বিশ্বাস কর অঞ্জন তোমার জন্য আমার একটুও কষ্ট হয় না। স্বপ্নের এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলা, এতো আমার সারা জীবনের সঙ্গী। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, ভাবতে শিখেছি তখন থেকে। । আগেও এমন করতাম স্বপ্নের বাসর গড়তাম, স্বপ্ন পুরুষের কাছে নিঃস্ব হতাম, পূর্ণ হতাম, তার সাথে প্রেম-ভালোবাসায়, মান-অভিমানে, আনন্দ-বেদনায়,সুখে-দুঃখে আমি হাসতাম কাঁদতাম, তারপরে এক সময় আমার স্বপ্নের বাসরটা কে আছাড় মেরে ভেঙ্গে দিয়ে আমি বাস্তবে ফিরে আসতাম।
এখনও তাই করি, পার্থক্য শুধু এই টুক, আগে আমার স্বপ্ন পুরুষের কোন আদল থাকত না, এখন থাকে; আমার জন্য এও বড় কম পাওয়া নয়।
আমি সুস্মিতা, এক্সিডেন্টে আমার একটা পা পঙ্গু হয়ে গেছে। আমার দেহের ভার বইতে এই পঙ্গু পা টার যেমন কষ্ট হয়, তেমনি আমার মনটা কে সামাল দিতে আমার এই দেহটার মাঝে মাঝে বড় হিম শিম খেতে হয়। আমার যখন দশ এগার বছর বয়স তখন একদিন বাসন্তী বিকাল, চারদিকে আমের মুকুলের গন্ধ, বিচিত্র ফুলের সমারোহ আমায় চঞ্চলা করেছিল। দুই ভাই-বোন ছুটছিলাম রঙ্গিন প্রজাপতি ধরতে, প্রজাপতির পিছনে ছুটতে ছুটতে অন্যদিকে খেয়ালই ছিল না।
এমন সময় একটা গাড়ি আমায় চাপা দিল; ভাইটা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল। প্রথমে ত ভেবেছিলাম আমি মরে গেছি কিন্তু, জ্ঞান ফিরলে জানলাম মরি নি, তবে আমার পা টা মরেছে,অর্থাৎ আমার মৃত একাংশকে আমার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। চিকিৎসা করাতে পারলে হয় তো পা টা ভাল হয়ে যেত কিন্তু, যে বাবা-মাকে আমাদের খাবার জোটাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়, তারা কিভাবে আমার চিকিৎসা করাবে! দুঃখ তেমন একটা ছিল না, ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আমার এই পঙ্গু জীবনটাকে ভালোই গুছিয়ে নিয়েছিলাম।
একবার আমার মোবাইলে একটা নাম্বার থেকে মিস কল আসতে লাগল প্রায় এক মাস হবে; ঠিক রাত বার টায়, একই সময়ে নিয়ম মাফিক। মনে মনে হাসতাম, ভাবতাম হয়তো কোন ছাত্র পড়ার ফাঁকে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছে আর প্রেমিকা খুঁজছে।
প্রেম আমার জীবনে যে একেবারে আসে নি তা না; কাউকে আমার তেমন করে ভাল লাগে নাই, তাছাড়া এই পঙ্গু জীবনটাকে কারো সাথে জড়ানোর ইচ্ছে নাই বলে ভালো লাগানোর মন নিয়ে কাউকে আমি কখনও দেখিও নি। হটাত একদিন আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল, আমার মোবাইলে মিস কল দেয়ারও ব্যালান্স ছিল না। তিনশ টাকার একটা কার্ড ঢুকালাম, আর মনে মনে বললাম দাঁড়াও আমাকে ডিস্টার্ব করার মজা দেখাচ্ছি; আর তোমার প্রেমের সাধও আমি মিটিয়ে দেব। প্রথমে মিস কলই দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোন এলো; যা ভেবেছিলাম তাই।
ছেলেটা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। গায়ে পড়ে আমিই প্রেম নিবেদন করলাম,সেও যথারীতি বর্তে গেল। কিছুদিন যেতে না যেতে তার যখন প্রেমের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার মত অবস্থা; ভাবলাম এ খেলা বন্ধ করা দরকার। বলে দিলাম আমার আসল পরিচয় এবং উদ্দেশ্য। ও বিশ্বাস করতে চাইল না।
পরে যখন বিশ্বাস করল তখন প্রস্তাব দিল আমরা বন্ধু থাকি, আমি মেনে নিলাম। ও কিছুতেই আমার সামনে আসতে চাইত না; হয়তো ভাবত আমার কথার মায়ায় পড়েই তার এই অবস্থা, এর পরে যদি রূপের জালে আটকে যায় হয়তো আমার এই পঙ্গু দেহটার বোঝা সে আর নামাতে পারবে না। ওকে ভড়কে দিতে আমার খুব মজা লাগত, তাই প্রায়ই আমি আগের সুরে কথা বলতাম, কতক্ষণ ও ও চালিয়ে যেত, পরে যখন হুস হত, দেখত প্রেম আর বন্ধুত্বের মাঝখানের দেয়ালটার কোন অস্তিত্বই নাই; ও খুব বিরক্ত হত; আর আমি তাতে মজা পেতাম। এমন যখন চলছে, একদিন দুপুর একটার সময় হটাত ফোন এলো, বলল রাতের গাড়িতে সে খুলনায় এসেছে শুধু আমার সাথে দেখা করতে, ঠিক সাড়ে তিনটায় আমি যেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটির সামনে থাকি। আমি শুধু আচ্ছা বলে রেখে দিলাম।
ভাবলাম আমার যাওয়া ঠিক হবে না; ছেলেটা হয়তো সত্যিই সমস্যায় পড়ে যাবে। অন্যদিকে কৌতূহলী মন জানতে চাইল পঙ্গুত্ব জীবনের কতটা কেড়ে নিয়েছে; এখন ও কারও সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তার আছে কি নাই। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলেরই জয় হল, আমি গেলাম তার সাথে দেখা করতে। সেই অঞ্জন। পাগলের মত ভালোবাসে আমায়, আমার সবটুকু জেনেই।
তাই আমিও পণ করেছি যে করেই হোক ওর কাছ থেকে দূরে রাখব নিজেকে; এই অভিশপ্ত পঙ্গু জীবনের বোঝা কোন ভাবেই আমি কারো ঘাড়ে তুলে দিতে পারি না; কিছুতেই না। কোন ভাবেই আমি কারো ঘাড়ে তুলে দিতে পারি না; কিছুতেই না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।