বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, বিহার, বসতবাড়ি, দোকানপাট ও অন্যান্য স্থাপনার ওপর নজিরবিহীন হামলা, হত্যা-নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনায় সমগ্র জাতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। জনৈক উত্তম বড়ুয়ার ইন্টারনেটের ফেসবুকে কোরআন অবমাননার একটি চিত্র পাওয়া গেছে এটাকে পুঁজি করে ওই এলাকায় বৌদ্ধদের ওপর এই নৃশংস হামলা সকল জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন, বেতার এবং মানবাধিকার সংগঠনসমূহের তদন্ত/ভাষ্য অনুযায়ী সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। এই হামলায় ২২টি বৌদ্ধবিহার ও মন্দির লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে, অর্ধশতাধিক বাড়ি ও দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এবং আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার সংবাদ জানার সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া হেলিকপ্টারে উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্থানীয় পুলিশ ও দমকল বিভাগের প্রাথমিক নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
বিএনপির স্থানীয় এমপি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন এমন ইঙ্গিতও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছেন। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও জামায়াতে ইসলামীর শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের সম্পৃক্তি সম্পর্কে বলেছেন, দুষ্কৃতকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। রামুর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় সেই সময় নিউইয়র্কে অবস্থানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অপরদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যথারীতি রামুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সব অপতৎপরতায় সরকারি দলে স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। ’ জামায়াতের প্রতিক্রিয়াও বিএনপির অনুরূপ।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও ভাষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার ঘটনা সুপরিকল্পিত। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কোটি কোটি ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ও বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে বিভিন্ন ধর্মের মহিমা কীর্তন করে যেমন কোটি কোটি এন্ট্রি থাকে, তেমনি ধর্মের সমালোচনা ও ব্যঙ্গ করেও বহু লেখা/ছবি/কার্টুন থাকে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রামুতে একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যুবকের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে কোরআন অবমাননার চিত্র পাওয়া গেছে এটাকে জনসভা আয়োজন করে প্রচার করে, ট্রাকে, ট্রলারে ও মোটর সাইকেলে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার লোক এনে একত্রিত করে রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর এই বর্বরোচিত হামলা কারা করতে পারে এ নিয়ে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। গত দেড় দশক ধরে আমরা বলছি কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলকে কেন্দ্র করে কীভাবে জামায়াত ও জঙ্গী মৌলবাদীদের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করছে, কীভাবে দুর্গম পাহাড় ও অরণ্যে ইসলামিক কমপ্লেক্স ও মাদ্রাসার নামে বিশাল ও দুর্ভেদ্য সব স্থাপনা গড়ে উঠেছে; কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে কর্ণপাত করেনি।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ক্ষমতায় ছিল তখন সরকারের সহযোগিতায়, প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ মদদে সারাদেশে শতাধিক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন এবং পাঁচ শতাধিক ইসলামী এনজিওর অভ্যুদয় ঘটেছে, যাদের অধিকাংশের তৎপরতা হচ্ছে কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে।
বিভিন্ন সময়ে এসব এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা কবুল করেছে বার্মার আরাকানের সঙ্গে কক্সবাজারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অংশকে যুক্ত করে তারা একটি স্বাধীন ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেই সময় আমরা অনুসন্ধান করে জেনেছি বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে ‘আরএসও’সহ রোহিঙ্গাদের ১৭টি জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী তৎপরতায় নিয়োজিত, যাদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত।
২০১০ সালে আমি ‘জিহাদের প্রতিকৃতি’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিভিন্ন জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের সম্পৃক্তির তথ্যপ্রমাণ এ ছবিতে আমি প্রদান করেছি। এতে জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন ‘আরএসও’ (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন)-এর একজন কর্মীর সাক্ষাতকার রয়েছে, যার নাম শাকিল জিহাদী।
এই সাক্ষাতকারে শাকিল বলেছে কখন, কীভাবে তারা আরাকান থেকে বাংলাদেশে এসেছে এবং কীভাবে চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসায় পড়ার সময় জামায়াত-শিবিরের মাধ্যমে ‘আরএসও’-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রশিক্ষণের পর শাকিলকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ২০০৩ সালে লিবিয়া পাঠানো হয়েছিল, যেখানে থাকার সময় সে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের জঙ্গীদের সংস্পর্শে এসেছিল। এর আগে ২০০৭ সালে আমি ‘আরএসও’র সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্তির একটি তথ্য প্রমাণভিত্তিক নিবন্ধ লিখেছিলাম ‘জামায়াতের জঙ্গী সম্পৃক্তি ও দুর্নীতির আর কত প্রমাণ চাই’ শিরোনামে। এতে বলেছিলাম
বাংলাদেশ ও বর্মায় ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি-অর্গানাইজেশন’ (জঝঙ) নামে একটি জঙ্গী জেহাদী সংগঠন রয়েছে যারা বাংলাদেশের মাদ্রাসা থেকে বহু তরুণকে রিক্রুট করে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও লিবিয়ায় পাঠিয়েছে জেহাদী প্রশিক্ষণের জন্য। আরবী ভাষায় প্রকাশিত এই সংগঠনের আন্তর্জাতিক মুখপত্রের নাম ‘আল-তাদামুন।
’ এই পত্রিকার আগস্ট ১৯৯১ সংখ্যার শেষ প্রচ্ছদে ‘ওয়ার্ল্ড এ্যাসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথ’ (ডঅগণ)-এর একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে—‘আরাকানের মুজাহিদদের আহ্বান’ শিরোনামে। এতে ইসলামের দোহাই দিয়ে আরাকানে জেহাদের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে মুসলিম উম্মাহর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তির শেষে জঝঙ প্রধানের নাম ও ব্যাংক হিসেবের বিবরণ দেয়া হয়েছে—
ডা. মোহাম্মদ ইউনুস
এ্যাকাউন্ট নং- ৪২৯৭
ইসলামী ব্যাংক (বাংলাদেশ) লিঃ
আগ্রাবাদ শাখা, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
জঝঙ-র আন্তর্জাতিক মুখপত্র ‘আল-তাদামুন’-এর উপদেষ্টা সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস। পত্রিকার প্রচ্ছদে অন্যান্য জেহাদীদের সঙ্গে সশস্ত্র জঝঙ প্রধানের ছবিও আছে।
‘আল তাদামুন’-এর এই সংখ্যায় কক্সবাজারের গহীন অরণ্যে জঝঙ-র ছাত্র সংগঠন ‘ইত্তেহাদুল তুলাবুল মুসলেমিন’-এর সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের কয়েকটি রঙিন ছবি আছে। এসব ছবিতে বর্তমান জামায়াত নেতা, তৎকালীন ছাত্র শিবিরের সভাপতি সৈয়দ আবদুল্লা মো. তাহের ও শিবিরের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মুকুলকে দেখা যাচ্ছে জঝঙ-র জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। জামায়াত কি বলবে জঝঙ জঙ্গী সংগঠন নয়, কিংবা তাদের দলের সাবেক এমপি তাহের জামায়াতের কেউ নন?
রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (জঝঙ)-র উর্দু মুখপত্রের নাম ‘ইনসাফ’। এই পত্রিকার জানুয়ারি ১৯৯১ সংখ্যায় ঢাকার ইসলামী ব্যাংকে তাদের একটি হিসাবের পাশাপাশি দুবাই-এর ইসলামী ব্যাংকে হিসাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দুবাইর হিসাবটি জঝঙ-র সম্পাদক মোহম্মদ আলীর নামে।
ঢাকার হিসাব নং-চখঝ-উঅ ১২৬৫৫, লোকাল ব্রাঞ্চ ঢাকা। দুবাই-এর হিসাব নং-৫০৪০৯০৬, উঁনধর ওংষধসরপ ইধহশ.
ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি বলবেন জঝঙ নামে কোন জঙ্গী সংগঠনের কথা তারা জানেন না বা তাদের কোন এ্যাকাউন্ট কখনও তাদের ব্যাংকে ছিল না?
ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত ১১ মে’র প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করেছে, ‘এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই। তাই কোন দলীয় ব্যাংক বলে মন্তব্য করা অবাস্তর। ’
ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকদের সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্তির বহু প্রতিবেদন বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উদ্ধৃত করতে চাই।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা বাংলাদেশ সফরে আসেন। তারা ইসলামী ছাত্র শিবিরের বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও গোলাম আযম ও নিজামীসহ শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং জামায়াতের কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। দেশে ফিরে প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মুনিম জাফর খান এই সফর সম্পর্কে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। “কেন্দ্রীয় শূরার প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর : প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ” শিরোনামে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে পাকিস্তানি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ‘জমিয়তে তুলাবা ইসলামীয়া’র মুখপত্র ‘হামকাদাম’-এ। অক্টোবর ২০০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে—
‘... দোয়া এবং আপ্যায়নের পর মেজবান আমাদের শাহ্ আব্দুল হান্নান সাহেবের বাসায় নিয়ে যান।
হান্নান সাহেব ‘ইসলামিক ব্যাংক অব বাংলাদেশ’-এর দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের একজন বলে গণ্য করা হয়। তিনি বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে একথাও উল্লেখ করতে চাই ওংষধসরপ ইধহশ ড়ভ ইধহমষধফবংয-কে বাংলাদেশের বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলোর একটি হিসাবে গণ্য করা হয়। এই ব্যাংক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অধীনে পরিচালিত। এবং সমগ্র বাংলাদেশে-এর ১৪১টি শাখা বিদ্যমান।
এই ব্যাংকের ইড়ধৎফ ড়ভ উরৎবপঃড়ৎং-এর ভেতর ঢাকা শহরের ধনাঢ্য এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে ওংষধসরপ ইধহশরহম-এর এত সফল পরিচালনা আর এর প্রতি জনগণের আস্থা নিঃসন্দেহে অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটি অনুকরণীয় বিষয়। শাহ্ আব্দুল হান্নান সাহেব আমাদের কাছে খুরশীদ সাহেব এবং মোহ্তরম কাজী সাহেবের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন এবং কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন করেন। এরপর তিনি ব্যাংক প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিষয়াদি জানান। ... এক ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাতের পর আমরা হোটেলে ফেরত আসি।
ফিরতি পথে আমাদের মেজবান সাথীরা ওইইখ-এর কেন্দ্রীয় দফতরও দেখান। এটি পনের তলা একটি বৃহৎ ভবন এবং শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ’
ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি বলবেন তাদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শাহ আবদুল হান্নান এবং বর্তমান চেয়ারম্যান মীর কাশিম আলী বা পরিচালনা পর্ষদের কেউ জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত নন, পাকিস্তানের জামায়াত নেতারা তাদের কাগজে মিথ্যা লিখেছেন? বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক হতে পারেন। শাহ আবদুল হান্নান ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে জামায়াতে ইসলামীর উপদেষ্টা হতেই পারেন, এতে আপত্তির কোন কারণ থাকতে পারে না। আমাদের আপত্তি হচ্ছে জঙ্গীদের আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে এই ব্যাংকটির সম্পৃক্তি।
(‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতের অপরাজনীতি’, প্রকাশক : অনন্যা, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
আমার উপরোক্ত গ্রন্থে আরাকানে হরকাতুল জিহাদ (হুজি)-র কার্যকলাপ সম্পর্কেও একটি লেখা আছে। তখন হুজির অর্থের লেনদেন হতো জামায়াতের ইসলামী ব্যাংক-এর মাধ্যমে। ‘জামায়াতের সরলতা ও মিথ্যাচার’ শীর্ষক নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম
‘বাংলাদেশে হরকাতুল জেহাদ একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন, যার নেটওয়ার্ক বর্মা, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়াসহ বহু দেশে বিস্তৃত। বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদের আগমন ঘটেছে হরকত-উল জেহাদের মাধ্যমে।
হরকত-উল জেহাদের আরাকান শাখার একটি প্রকাশনা আমার সংগ্রহে আছে।
উর্দু ভাষায় লিখিত গ্রন্থটির নাম ‘তাযকারায়ে আরাকান’, লেখক হরকত-উল জেহাদ আল ইসলামীর আরাকানের আন্তর্জাতিক প্রচার সম্পাদক হযরত মওলানা হাফেজ মোহাম্মদ সিদ্দিক আরাকানী বিন মওলানা হাসান আলী। করাচীর জামিয়া দারুল উলুম কৌরাঙ্গী থেকে দাওরা হাদিস সনদপ্রাপ্ত এই মওলানা আলোচ্য গ্রন্থে আরাকানে জেহাদী কার্যক্রম এবং বাংলাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। গ্রন্থটির প্রকাশক হরকতুল জেহাদ আল ইসলামী বার্মা। প্রকাশকাল জুলাই ১৯৯৭।
‘তাযকারায়ে আরাকান’-এর শেষে হরকত-উল জেহাদের একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে।
এতে জেহাদের জন্য আল্লাহ, কোরান ও হাদিসের দোহাই দিয়ে অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে। শুধু ব্যক্তি বা সংগঠন নয়, সংগঠনের মুখপত্র মাসিক ‘আল রাবাত’-এর জন্যও অনুদান চাওয়া হয়েছে। এই বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে উর্দু ও ইংরেজীতে একটি নাম ও ব্যাংক হিসেবে-এর নম্বর ও ঠিকানা দেয়া হয়েছে যেখানে জেহাদের জন্য অর্থ পাঠাতে হবে। হিসাবটি হচ্ছে হরকত-উল জেহাদ আল ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমির আফগানফেরত জেহাদী আবদুল কুদ্দুস মুজাহিদের নামে। এ্যাকাউন্ট নম্বর ও ঠিকানা হচ্ছে— অ/ঈ ঘড়. ২৮৫৩৫, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ, ৭৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০।
নিচে ডাক যোগাযোগের ঠিকানাও রয়েছে। বাংলাদেশের ঠিকানা : পোস্ট বক্স-২১, কক্সবাজার এবং পাকিস্তানের ঠিকানা : ইসলাম মেডিকেল সেন্টার, ৩৬ ঝিলান্ডি, করাচী-৩০।
হরকত-উল জেহাদের যে মুখপত্রের জন্য অনুদান চাওয়া হয়েছে তার কয়েকটি পুরনো কপি আমার সংগ্রহে রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকওয়ালারা কি এরপর বলবেন তাঁরা হরকত-উল জেহাদ বা আবদুল কুদ্দুসের নাম শোনেননি কিংবা উক্ত নম্বর ও ঠিকানায় তাদের কোন হিসাব নেই! বলতেই পারেন, যেভাবে জামায়াতের নেতারা বলেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিলেন না, কিংবা রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী তারা গঠন করেননি কিংবা ’৭১-এ বিজয়ের প্রাক্কালে বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের তারা নয় আওয়ামী লীগ হত্যা করেছিল!
যে কথা আগেও বলেছি, আবারও বলছি, বর্তমান সরকার যদি জঙ্গী দমন কার্যক্রমে সাফল্য অর্জন করতে চায় তাহলে যারা জঙ্গীদের আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে এবং যারা তাদের হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের আদর্শিক প্রণোদনা সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ’ (‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতের অপরাজনীতি’, প্রকাশক : অনন্যা, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৮)
কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল এবং বর্মার রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র মুুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে, যাদের প্রধান মদদদাতা পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।
বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তারা গ্রামের গরিব ছেলেদের জিহাদে প্রলুব্ধ করে বটে, তবে এই জিহাদের তথাকথিত শহীদদের পরিবারবর্গ প্রতিশ্রুত অর্থের কিছুই যে পায় না তার প্রমাণও রয়েছে আমার ‘জিহাদের প্রতিকৃতি’ প্রামাণ্যচিত্রে।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি অধ্যুষিত চার দলীয় জোট সরকারের জমানায় জঙ্গী মৌলবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছিল বাংলাদেশে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে জঙ্গী দমনে যথেষ্ট সফল হলেও জঙ্গীদের গডফাদার জামায়াতে ইসলামী এবং জঙ্গীদের অর্থ যোগানদাতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করছে। জামায়াতকে বহাল তবিয়তে রেখে জঙ্গী নির্মূল অভিযান সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘বন্ধাগমনের মতো নিষ্ফল’ হতে বাধ্য।
একইভাবে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার যদি কয়েকজন ব্যক্তির ভেতর সীমাবদ্ধ রেখে জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস-এর বিচার না করা হয় এ বিচারও প্রহসন হতে বাধ্য। ’৭১-এ গো. আযম গংরা যে অপরাধ করেছিলেন তা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় ছিল না। এই গণহত্যা ছিল এক ভয়াবহ এথনিক ক্লেনজিং, যা সংঘটিত হয়েছে সম্প্রদায়, জাতি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দল বিশেষের জিহাদী রাজনীতির এজেন্ডা অনুযায়ী। ইসলামের নামে মওদুদীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতে ইসলামী জঙ্গী মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে, জঙ্গীদের যাবতীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে ধর্মের নামে বৈধতা দিচ্ছে।
জামায়াত শুধু সামরিক/অসামরিক প্রশাসনের অভ্যন্তরে নয়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভেতরও শেকড় বিস্তার করছে।
রামুর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কতিপয় স্থানীয় নেতা-উপনেতার সম্পৃক্তির সংবাদ বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকেও জামায়াতের প্রভাবমুক্ত করবার উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে।
জামায়াতের বিচার হতে হবে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার জন্য। জামায়াতের বিচার হতে হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং জঙ্গী সম্পৃক্ততার জন্য। জামায়াত নিষিদ্ধ না হলে ’৭১-এর গণহত্যার পুনরাবৃত্তি, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন কিংবা জঙ্গী সন্ত্রাস কিছুই রোধ করা যাবে না।
সরকারের যে সব মন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমরা কোন সংগঠনের বিচার করব না তারা যদি আহাম্মকের স্বর্গের বাসিন্দা না হন তাদের মতলব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের যুক্তিসঙ্গত যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
১৫ অক্টোবর ২০১২
জামায়াতের জঙ্গী সম্পৃক্তি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
আসলেই তারা গণদুশমন...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।