১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ দেশমাতৃকাকে শৃঙ্খলমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে। শুধু রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি সহযোগীর নিজের দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার সৈন্যদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে। এছাড়া তারা সরাসরি বাঙালী নিধনে মেতে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস তারা হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন ইত্যাকার অপকর্মে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু বাঙালীর অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযুদ্ধ যখন বিজয়ের দ্বার প্রান্তে, তখন আলবদরদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা ও তার নিষ্ঠুরতম বাস্তবায়ন মুক্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়। বিজয়কে যখন আর কোনভাবেই ঠেকানো গেল না, রোধ করা গেল না নতুন রাষ্ট্রের নতুন স্বাধীনতার অভ্যুদয়কে, সেই প্রত্যাশাদীপ্ত শুভক্ষণে আলবদরের ঘাতকরা দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সেরা সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা হাতে নেয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর এই ৬ দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রখ্যাত চিকিৎসক, লেখক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাংবাদিক প্রমুখকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। আর বৃদ্ধিজীবী হত্যার এই কর্মকা-ের পুরোভাগে ছিল আলবদর আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন। জাতিকে মেধাশূন্য করে নতুন স্বাধীন দেশের উন্নতি-অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে আলবদরেরা একে একে হত্যা করে প্রফেসর গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. ফয়জুল মহি, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ডা. মোহাম্মদ মর্তুজা, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি, প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লা কায়সার, সৈয়দ নাজমুল হক, নিজামউদ্দিন আহমদ,মুহম্মদ আখতার, আ ন ম গোলাম মোস্তফাসহ আরও অনেককে।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়ে সমগ্র জাতি যেমন বেদনার্ত, তেমনি তাদের স্বজনরাও দীর্ঘ একচল্লিশটি বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন দুঃখ, ক্ষোভ, অভিমান আর হতাশার ভারী পাথর। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একাত্তরের নরঘাতকদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়েছে একাত্তরের মানবতা বিরোধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে।
এবার বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই পুরোধা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিচার কাজ শুরু হয়েছে এই পদক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরে বিচারের প্রতীক্ষায় থাকা বুদ্ধিজীবীদের স্বজনদের যেমন আশ্বস্ত ও ভারমুক্ত করবে, তেমনি জাতিও এর মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হওয়ার উপলক্ষ খুঁজে পাবে। দীর্ঘ চারটি দশক ধরে ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করতে না পারার ব্যর্থতাও লাঘব হবে এসব ঘাতকের সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন ও যথাযথ শাস্তি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই হোতা স্বাধীনতার পর থেকে বিদেশে আছে বলে জানা যায়। তাদেরকে যথাযথ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় দেশে ফেরত এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। এছাড়া আরও যারা এই নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদেরকেও গ্রেফতার করা জরুরী। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকারী এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত এই বিচার শেষ হবে এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।