শরৎকালের দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন গল্প প্রচলিত আছে হিউয়েন সাংকে নিয়ে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কোনো এক সময়ে শরৎকালে গঙ্গাপথে চলেছিলেন এই চীনা পর্যটক। পথে পড়লেন দস্যুর কবলে। দস্যুরা তাকে দেবী দুর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে চলল। বলির আয়োজন সারা।
এমন সময় খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনের আঙিনায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব আয়োজন। দস্যুরা মাথা বাঁচাতে যে যেদিকে পারল দিল ছুট। সেই সুযোগে নিজেকে মুক্ত করে পালালেন হিউয়েন সাং। বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা।
জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গন থেকেই দুর্গাপূজা হয়েছে বাঙালির জাতীয় উৎসব। দুর্গাপুজোর যে রূপ আমরা দেখি তার সময়কাল খুব বেশি হলে পাঁচশো বছরের কাছাকাছি। কিন্তু এই আরাধনার ব্যাপ্তি খুব দ্রুত হয়েছে বলে এখন এই পুজো মহোৎসবে পরিণত হয়েছে।
পূজা হিন্দুদের পালনীয় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। পূজানুষ্ঠানের মূল আচারটি হল দেবতা ও ব্যক্তির আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য তাঁদের উদ্দেশ্যে বিশেষ উপহার প্রদান।
পূজা সাধারণত গৃহে বা মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। অনেক হিন্দুগৃহেই নির্দিষ্ট ঠাকুরঘর বা উপাসনাস্থল রয়েছে। ঠাকুরঘরে দেবদেবীর ছবি বা মূর্তি রাখা থাকে। পূজায় দেবতার উদ্দেশ্যে ধূপ, দীপ, জল ও ফল উৎসর্গ করা হয়। পূজার পর ছোটো করে আরতিও করা হয়ে থাকে।
মূল রামায়ণে রামচন্দ্রের দুর্গোৎসবের কোনও বিবরণ না থাকলেও, কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর বাংলা রামায়ণ পদ্যানুবাদে কালিকা পুরাণের ঘটনা সাজিয়ে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার চিত্র এঁকেছেন। বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তাঁর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। প্রাচীন কাল থেকেই প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেঞ্জোদারোতে দেবীর পূজা হতো।
ষোড়শ শতকে রাজশাহী অঞ্চলের রাজা কংশনারায়ন দুর্গা পূজা করেন।
অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র দুর্গা পূজা করেন। তেত্রিশ কোটি দেব দেবী নিয়ে হিন্দুদের জীবন। হিন্দুদের জীবনের প্রতিটি পর্বে একজন করে নিয়ন্ত্রক (দেব দেবী) থাকেন, যিনি স্বর্গ থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন (হিন্দুদের বিশ্বাস)। বাঙালি সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লোকায়ত দেবদেবীর পূর্জা-অর্চনা করত । গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর "বাংলার লৌকিক দেবতা" বইটি থেকে আমরা প্রায় পঁয়ত্রিশটি লৌকিক দেব-দেবীর নাম জানতে পেরেছি।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন বা দশমী অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দশরথের পুত্র রাম রাবণকে বধ করার জন্য শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তখন থেকে শরৎকালের পূজাকে শারদীয় দুর্গোৎসব হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সনাতন ধর্মের প্রাচীন আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের প্রতীক হিসেবে দেবী দুর্গার প্রসন্নতা ও আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন।
মন্দিরেই দিনে একাধিকবার পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
এই পূজা সাধারণত পুরোহিত সম্পাদনা করে থাকেন। মন্দিরে সকালে দেবতাকে জাগরিত করা হয়, তাঁকে আবাহন করা হয় না। অঞ্চল ও সম্প্রদায় ভেদে মন্দিরের পূজায় নানান প্রথা লক্ষিত হয়। মন্দিরের পূজায় পুরোহিতই সকলের হয়ে পূজা নিবেদন করেন। পূজার কয়েকটি সাধারণ উপচার হল আবাহন, আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, স্নান বা অভিষেক, বস্ত্র, অনুলেপনা বা গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, চাঁদমালা, মালা, বিল্বপত্র, প্রণাম ও বিসর্জন।
ধর্মীয়শাসেত্র আমরা দুর্গার বিভিন্ন নাম পাই। দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শূলিণী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চন্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। দুর্গাপূজায় মায়ের আরাধনার মতো দেবীমূর্তির ইতিহাসও অনেক সুপ্রাচীন।
সরস্বতী পূজা হিন্দু বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠেয় একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু উৎসব। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও প্রচলিত।
পূজার দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়। পূজার পরের দিনটি শীতলষষ্ঠী নামে পরিচিত। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। দেবী সরস্বতীকে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে সকলেই সম্মান করে থাকে। কারন জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনটাই বড় কথা, এখানে ধর্ম বিবেচ্য নয়।
দেবীর বোধন বা অধিষ্ঠান হয় শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ তিথিতে। তার আগে অমাবস্যায় শুরু হয় মহালয়া। আজ মন্দিরে মন্দিরে চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহন ঘোষণা করা হবে। রামকৃষ্ণ মিশন, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের উপাসনালয়, বরদেশ্বরী কালীমন্দির, কে এম দাস লেনের ভোলানন্দগিরি আশ্রম, স্বামীবাগের লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম ও মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার ও লালবাগের বিভিন্ন মন্দির এবং মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে রয়েছে বিভিন্ন আয়োজন।
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিন্দু দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব।
বাংলায় শারদীয়া দুর্গাপূজা অধিক জনপ্রিয়। যদিও অনেক পরিবারে বাসন্তী দুর্গোৎসব পালনের প্রথাও বর্তমান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ও বিশেষ উৎসাহে এই উৎসব পালন করে থাকেন। সারা বিশ্বের কাছেই বর্তমানে বাংলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে দুর্গোৎসব। বর্তমানকালে দুর্গাপূজা দুইভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে – ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে পাড়া স্তরে।
পুরাণে দুর্গাপূজা প্রবর্তনের একটি ইতিহাস কথিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই ইতিহাস কোনও প্রামাণিক ইতিহাস নয়, বরং একটি পৌরাণিক সূচিমাত্র।
বর্তমানে আমাদের সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, বিরাজমান। চাঁদাবাজ, দুনীতি, ঘুষখোররা সমাজকে কলুষিত করছে। মা দুর্গাদেবীর আর্শিবাদে সকলের দেহ মন বিশুদ্ধ হোক এ কামনা করি।
ঈদ, পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন আমাদের সবার। সবাই আমরা সব উৎসবের ভাগীদার। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসে তেরো পূজা। শ্রীরামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণ রাজাকে পরাজিত করতে শক্তি সঞ্চারে মায়ের পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজাকে অকালবোধন আবার কেউ কেউ শারদীয়া পূজা নামেও উল্লেখ করে থাকেন।
দুর্গাপূজার ব্যাপ্তি অনেক। মহানগর পূজা কমিটির সূত্র থেকে জানা যায়, এ বছর রাজধানীর ৪১ থানার মধ্যে ৩১ থানায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মণ্ডপের সংখ্যা ১৯৬। এর মধ্যে পুরান ঢাকায় ৮০টি পূজার আয়োজন করা হয়েছে। এবার নতুন ১০টি পূজামণ্ডপ বাড়লেও পুরনো সাতটি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে না।
আইল শান্ত সন্ধ্যা, গেল অস্তাচলে শ্রান্ত তপন। ।
নমো স্নেহময়ী মাতা, নমো সুপ্তিদাতা,
নমো অতন্দ্র জাগ্রত মহাশান্তি। । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।