[লেখার শুরুতেই বলে নিচ্ছি লেখাটা পড়ে কেউ ভাববেন না প্রচণ্ড কষ্ট থেকে লিখছি। নাবিক দের জীবন নিয়ে সাধারন মানুষদের যেমন একটা আগ্রহ থাকে সেরকম আগ্রহ আর পৃথিবীকে ঘুরে অদেখা কে দেখার এক দুর্নিবার আকর্ষন থেকেই আমার নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা। স্বর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব আর প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ এর মুখমুখি হতে হতে দিনে দিনেএকজন শিক্ষানবিস নাবিক মনে প্রানে সমুদ্রচারী হয়ে ওঠে। নাবিকদের তাদের সমুদ্র জীবন শুরুর ধাপ গুলতে যে ব্যাপার গুলোর মুখোমুখি হতে হয় তা মাটির পৃথিবীর মানুষদের কাছে অন্যরকম বা খারাপ লাগার মনে হতে পারে। ]
জাহাজেঃ
৯ জানুয়ারি ২০১২।
সিঙ্গাপুর এর ওয়েস্ট কোস্ট পিয়ার এ আমার কোম্পানির বাংলাদেশী সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন কদরুল ইসলাম এর সাথে আমার ব্যাগ পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আমার পূর্ব পরিচিত। এর আগে অফিস এ যাবতীয় কাগজ পত্র সই করে বয়লার স্যুট আর সেফটি সু দিয়েছে দুই সেট। আর সাদা ইউনিফর্ম। ইমিগ্রেশন এ আমার পাসপোর্ট আর ইমিগ্রেশন এর কাগজ জমা দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
বেশিক্ষন দাড়াতে হল না। ৩ মিনিটেই কাজ শেষ। সেখান থেকে পেরিয়ে বোটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর স্যার আমাকে নানা দিক নির্দেশনা মূলক কথা বলছিলেন। একটু পর এজেন্ট এর দেয়া বোট আসল।
সেখানে ব্যাগ পত্র সহ উঠে বসলাম।
আমার জাহাজ এর অবস্থান ছিল ওয়েস্ট পেট্রোলিয়াম আলফা তে। বোট চলছে বড় বড় ঢেউ গুলোর উপর লাফিয়ে লাফিয়ে, সিঙ্গাপুর বন্দর এর কন্টেইনার জেটি র পাশ দিয়ে। অসঙ্খ্য জাহাজ। বড় বড় জাহাজ এক সাথে এই প্রথম দেখলাম।
সঙ্খ্যায় এত বেশি যে সেসব বড় জাহাজ কে প্রথমে তাদের আকৃতির মত বড় বলে মনে হয় না। ছোট্ট দেশ কিন্তু তাদের কোস্ট লাইন কে সঠিক ভাবে খুবই পরিকল্পনা মাফিক ব্যাবহার করেছে তারা। পাশে দেখলাম নির্মানাধীন আরো অনেক গুলো জেটি। আর নোঙ্গর করে আছে যে কতগুলো জাহাজ তার ইয়ত্তা নেই। অবাক চোখে সেগুলো দেখছিলাম।
আমরা একটা গভীর সমুদ্র বন্দর এর জন্য কত রাজনীতি কত প্রতিশ্রুতি শুনি আমাদের জ্ঞানী নেতাদের কাছ থেকে। চট্টগ্রাম আর মংলা বন্দরকেও আমরা সঠিকভাবে ব্যাবহার করতে পারিনি। অন্য দেশ এর সাথে ব্যাবসায়ীক চুক্তি ভিত্তিক কোন জেটিও আমরা খুলতে দিতে রাজি নই। কত চিন্তা ভাবনা কত আজগুবি গুজব কে কান দিয়ে আমরা আমাদের মূল্যবান প্রাকৃতিক স্থান গুলোকে অর্থনৈতিক ভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। ছোট্ট একটা কাজ করি ত তাকে নিয়ে এত চিল্লা ফাল্লা করি যে তার মনে হয় কি না কি কইরা ফালাইছি।
কথা গুলো এভাবে বলা ঠিক হল কি না জানি না। কিন্তু আমাদের দেশের একটা ছোট্ট জেলার থেকেও ছোট্ট শহর সিঙ্গাপুর যাদের কি না খাওয়ার পানিও মালয়শিয়ার কাছথেকে কিনে আনতে হয় তারা যদি বিশ্বে বড় বড় অর্থনৈতিক দেশ গুলোর কাতারে দাড়িয়ে থাকতে পারে তাহলে আমাদের সব কিছু থাকা সত্বেও কেন আমরা এ রকম থাকব? আমরা তাদের মত যান্ত্রিক জীবন চাই না কিন্তু আমরা কি সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন একটা দেশ হতে পারতাম না?
এসব নানা চিন্তা করতে করতে প্রায় ৩০ মিনিট পর আমার জাহাজ এর কাছে বোট চলে আসল। জাহাজ এর নাম MT. LENA. এটি সিঙ্গাপুর এর পতাকাবাহী একটি সমুদ্র গামী জাহাজ। লম্বায় ১০১ মিটার। এটি হেভি ফুয়েল ওয়েল পরিবহন করে।
ইঞ্জিন এর ক্ষমতা ৩০৩০ কিলোওয়াট।
স্যার কে আর আমাকে স্বাগত জানালেন ক্যাপ্টেন মুঞ্জুর উল ইসলাম। উনিও বাংলাদেশী। মেরিন একাডেমির। প্রথমেই আমাকে আমার জন্য নির্দিষ্ট কেবিন দেয়া হল।
ক্যাপ্টেন স্যার বললেন একটু রেস্ট কর 2nd অফিসার তোমাকে ডাকবে একটু পর। কেবিনটি বেশ সুন্দর। একটি চেয়ার একটি টেবিল সিঙ্গেল একটি খাট, লকার আর সামনের জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেই সাগর চোখের সামনে চলে আসে।
আমি বয়লার স্যুট পরে অপেক্ষা করছিলাম। মনের মাঝে দুরু দুরু করছে।
ক্যাপ্টেন আর আমিই বাঙ্গালী। আসার আগে নানা কথা শুনেছি। চীফ ইঞ্জিনিয়ার কেমন হবে কে জানে? আমি ইঞ্জিন ক্যাডেট। 2nd ইঞ্জিনিয়ার এর তত্ত্বাবধানে আমার থাকতে হবে। সে কেমন হবে, আর সবার সাথে কি করে কি করব, মেশিনারিজ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা আছে কিন্তু সবই যেন ভুলে যাচ্ছি।
তার উপর মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন স্যার না জানি কি বলে? কি জিজ্ঞাস করে? যদি না পারি তাহলে কি হবে? এসব নানা চিন্তায় এক রকম মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। তখনই দরজায় টোকা পরল। আমি চমকে উঠে দরজা খুললাম। দেখি একজন তরুন অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলল সে ইলহাম।
অতিরিক্ত 2nd অফিসার। সে ইন্দোনেশিয়ান। প্রথমেই বেশ ভালো লাগলো তার সাথে কথা বলে। সে আমাকে একটি হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলল এখন আমার জাহাজ ফ্যামিলিয়ারিজেশন হবে। তার সাথে জাহাজ এর ব্রিজ, ইমার্জেন্সী বহির্গমন পথ, রেস্কিউ বোট, লাইফ বোট সহ জাহাজ এর যাবতীয় গুরিত্বপূর্ন যায়গার সাথে পরিচিত হলাম।
নতুন কেউ জাহাজে যোগ দেয়ার ২৪ ঘন্টার মাঝে এ পরিচিতি পর্ব সারতে হয়। এটা শেষ হলে 2nd ইঞ্জিনিয়ার আমাকে নিয়ে ইঞ্জিন রুমে আসল। 2nd ইঞ্জিনিয়ার ও ইন্দোনেশিয়ান, নাম আব্দুল আশিস। উনিও আমাকে ইঞ্জিন রুম এর যাবতীয় সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সব কিছু একদিনে মাথার ভিতর খিচুড়ি হয়ে যাচ্ছিল, তারপরও নোটবুকে টুকে রেখে মনে রাখার চেষ্টা করছিলাম।
প্রথমে ইঞ্জিন রুম এ এসে ঢোক গিললাম। অসঙ্খ্য মেশিনারিজ এ সব কিছু আমাকে বুঝতে হবে ভাবতেই মনে হল জ্বর আসতেছে। একে একে পরিচিত হলাম 3rd ইঞ্জিনিয়ার রিয়ান্ত, 4th ইঞ্জিনিয়ার মুলিয়ান্ত নুরা, চিফ ইঞ্জিনিয়ার জেমস মক্সয়ান্দিব, অয়লার ডেডেন, সোয়ার্ডিন এরা সবাই ইন্দোনেশিয়ান। আরো পরিচিত হলাম জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার যাং ও চাইনিজ আর ইলেক্ট্রিশিয়ান কঅও স মিন ও বার্মিজ।
আমি যখন যোগ দেই তখন জাহাজ এর তিনটি জেনারেটর এর দুটি ওভারহল হচ্ছে।
কাজ করছে চাইনিজ কিছু টেকনিশিয়ান। আর ডিউটি অয়লার 3rd ইঞ্জিনিয়ার সবাই তাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করছে। প্রথমে এসেই এরকম একটি বড় কাজ দেখতে পাওয়া শেখার ক্ষেত্রে বেশ ভালো। চিফ ইঞ্জিনিয়ার তাই বলছিলেন। শুরু হল আমার কাজ।
তাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করি। নোট করি। সময় মত ইঞ্জিনিয়ার দের জিজ্ঞেস করে জেনে নেই যেটা বুঝছিনা সেটা।
প্রথম কাজ শুরু করতেই একটু খারাপ লাগা কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল ধুর, কই আসলাম রে ভাই।
এত কাজ ক্যান? কাউরে কিছু বলাও যায় না। কখন কাজ শেষ হবে কিছুই বুঝি না। সব সময় আতঙ্কে থাকি। ওরা যে উচ্চারনে বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট এর নাম বলে সেটা বুঝতেই আমার দু মাস লেগেছে। যেমন প্ল্যায়ার্স কে ওরা উচ্চারন করে প্লাইয়ার্স।
তাও এমন ভাবে সেটা শুনে আমি প্রথমে ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়ে থাকি। স্যরি বলে বলি, স্যার বুঝি নাই আর এক বার প্লিজ। সে আমাকে ঝারি মেরে বলে প্লাইয়ার্স চিননা কেমন ক্যাডেট? লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। যখন দেখি সেই প্লাইয়ার্স নিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে, তখন মনে মনে বলি চান্দু আমারে প্লাইয়ার্স চিনাও? ওইটা চিনতে আবার ক্যাডেট হইতে হয় না কি?
প্রথম দিন এর কাজ দেখে মনে হল পারব সমস্যা নাই। ৫ টার সময়ই ছেড়ে দিল।
কেবিনে এসে কাপড় ছেড়ে গোসল করে খেতে গেলাম মেস রুমে। সেখানে আবার ইউনিফর্ম পরে যেতে হয়। মেস রুমে সবাই খাওয়াদাওয়া করছে আড্ডা দিচ্ছে, গান শুনছে। ইন্দোনেশিয়ান মনাটা নামে এক ব্যান্ড এর মিউজিক ভিডিও চলছিল। এক একটা গান যেন ম্যারাথন গান।
আর শিল্পী গুলো গানের থেকে কোমর দুলায় বেশি। সে দুলুনির কাছে শাকিরা নিতান্তই শিশু। প্লেট নিয়ে খাবার নিজে নিজে নিয়ে বসলাম। খাবার মেনু ভালোই। ভাত আছে সাথে সবজি, মুরগি যদিও রান্নার ধরন আলাদা তার পরও খারাপ লাগছিল না।
আর আমার খাবার নিয়ে এত ঝামেলা করার অভ্যাস নাই। যা আসে সামনে হালাল হলেই হল। খাবার খেয়ে বসে ছিলাম মেস রুমে। ক্যাপ্টেন স্যার এসে বললেন কি খাওয়া যাচ্ছে। বললাম যাচ্ছে স্যার।
অন্য ক্রু রাও নিজের থেকেই এসে পরিচয় হচ্ছিল। বোসন বেশ মজার মানুষ। ইন্দোনেশিয়ান, মাঝে মাঝে তার ইয়ার্কি একটু বেশি বেশি মনে হলেও ঐ রকম আচরন এর কারনেই সবার সাথে খুব তারাতারি একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
চিফ ইঞ্জিনিয়ার বুড়ো টাইপ। বয়স পঞ্চাশ এর উপরে।
উনি মেস রুমে এসেই আমাকে দেখে বললেন তুমি মেস রুমে বশিক্ষন থাকবে না। খাওয়া শেষে উঠে যাবে। কেবিনে পড়াশুনা করবে রেস্ট নিবে। তার এমন কথা শুনে খারাপ লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম জালাবে বহুত।
মেজাজ টা খারাপ করে কেবিনে আসলাম। আমি ল্যাপটপ আনিনি সময় কাটানোর উপায় বলতে কিছু বই এনেছি। তারই একটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। কিছুক্ষন পরই বুঝতে পারলাম খারাপ লাগা কাকে বলে? আগে আড্ডা বাজ ছিলাম খুব, আর এখন এ কেবিনে একা একা সময় কাটাতে হবে। বন্ধুরা এই সময় কে কি করছে সে সব ভাবতেই চোখে পানি এসে গেল।
বাসায় ফোন করলাম। মা র সাথে কথাও বলতে পারলাম না ঠিক মত। বন্ধুদের দু এক জনকে ফোন দিলাম। খারাপ লাগাটা যেন আরো বারছিল। ফোন রেখে ডাইরি নিয়ে বসলাম।
যা লিখছি তা এখন দেখলে হাসি পায়। রাত ৮ টার দিকে আমার কেবিনের ফোন বেজে উঠল। ফোনের রিং এর শব্দে বুকে কাপন ধরে যায়। তাড়াতাড়ি ফোন টি ধরলাম। চিফ ইঞ্জিনিয়ার ফোন করেছে।
বলল এক্ষুনি ইঞ্জিন রুমে আস। আমি ওকে বলে ফোন রেখে বয়লার স্যুট পরে তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। নামার সময়ই মনে হল আমি ভুলে গেছি কোন দিক দিয়ে ইঞ্জিন রুম এ যায়। একটার পর একটা ফ্লোর পার হয়ে না না দরজা খুলে ইঞ্জিন রুম এর যাওয়ার রাস্তা খুজে পেলাম। এসে দেখি একটা লুব ওয়েল পাইপ লাইনে র ফ্লাংজ লিক করে লুব ওয়েল চার দিকে ছড়িয়ে গেছে।
সবাই মিলে সেগুলো পরিষ্কার করে ঘন্টা খানেক পর কেবিনে আসলাম।
কেবিনের দরজা লাগানোর পর নতুন এক ভয় ঢুকল। শুধু মনে হয় এই বুঝি কেউ দরজায় টোকা দিল। এই বুঝি কেউ ডাকল। এই বুঝি ফোন টা বেজে উঠল।
সে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। ৯টার দিকে আবার কেবিনের দরজায় টোকা। এবার খুলে দেখি কদরুল স্যার। উনি চলে যাচ্ছেন। বললেন ভালো থেকো।
কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে ক্যাপ্টেন কে জানিও আর সব সময় মনে রাখবে বাংলাদেশী মেরিনারদের একটা সুনাম আছে, সেটা র কিছুটা এখন তোমার উপরও চলে আসল সেটা ঠিক রাখতে চেষ্টা করবে। আমি মাথা নাড়লাম। এই অজানা যায়গায় আপজন বলতে উনিই। উনিও চলে গেলেন। কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে আমি বুঝতে পারলাম এত দিন যে জীবনে ছিলাম সেখান থেকে আলাদা জীবনে প্রবেশ করলাম।
যেখানে দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে, যেখানে কেউ বলবে না, ঠিক আছে তোমার আজ কিছু করতে হবে না ঘুমাও। আমি না খেলে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। নিজেকে প্রশ্ন করলাম “ এটাকেই কি বাস্তব জীবন বলে?”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।