আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মন্দের ভালো

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। মন্দের ভালো মোহাম্মদ ইসহাক খান আহসান সাহেব দীর্ঘ দশ বছর পরে নিজের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন। কী আশ্চর্য, বাসস্ট্যান্ডে এসে নামা মাত্রই তাঁর নাক দিয়ে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেলো, বেশ ফুরফুরে ঠেকল শরীরটা।

তিনি বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন, আহ, কি পরিষ্কার বাতাসটা। কে যেন বলেছিল, গ্রামের ধুলোবালিও পরিষ্কার, সেটা নাকে ভরে রাখলেও কোন ক্ষতি নেই! আর শহরের কী অবস্থা, সেটা তাঁর থেকে ভালো আর কে জানে? তাঁর ধুলোবালি সহ্য হয়না, সারাবছর ঠাণ্ডা লেগেই থাকে, নাক মুছতে মুছতে নাকের ভেতরটা "ছিলে" গেছে, এখন জ্বালা করে; হাঁচি দিতে দিতে মাথার বাঁপাশটা ব্যথা হয়ে যায়, কোন ওষুধেও কাজ হয় না। কদিন ধরে আবার খেয়াল করছেন, কফের সাথে কালচে কী একটা যাচ্ছে, কে জানে, ধুলোবালি ফুসফুসে ঢুকে দলা পাকিয়ে আছে কীনা! এখান থেকে তাঁর পৈতৃক ভিটা অনেক দূরে, নবগ্রামে, এখান থেকে এক-দেড় ঘণ্টার রাস্তা। পুরোটাই কাঁচা রাস্তা, মাঝখানে অবশ্য ইট বিছিয়ে পাকা করার পাঁয়তারা হচ্ছিল, কিন্তু বর্ষার পানি এসে সব ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে। এখন গ্রামে যাওয়ার উপায় পায়ে হেঁটে অথবা ভ্যানে।

ওই তো ব্রিজের নিচটায় ভিড় করে আছে অনেকগুলো ভ্যান আর রিকশা। ঢাকা থেকে এইমাত্র এসে নামা যাত্রীদের ডাকাডাকি করছে। আহসান সাহেব একটা ভ্যান ঠিক করলেন। একা এসেছেন, কাজেই কোন ঝামেলা নেই, কারো সাথে জায়গা ভাগাভাগির ব্যাপার নেই, তিনি সাথে আনা ব্যাগটা তুলে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লেন; পা ঝুলিয়ে আরাম করে বসলেন। ভ্যানওয়ালা বেশ হাসিখুশি মানুষ, জিজ্ঞেস করলেই বলে দিচ্ছে এদিককার অবস্থা।

আহসান সাহেব দিব্যি গল্প জুড়ে দিলেন তার সাথে। ভ্যানওয়ালার বয়স আর কত হবে, ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে, সে তাকে চাচা বলে ডাকছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই ব্রিজ কবে হল? চাচা, এই "বিরিজ" কি আইজকার কথা? পাঁচ বছর হইয়া গেছে। গেলোবারের বন্যায় যহন সাঁকোডা ভাইঙ্গা গেলো, তহন সরকারে ট্যাকা দিয়া পাকা "বিরিজ" বানাইয়া দিলো। বাহ, ভালো তো।

কত সুবিধা। নইলে তো এই খাল নৌকায় পার হতে হতো। হ, ঠিকই কইছেন চাচা। ম্যালা সুবিধা হইছে। তয় কয়েক বছরের মইদ্দে তো এইহানে আর খালই থাক্‌তো না।

সবাই জায়গা দহল কইরা চাষবাস করতাছে। আচ্ছা, তোমাদের চেয়ারম্যান এখন কে? চেয়ারম্যান? মফিজ মিয়া। মফিজ উদ্দিন তালুকদার? হ চাচা। নাম হুনছেন? আহসান সাহেবের মুখে হাসি খেলে যায়, তিনি নাম শুনেছেন। তিনি যখন শেষবার গ্রামে এসেছিলেন, তখনো মফিজ মিয়া চেয়ারম্যান হবার জন্য প্রতিবারই প্রাণপণে চেষ্টা করতো।

ইলেকশান করা সোজা খরচের কথা নয়, কিন্তু তিনবার "ঠগ" খাওয়ার পরেও তার শিক্ষা হয়নি, সে আবারো চেষ্টা করেছে। দুষ্ট লোকে বলতো, তার বউ পর্যন্ত তাকে ভোট দিত না। শেষে দেখা যাচ্ছে সবুরে মেওয়া ফলেছে, মফিজ মিয়া চেয়ারম্যান হতে পেরেছে। তা সে মানুষ কেমন? তোমাদের সুখদুঃখ দেখে তো? ভ্যানওয়ালা ঠোঁট উল্টায়। কী যে কন্‌ চাচা, চেয়ারম্যান দ্যাখবো আমাগো দুঃখকষ্ট, তাইলে তো হইতোই।

ধরেন সরকার যদি একটা কাজ করবার লেইগা দশ ট্যাকা দেয়, হ্যায় নয় ট্যাকা নিজে খায়, বাকি এক ট্যাকা দিয়া কাজ করে। একশো বস্তা গম দিলে নব্বই বস্তা গুম হইয়া যায়, বাকি দশ বস্তা আমরারে দেয়। তাহলে ভোট দিলে কেন? যে তোমাদের দেখে না, তাকে জেতানোর দরকার কী? আহসান সাহেব ভাবলেন, মফিজ মিয়া তো দেখা যায় গভীর জলের মাছ। ভ্যানওয়ালা বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, কী কন চাচা? ভোট একজনেরে তো দিতেই হইব। মফিজ মিয়া তো ভালা লোক, হ্যায় তো তবু দশ ট্যাকার মইদ্দে এক ট্যাকার কাম করে।

কিন্তু অন্য "পাটি (পার্টি)" তো হেইডাও করতো না, দশ ট্যাকাই খাইয়া ফালাইতো, হে হে। আহসান সাহেব গভীর চিন্তায় ডুবে যান। মানুষের সামনে যখন দুটো অপশন দেয়া হয় তখন সে কী করে? যেটা ভালো সেটা নেয়, যেটা খারাপ, সেটাকে ফেলে দেয়। কিন্তু যদি এমন হয়, দুটো অপশনই খারাপ, তাহলে? তাহলে সে নেয়, সত্যি বলতে নিতে বাধ্য হয় যেটা "কম খারাপ", সেটাকে। ভ্যানওয়ালা সরলসোজা মানুষ, তার বুদ্ধিমত্তা যে খুব উঁচু মানের তা নয়, কিন্তু এই কঠিন সত্যটি সে জানে।

সে অশিক্ষিত হলেও ভেবেচিন্তেই ভোট দিয়েছে। আহসান সাহেব বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এখন আর তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাস্তার দুধারে সুন্দর দৃশ্য, ধানক্ষেত, পুকুর, গাছপালা, গরুছাগল, গ্রামের ছোট ছোট বাড়ি, দোকানপাট। তিনি এখন সেগুলোই দেখছেন।

ভ্যানওয়ালা সোজা রাস্তা পেয়ে জোরে জোরে টেনে যাচ্ছে। ঐ তো আহসান সাহেবের বাড়ি দেখা যায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.