আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহযাত্রী!

আমি খুব সাধারন মাপের এক মানুষ। বেঁচে আছি, এটাই জীবনের একমাত্র সত্যি। বেঁচে থাকাটা সব সময় অনুভব করার চেষ্টা করি। ভীষন অভিমানী, মোটেও ঝগড়াটে নই। আড্ডা মারতে ভালোবাসি, গসিপ করতে মোটেও ভালোবাসিনা, কারোর হাঁড়ির খবর নেইনা, মানুষের কষ্ট শেয়ার করার মত দুঃসাহস মনে দুই সপ্তাহ আগেই মায়ের গুরুতর অসুস্থতার সংবাদ পেয়েছুটে গেছিলাম দেশে।

আমি থাকি আমেরিকায়, যখন তখন দেশে যেতে পারিনা। দুই বছরে একবার যাই, পুরো পরিবারসহ। এই হিসেবেই গত এগারো বছর ধরে আমরা দেশে যাওয়া আসা করি। এই বছর সামারে দুই মাসের জন্য দেশে গিয়েছিলাম, পুরো পরিবার। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা মোট পাঁচজন।

তিন কন্যা, স্বামী, আর আমি। এই সামারে বড় কন্যার বিয়ে দিলাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচের বদলে ছয় হলো অথবা পাঁচের বদলে চার হলো। দুটোই সত্যি। লেখাটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ে নয়, ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া আমার স্বভাব। মূল কথায় চলে আসি।

লেখাটি লিখতে চেয়েছি আমার দেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে, দেশে যাওয়ার পথে সহযাত্রীদের নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই আমি একা পথ চলতে ভয় পাই। মায়ের শাসনে বড় হয়েছি বলেই আমার মধ্যে এক ধরনের জড়তা কাজ করে। বিশেষ করে পথ চলতে গেলেই আমি কাবু হয়ে যাই, একা একা কোথাও যেতে সাহস পাইনা। নির্দিষ্ট একটা বয়সের পরে মা আমাকে কোথাও একা একা যেতে দিতেন না।

স্কুল আর কলেজের গন্ডীটুকু ছাড়া আমি কোথাও যাইনি, তাই আমার নিজের শহর নারায়নগঞ্জের কিছুই ভালভাবে চিনতেও শিখিনি। একা একা কোথাও যেতাম না বলেই একা একা চলতেও শিখিনি। বাইরে বেরোবো কি, পথ হারিয়ে ফেলতে পারি ভয়ে পরবর্তী জীবনেও সাথী ছাড়া কোথাও বের হইনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হতেই স্বাধীনতা পেয়েছি। বাইরে ঘরে চলার স্বাধীনতা, তবে খাঁচার পাখী ছিলাম তো, তাই আকাশে উড়ার সুযোগ পেলেও উড়তে পারিনি।

সব সময় সাথে একজন সঙ্গী থাকতোই আমার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়নগঞ্জ আসতে গেলেও দুই একজন বন্ধু আমার সাথে আসতো, গুলিস্তান এসে নারায়নগঞ্জের বাসে তুলে দিয়ে যেত। এই হচ্ছি আমি। বিয়ের পরে তো সর্বক্ষনের সঙ্গী পেয়েই গেলাম। আমার স্বামীই আমাকে গাইড করেছে।

যদিও উঠতে বসতে ‘বোকা’ বলে মৃদু ধমক দিয়েছে, তারপরেও আমাকে কোথাও একা ছাড়েননি। যেখানেই গিয়েছি, হয় আমার স্বামী নাহয় আমার তিন কন্যাকে পেয়েছি সহযাত্রী হিসেবে। সহযাত্রী হিসেবে আমার মধ্যম কন্যাটি সর্ব শ্রেষ্ঠ। মধ্যম কন্যার নাম ‘মিশা’। মিশা পাশে থাকলে যে কোন অন্ধও অনায়াসে পৃথিবী ভ্রমন করতে পারবে নিশ্চিন্ত মনে।

যতবার দেশে গেছি, মিশা আমাকে গাইড করেছে। দেশে যেতে আমার লাগেজ হয়ে যায় অতিরিক্ত ওজনে ঠাসা। কাস্টমসে গিয়ে কাস্টমস অফিসারকে কিভাবে যেনো ভুলিয়ে ফেলে মিশারানী। অতিরিক্ত এক কেজি ওজন যেখানে এলাউড না, অতিরিক্ত চার কেজি ওজনও পার পেয়ে গেছে মিশার বদৌলতে। প্লেনে উঠে একটি মাত্র জানালার পাশের সীট মিশা আমাকে দিয়ে দেয়।

খাবারের কার্ড নিয়ে যখন বিমান বালা সামনে আসেন, ‘ভ্যাবলাকান্ত’ মায়ের জন্য খাবারের মেন্যু ঠিক করে দেয় মিশা। আমি নিশ্চিন্ত মনে প্লেন যাত্রা উপভোগ করি। আমার পরিবারের সদস্যরাই ছিল আমার সহযাত্রী, এভাবেই আমি অভ্যস্ত ছিলাম। এবারই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটলো। যে মায়ের শাসনে থেকে আমি এমন ভীতু হয়েছি, বলা নেই কওয়া নেই, সেই মা’ই হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

মাত্র দুই মাস আগেই দেশ থেকে ফিরেছি সুস্থ মা’কে দেখে। মা এমনই অসুস্থ হলেন যে সবার বদ্ধমূল ধারনা হয়ে গেল, মা আমার যখন তখন আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে যাবেন। আমি মায়ের একটা মাত্র মেয়ে। মা আমাকে শেষ বারের মত আরেকবার দেখবেন না, তা কি করে হয়! সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো, আমি দেশে যাব। কিনতু মনে মনে ভীষন মুষড়ে পড়লাম।

একা একা কীভাবে যাব! মিসিসিপি নামের যে স্টেটে আমি থাকি, এর অবস্থান এমনই এক জায়গায়, যেখান থেকে দেশে যেতে গেলে দুই তিনবার প্লেন পাল্টাতে হয়। এবার আমি গিয়েছি, মিসিসিপি টু হিউস্টন, হিউস্টন টু দোহা, দোহা টু ঢাকা। হিউস্টন এয়ার্পোর্ট হয়ে এর আগেও আমরা গিয়েছি দেশে। তখন সাথে ছিল মিশা, মৌটুসী নামের দারুন স্মার্ট দুই কন্যা। ওরা আমাকে বলতে গেলে চোখ বন্ধ করেই নিয়ে গেছে।

হিউস্টন এয়ারপোর্টে অনেকগুলো টার্মিনাল আছে। এক টার্মিনাল থেকে ট্রেনে চেপে আরেক টার্মিনালে যেতে হয়। হাতে সময় থাকে অল্প। এই সময়ের মধ্যেই লাগেজ নিয়ে ছুটতে হয়। আমি ওদের পেছন পেছন ছুটেছি, এই পর্যন্ত।

হাতে প্লেনের টিকিট পেয়েই আমি ঘামতে শুরু করেছি। মায়ের কাছে যেতে পারবো তো! প্লেন যদি মিস করি! ভুল করে যদি অন্য প্লেনে উঠে যাই! যদি লাগেজ হারিয়ে ফেলি! পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলবো না তো! মাত্র একদিনের সিদ্ধান্তে অতিরিক্ত ডলার খরচ করে পরের দিনের টিকিট কেটেছি। রাতের বেলা মিশাকে ফোন করে বলেছি, কিভাবে যেতে হবে তার একটি ডায়াগ্রাম একে যেন মেসেজ করে পাঠায়। মিশা সাথে সাথে অ আ ক, খ করেই পাঠিয়েছিল ডায়াগ্রাম। কিনতু দূর্ভাগ্যবশতঃ ডায়াগ্রামটি ওপেন করতে পারিনি।

সম্পূর্ণ একা রওনা হয়েছি। মিসিসিপি এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছি, কোথায় কোথায় থামতে হবে। সে সংক্ষেপে বলে দিয়েছে, ঠিক কোন কোন জায়গায় আমাকে থামতে হবে। ব্যস! আমি রওনা হয়ে গেছি। প্রথম ধাপ পেরিয়ে প্লেনে উঠে বসেছি।

মায়ের কথা মাথায় ছিল না, একটাই চিন্তা ছিল, হিউস্টনে গিয়ে কিভাবে টার্মিনাল পার হবো। আমি মানুষের সাথে কথা বলতে পারি, এই একটা গুণ আমার আছে। সেই গুণকে সম্বল করেই মনে সাহস আনতে চেষ্টা করছিলাম, প্রথম সহযাত্রী হয়ে আমার পাশে বসলো বিরাট লম্বা চওড়া এক হোয়াইট যুবক। মাথা কামানো, হাতে ট্যাটু করা যুবকটিকে আমি আগেই লাইনে দাঁড়ানো দেখেছিলাম। তাকে দেখে আমার একটুও পছন্দ হয়নি, আর সে-ই কিনা আমার সহযাত্রী! আমেরিকান এয়ারলাইন্স গুলো হচ্ছে পিশাচের পিশাচ।

এরা প্লেনে কিছুই খেতে দেয়না, তার উপর সীট গুলো এমনই ছোট এবং চাপা যে দু’জন দূর্বল স্বাস্থ্যের মানুষও ভালোভাবে বসতে পারেনা। সেই জায়গায় এই বিশালদেহী আমার পাশে বসে আবার ঘুমিয়েও পড়েছে। আমি একেবারেই কোনঠাসা অবস্থায় বসে আছি। আমার অবশ্য কোন শুচিবাই নেই। একজন এত জায়গা নিয়ে বসেছে, তার শরীরের অনেকটা অংশই আমার সীটের উপর এসে পড়েছে বলেই যে আমি ‘আমার মান সম্ভ্রম চলে গেছে’ বলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াব, তেমন অবিবেচক আমি নই।

তবে ছেলেটি কিনতু অবিবেচক ছিল, তার এই বিশাল দেহ আরেক যাত্রীর সীটে চলে যাওয়ার পড়েও সে কিভাবে ঘুমিয়ে গেলো, সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। দুই ঘন্টায় প্লেন হিউস্টনের মাটি স্পর্শ করলো। নেমে গেলাম প্লেন থেকে, গিয়ে পৌঁছলাম ‘বি’ টার্মিনালে। যেতে হবে ‘ ডি’ টার্মিনালে। কিভাবে যাবো, সকলকেই দেখি টিভি স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি টিভি স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়ে একজনকে থামালাম, বললাম ‘ডি’ টার্মিনালে যাব। সাথে সাথে সে আমাকে বললো, তাকে ফলো করার জন্য। কিনতু ‘কাতার’ এয়ার লাইনসের কথা বলতেই সে বললো, টিভি স্ক্রীনে চেক করে নেয়ার জন্য। এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম টার্মিনাল পুলিশকে। সে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিতেই আমি টুক টুক করে এস্কেলেটার পালটিয়ে পালটিয়ে চলে গেলাম ট্রেন স্টেশানে।

অবশ্যই মিশার নির্দেশ মত সাইন গুলোও পড়ছিলাম। ট্রেনে উঠেই মিশার ফোন পেলাম। ও যখন জানতে পারলো যে আমি ট্রেনে উঠে গেছি, ও যে কী খুশী হলো। ট্রেন থেকে নেমেই আমি প্রথমেই একজন এয়ারপোর্ট স্টাফকে বললাম, কাতার এয়ারওয়েজ এর গেইট দেখিয়ে দেয়ার জন্য। সে আমাকে বললো, ডোহা ডোহা? মনে পড়ে গেলো, এরা দোহা বলতে পারেনা, বলে ডোহা।

বললাম, ইয়েস ডোহা। সে বলে দিল, সোজা চলে যাও ১২ নাম্বার গেইটে। ব্যস! সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে উঠে বসলাম প্লেনে। এবারও আমি পেলাম জানালার পাশের সীট, পরবর্তী সীটে এসে বসলো আরেকটি হোয়াইট ছেলে, এর মাথাও সম্পূর্ণ কামানো। দোহা গিয়ে কিভাবে ঢাকার ফ্লাইট ধরবো, সেই চিন্তায় একটু অস্থির ছিলাম।

আশা করছিলাম, আমার সহযাত্রী যদি ঢাকাগামী কেউ হয়! যাই হোক আমেরিকান সহযাত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, সে কোথায় যাচ্ছে। বললো, নেপাল। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, সে কি নেপালী কি না! বললো, সে ইউরোপিয়ান আকেরিকান, নেপাল যাচ্ছে হাইকিং করতে। একা যাচ্ছে কিনা জানতে চাইতেই একটু দূরে দাঁড়ানো আরেক জনকে দেখিয়ে বললো, বাবার সাথে যাচ্ছে। বাবা এসে তিন নাম্বার সীটে বসতেই আমি নিজে থেকে আলাপ শুরু করে দিলাম।

বাবার নাম স্টীভ, ছেলের নাম পিটার। একমাত্র সন্তান পিটারকে নিয়ে বাবা যাচ্ছেন হাইকিং করতে। বাপ-ছেলেতে মিলে বছরে একবার অন্তঃত নানা দেশে যায়, হাইকিং করতে। ছেলের মা’কে খুব বেশী কিছু জানায়না, মা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে ভেবে। নেপালে স্টীভ এর আগেও আরেকবার গিয়েছিল, এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারেনি, তবে অনেকটাই উঠেছিল।

স্টীভ খুব গর্বের সাথেই বললো, ছেলের কথা। স্টীভ শুধুই হাইকিং করে, কিনতু ছেলে পিটার ক্লাইম্বিংএও পারদর্শী। এমন সহযাত্রী পেয়ে আমার ভালো লেগেছে। সাহসী সহযাত্রী পাশে থাকলে মনে সাহসের সঞ্চার হয়। তাদেরকে বললাম, আমাকে একটু সাহায্য করতে দোহা এয়ারপোর্টে গিয়ে।

ঠিক গেইটে যেনো উপস্থিত হতে পারি। দোহা পৌঁছে স্টীভ আর পিটার আমার জন্য গেইটে অপেক্ষা করছিল। ততক্ষনে এয়ার পোর্ট পুলিশকে জিজ্ঞেস করে আমি জেনে নিয়েছি ঢাকা যাওয়ার গেইট নাম্বার। আমাকে সেই পথে যেতে দেখে স্টীভ হাত তুলে ‘গুড লাক’ জানিয়ে অন্য পথে চলে গেলো। দোহা থেকে যে ফ্লাইটে উঠেছি, সেটা এক কথায় অসহ্য।

আমার সীট পড়েছে মাঝের রো তে। আমার আগে যারা উঠেছে, তারা প্লেনে উঠেই ক্যাঁচোর ব্যাঁচোর শুরু করে দিয়েছে। এত বছর বাইরে থেকেও আমার দেশী ভাই বোনেরা ন্যুনতম ভদ্রতা শিখেনি, এটা দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। একজনের সীটে আরেকজন বসে পড়ার মত ঘটনা তো আছেই, প্লেনে উঠেই লাগেজ রাখার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। প্লেন যখন ল্যান্ড করে, প্লেনের চাকা না থামতেই পাইলটের ‘ নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সীটে বসে থাকুন’ ঘোষনাকে অমান্য করেই অনেকেই সীট বেল্ট খুলে দাঁড়িয়ে লাগেজ বক্স খুলে ফেলে।

এয়ারহোস্টেসদের দৌড়ে আসতে হয় তাদের থামানোর জন্য। এটা প্রতিবার ঘটে। আমার যাত্রাটিকে আরেকটু অসহণীয় করে তোলার জন্যই বোধ হয় এবারই বেশ কিছু যাত্রীর সাথে ‘নন স্টপ ক্রাইং’ বাচ্চা ছিল । সারাটা পথ বাচ্চাদের চীৎকারে এক সময় অসহণীয় হয়ে উঠেছিল পথটুকু। বাচ্চাদের অভিভাবকেরা বাচ্চাগুলোকে কান্না থামানোর কোন চেষ্টাই করছিল না।

বাচ্চাদের ভুলানোর কত কৌশল আছে, কাউকেই দেখলাম না এতটুকু বিচলিত হতে। একজন যাত্রী বলেই ফেললো, বাচ্চার কান্না থামান প্লীজ! আর কেউ অবশ্য এমন অনুরোধ করেনি, কারন বিষয়টি অত্যন্ত সেনসিটিভ। বাচ্চাদের মা বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিল, টাকা খরচ করে উঠেছি প্লেনে, বাচ্চার কান্না থামানোর দায়ও প্লেনের এয়ারহোস্টেসদের নিতে হবে। এক মহিলা শেষ মুহূর্তে এসে উঠেছে প্লেনে। সাথে ছোট বাচ্চা, কিনতু টিকেট কেটেছে একটা।

বাচ্চা কোলে নিয়ে যাবে। এক ভদ্রলোক ছিলেন জানালার পাশে বসা। মহিলা সেই ভদ্রলোককে বললেন, তাকে যেন জানালার পাশের সীটটি দিয়ে দেয়। ভদ্রলোক এক কথায় উনার সীট দিয়ে দিলেন। এরপর মহিলা তার বাক্স প্যাঁটরা খুলে বসেছে।

হঠাৎ করেই সে আবিষ্কার করেছে, অদূরে একটি সীট খালি পড়ে আছে, মহিলা সেই ভদ্রলোককে বললো, উঠে সেই খালি সীটে গিয়ে বসতে। ভদ্রলোক উঠে যেতেই মহিলা দুই সীট জুড়ে বসে গেছে। এক টিকিটে দুই সীটের সুবিধা পেয়ে গেল। মহিলাকে দেখে মনে হয়েছে, এর আগেও সে এভাবেই গিয়েছে। একেবারে অভিজ্ঞ যাত্রী।

একটু পর পর এয়ারহোস্টেসকে ডাকছিলেন আর এই লাগবে, সেই লাগবে করেই যাচ্ছিলেন। প্লেন ল্যান্ড করার আগ মুহূর্তে সে প্লেনের সহকারী পাইলটের কাছেই বোধ হয় এক প্যাকেট খাবার চেয়ে নিলেন। কারন মহিলাকে তার বান্ধবীর কাছে বলতে শুনেছি, এয়ার হোস্টেসের কাছে চাইলে দিত না, যেটাই চাই সবই বলে নাই নাই, সেজন্য পাইলটের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিলাম। মায়ের কথা ভুলে আমি এসবই দেখছিলাম। আর আমার পাশে যে বসেছে, সে ছিল নিতান্তই সাধারন এক শ্রমিক।

প্লেনের অনেক কিছুই সে বুঝতে পারছিল না, আমি তার প্রতি বড়বোনসুলভ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সে আমার প্রতি এতটাই কৃতজ্ঞ ছিল যে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হয়েছে, দূরযাত্রায় একজন আরেক জনকে সাহায্য করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাকেও অনেকের সাহায্য নিয়ে এখানে আসতে হয়েছে। এবার আসি বাথরুমের কথায়। যে কোন স্থান থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলোর বাথরুম গুলো শেষ পর্যন্ত আর ব্যবহারযোগ্য থাকেনা।

মাঝে মাঝেই পাইলটকে ঘোষনা দিয়ে বলতে হয়, ঠিক মত ফ্ল্যাশ টানতে, বাচ্চাদের ন্যাপিগুলো ট্র্যাশ ক্যানে ফেলতে। ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলোতে এয়ারহোস্টেসদেরকে দেখলে খুব অসহায় মনে হয়। এবারও তাই মনে হয়েছে। এভাবেই এক সময় ঢাকা পৌঁছে গেলাম। এবার ঢাকা থেকে ফেরার পালা।

ঢাকা টু বাংলাদেশ ফ্লাইটে উঠেই সহযাত্রী পেলাম এক যুবককে। খুবই মিষ্টি চেহারার ছেলেটি সীটে বসেই ফোনে কাউকে বলছিল, ‘ আম্মাকে চলে যাইতে বলেন। আমার প্লেন এখনই ছেড়ে দিবে। আম্মাকে চলে যাইতে বলেন”। বুঝলাম, তার মা এসেছে তাকে বিদায় জানাতে।

সময় তখন ভোর রাত সাড়ে চারটা। আহারে! আমি সদ্য মা’কে হারিয়ে এলাম, আর এই ছেলেটিও মা’কে ছেড়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে! জানতে চাইলাম, সে কোথায় যাচ্ছে। বললো, ওয়াশিংটন ডিসি। বুঝলাম, দোহা গিয়ে আমাদের দুজনকে দুদিকে যেতে হবে। জানলাম ছেলেটি ২০০৩ সাল থেকে আমেরিকাতে আছে, পারিবারিক ব্যবসা তাদের।

দেশে গিয়ে বিয়ে করেছে, এবার গিয়েছে নতুন বৌয়ের সাথে কয়েকটা মাস সময় কাটাতে। তিন মাস ছিল দেশে, মা ও নতুন বৌয়ের কাছে। বৌয়ের কাগজপত্র রেডি হয়ে গেছে। আর কয়েক মাস পরেই বৌ কে নিয়ে যেতে পারবে। সুন্দর গল্প, সুখের গল্প।

শুনতে ভাল লেগেছে। পাঁচ ঘন্টার জার্নিতে অন্য যাত্রীরা বাথরুমের অবস্থা কী করেছে জানিনা, আমি একবার বাথরুম গিয়ে ফিরে আসতেই এয়ার হোস্টেস আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ফ্ল্যাশ টেনেছি কিনা। আমার একটুও রাগ হয়নি, হাসি মুখেই বললাম, হ্যাঁ ফ্ল্যাশ টেনেছি। এই এয়ারহোস্টেসটিকে শুরুতেই খুব বিরক্ত হতে দেখেছি। তাই তার বিরক্তি আর বাড়াতে চাইনি।

তার কাছে জলের বোতল চেয়েছি, সে আমাকে ছোট একখানি কাপ দিয়েছে। আমি আবার বললাম, কাপ চাইনা, ছোট এক বোতল জল দাও। সে এবার বিরাট বড় এক বোতল তুলে দিল আমার হাতে। সেটা নিয়ে আমি আবার সীটে বসেছি। এয়ারহোস্টেসের দোষ নেই, ঢাকাগামী বা ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ফ্লাইটে ডিউটি পড়লে যে কারো মাথা খারাপ হবেই হবে।

দোহা টু হিউস্টন ফ্লাইটে উঠে আবার সীট পড়লো মধ্যম সারিতে। আমার পাশের সীটে বসেছে অবাঙ্গালী এক যুবক। খুবই ভাল ছেলে, সীটের উপর পা তুলে বসতে গিয়ে কতবার ছেলেটির গায়ে পা ঠোকর খেয়েছে, সে হাসিমুখে আমাকে ‘দ্যাটস ওকে’ বলে আশ্বস্ত করেছে। তবে আমার সামনের সীটে বসা যাত্রীগুলো ছিল একেবারেই অদ্ভুত। মিডল ইস্টের এক পরিবার।

স্বামী, স্ত্রী, তিন কন্যা। তৃতীয় কন্যাটি এক কথায় স্পয়েলড। মেয়েটির বয়স দশ -এগারো হবে আর কি! আমি বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসি, তবে স্পয়েল্ড বাচ্চাদেরকে এভয়েড করে চলি। স্পয়েল্ড বাচ্চাদের দুষ্টামী সহ্য করতে পারিনা। এই পরিবারের মহিলা ও তিনটি মেয়েই দেখতে সুন্দর।

বড় মেয়ে দুটি যেমন সুন্দর তেমনই শান্ত। বড় মেয়ে দুটিকে নিয়ে তাদের মা বসেছে এক সারিতে, আর স্পয়েল্ড মেয়েটিকে নিয়ে তাদের বাবা বসেছে আমার সামনের সারিরতে। তাদের পোষাক দেখেই বলে দেয়া যায়, পয়সাওয়ালা লোক এরা। কিনতু ভদ্রলোকটি এমনই নির্বিকার, দেখে মনে হয়, মেয়েদের বাবা হতে পেরেই উনার কাজ শেষ, মেয়েগুলির প্রতি তার কোন অভিব্যক্তি দেখলাম না ১৫ ঘন্টার জার্নিতে। খাবারের ট্রলি ঠেলে এয়ার হোস্টেস কাছে আসতেই ছোট মেয়েটি এমন পাগলামী করছিল যে আমার লজ্জা লাগছিল।

এয়ার হোস্টেসটি অসহায়ভাবে বাচ্চার বাবা মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল, আর ১০ বছর বয়সী মেয়েটি পাগলের মত ট্রলি থেকে একবার এই স্যান্ডুইচ টেনে নেয়, গন্ধ শুঁকে, আবার ফিরিয়ে দেয়। পাশে বসা বাবা অথবা আরেক পাশে বসা মা’কে দেখলাম নির্বিকারভাবে মেয়ের খেলা দেখা যাচ্ছে। কী অসভ্যতা! এয়ার হোস্টেস চলে যেতেই মেয়ে সীটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার সামনের সীটটিই ছিল মেয়েটির। মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়লেই আমার ভয় লাগে, যদি উলটে আমার উপর এসে পড়ে।

তাছাড়া মেয়েটি বেশ কয়েকবার সীটে দাঁড়িয়ে প্লেনের লাগেজ কেইসের ঢাকা খুলে ফেলেছে, পাশের আমেরিকান সহযাত্রী নিজে উঠে সেই ঢাকা বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিবার। একবার একটি ব্যাগ দুম করে এসে পড়েছে আমার পায়ের কাছে। এসব দেখেও পাশে বসা বাবা মা কিছুই বলেনা। আমিই এক সময় চোখ গোল করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওকে সীটে বসতে বললাম। মেয়েটি বসে গেল, পরক্ষনেই হাত পেছনে দিয়ে আমার সীটের ডিভিডির রিমোট কন্ট্রোল দিল ছুটিয়ে।

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি , মা আর মেয়ে মিলে খাবারের খালি প্যাকেট, চকোলেটের খোসা, দইয়ের শূণ্য কাপ সীটের পাশেই ফ্লোরে ফেলে রেখেছে। হাত ফসকে যদি পড়ে গিয়েও থাকে, তবুও নীচু হয়ে সেটা তুলে ফেলার মত ভদ্রতাটুকুও করেনি মহিলাটি। এক সময় এয়ার হোস্টেস এসে সব পরিষ্কার করে গেলো। বাকী যে দু’টি মেয়ের কথা বললাম, মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়, এরা স্কুলে পড়াশোনা করার পাশাপাশি সহবৎও শিখেছে। তিনজনেই বোরকা দিয়ে সম্পূর্ণ ঢাকা হলেও মুখগুলো অনাবৃত ছিল।

ওভাবেই অনিন্দ্য সুন্দর মুখগুলো দেখতে পেয়েছি। দুজনের একজনকে দেখেছি, এক ফাঁকে মায়ের নোংরা করা জায়গাতেই নামাজ পড়তে। যাই হোক এভাবেই ১৫ ঘন্টা পার করলাম। প্লেন থামতেই যাত্রীরা দাঁড়িয়েছি দরজা খোলার অপেক্ষায়, ছোট মেয়েটি ঘ্যানর ঘ্যানর করেই চলেছে। বাবা টা হঠাৎ করেই সামনে দাঁড়ানো আমেরিকান যাত্রীকে বলে ফেললো, এবার সামনে যাও, আমাদেরকে বের হতে দাও।

যাত্রীটি অনেকক্ষন ধরেই এদের অত্যাচার সহ্য করেছে, কারন প্রথম দিকে সে অনেকবার ওদেরকে হেল্প করেছে হাজার বার লাগেজ কেইসের ঢাকনা খুলতে আর বন্ধ করতে। এবার ভদ্রলোক সেই বাপের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জবাব দিল, প্লেনের নিয়ম আছে। যখন ওরা বলবে সিঁড়ি রেডী, তখনই আমি বের হতে পারবো। ততক্ষন তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। হিউস্টন টু মিসিসিপি আসাটা খুব একটা কঠিন ছিল না।

প্লেন থেকে নামতেই সময় বুঝে মিশা ফোন করেছে। বলেছে কিভাবে কাস্টমস পার হতে হবে, লাগেজ তুলতে হবে, লাগেজ আবার কিভাবে নতুন করে বুকিং দিতে হবে। মিশার নির্দেশ মতই কাজ করেছি, তবে অবশ্যই এয়ারপোর্ট পুলিশদেরকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি। কাস্টমস অফিসার কে জিজ্ঞেস করেছি, ব্যাগেজ ক্লেইম করতে কোথা দিয়ে যেতে হবে। অফিসার খুব সুন্দর করে আমাকে রাস্তা বলে দিয়েছে।

সব সেরে যখন প্লেনে উঠেছি, ১৯ নাম্বার সীট খুঁজতে খুঁজতে প্লেনের শেষ প্রান্তে গিয়ে সব শেষ সীটটি খুঁজে পেয়েছি। দুই সীটের মধ্যে একটি আমার। অপেক্ষা করেছি সহযাত্রীটির জন্য। শেষ পর্যন্ত সহযাত্রী আর কাউকে পেলাম না। আমি একাই দুই সীট জুড়ে বসে মিসিসিপি এসে পৌঁছেছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।