আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সঞ্জীব দা’ - তুমি কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া ('দলছুট' এর সঞ্জীবদা'র স্মণে)

জনপ্রিয় ব্যান্ড 'দলছুট ' এর প্রতিষ্ঠাতা ,জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি । । মাতাল করা কতগুলো বছর। শুধু গান আর গান। নতুন নতুন অ্যালবাম কিনছি আর চুটিয়ে শুনছি সেই সব অ্যালবাম।

বড় দুই ভাইয়া আর আমি, তিনজন মিলে অডিও ক্যাসেট কিনছি। সবারই পছন্দ ব্যান্ড মিউজিক। মূলধারার ব্যান্ড, সলো, মিক্সড সবই ভিড়ে যাচ্ছে ক্যাসেটের তাকে। আর্ক, সোলস্‌, মাইলস, এবি-এল.আর.বি, ফিডব্যাক-সহ আরও অনেক ব্যান্ড, ব্যান্ডমিক্সড ও সলো অ্যালবাম শুনে শুনে আমাদের তিন ভাইয়ের দিন চলছে সুরের তালে তালে। বর্তমান সময়ে যে হারে কিংবা সংখ্যায় যত বেশী অ্যালবাম প্রকাশ পায় তখনকার অডিও বাজারের অবস্থা ঠিক তেমনটা ছিল না।

অডিও ক্যাসেট মানেই বছরের আকর্ষণীয় কয়েকটা উপলক্ষ। যার মধ্যে দুইটা ঈদ, ১লা বৈশাখ, নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ব্যান্ড কিংবা সলো অ্যালবামের পাশাপাশি ব্যান্ডসঙ্গীত ভক্ত হিসেবে বিষ্ময় নিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামগুলোর জন্য। এটাও সত্য যে, বিষ্ময়গুলো মিক্সড অ্যালবামেই থাকতো সবচেয়ে বেশী। এখনও দু’চোখে বন্যা, মেয়ে, শেষ দেখা, দেখা হবে বন্ধু, দাগ থেকে যায়, মিলিনিয়াম, ও আমার প্রেম, শুধু তোমারই কারণে, ঝড়, ধুন, তারাদের গুঞ্জনে, দেয়াল দুই হৃদয়ের মাঝে, ফিরে আয়, হারজিৎ, স্রোত, সন্ধি, কষ্টের ভালোবাসা, একটি গোলাপ, স্টারস (বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম।

সুরবিন্যাস, সঙ্গীতায়োজন ও পরিকল্পনায়ঃ আশিকুজ্জামান টুলু-আর্ক), স্টারস টু, রাজকুমারী, তারা ভরা রাতে, তুমিহীনা সারাবেলা, আনন্দধারা, একই বৃন্তে, শক্তি, ক্ষমা, ঘৃণা, টি এন্ড টি, আলোড়ন, চিরদুখী, টুগেদার, ব্যথা, নীরবতা, বিতৃষ্ণা জীবন আমার সহ আরো অনেক অনেক অ্যালবাম। এখানে উল্লেখিত প্রতিটি অ্যালবামই কোনো না কোনো গানের মাধ্যমে ঝড় তুলেছে সঙ্গীতাঙ্গনে। (বর্তমান সময়ে মিক্সড অ্যালবামগুলো কেন যেন আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনা! মিক্সড অ্যালবাম!!! অন্যভাবে বলতে গেলে, কতদিন যে প্রিয় শিল্পীদেরকে একটা ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামে একসাথে দেখিনা আগের মতন!) তবে, আমি ভাগ্যবান, বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণযুগের কিছুটা সময় পুরোদস্তুর শ্রোতা হিসেবে ঐ সময়টাকে ছুঁয়ে দিতে পেরেছিলাম। ব্যান্ড সঙ্গীত আন্দোলনের একজন নিরব সাক্ষী হয়েছিলাম। নতুন নতুন অ্যালবামের পাশাপাশি দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে পুরাতন ব্যান্ড ও মিক্সড অ্যালবাম কিনে এনে শুনতাম।

মূলধারার গান শুনে শুনে প্রায় শেষ তখন! আরো অ্যালবাম চাই। আরও.....। ভৈরবের ‘বাদল অডিও’ থেকেই নিয়মিত অডিও ক্যাসেট কিনতাম। একদিন গিয়ে প্রায় আধ-ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, কেনার মত কোন অ্যালবাম-ই খুঁজে পাচ্ছিনা। যে দিকে চোখ যায়, সবই চেনা-পরিচিত ব্যান্ড, সলো কিংবা মিক্সড অ্যালবাম।

এই দোকানের মালিক বাদল ভাই। এত অ্যালবাম কিনেছি যে, বাদল ভাই অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন এইভাবে, ‘আপনার যতগুলো ইচ্ছা নিয়ে যাবেন, যে কইটা ভালো লাগবেনা ফেরত দিয়ে যাবেন’। (‘গাঁয়ের খবর’ নামের একটা ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম এখনও আমার কাছে আছে, আজও অব্দি যার মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। সেই দোকান এখন আর নেই, বাদল ভাইও দেশের বাইরে চলে গেছেন। ‘বাদল অডিও’ আজ একটি লেদার পণ্যের দোকান।

তবে আমি প্রায়ই যাই। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। মাঝে মাঝে গল্প জমানোর চেষ্টা করি বাদল ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের সাথে। লজ্জায় মূল্যটা আর পরিশোধ করা হয়না)। কিন্তু ঐদিন কোন অ্যালবামই চুজ করতে পারছিলাম না।

বাদল ভাই ক্রেতা বিদায় করে এসে আমাকে বললেন, ‘কি ভাই, কোনো অ্যালবাম পান নাই?’। আমি নিরব রইলাম। বাদল ভাই বললেনঃ ‘দলছুট শুনছেন?’ উত্তরে বললাম ‘শুনিনি’। তিনি দলছুটের ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামটি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন ‘এইটা শুনেন। ভালো লাগবে’।

অ্যালবামের প্রচ্ছদে বাপ্পা মজুমদার এবং গোঁফ আর ঝাঁকড়া চুলের বোহেমিয়ান টাইপ একজন মানুষ। কাভার খুলে দেখলাম উনি সঞ্জীব চৌধুরী। অনেকটা অনিচ্ছাসত্বেও অ্যালবামটি কিনলাম। মিক্সড অ্যালবামের কল্যাণে বাপ্পা মজুমদারের সাথে পরিচিত ছিলাম। সেই সাথে দলছুটের সাথেও।

কিন্তু সঞ্জীব চৌধুরীর সাথে একেবারেই পরিচিত না। মিক্সড অ্যালবামগুলোতে উনার বিরচণ ছিলনা বলেই হয়ত। সাধারণত, নতুন অ্যালবাম কিনলে উত্তেজনায় অস্থির থাকি কখন শুনবো পুরো অ্যালবামটা! কিন্তু এই অ্যালবামে কেমন যেন আগ্রহ পেলাম না। বাসায় এনে অ্যালবামটা ফেলে রাখলাম। রাতে পড়াশোনা শেষে ঘুমুতে যাবার সময়, প্রতিদিনের মত কোন অ্যালবামটা শুনবো তাই ভাবছিলাম।

তখনই মনে পড়ল, দুপুরে নতুন একটা ব্যান্ডের অ্যালবাম কিনে এনেছি (‘হৃদয়পুর’ দলছুটের দ্বিতীয় অ্যালবাম। প্রথম অ্যালবাম ‘আহ্‌’। যেহেতু দলছুটের কোন গান এর আগে শুনিনি আমার কাছে নতুন ব্যান্ড-ই মনে হয়েছিল। ) ক্যাসেট প্লেয়ারে অ্যালবামটি চালিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় এলাম। প্রথমেই শাহ্‌ আব্দুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’।

এক অবাক কণ্ঠ। মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। এরপর, বাপ্পা দা’র ‘তুমি আমার বায়ান্ন তাস/বাজি’। মুহুর্তেই ভালো লাগার মত একটি গান। বাপ্পা দা’র জনপ্রিয় গানগুলোর একটি।

এখনও আগের মতই প্রিয়। এরপরই রাতের নীরবতাকে সারা ঘরময় প্রসারিত করে নেমে এলো কথা, সুর ও কণ্ঠের এক যাদুকরী সন্মোহন ‘নৌকা ভ্রমণ’। একটু নড়েচড়ে কানদুটিকে প্রসারিত করে গানের কথায় মনোযোগ দিলাম। ‘... ওঠো গোলাপ, জাগাও আমাকে, কাঁটার পলকে যে উদ্ভাসিত ...’। বাপ্পা দা’ আর সঞ্জীব দা’ আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল সে রাতে।

রাত বাড়তে থাকে, জানালার ফাঁক গলে চাঁদের আলো এসে ভিড়ে গায়ে জড়ানো ফুলতোলা কাঁথায়। আর আমার বিষ্ময় ক্রমেই বাড়তে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকি সেই অবাক কণ্ঠ। অদ্ভুত শিহরণে ঘোরের মত লাগে সেই কথা-সুরে, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ, আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ, আমার চোখ গেল, ধরেছে সুন্দর, মেয়ে তুমি এভাবে তাকালে কেন? এমন মেয়ে কি করে বানালে ঈশ্বর বুঝিনা!’ উপর্যুপরি উপমাভরা কথার গাঁথুনি আমাকে অভিভূত করেছিল। কথা ও সুরের ব্যতিক্রম উপস্থাপন আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

সে রাতে মুহুর্তেই প্রিয় শিল্পীর তালিকায় টেনে নিয়েছিলাম সঞ্জীব দা’কে। কণ্ঠের এমন উপস্থাপনা আমি এর আগে কখনোই শুনিনি। কাউকে দেখিনি এভাবে গাইতে। গানের কথায় আবেগ, অভিমান ও মুগ্ধতার যে সহজ সরল বহিঃপ্রকাশ, এবং সুর ও কণ্ঠ উপস্থাপনে যে আবেদন তিনি তৈরী করেছেন, গান পাগল মানুষ মাত্রই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই আমি বিশ্বাস করি। চাঁদ যেমন সঞ্জীব দা’কে মুগ্ধতায় অন্ধ করে দিয়েছিল।

তেমনি, আমিও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম অবাক বিষ্ময়ে। সঞ্জীব দা’র গানের মত আমারও প্রায়ই জানতে ইচ্ছে করে ‘এমন গান কি করে বানালেন সঞ্জীব দা, বুঝিনা এমন গান কি করে বানালেন? আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল চাঁদের জন্য গান’। দু’চোখের ঘুম পালিয়ে গেল সে রাতে। রাতের বয়স বাড়তে থাকলো। জোছনার আলো আরও তীব্র হয়ে প্রাণ-স্পন্দনের অপার্থিব সঙ্গীতে নেমে এলো মাটির পৃথিবীতে।

বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো দুই গানপাগল মানুষের যাদুকরী সুরের মূর্ছনায়। জাগতিক আলাপচারিতায় উঠে এলো তীক্ষ্ণ উপলব্ধির রুপ ও রস। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে একে একে চলে গেল ‘জলের দামে দিলাম খুলে’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘আমার সন্তান’, ‘সবুজ যখন’, ‘গাছ’, ‘বৃষ্টি’, ‘চল বুবাইজান’, ‘আন্তর্জাতিক ভিক্ষা সঙ্গীত’। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ অন্য কারো গানের কথায় এমন তীব্রভাবে উঠে এসেছে কিনা আমার জানা নেই, যেমনটি উঠে এসেছে দলছুটের সঞ্জীব দা’র গানের কথায়। উঠে এসেছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অসঙ্গতিতে শিল্পীমনের তীব্র যাতনা ও দুঃখবোধ।

সঞ্জীব দা’র গাওয়া গানগুলোর মধ্যে ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো’ গানটিই আমার সবচেয়ে বেশী প্রিয়, ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া। সেই রাতের পর কত যে নির্ঘুম রাত সঙ্গ দিয়েছে এই গানটি, জানা নেই। ‘আমি কাউকে বলিনি সে নাম, কেউ জানে না, না জানে আড়াল, জানে কান্নার রঙ, জানে জোছনার ছায়া’- এখনও নিরব সঙ্গী হয়ে আছে। সঞ্জীব দা’র গানের কথায় যে গল্প চিত্রিত হয়, কণ্ঠের নির্লিপ্ততায় যে হাহাকারের সূচনা হয়, যন্ত্রসঙ্গীতের সন্মোহনে যে আবেশের সৃষ্টি হয়, তার সাথে দৃশ্যমান জগতের অনেক কিছুতে সাদৃশ্য দেখা গেলেও অনুভূতিটুকুর পুরোটাই অপার্থিব জগতের। যে জগতে বাঁধভাঙা জোছনাধারায় নীরব রাতে আমাদের কথা ভেবে হয়ত তিনি আজও গেয়ে উঠেন, “তবে এই হোক তীরে জাগুক প্লাবন, দিন হোক লাবণ্য হৃদয়ে শ্রাবণ, তুমি কান্নার রঙ, তুমি জোছনার ছায়া”।

আমি জানি, অজস্র রাত এই গান আমায় আরো নিঃসঙ্গতায় ডুবিয়ে দেবে আবেগ, ভালোবাসা ও মুগ্ধতায়! দলছুট আমার নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে গেল। হৃদয়পুর অ্যালবামটি ঠিক কতবার শুনেছি তা জানা নেই। তবে জানতে পারলে বিষ্মিত হতাম নিশ্চয়ই! এরপরই কিনে নিয়ে আসলাম দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ্‌’। ঘাতক পুলিশের লৌলুপ্য চোখের বিষাক্ততায় প্রাণহারানো ‘ইয়াসমিন’-র কষ্টে সমব্যথিত হয়েই অ্যালবামের এই নামকরণ ‘আহ্‌’, ইয়াসমিন। দলছুটের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই মানবিক বোধে তাড়িত হয়ে গান হয়ে উঠেছে জীবন গল্প।

ইয়াসমিন, সানগ্লাস, চোখ, নিষিদ্ধ, মনে পড়ে গানগুলো মানবিক বোধ তাড়িত এক উজ্জীবিত স্বত্বা, যেখানে তিনি স্বপ্নের কথা বলেছেন, কষ্টের কথা বলেছেন, সুন্দরের কথা বলেছেন, জীবনের কথা বলেছেন জাগতিক ভালোবাসায় কথা, সুর ও কণ্ঠে। তখন খুব সম্ভবত ২০০৩ সাল। কামরুজ্জামান কামু’র কথামালায় গাঁথা ‘বায়োস্কোপ’ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। প্রথমে বায়োস্কোপ নামে একটি ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামে গানটি শুনি। পরবর্তীতে ২০০২ সালে প্রকাশ পাওয়া দলছুটের তৃতীয় অ্যালবাম ‘আকাশচুড়ি’তে বায়োস্কোপ গানটি সংযোজন করে ‘আকাশচুড়ি’ অ্যালবামটি পুনঃপ্রকাশিত হয়।

অনেকটা ফোক-ঘরানার সুরারোপ এবং বাপ্পা ও সঞ্জীব দা’র দরদী কণ্ঠ মুহুর্তেই অভিভূত করে যায় সবাইকে। খুব সম্ভবত ইত্যাদিতে গানটি প্রথম প্রচার পেয়েছিল। গানটি প্রচার পাবার পর মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায়, দেখেছিলাম বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না, ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি, বায়ের দিকে পুকুর ঘাট, সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না ...’। আকাশচুড়ি অ্যালবামে ‘হৃদয়ের দাবী’, ‘নষ্ট শহরে’ ‘ফিরে পেতে চাই’ গানগুলো কতবার যে ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে এসেছে হৃদয়ের দাবী নিয়ে, ইয়ত্তা নেই। তবে, সেই সময়টাতে সঙ্গীতাঙ্গন বড় অস্থির হয়ে উঠেছিল।

প্রমিথিউসের বিপ্লব, সুরকার শওকাত এর সস্তা-বস্তাপচা মানহীন গান দিয়ে সেলুন, চায়ের টঙ, ক্লাব-ঘর, রাস্তার পাশের দোকান কিংবা হিন্দি দামাক্কা গানের বেপরোয়া শ্রোতাদের মুগ্ধ করে অ্যালবাম কাটতি বাড়িয়ে ছেয়ে ফেলেছিল অডিও বাজার। অবাক ও দুঃখের ব্যপার ছিল, মূলধারার অনেক জনপ্রিয় শিল্পী নিজেদের স্বকীয়তা ছুঁড়ে ফেলে পাল্লা দিয়ে মেতে উঠেছিলেন সেই সস্তা জনপ্রিয়তায়। এদের মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস্‌, হাসান ও প্রিন্স মাহমুদের মত মেধাবী তারকা শিল্পীরা উল্লেখযোগ্য। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস্‌ কিংবা হাসান এমন কিছু গীতিকার ও সুরকারের গান কণ্ঠে তুলেছেন যারা হয় এই গুণী শিল্পীদের লেভেল জানেন না নতুবা এইসব শিল্পীদের জন্য গান লেখা কিংবা সুর করার যোগ্যতা রাখেন না। একাধারে, প্রতিষ্ঠিত গীতিকার সুরকার-রাও এমন কিছু গান তৈরী করেছেন, যা এইসব শিল্পীদের কণ্ঠে তোলা একেবারেই মানায় না।

(তবে, দেরীতে হলেও প্রিন্স মাহমুদ, এবি, হাসান অসম্ভব প্রিয় এই গুণী শিল্পীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অবশ্য ততদিনে সঙ্গীতাঙ্গনের বারোটা বেজে গিয়েছিল। আর ঠিক সেই সময়টাতেই নব্বই দশকের অনেক জনপ্রিয় শিল্পী ও ব্যান্ড এই সস্তা স্রোতে গা ভাসাতে না পেরে কিংবা অন্যভাবে বললে এই সস্তা জনপ্রিয়তায় ‘চান্স’ না পেয়ে প্রচারবিমুখ হয়ে পড়েছিল। এবং একটা সময়, সঙ্গীত থেকে নিজেদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন অনেকেই। তবে, খুশির সংবাদ অনেকেই ফিরছেন আবার এই সময়ে।

আর এজন্য অনেক অনেক শুভকামনা প্রিয় মানুষগুলোর জন্য। ) ২০০৫-এর কোন এক সময়, আমার গান পাগল বন্ধুর সাথে দেখা। শুরুর সময়টাতে দুজনে মিলে কত যে অ্যালবাম কিনেছি, স্টেশন রোড, দাগ থেকে যায়, প্রবাহ, দুঃখিনী দুঃখ করোনা, লেইস ফিতা লেইস, আমাদের? বিষ্ময়!, কষ্ট, শেষ দেখা, কিরণ, অতিথি, নীরবতা, আলো, সন্ধি, মেয়ে, দেয়াল সহ আরও অনেক অ্যালবাম। নতুন অ্যালবাম অথচ আমরা কিনবোনা, এমনটি ছিল বিরল। গানের মাঝেই বেড়ে উঠেছিলাম দুই বন্ধু।

কিন্তু কষ্টের ব্যপার হলো, সেই গানপাগল বন্ধু ততদিনে বাংলা ব্যান্ড মিউজিক শোনা ছেড়ে দিয়ে লাকী আলী, রাহাত ফতেহ্‌ আলী খানের গান শুনছে নিয়মিত। কষ্ট ও হতাশামাখা একজোড়া বিষ্মিত চোখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলামঃ ‘কেন? বাংলা ব্যান্ড মিউজিক শুনিস না কেন?’ তীক্ষ্ণ উত্তর এলোঃ ‘এখন শিল্পীরা যা গায়, তাকে আর যা-ই হোক গান মনে হয়না’। আমি থেমে গেলাম। প্রতিউত্তর দেবার কিছুই ছিল না। আমি তখনো ক্যাসেটের সাথে লেগে আছি।

নতুন অ্যালবাম বেরোলে নতুন অ্যালবামগুলোর প্রায় সবই শুনে দেখার চেষ্টা করছি। ম্যাক্সিমাম অ্যালবামই একবার শুনে ফেলে রাখতে হয়েছে। কিছু কিছু অ্যালবাম অবশ্য পাওয়া গেয়েছিল, যেখানে শোনার মত ভালো কিছু গান ছিল। তবে পুরো অ্যালবামে সেই ধারাবাহিকতা ছিল না। ঐ সময়টাতে নিয়ম করে দলছুট শুনছি।

তাই, আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ‘সঞ্জীব দা’র গান শুনেছিস?’ উত্তরে বললঃ ‘না’। আমার সংগ্রহে থাকা দলছুটের ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামটি দিতে চাইলাম। কিন্তু বাংলা গানে আর আগ্রহ নেই এমনটি বলে, অপারগতা প্রকাশ করলো। অনেকটা জোড় করেই সঙ্গে দিয়ে দিলাম দলছুটের ‘হৃদয়পুর’ আর মাহমুদুজ্জামান বাবুর ‘অচেনা সময়’ অ্যালবাম দুটি। ঢাকায় ফিরে ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামটি শুনে ফিডব্যাক দিলঃ ‘অসম্ভব ভালো লেগেছে।

বিশেষকরে, আমি তোমাকেই বলে দেবো, চাঁদের জন্য গান, চল বুবাইজান, গাড়ি চলে না, জলের দামে গানগুলো অসম্ভব ভালো লেগেছে। প্রতিদিন নিয়মিত করে শোনে অ্যালবামটি। রাতে ঘুমুনোর আগে একবার হলেও সঞ্জীব দা’র ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো’ গানটি শুনতে হয়। সে-ই সঞ্জীব দা’র সাথে ওর প্রথম পরিচয়। আজও তিনি সঙ্গী হয়ে আছেন।

এরপর দিন কেটে যেতে লাগল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। স্বপ্নীল এক নতুন জীবন শুরু হলো। ক্লাস, আড্ডা, চায়ের টঙ, ঘুরে বেড়ানো আর গান। রিক্সা, আড্ডা, গান আর নৌকায় অন্যসব শিল্পীর গানের পাশাপাশি নিয়মিত জমে উঠতো সঞ্জীব দা’। ‘বায়োস্কোপ’, ‘চাঁদের জন্য গান’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘এই নষ্ট শহরে’, ‘আমি ফিরে পেতে চাই’, ‘হৃদয়ের দাবী’, ‘রিক্সা কেন আস্তে চলে না’, ‘বয়স হলো সাতাশ’, ‘কথা বলবোনা’, ‘একটি চোখে কাজল’, ‘সমুদ্র’, ‘স্বপ্ন বাজি’, ‘ভালো লাগেনা’ গানগুলোই ঘুরে ফিরে উঠে আসতো।

আমরা কতিপয় আড্ডাবাজ আর গানপাগল বন্ধুদের মাঝে সঞ্জীব দা’ ছিল নিত্য সঙ্গী। ১৯-শে নভেম্বর ২০০৭ সাল, হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো “সঞ্জীব দা’ আর নেই, দলছুট্‌ হয়ে গেছেন প্রিয় সঞ্জীব দা”। আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল। অজান্তেই চোখের কোণে নোনা জমে গিয়েছিল। আমরা সমমনা আড্ডাবাজ গানপাগল বন্ধুরা অন্য সবার মতই থমকে গিয়েছিলাম।

হাহাকারে ডুবে গিয়েছিল চিত্তচেতনা। পদার্থ বিজ্ঞানের সদা হাস্যজ্জল বন্ধু ইসমাইল আমাদের মেসে এলেই হাসানের ‘কবিতার মত সেই চোখ দু’টো’, পার্থ দা’র ‘তোমার ঐ মনটাকে’ আর শুধু সঞ্জীব দা’র গান শুনতো। সেই সঞ্জীব দা’ আর নেই বিশ্বাস হতে চায়নি। বিশ্বাস করিনি তখন, এখনও যেমন। এমন স্বপ্নবাজ একজন মানুষ হারিয়ে যেতে পারেন না।

তবে মাঝে মাঝে কেমন যেন জানতে ইচ্ছে করেঃ ‘চোখটা এত পোড়ায় কেন ...?’ সঞ্জীব দা’র গানে মন খারাপ করা বিষন্ন দিন খুঁজে পাই, জীবনের মানে খুঁজে পাই, বেঁচে থাকার দুরন্ত উদ্দীপনা জেগে উঠে এই সঞ্জীব দা’তেই। নষ্ট হতে ইচ্ছে করে ‘নষ্ট শহরের নাম না জানা এক মাস্তানের মতন’। রিক্সায় দুরন্ত বেগে ছুটে যাওয়া প্রিয়তমা নারীকে দেখে গাইতে ইচ্ছে করে ‘রিক্সা কেন আস্তে চলে না’। হৃদয়ের দাবী নিয়ে বলতে ইচ্ছে করে ‘হঠাৎ তোমায় মন দিয়েছি, ফেরত চাইনি কোনদিন, মন কি তোমার হাতের নাটাই, তোমার কাছে আমার ঋণ, মন হারালেও মনের মানুষ হারেনা’। সঞ্জীব দা’র মত আমিও বিশ্বাস করি, “মন হারালেও মনের মানুষ হারে না”।

আপনি আমার কাছে এক গানের-যাদুকর। যে যাদুকরী সন্মোহনে আমাকে বশীভূত করেছেন সেই মুগ্ধতা আমার কোনদিনও কাটবে না। তাই আপনাকে হারানোর কোন ভয় নেই। বায়োস্কোপ দেখার ছলে আপনার চোখে চোখ পড়বে জানি, হয়ত কখনোবা নৌকা ভ্রমণে আপনাকে নিমন্ত্রন জানাবো। হেলে দুলে নৌকার মতই আপনার ঝাঁকড়া চুলগুলো দুলে উঠবে, আর আপনি গেয়ে উঠবেন, “দুলো ভাটিয়ালী এ নদী রূপালী, ঢেউয়ের তালি নৌকা বাজাও, ঢেউয়ের তালি নৌকা বাজাও ...”।

কিংবা কোন বাধ ভাঙা জোছনা রাতে একলা বিষন্নতায় ডুবে গেলে মনে যখন কষ্টের ঝড় বইবে, বাতি নিভিয়ে দেয়া আঁধার ঘরে জড়সড় শুয়ে থেকে সারারাত জেগে শুনবো ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো .... ছুঁয়ে কান্নার রঙ ... ছুঁয়ে জোছনার ছায়া’। ------------------------- মোখলেছুর রহমান সজল ১৯.১১.২০১২ একটি RaDiO bg24 এর নিবেদন ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.