন্যই আজ আমাদের সমাজের এই দুরবস্থা। মাথা থেকে একটু আগের পালানোর চিন্তা ঝেড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি- আমার পাপের প্রায়শ্চিত্য এবার করবো। অথৈকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে আমার পথ চলার সাথী করে নেবো এবং সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই আমি তা করবো।

যে সমাজ দিনের আলোতে প্রগতিশীলতার ফাঁপা বুলি আওড়ায়, আর রাতের অন্ধকারে গোড়ামীতে আচ্ছন্ন হয়, যে সমাজ শুধু 'লিঙ্গ' এর পরিচয়কেই প্রাধান্য দেয়,সে সমাজের প্রতি আমার তীব্র ঘেন্না। সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি অথৈর পাশে গিয়ে বসি। গভীর ঘুমে অচেতন। ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আগের দিনগুলোতে ফিরে যাই যখন আমি আমার শিক্ষা জীবনের এর শেষদিকে। সামনেই আমার ফাইনাল প্রফ, পাশ করতে পারলেই 'ডাক্তার'।

এতদিনের সাধনা, কষ্ট সব সফল হবে। স্বপ্ন পুরনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাকে পূর্ণ রূপ দেবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম। দিনে মাত্র ৩-৪ ঘন্টার জন্য বাসায় যাই, বাকীটা সময় কখনো লাইব্রেরীতে গ্রুপ স্টাডি করি, কখনোবা ওয়ার্ডে রোগীর পাশে বসে শেষ মুহুর্তের প্রস্ততি নিই। এরই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। সার্জারী পরীক্ষার আগেরদিন অথৈ ছুটে আসে আমার কাছে।

কাহিনী কি? বাসা থেকে ওকে না জানিয়েই ওর বিয়ে ঠিক করেছে, ওই রাতেই ওদের এঙ্গেজমেন্ট। কিন্তু আমি এখন কি করবো? আমিতো পালিয়ে বিয়ে করবোনা। অথৈ বলে ওর সাথে গিয়ে শুধু একবার ওর বাবা মায়ের সামনে দাড়াতে,আমাদের কথা বলতে। বাকিটা সে ম্যানেজ করতে পারবে। পরীক্ষার শেষে না হয়...... ।

কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়ে এখনই বিয়ে করার বিলাসিতা যে আমাকে মানায় না। এখনো যে অনেক পথ পাড়ি দেয়ার বাকি। চকিতে চোখে ভেসে উঠে বাবা মায়ের মুখ যারা অনেক কষ্ট করে আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন,যাদের চোখে আমাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন,যারা আমার পড়ালেখা যাতে স্বচ্ছন্দ গতিতে চলতে পারে সেজন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন কোন অভিযোগ ছাড়াই,কিভাবে নিজের সুখের চিন্তা করে তাদেরকে ঠকাই??নাহ, আমি পারি নাই অথৈর আহবানে সাড়া দিতে। আমি পারি নাই ওর বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাড়াতে। পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ সেদিন আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিলো।

রাতে অথৈ ফোন করে একটা কথাই বলে- 'ভালোবাসা কাপুরুষদের জন্য না। ' ওটাই ছিলো ওর সাথে আমার শেষ কথা, এরপর আর কোনদিন ওর সাথে কথা হয় নাই। একসময় পরীক্ষা শেষ হয়,৩ মাস পর পাশ করে ডাক্তারও হয়ে যাই। কিন্তু স্বপ্ন পুরণ হওয়ার কোন আনন্দ আমাকে স্পর্শ করেনা। অন্যরা যখন স্বপ্ন পুরনের আনন্দে বিভোর, তখন আমি অন্য এক স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় নীল।

সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা হলো আমার নতুন সাথী। মানুষের রোগ, শোক, মৃত্যু, আনন্দ কোন অনুভতিই আমাকে স্পর্শ করেনা। আমার দেহের মাঝে আমার আত্মার মৃত্যু হয়েছে আমারই কারণে। হঠাৎ করেই অথৈ ছটফট শুরু করে।

ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি আমার কাছে ভাল মনে হয়না। নার্সকে ডাকলাম। ব্লাড প্রেসার অনেক কমে গেছে। হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। মনের মধ্যে খারাপ চিন্তাটাই আগে আসলো- ও হয়তো শক এ চলে যাচ্ছে,আর যেহেতু শরীরে রক্তের পরিমান খুবই কম এ্যনিমিক হার্ট ফেইলর ও হয়ে যেতে পারে।

ম্যাডামের সাথে কথা বলে তখনই আই.সি.ইউ তে নেয়ার ব্যবস্থা করি। একবার আমি আমার ভালবাসাকে হারিয়েছিলাম, এবার আমি আর কিছুতেই আমার অথৈকে হারিয়ে যেতে দিবোনা। কিন্তু অথৈ আমাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ব করার সুযোগ দিলোনা। আর সবার সাথে আমাকেও ফাকি দিয়ে ও চলে গেলো না ফেরার দেশে। আর আমি? বেচে থেকে দ্বিতীয়বার মারা গেলাম।

জানাজায় প্রচুর মানুষ হলো। দিনটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। একটানা বাতাস বইছিলো শোঁশোঁ করে। মাঝে মধ্যে ঈলশে গুড়ি বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছিলো সবাইকে। আমার প্রাণহীন,নিথর অথৈকে যখন কবরে নামানো হলো তখন একটা মাতম উঠলো।

কিছু কিছু কান্না আছে যা শুনলেই কষ্টটা সম্পর্কে শুধু যে একটা ধারনা হয় তাই না, ঠিক সেই পরিমান কষ্ট নিজেরও হতে থাকে। আমার ভেতরেও হাহাকারের সুর তীব্রভাবে বেজে উঠলো। আর দুঃখ, ক্ষোভ, গ্লাণিবোধ আমার হৃদপিন্ডটাকে যেনো পিষে ফেলতে লাগলো। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারন হয়তো লেখা আছে- 'হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু' কিন্তু আমি জানি ওর এই পরিনতির জন্য যারা দায়ী তাদের অন্ততঃ দুজন আজ এই জানাজায় উপস্থিত এবং তার একজন অবশ্যই আমি। কোনভাবেই আমি এই দায় এড়াতে পারিনা।

পুনশ্চ: ৩০ বছর পর...বসন্তের কোন একদিন। ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় একা একটা চেয়ারে বসে আছি। ভোরের আলো ফুটছে। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ সবচেয়ে বড় তারাটা মিটমিট করছে দেখে চমকে উঠলাম।

নিচের বাগান থেকে ফুলের গন্ধ এসে নাকে ঢুকলো। দূরে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠলো। তারপর হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে লুটিয়ে পড়লো গায়ে। সেই গানটা বেজে উঠলো মনে। উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বললাম-'জেগে আছি, আমি জেগে আছি।

' ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।