এই তো, ক'মাস আগেও চট্টগ্রামের চকবাজারের গুলজার মোড়ে অবস্থিত ছিল "নীডস ভার্সিটি এডমিশন ফর্ম সেন্টার"-এর চট্টগ্রাম শাখাটি। পরিচালনা করতেন আমাদের সবার প্রিয় মঞ্জু ভাই। একাই ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সব, সাহায্য করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে কেউই ছিল না। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফর্ম আনা-নেওয়ার জন্য হয়তো দু-একজন কর্মচারী ছিল, কিন্তু ওই কাজটাও মাঝে মাঝে উনি নিজেই করতেন। ফেনী কিংবা নোয়াখালীতে ছিল উনার গ্রামের বাড়ী, আমার ঠিক মনে নেই।
উনার সাথে আমার পরিচয় সাত বছর আগে, এইচ-এস-সি পাশ করার পর থেকেই, ভার্সিটি ফরম কেনার সুবাদেই। আমার বাবাকে উনি খুব সম্মান করতেন।
এরপরে আমি জীবনের অনেক সময় পার করে এসেছি, পার হয়ে এসেছি অনেক চড়াই-উতরাই। কিন্তু মঞ্জু ভাই-এর শুধু টাকের বাকি চুলগুলো চলে যেতে দেখেছি, ভুড়িটা আরেকটু বড় হতে দেখেছি, কিন্তু বাকি সব আগের মতই ছিল। জীবনের সব ভুলগুলো তিনি হালকাভাবে নেওয়ার কথা বলতেন, অনেক পরিশ্রমী আর আশাবাদী ছিলেন।
সময়ের কাজ সময়ে করার কথা বলতেন। তিনি জীবনে বেশিদূর পড়ালেখা না করে যে ভুল করেছেন, তা' অন্যদের না করার পরামর্শ দিতেন। তিলে তিলে তিনি তার এই ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। কত যে ছেলে-মেয়ে তার কাছ থেকে ভর্তি ফর্ম নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে গিয়েছে, তা বলা কঠিন। চকবাজারের আশেপাশের সব এলাকার ছেলেপেলের জন্য তিনি ছিলেন "প্রিয় মঞ্জু ভাই"।
তার মিশুক স্বভাবের জন্য সিনিয়র-জুনিয়র-সমবয়সী সবার সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল।
চক মালঞ্চের পাশে আড্ডা কিংবা নাস্তা খেতে গেলে একবার হলেও উনার সাথে দেখা করতাম। কিন্তু গত ৮ মাসে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে ঐদিকে যাওয়া হয়নি। তাই আর দেখাও হল না শেষবারের মত মঞ্জু ভাই-এর সাথে। তিনি তার বৃদ্ধ বাবা-মা কে একাই ফেলে চলে গেলেন।
সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে পিতৃহীন, নববধূকে বিধবা করে গেলেন। তার এই মৃত্যু শুধু অকালমৃত্যু-ই ছিল না, এটা ছিল বড় ধরণের অপমৃত্যু! আমি প্রত্যক্ষদর্শী সবার মুখে শুনে এই দূর্ঘটনার মূলদিকটা তুলে ধরতে চাই।
এক বছরের-ও বেশী সময় আগে মঞ্জু ভাই চট্টগ্রামের হালিশহরনিবাসী এক মেয়ের কাছে "নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের" ফর্ম বিক্রি করে। মেয়ের বাবা মধ্যপ্রাচ্যনিবাসী ব্যবসায়ী; শিক্ষা-মূল্যবোধবিহীন পরিবারটি শুধু টাকা ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে জীবনযাপন করাই জানত। ধনীর দুলালী মেয়ে পা রাখে এন-এস-ইউর সেই "অবাধ রঙ্গিন" দুনিয়ায়।
একে তো পরিবারের অনুশাসন নেই, তার উপরে টাকার-ও কোন অভাব নেই, মেয়েটির অতি আধুনিক জীবনযাপনের ফলে তার পড়ালেখা উচ্ছন্নে যায়। পরপর দুই সেমিস্টার সব বিষয়ে সার্থকতার সাথে অকৃতকার্য হওয়ায় ভার্সিটি কতৃপক্ষের ফোন/চিঠি যায় মেয়েটির বাসায়। মেয়ের মা ভালমন্দ কিছু বুঝতে না পেরে বিদেশে তার স্বামীকে ফোন করে। মেয়ের বাবা দেশে আসার পরই মেয়েটি তার বাবাকে বুঝাতে সমর্থ হয় যে, তার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে, তাকে ধোঁকা দিয়ে একটি ভণ্ড প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছিল।
তখন সেই লোক তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে নীডসে যায়, মঞ্জু ভাইকে দোষারোপ করে তার কাছে সব টাকা ফেরত দাবি করে, তাকে মারতে উদ্যত হয়।
কিন্তু এই "উন্মাদের দাবি", মঞ্জু ভাই ও তার আশেপাশের মানুষদের প্রতিবাদের সামনে এক মুহুর্ত-ও টিকে না! দুই মাস ধরে অনেকবার এই মেয়ের বাবা তার লোকজন নিয়ে মঞ্জু ভাইকে হেনস্তা করতে এসে প্রতিবেশী দোকানদারদের কারণে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। অবশেষে ২০১৩ এর জানুয়ারীর একদিন রাত ১০টায় লোকটি একা এসে মঞ্জু ভাইকে "সমঝোতার" শান্তিপূর্ণ আহ্বান জানায় আর মেয়ের জন্য চিন্তিত তার স্ত্রীর মানসিক অসুস্থতায় প্রশান্তির বাণী শুনানোর জন্য অনুরোধ করে।
মঞ্জু ভাই এই হঠকারী অনুরোধকে সরল মনে নিয়ে যেতে রাজি হয়। তখন তার শুভানুধ্যায়ী অনেকেই তাকে যেতে নিষেধ করে, প্রয়োজনে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সমঝোতার জন্য শুধু একজন দরকার বলে মনে করেই মঞ্জু ভাই কাউকে সাথে না নিয়ে একাই সেই অন্ধকার পথে যাত্রা করেন।
এরপর দুইদিন মঞ্জু ভাই-এর কোন হদিস ছিল না। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিল না। বন্ধু-প্রতিবেশীরা পুলিশের কাছে গিয়ে সব খুলে বললে পুলিশ যথাস্থানে গিয়ে খোঁজ করে। একদিন পরে সীতাকুণ্ডের জঙ্গলে মঞ্জু ভাই-এর ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে বের হয়ে আসে মেয়ের সেই "কুশিক্ষিত-উন্মাদ" পিতা বাসায় ডেকে এনে মঞ্জু ভাই-এর সাথে বাগ-বিতণ্ডা শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তাকে "কাঁটাযুক্ত মেটালিক বক্সিং রিং" দিয়ে উপর্যপুরি ঘুষি মারে; এতে মঞ্জু ভাই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরে তাকে মেরে ফেলা হয়।
অথচ এসব কিছু চলার সময় সেই "দুশ্চরিত্রা" মেয়েটি ছিল নির্বাক, নিশ্চুপ।
এখন ঐ মেয়ের বাবা জেল-হাজতে, আদালতে মামলা চলছে। আসামীর বক্তব্য- "সে চিন্তা করেনি যে সামান্য আঘাতেই একজন মরে যেতে পারে"। আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন-দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজে ক্ষমতা ও টাকার-ই হয়তো বা জয় হবে শেষ পর্যন্ত। মঞ্জু ভাই-এর খুনির যোগ্য বিচার হবে না, আর এই খুনের প্লট রচয়িতা সেই "মহামিথ্যাবাদী" মেয়ের-ও কিচ্ছুই হবে না; সে অন্য কোন ধনীর দুলালের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে জীবনযাপন করতে থাকবে।
আমিও এই লেখা লিখার পরে নিজের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করব। যদি মঞ্জু ভাই-এর খুনের বিচারের রাজনৈতিক মাহাত্ম্য থাকত, তাহলে হয়তো বা এই খুনের বিচার নিয়েও নাটক মঞ্চায়ন হত, আন্দোলন হত, মানববন্ধন হত। বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র এই দুনিয়া। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।