পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু হচ্ছে নিজের মন... সবার আগে নিজের মনকে চিনুন... নিজের মনের কাছে অচেনা থাকবেন না ... হ্যাঁ, মামার কথাই বলছি। যদিও তিনি আমাদের মামা নন, তারপরও ওনাকে মামা বলেই ডাকি। বয়সে আমাদের ৭-৮ বছরের বড় হবেন। ছোটবেলা থেকেই সবকিছুর আবদার ওই মামার কাছে। পুকুরে মাছ ধরা, নদীতে সাঁতার কিংবা রাতের বেলা পাড়ার পাজি মাতব্বরের টিনের চালে ঢিল ছোড়া কোনটাই মামা ছাড়া জমত না।
তাই মামার সাথে আমাদের বয়সের গ্যাপটা টের পেতাম না। মামাদের দু-বাড়ি পরেই আমাদের বাসা। তারপরেই নিলু আপুদের বাসা...
নিলু আপুর বাসার সামনে শিমুলতলায় আমাদের নিয়মিত আড্ডা বসত। সেই আড্ডাটার মধ্যমণি যথারীতি মামা। নিলু আপু স্কুলে যেতেন শিমুলতলার সামনে দিয়েই।
তখনও আমাদের বয়সন্ধিকাল পেরোয়নি কিন্তু নিলু আপুকে দেখলেই মামার চোখ চকচকে হয়ে উঠা, আমাদের চোখ এড়ায়নি। মামা কেমন যেন উদাস হয়ে যেতেন। নীলপরী নিলু আপু যেমন সুন্দরী তেমনি অমায়িক। মামা প্রায়ই আপুর সাথে কথা বলতে চাইতেন। আপু কিছুটা রেগে গেলেও মুখে কিছুই বলতেন না।
আপুর এই আশ্চর্য নীরবতা মামাকে বাউলা করে দিল। অবশেষে মামা আমাকে পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুষ দিয়ে আপুকে চিঠি লিখে পাঠালেন। আপু চিঠি নিলেন কিন্তু রহস্যময় ভাবে নীরব রইলেন। মামা পুরা দিশেহারা হয়ে গেলেন। খেলা, আড্ডাতেও থাকতেন না বরং আমাদের এড়িয়ে যেতে লাগলেন।
পড়াশুনাতো ছেড়েই দিলেন। এর ষোলকলা পুরন হল যখন মামার ম্যালেরিয়া ধরা পরল। মামা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে লাগালেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রলাপের আলাপ হল নিলু আপু। আমরা বিচ্ছুবাহিনী আপুকে বার্তাটা পৌছিয়ে দিলাম।
আপু সব শুনে শুধু একটা কথাই বললেন, 'ঢং'... আপু এই প্রথম মামা সমন্ধে একটা মন্তব্য করলেন...
আড়াইদিনের মাথায় মামা প্রি-কোমা তে চলে গেলেন। এইবার আপু মামাকে দেখতে গেলেন সেটা আমাদের চাপাচাপিতেই হোক কিংবা আপুর অবচেতন মনের ইচ্ছাতেই হোক। দীর্ঘ ১৩ দিন পর মামার চেতনা ফিরল। এর মাঝে মামার প্রতি আপুর ভালবাসাটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। এই ১৩ দিন আপুকে এতো বদলে দিবে আগে কখনও ভাবিনি।
মামাও ভাবেননি মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে চোখ খুলে প্রথম আপুকেই পাবেন। এরপর? এরপর আমরা হারালাম আগের সেই মামাকে। খেলা,আড্ডা কোথাও মামা নেই। মামা নেমে গেলেন আপুর সাথে প্রেম খেলায়। পড়াশুনায় মনোযোগী হলেন, জীবনটাকে গুছিয়ে ফেলতে লাগলেন।
এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করে নটরডেমে ভর্তি হলেন। মাঝে মাঝে নিলু আপুর গিফট মামার কাছে পৌঁছে দিতাম। নিলু আপুর মামাকে দেয়া প্রথম গিফটের কথা মনে পরলে আজও হাসি পায়। এটা ছিল নিলু আপুর নিজহাতে বোনা একটি কাঁথা। ম্যালেরিয়া হবার পর ডাক্তার মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে বললেও মামা দম বন্ধ হয়ে আসে এই অজুহাতে তা টাঙ্গাতেন না।
এর মধ্যে আপুকে প্রমোশন দিয়ে মামি বানিয়ে দিলাম। আপু কখনই মামাকে প্রথাগত গিফট দিতেন না। সবকিছু ভালই চলছিল। হঠাৎ মামা বুয়েট ভর্তি পরিক্ষার দুদিন আগে আপুকে জরুরী তলব করলেন। শিমুলতলায় ৫ মিনিটে কি কথা হয়েছে তা আজও জানতে পারিনি।
সেই থেকে মামা আপুকে আর একসাথে দেখিনি। শুধু জানতে পেরেছি কথা কাটাকাটির মাঝে মামা আপুকে চড় মেরেছিলেন...
আজ ১৭ বছর পার হল। আপু ও মামাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দুজনই নীরব। মামা বুয়েট পরীক্ষার পর আপুর দেয়া সেই কাথা, ব্রেসলেট, কবিতার বই আমাকে রেখে দিতে বললেন।
মুখে কিছুই বললেন না। একবার ভাবলাম আপুকে ফিরিয়ে দেই। কিন্তু পরে আর দেয়া হল না...
২০০১ সালের কথা। ৭ বছর পেরিয়ে গেছে। মামা জার্মানি থেকে এমএস করে দেশে ফিরেছেন।
মাঝে মাঝে আমার বাসায় আসতেন। এসে কাঁথা,চিঠি,পাঞ্জাবীগুলো দেখতে চাইতেন। মুখে কিছুই বলতেন না। শুধু একদিন আপুর বিয়ের কথা বলাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠলেন। আর ওদিকে আপুর সাথে আমার তেমন যোগাযোগ হয়নি।
একদিন শুধু দেখেছিলাম ছাদের কার্নিশে মামার দেয়া সেই নীল শাড়িটা পরে দাড়িয়ে আকাশ দেখছেন। আগেই বলেছি আপু আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। সেই সুবাদে এখন মাঝে মাঝে আপুকে দেখি ছোট্ট একটার বাচ্চার পিছে দৌড়াতে। খারাপ নেই আমাদের নীলপরী নিলু আপু।
আপনাদের জন্য আমার গল্পের কাহিনী এখানেই শেষ।
এই অংশটা শুধু মামা ও নিলু আপুর জন্য। মামা ও নিলু আপু যেখানেই থাকোনা কেন, প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমাদের কাহিনী তোমাদের অনুমতি ছাড়া এখানে শেয়ার করার জন্য। তোমরা কোথায় আছ জানিনা কিন্তু এই আমাকে তোমাদের ভালবাসা বা বিরহ যেটাই বল,সেটার নীরব সাক্ষী আর বানিও না। কেন তোমরা আলাদা হয়ে গেছ কখনই বলনি। আমাকে সবসময়ই অন্ধকারে রেখেছ।
এইবার আমাকে একটু শান্তি দাও। তোমাদের ভালবাসার আলামত আমি কেন বয়ে বেড়াবো? যদি কখনো পারো দুজনে হাতে হাত রেখে সেই শিমুল তলায় এসে ১৭ বছর আগের মত আমাকে ঝালমুড়ির ঘুষ খাওয়াতে এসো। ভাল থেকো মামা, অনেক ভাল থেকো আমাদের নীলপরি নীলুআপু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।