মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, 'তিন ধরনের মিথ্যা রয়েছে। মিথা, ডাঁহা মিথ্যা ও পরিসংখ্যান। ' পরিসংখ্যান দেখলেই আমরা সম্বিতহারা হয়ে যাই। মনে করি, পণ্ডিত ব্যক্তিরা যখন অঙ্ক ও সংখ্যা দিয়ে দুরূহ কিছু একটা প্রকাশ করেছেন, কাজেই কোনো রকম তর্ক না করে তা মেনে নিই। বিশেষ করে যখন দশমিক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে, তখন ব্যাপারটি এতই বিজ্ঞানভিত্তিক যে কোনো প্রশ্ন না ওঠানোই ভালো।
রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট তাদের ফাইনাল পরীক্ষায় একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তা হচ্ছে- পরীক্ষার্থীদের প্রকাশিত একটি রচনার সমালোচনা করতে দেওয়া। পরীক্ষক হিসেবে ব্যাপারটি আমার কাছে খুব একটা উপভোগ্য হলো না। আমাকে আবার পরিসংখ্যান ভালো করে পড়তে হলো। পরীক্ষার্থীরা ভীষণ বিরক্ত; কিন্তু তাঁরা অসহায়। আমাদের হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল টিউটর আমাকে ধরে বসলেন প্রশিক্ষণরত ডাক্তারদের বিষয়টি পড়াতে।
আমি স্পষ্টভাবে না করে দিলাম এ জন্য যে একটি প্রকাশিত বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা পড়ানো মানে আমাকে দুই-তিন ঘণ্টা ধরে রচনাটি পড়তে হবে। কিন্তু রক্ষা পেলাম না। রাজি হতেই হলো। এমনি করে কয়েক বছর ধরে এই যন্ত্রণায় আমাকে ভুগতে হয়েছে। আমার আর কোনো সহকর্মী এই দায়িত্ব না নেওয়ায় কাঁধ থেকে এই ঝামেলা নামিয়ে দিতে পারিনি অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত।
আরো বড় ঝামেলা। একদিন অনুরোধ পেলাম, আমি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। আমাকে বলা হলো, গবেষণার জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দরকার, যিনি কিছুটা পরিসংখ্যান বোঝেন। আমাকে আরো বলা হলো, একজন স্ট্যাটিসটিশিয়ান আছেন, যিনি কিছুটা সাইকিয়াট্রি বোঝেন এবং তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। অর্থাৎ স্ট্যাটিসটিকস নিজে স্বাধীন কিছু নয়।
বাংলাদেশে টিআইবি প্রকাশিত জরিপকাজ এবং এটি নিয়ে মহা হৈচৈ দেখে সংগত কারণেই ভাবলাম, কিছু মন্তব্য করি।
ক্লাসে আমার আলোচনার সময় প্রশিক্ষণরত ডাক্তাররা বাধ্য হয়ে তা শুনতেন। আমার সহকর্মীদের প্রায় সবাই বিরক্ত হতেন। কিন্তু উপায় কী? ফলাফলে দশমিকের ব্যবহার দেখে হিসাবের সঠিকতা নিয়ে মুগ্ধ না হয়ে একজন ডাক্তার একটি গল্প বলেছিলেন। একজন লোক একটি মিউজিয়ামে কাজ করতেন।
তাঁর কাজ ছিল একটি ডায়নোসরের ৬০ ফুট দীর্ঘ একটি কঙ্কাল দর্শনার্থীদের দেখানো। একদিন স্কুলের একদল ছাত্রছাত্রী এলো। তারা লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, 'কঙ্কালটির বয়স কত?' লোকটি নির্বিকার উত্তর দিলেন, '৩০ লাখ বছর সাত মাস ১২ দিন। ' একজন ছাত্র অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, 'এত নিখুঁতভাবে আপনি কঙ্কালটির বয়স হিসাব করলেন কিভাবে?' আগের মতো নির্বিকার ভঙ্গিতে তিনি উত্তর দিলেন, 'আমি যখন এই মিউজিয়ামে কাজ করতে আসি তখন আমাকে বলা হয়েছিল যে কঙ্কালটির বয়স ৩০ লাখ বছর। আর আমি এখানে কাজ করছি সাত মাস ১২ দিন।
' পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, টিআইবির রিপোর্টে দশমিকের ব্যবহার করা হয়েছে।
একটি জরিপকাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এর পদ্ধতি। পদ্ধতি যদি সঠিক না হয়, তবে গবেষণাটির ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমি জানি, বর্তমান রিপোর্টটি একটি সংক্ষিপ্তসার। বিস্তারিত রিপোর্টে আরো জানা যাবে।
কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কাজেই এখন যেটুকু তথ্য আমরা পাচ্ছি, এর ওপরই আমরা আলোচনা করব।
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আলোচনা করা যাক গবেষণাটি কী ধরনের? কী ধরনের গবেষণা, এর ওপর নির্ভর করে এর পদ্ধতি। এটি একটি জনমত জরিপ। এরপর প্রশ্ন আসে, এটি কি একটি 'কোয়ালিটেটিভ জরিপকাজ'।
উত্তর হচ্ছে, 'না'। এ ধরনের জরিপকাজে অংশগ্রহণকারীদের অত্যন্ত বিস্তারিত প্রশ্ন করা হয়। উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষণার ফলাফল লেখা হয়। এই জরিপটিতে এসব কিছু করা হয়নি। কোয়ালিটেটিভ গবেষণায় স্যাম্পলের (নমুনা) আকার অতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
তাহলে ধরে নিতে হয়, জরিপকাজটি 'কোয়ানটিটেটিভ'। এ ক্ষেত্রে স্যাম্পলের আকারের গুরুত্ব অপরিসীম। পপুলেশনের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করা মুশকিল, কারণ আমরা যদি আলু নিয়ে গবেষণা করি, তবে আলু হবে পপুলেশন, আকারের ওপর নির্ভর করবে স্যাম্পলের আকার। যেহেতু স্যাম্পলের আকার পপুলেশনের আকারের চেয়ে ছোট, তাই 'কনফিডেন্স ইন্টারভাল, কনফিডেন্স লেভেল, পাওয়ার ইত্যাদি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। একটি পদ্ধতিতে ২০ হাজার পপুলেশনের জন্য ৩৭৭ জন স্যাম্পলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এই জরিপকাজে উল্লেখ করা হয়েছে যে শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, 'অন্য পেশাজীবী কর্মীদের' অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কথাটি স্পষ্ট নয়। উল্লেখ করতে হবে যে কারা এই 'অন্য পেশাজীবী'।
বিভিন্ন পেশার মানুষের কথা উল্লেখিত হওয়ায় পরিসংখ্যানের আরেকটি বিষয় উঠে আসে, আর সেটি হচ্ছে স্ট্রাটিফাইড স্যাম্পল।
যে পেশায় যতজন সমাজে আছেন, স্যাম্পলেও সেই অনুপাতে থাকতে হবে, নইলে স্যাম্পলটি পপুলেশনের প্রতিনিধিত্বশীল হবে না। মনে করুন, শিক্ষক একটা সমাজের শতকরা পাঁচজন। কিন্তু যদি স্যাম্পলে শতকরা ২৫ জন থাকে, তবে স্যাম্পলটি ওই পপুলেশনের প্রতিনিধিত্বশীল হবে না। আর সে ক্ষেত্রে গবেষণাটির ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ছাত্রদেরও এই জরিপকাজের বাইরে রাখা হয়েছে, যারা শিক্ষিত এবং অবগত বিশাল জনগোষ্ঠী।
উল্লেখ করা হয়েছে, 'দলনিরপেক্ষ ও সচেতন জনগোষ্ঠীর সদস্যদের' নিয়ে দলগত আলোচনা করা হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, 'দলনিরপেক্ষ ও সচেতন মানুষের' সংজ্ঞা কী এবং কিভাবে তাদের গ্রহণ করা হয়েছে? যদি সংজ্ঞা ও নির্বাচনপদ্ধতি সঠিক না হয়, তবে হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তবে কি প্রশ্নকারীর মনের মতো লোকদের বাছাই করা হয়েছিল?
এবার আসা যাক কী পদ্ধতিতে এই স্যাম্পল নির্বাচন করা হয়েছিল সেদিকটায়। টিআইবির প্রকাশনায় এটি উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়েছে যে ৪২টি জেলায় ৪৪টি দলগত আলোচনা সভা হয়েছে এবং সেখানে ৬০০ জন আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। প্রতিটি জেলায় প্রায় একই সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করেছে কি না তা স্পষ্ট নয়।
যাঁরা সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের মতামত দিয়েছেন কি না তা পরিষ্কার নয়। সাধারণত একটি সভায় যাঁরা উপস্থিত হন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বেশি কথা বলেন। কেউ কম কথা বলেন। আবার কেউ একেবারেই কথা বলেন না। কাজেই প্রশ্ন ওঠে, সভায় গৃহীত মত কি সভার সবার মত ছিল? নাকি উচ্চকণ্ঠ কয়েকজনের মতামতকেই সবার মত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
এককথায়, সভায় উপস্থিত ছিলেন বলেই তাঁকে স্যাম্পলের একজন বলে ধরে নেওয়া যায় না। স্যাম্পলের সংখ্যা ৬০০ জন, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
পরের প্রশ্নটি হচ্ছে, যাঁরা সভায় নিমন্ত্রিত হলেন, তাঁরা নির্বাচিত হলেন কিসের ভিত্তিতে? স্যাম্পলের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, তা হবে পপুলেশনের প্রতিনিধিত্বশীল। তাই স্যাম্পল বাছাই করতে হবে দৈবচয়নের (র্যানডামলি) মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়েছিল কি না উল্লেখ করা হয়নি।
র্যানডাম স্যাম্পল নির্বাচন করার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এর কোনোটি অনুসরণ করা হয়েছিল কি? প্রকাশনাটিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা বিপরীত ধারণাই দেয়। কোনো একটি জরিপকে বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রশ্নমালার প্রয়োজন হয়। এই প্রশ্নমালাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। এর তিনটি পদ্ধতি হচ্ছে- রিলায়েবিলিটি, ভ্যালিডিটি ও স্ট্যান্ডারাইজেশন।
এগুলোর সংজ্ঞা ও এগুলো নিরূপণের পদ্ধতি আলোচনার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই জায়গার অভাবে। তবে বলতে হয়, বিশ্বাসযোগ্য প্রশ্নমালা ছাড়া কোনো জরিপকাজ গ্রহণযোগ্য নয়। তেমন কোনো প্রশ্নমালা ব্যবহার করা হয়েছিল কি না টিআইবির প্রকাশনায় এমনটি উল্লেখ নেই। আলোচনা সভায় আলোচনার ভিত্তিতে গৃহীত কোনো তথ্য বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, কাজেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। এর একটা কারণ হচ্ছে এই যে প্রশ্নের ভাষার ভিন্নতার জন্য ভিন্ন উত্তর আসতে পারে।
প্রশ্নের অন্যান্য ভিন্নতার জন্যও ভিন্ন উত্তর আসতে পারে। কোন প্রশ্নটি আগে করা হবে আর কোনটি পরে করা হবে এর ওপরও উত্তর ভিন্ন হতে পারে। সবাইকে একইভাবে প্রশ্ন করা উচিত। এককথায়, বিশ্বাসযোগ্য প্রশ্নমালা ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য উত্তর আসতে পারে না।
স্থানের অভাবে টিআইবির দেওয়া সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আলোচনা করা যাচ্ছে না।
তবু এটুকু বলতে হয়, সংসদ সদস্যদের 'ক্রিমিন্যাল কাজের' তালিকায় খুন, জমি দখল, সরকারি জমি দখল, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, শক্তির ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কোন অপরাধ কয়টি করা হয়েছে এবং কয়জন সেগুলো করেছেন- এটি উল্লেখ না করায় গোটা ব্যাপারটি অস্বচ্ছ রয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি খুন অনেকগুলো হয় (যেটি সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে), তবে তা টেন্ডারবাজির তুলনায় অনেক ভয়াবহ এবং জরিপকাজে সংগৃহীত তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে জরিপকাজের বাইরের তথ্যও ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রকাশনায়। এই বাইরের তথ্য টিআইবির কর্মকর্তারা নিজেদের পছন্দমতো নির্বাচন ও ব্যবহার করেছেন। এখানে বিজ্ঞানসম্মত কিছুই নেই।
জরিপকাজের তথ্যের সঙ্গে বাইরের তথ্যকে মেশানোর ফলে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় এসব প্রকাশিত হয়েছে। আমরা অনুরোধ করব, পরিসংখ্যানভিত্তিক কোনো রচনা প্রকাশ করার আগের জরিপকাজটির পদ্ধতিগত দিকটি যেন যাচাই করে নেওয়া হয়।
রাজনীতি রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে। অরাজনীতিবিদদের রাজনীতিতে নিয়ে এলে কী হয়, তা জাতি দেখেছে।
এ অবস্থায় ত্রুটিপূর্ণ জরিপকাজের সাহায্যে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিশাল আকারের ভয়াবহ চিত্র অঙ্কন করা কাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা আশা করব, এ নিয়ে গবেষণা হোক। সঠিক তথ্য ছাড়াই আবেগপূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করবে শুধু।
(কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।