আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা: চিন্তার জগতে ঔপনিবেশিক মানসকাঠামো

"জীবনবোধ মানুষকে তার রূপ-রস-রঙে ভরে তোলে কানায় কানায়, জীবনকে দেখবার প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৃথিবীটাকে মোচড় দিয়ে বদলে দিতে চায়" বদরুদ্দীন উমরের "পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি" বইখানি পড়তে গিয়ে একটা তথ্য নতুনভাবে জানতে পারলাম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাব-কেন্দ্রিক উচ্চবর্গের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্তমূলক প্রচেষ্টা করেছিল। ভাষা আন্দোলন সহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কারণে সেটা সম্ভব হয় নি এবং ভাষাপ্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের মনোবৃত্তি পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে চিন্তার যে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল তার প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। এখানে জনগণের মধ্যে মুসলিম লীগের যে একটা ভিত্তি ছিল সেটা সেই নির্বাচনের মাধ্যমে অনেকাংশে খর্ব হয়েছিল। কিন্তু কথা সেটা নয়।

ভাষা আন্দোলনের সফলতার ফলে পাকিস্তানি শাসকগণ বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বিভিন্নভাবে ভাষা-বিষয়ক ষড়যন্ত্র তারা বহাল রেখেছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভাষার মুসলমানিকরণ তথা ইসলামিকরণের নামে সেখানে অপ্রচলিত আরবি-উর্দু-ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানো, রবীন্দ্রনাথ সহ পশ্চিমবঙ্গের 'হিন্দু' সাহিত্যিকদের রচনাসমূহ এদেশে নিষিদ্ধ করা, বর্ণ সংস্কারের নামে কিছু অক্ষর, কার, ফলা ইত্যাদি বর্ণমালা হতে বিদায় দেয়া, আরবি অথবা রোমান অক্ষরে বাংলা প্রচলনের প্রচেষ্টা ইত্যাদি। এসব কিছুই জানতাম। আমার কাছে নতুন মনে হয়েছে যে তথ্যটি তাহলো, আরবি/রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার পেছনে যে যুক্তিগুলো দেয়া হয়েছিল তার পরিচয়। বলা হয়েছিল বাংলা বর্ণমালা অবৈজ্ঞানিক এবং টাইপ রাইটারে এর অক্ষরসমূহের যথার্থ সংস্থান করা সম্ভব নয়।

আদপেই অসাধারণ যুক্তি বটে! তাদের কথা অনুযায়ী টাইপ রাইটার হলো এমন এক অপরিবর্তনীয় বস্তু যাকে নির্দিষ্ট বর্ণমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নির্মাণ করা যায় না! সুতরাং বর্ণমালার ব্যবহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে টাইপ রাইটার প্রস্তুত নয়, বরং টাইপ রাইটারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বর্ণমালাকে সংস্কার করতে হবে! কথায় বলে দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। কিন্তু সেই ছলনাও যে কতো করুণভাবে দুর্বল এবং হাস্যকর হতে পারে সেটা পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের পদলেহী তৎকালীন স্থূলবুদ্ধি আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের এই ধরনের যুক্তির অবতারণা থেকে অনুমান করা যায়। এই ধরনের উদ্ভট তত্ত্ব সে সময়েই অসার বলে প্রতিভাত হয়েছিল। বর্তমান সময়ের দিকে তাকালে এই বাস্তবতা আরো অধিক স্বচ্ছতার সাথে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। টাইপ রাইটারের যুগ চলে গিয়েছে বহু আগে।

এখন কম্পিউটারেই সকলে টাইপ করে থাকে। বাংলায় মুদ্রিত হয়ে প্রতিদিন অসংখ্য বইপত্র আমাদের দেশে বেরোচ্ছে। বহু অফিস-আদালতে অধিকাংশ কাজকর্ম বাংলায় হয়ে থাকে। যদিও ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনা অনুযায়ী বাংলাকে সর্বস্তরে প্রচলন করা এখনো সম্ভব নি বিভিন্ন কারণে তারপরেও যেটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি তাতে বিদেশিদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত কিবোর্ড বাংলায় টাইপের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি যে করছে না সেটা অত্যন্ত স্পষ্ট। বাংলা অক্ষর, কার, ফলা, যুক্তাক্ষর, রেফ, হসন্ত সব কিছুই এই কিবোর্ডের মধ্যে সংস্থান হচ্ছে।

বর্তমানে বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী এবং অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে, ব্লগে বাংলা ভাষার মাধ্যমে তাদের বক্তব্যের চর্চা করছেন, লেখালিখি করছেন তুমুলভাবে। এই প্রবাহের পরিমাণগত দিক সত্যিই বিস্ময়কর। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশে দৈনন্দিন এই ভাষাচর্চার ব্যাপ্তিও অধিক। কিন্তু পাকিস্তান আমলে ভাষার যে সঙ্কটকে মোকাবেলা করা হয়েছিল- এখন অন্যভাবে, অন্য চেহারায় তার উপস্থিতি ঘটেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। পাকিস্তান রাষ্ট্র আর সশরীরে তার আধিপত্য নিয়ে আমাদের দিনানুদৈনিক বাস্তবতায় উপস্থিত নেই কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্যবাদকে মোকাবেলা করা তার চাইতে অনেক বেশি জটিল, দুঃসাধ্য।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভাষা হিসেবে বাংলা অবহেলিত। উচ্চ আদালতের ক্ষেত্রেও তাই। যা কিছু 'উচ্চ' শব্দের সাথে সম্পর্কিত তার সাথে বাংলার সংযোগ ছিন্ন। পরাধীন যুগে যেমন উচ্চ শ্রেণীর সাথে বাংলার একটা দূরত্ব ছিল সামন্তবাদী চিন্তাকাঠামোয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পরিশীলিত রূপ আমাদের সম্মুখে হাজির হয়েছে তুলনায় ভিন্ন স্তরের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। পাকিস্তানবাদী স্থূল এবং হাস্যকর যুক্তির বদলে অনেকটা যৌক্তিক উপরি-কাঠামোয় বক্তব্যগুলো পরিবেশিত হচ্ছে।

এক ধরনের কোট-টাই, চশমা-পরিহিত শিক্ষিত ভদ্রলোক অনলাইনে, ব্লগে, পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে যুক্তি দিচ্ছেন যে আধুনিক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান বাংলা ভাষায় শিক্ষা করা সম্ভব নয়। যেহেতু চিকিৎসা, প্রকৌশল, স্থাপত্য, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র এগুলো বিজ্ঞান শিক্ষার 'আধুনিক' ও 'অগ্রসর' শাখা-প্রশাখা, এবং বাংলা তুলনামূলক 'অনাধুনিক' ও 'পিছিয়ে পড়া' ভাষা, তাই নিম্নস্তরে বাংলার মাধ্যমে এসব শিক্ষা দেয়া চললেও উচ্চস্তরে উত্তরণের সাথে সাথে বাংলাকে ক্রমান্বয়ে পরিত্যাগ করে ইংরেজির আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত। কেননা বাংলা এতোটাই পিছিয়ে পড়েছে যে পাল্লা দিয়েও নাকি তা ইংরেজির সমকক্ষতা অর্জন করতে পারবে না কখনো। আমরা ব্রাহ্মণ্যবাদী ধ্যান-ধারণার যে চর্চা অতীতে দেখেছি সেখানেও মানুষের উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করত তার জন্মপরিচয়ের ওপর। একজন নমঃশূদ্র জ্ঞান, শিক্ষা, দক্ষতা অর্জন করে যতোই গরিমা লাভ করুক না কেন, তার স্থান সব সময়ই একজন অশিক্ষিত ব্রাহ্মণের পায়ের তলায়।

বর্তমানে ভদ্রলোকদের যুক্তির ধরন দেখলে কেন জানি সেইসব অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। এই ভদ্রলোকেরা ধরেই নিয়েছেন যে বাংলার মাধ্যমে বিজ্ঞানের কোনো শাখায় প্রকৃত শিক্ষার্জন সম্ভব নয়। অর্থাৎ বাংলার শব্দসম্ভার, ব্যাকরণ, পারিভাষিক ভাণ্ডার, তার বাক্যের গঠন ও কাঠামো এমনই যে তার দ্বারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সম্ভব নয়। পাকিস্তানি আমলে টাইপ রাইটারের গঠনকে অপরিবর্তনীয় হিসেবে ধরে নিয়ে বাংলা ভাষাকে তার উপযোগী করে গড়ে তুলবার যে প্রয়াস ছিল, তার মধ্যে ভাষার উৎকর্ষের চেয়ে তার সর্বনাশ সাধন করে তাকে অন্য ভাষার অধীন ও নির্ভরশীল রাখার উদ্দেশ্যই ছিল প্রধান। বর্তমান সময়ে এই কোট-টাই পরিহিত ভদ্রলোকগণ বাংলা ভাষাকে অপরিবর্তনীয় এবং উৎকর্ষ অর্জনের অনুপযোগী বিবেচনায় তাকে বিশেষভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিত্যাজ্যরূপে ঘোষণা করছেন! সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হলেও এই দুই শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের উভয়ের মস্তিষ্ক ও মননের মধ্যেই বাংলা ভাষার উন্নতি এবং তাকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যম হিসেবে উপযোগী করে গড়ে তোলার বিষয়ে সক্রিয় চিন্তার অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।

এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতার দ্বারা আবদ্ধ হয়েই এই ধরনের যুক্তির উদ্ভব ও বিস্তার সম্ভব। কিন্তু পাকিস্তান আমলে দৃশ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা যতোটা সহজসাধ্য ছিল এখন মননে ও মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য শত্রুর উপস্থিতি চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা আসলেই তার চাইতে অনেক বেশি জটিল। আমাদের দেশে প্রগতিশীল রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীগণ অহরহ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন হতে সাধারণ জনগণের মুক্তির বাণী উচ্চারণ করে থাকেন। কিন্তু আধুনিক বাস্তবতায় সাম্রাজ্যবাদ কোনো একরৈখিক বিষয় নয়, বরং তা কাজ করে যায় বিভিন্ন স্তরে- যার মধ্যে মস্তিষ্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই জায়গায় গেড়ে বসে থাকা আধিপত্যবাদী মানসকাঠামোকে ধ্বংস করতে না পারলে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রকৃত জয়ী হওয়ার চিন্তা ভ্রান্তবিলাসী কল্পনা ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.