কি বলব ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কো রে শী
আমাদের বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। স্মরণাতীতকাল থেকে চট্টগ্রামের পশ্চাৎভূমি হিসেবেই থেকেছে এ এলাকাটি। সেজন্য পরিচিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে। অর্থাৎ চট্টগ্রামের পার্বত্য অংশ।
অঞ্চলটি অতীতে জনহীন ছিল।
দ্বাদশ শতাব্দীর পর, সুলতানি আমলে চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। মোগল আমলেও তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। দিল্লির সম্রাট শের শাহ্ চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে আরাকান পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করেন, যা ‘গ্রান্ড ট্রাংক রোড’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ পার্বত্য এলাকাটিও তখন বাংলার শাসনে চলে আসে। একে তখন ‘কার্পাস মহল’ বলা হতো।
এ অঞ্চলে কার্পাস তুলা উৎপন্ন হতো এবং তুলা দিয়েই স্থানীয়রা রাজস্ব পরিশোধ করত।
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে তখন নির্দিষ্ট কোন সীমানা ছিল না। আজকের পার্বত্য এলাকার চাকমারা মোগল আমলের আগ থেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমতল এলাকায় বসতি স্থাপন করে। চাকমা ঐতিহাসিকরা দাবি করেন তারা ‘শাক্য’ বংশোদ্ভূত। তাদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তর ভারতে হিমালয়ের পাদদেশে।
‘চম্পকনগর’ নামক স্থানে ছিল তাদের ঐশ্বর্যমণ্ডিত রাজধানী। চাকমা রাজবংশের ৫০ জন রাজার বংশলতিকাও উল্লেখ করা হয়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের মুখে দেশান্তরী হয়ে তারা ধাপে ধাপে স্থানান্তরিত হয়ে সব শেষে এই অঞ্চলে এসেছেন। কিন্তু উত্তর ভারতে তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে এই দাবির ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। তবে চাকমারা যে চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের আগে দীর্ঘদিন আরাকান অঞ্চলে ছিল এবং সেখান থেকে এখানে এসেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তার আগে তারা কোথায় ছিল তা স্পষ্ট নয়।
চাকমারা বরাবরই গোত্রবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত ছিল এবং কম-বেশি এখনও আছে। এজন্য পরিস্থিতি যা-ই থাকুক না কেন, তাদের গোত্রপ্রধানকে ‘রাজা’ হিসেবে মান্য করে এসেছে। এই রাজারা কখনও কখনও শক্তিশালী হয়ে অন্যদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজ্য শাসনও করেছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলেও এক পর্যায়ে চাকমা রাজত্ব কায়েম হয়েছে।
তবে এই চাকমা রাজাদের রাজ্য সমতল চট্টগ্রামেই ছিল। মূলত কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষেই চাকমাদের বসবাস ছিল। তাদের রাজবাড়ি বা রাজধানীও সমতলেই ছিল। তখনও পাহাড়ি এলাকায় স্থায়ী চাকমা বসতি গড়ে ওঠেনি। উঠলেও তা ছিল সমতলের সন্নিহিত এলাকায়।
তার প্রয়োজনও দেখা দেয়নি। সমতল চট্টগ্রামের মানুষ পার্বত্য এলাকায় যাতায়াত করত বাঁশ, বেত ও কাঠ সংগ্রহের জন্য। ইংরেজ আমলের আগে এই পার্বত্য এলাকায় আদৌ কোন জনসমাগম ছিল কিনা তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। থাকলেও তারা অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ হয়ে থাকবে।
ইংরেজরা মোগলদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়ার পর ১৮৭১ সালে প্রথম এই পার্বত্য এলাকায় জনগণনা হয়।
তাতে পুরো এলাকায় সর্বমোট ৯০ হাজার লোক পাওয়া যায়। এই জনবসতিও অধিকাংশ সমতল অঞ্চলের কাছাকাছি জায়গায় ছিল। ইংরেজ আমলের আগ থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পুবে অবস্থিত লুসাই পাহাড় (বর্তমান মিজোরাম) থেকে সেখানকার লোকেরা, কুকি নামে পরিচিত, মাঝে মাঝে এ অঞ্চলে আক্রমণ চালাত। তারা এটাকে দখল করার চেষ্টা করত। ১৮৬০ সালে এই কুকিদের দমন করার জন্য ইংরেজরা লুসাই পাহাড়ে অভিযান চালায়।
এ সময় তারা তৎকালীন চাকমা গোত্রপ্রধানের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে বিপুলসংখ্যক চাকমাকে তাদের বাহিনীর সঙ্গে নিয়ে যায়। কুকিদের সঙ্গে যুদ্ধে চাকমারা ইংরেজদের পক্ষে লড়াই করে। এর পুরস্কার হিসেবে তাদের রাঙ্গামাটি এলাকায় বসবাস করার জায়গা এবং চাকমা গোত্রপ্রধানকে ‘রাজা’ উপাধি দেয়া হয়। চাকমারা সমতল চট্টগ্রাম থেকে, বিশেষ করে রাঙ্গুনিয়া থেকে তাদের বসতি গুটিয়ে রাঙ্গামাটি চলে যায়। তাদের সঙ্গে সমতল অঞ্চলের অনেক বাঙালিও তখন সেখানে বসতি স্থাপন করে, যারা এখন দাবি করে তারা সেখানকার ‘আদি বাঙালি’।
এ থেকে বোঝা যায় চাকমারা কখনোই পাহাড়ি, জংলি বা আদিবাসী (ধনড়ৎরমরহব) ছিল না। তারা চট্টগ্রামের সমতলের মানুষের চেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী ছিল না। তারা অন্য অঞ্চল থেকে এসেছে বটে, কিন্তু হাজার বছরেরও অধিক বৌদ্ধধর্মের নিবেদিত অনুসারী হিসেবে একটি সুসভ্য মানবগোষ্ঠী। তারা অতীতে কখনোই ‘জুম চাষী’ ছিল বলে জানা যায় না। সম্ভবত পার্বত্য এলাকায় বসতি স্থাপনের পরেই তারা নিতান্ত বাধ্য হয়ে জুম চাষী হয়েছে।
১৯০০ সালে ইংরেজরা একটা ‘হিল ট্রাক্টস্ ম্যানুয়াল’ প্রবর্তন করে। এতকাল এ এলাকা চট্টগ্রাম জেলার অংশ থেকেছে। এখন ইংরেজ সরকার সিদ্ধান্ত নিল, একে আলাদাভাবে দেখা হবে। সমতলের লোকদের সেখানে যেতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পারবে না।
জমি কিনতে পারবে না ইত্যাদি।
এটা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। ব্রিটিশ মিশনারি এবং অন্যান্য দেশের মিশনারি যারা এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার জন্য আসত, তাদের দাবির মুখেই এটা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এই ম্যানুয়াল ঔপনিবেশিক ভারতের অন্যান্য কিছু অঞ্চলের জন্যও করা হয়। ম্যানুয়াল মানে কিছু বিধিনিষেধ।
এ অঞ্চলগুলোতে সমতলের লোকেরা যেতে পারবে না পারমিশন ছাড়া। কতগুলো এলাকাকে করা হয় ‘টোটালি এক্সক্লুডেড’ এরিয়া যেমনÑ আসামের মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, খাসিয়া-জৈন্তিয়া এলাকা। অর্থাৎ এখানে সমতলের কোন লোক যেতেই পারবে না। আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বলা হয়, ‘পার্শিয়ালি এক্সক্লুডেড এরিয়া’। এখানে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।
থাকতে হলে বিশেষ অনুমতি লাগবে। এটা এজন্য করা হয় যে, মিশনারিরা তাদের সরকারের কাছে দাবি করেছিল এই এলাকাগুলো যদি সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায় তাহলে তাদের পক্ষে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে সুবিধা হবে।
ব্রিটিশ শাসনের একটা বড় দিক ছিল তারা যেখানে গেছে সেখানেই খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে তাদের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশবাদী তৎপরতা চালাতে অনেক সুবিধা হয়। এভাবেই আমেরিকাতে তারা প্রায় সব লোককে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলেছে।
স্পেনের রানী ইসাবেলা কলম্বাসকে তার সমুদ্রযাত্রার উদ্বোধন করতে গিয়ে নব আবিষ্কৃত দেশে খ্রিস্টের পতাকা উড্ডয়নের শর্ত দিয়েছিলেন। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত কোথাও তখন ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য কোন শক্তিশালী ধর্মমত ছিল না। সেখানে অ্যানিমিস্ট বা প্রকৃতিপূজারি ছিল বা তাদের নিজস্ব কিছু ধর্মবিশ্বাস ছিল। কোন অর্গানাইজড রিলিজিয়ন ছিল না। সেজন্য তারা সেগুলোকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে সব লোককে খ্রিস্টান বানাতে পেরেছে।
কিন্তু তারা যখন এই উপমহাদেশে এলো তারা দেখল, এখানে এটা একটু ডিফিকাল্ট। কারণ এখানে মুসলিম, হিন্দু, শিখরা আছে। এরা ধর্মের বন্ধনের দিক থেকে খুব গোঁড়া। তারা নিজেদের ধর্ম থেকে সরতে চায় না। মিশনারি দেখলে তেড়ে আসে।
তখন ব্রিটিশরা দেখল, এখানে যারা পাহাড়ি আছে যেমন উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং আমাদের পার্বত্য অঞ্চল, আবার যারা গভীর জঙ্গলে বাস করে যেমন ভারতের মধ্যাঞ্চল, ওইসব অঞ্চলের জঙ্গলে সাঁওতাল, ওরাঁও, মুণ্ডা; আমাদের বাংলাদেশেও শালবন এলাকায়Ñ দিনাজপুর, রংপুরে অনেক শালবন ছিলÑ সেখানেও কিছু সাঁওতাল, ওরাঁও বাস করে আসছে, এই এলাকাগুলোকে তারা আলাদা করার জন্য এ আইনটা করল; যাতে তাদের খ্রিস্টান বানানো সহজ হয়। খ্রিস্টান বানানো গেলে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের খুঁটি শক্ত করা যায়। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকেও তারা সেজন্য আলাদা করে রাখার উদ্যোগ নেয়। সে জন্যই ১৯০০ সালের ‘হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল’।
বাহ্যত তারা যুক্তি দিল যে সমতলের লোকেরা সেখানে গেলে তারা সেখানকার মানুষকে এক্সপ্লয়েট করবে।
তাদের সম্পদ এবং সব কিছু নিয়ে নেবে। সেখানকার মানুষের উন্নতির জন্য, তাদের প্রোটেক্ট করার জন্য, সুরক্ষা দেয়ার জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু পুরো ব্রিটিশ আমল যখন পার হয়ে গেল, ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান ও ভারত তৈরি হল, আমরা যদি তখনকার পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, পুরো এলাকায় একটি মাত্র হাইস্কুল, সেটাও রাঙ্গামাটি শহরে। সেখানে বাইরের লোকই বেশি। ওখানে কিছু চাকরিজীবী, কিছু প্রশাসক, কিছু ব্যবসায়ী হিন্দু-মুসলিম আছে।
স্কুলে ওদের ছেলেমেয়েরাই বেশি। পাহাড়িদের সংখ্যা খুবই কম।
পাহাড়িদের উন্নতির জন্যই যদি এই পৃথকীকরণ করা হতো, তাহলে তো বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে কিছুটা সামঞ্জস্য রেখে বা তখনকার ব্রিটিশ-ভারত, ঔপনিবেশিক ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে এত বড় এলাকায় একটা মাত্র স্কুল থাকত না। অর্থাৎ ব্রিটিশ তাদের লেখাপড়া শেখানোর, তাদের উন্নতি করার দিকে কোন চেষ্টাই করেনি। যে জনগোষ্ঠী সমতল চট্টগ্রামে রাজ্য স্থাপন করে মোগল ও ব্রিটিশের সঙ্গে লড়েছে, তারা এ সময়ে এমনই পিছিয়ে পড়ে যে তারা নিজেদের আদিবাসী বা পিছিয়েপড়া জাতি ভাবতে থাকে।
সেটা তাদের লক্ষ্যই ছিল না। লক্ষ্য ছিল, এ জায়গাটা তারা মিশনারিদের হাতে ছেড়ে দেবে। তাদের জন্য ‘গেইম রিজার্ভ’ তৈরি করে দেবে। তারা যেন সেখানে বাধাহীনভাবে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে পারে, সেজন্য সেখানে দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন ধরে রাখতে হবে। যেমন করে আজকে দেখি পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল, যেটা আমরা ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলি, যদি মানচিত্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশে মিজোরাম তার উপরে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল, মেঘালয়Ñ সর্বত্র সেখানকার প্রায় সব লোক খ্রিস্টান হয়ে গেছে।
এসব এলাকাকে তারা বাইরের জগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছিল এবং সেখানে তারা কোন সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। তাদের বৈষয়িক দিক থেকে উন্নত করতে শিল্প-কারখানা কিছুই গড়ে তোলা হয়নি। তাদের একটা পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী করে রেখেছে। আর জায়গায় জায়গায় চার্চ তৈরি করেছে। চার্চের পরিচালকরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ধীরে ধীরে আজ পুরা এলাকা খ্রিস্টধর্মের আওতায়। যেমন মিজোরামে এখন ৯৯ ভাগ লোক খ্রিস্টান, নাগাল্যান্ডে ৯০ ভাগ, মণিপুরে ৬০ ভাগ, মেঘালয়ে প্রায় ১০০ ভাগ লোক খ্রিস্টান। এভাবে তারা তাদের উদ্দেশ্য সফল করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে তারা একটু সমস্যায় পড়ে গেল। এখানে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের ওই যে অঞ্চলগুলোর মানুষকে তারা খ্রিস্টান বানিয়েছে, সেখানে কিন্তু এই পাহাড়িরা কোন ধর্মাবলম্বী ছিল না। মোস্টলি তারা অ্যানিমিস্ট বা প্রকৃতিপূজারি ছিল। সাপ পূজা, গাছ পূজা বা কোন কিছুতে শক্তির প্রকাশ দেখলে তাকে পূজা করত। তাদের নিজস্ব কিছু ট্রাইবাল রিলিজিয়ান ছিল। ওইভাবে তারা নৃত্য গীতের মাধ্যমে বা একটা কল্পিত দেবতার উদ্দেশে বলি দিয়ে ধর্মকর্ম পালন করত।
কিন্তু তাদের কোন অর্গানাইজড রিলিজিয়ান ছিল না। তারা ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা শিখ ধর্মÑ যেসব অর্গানাইজড রিলিজিয়ান এই উপমহাদেশে ছিল, সেগুলোর সংস্পর্শে আসেনি। সেজন্য তাদের সহজে ধর্মান্তর করতে পেরেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ লোক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। আমরা আগেই দেখেছি, চাকমারা আদিতে পাহাড়ের অধিবাসী ছিল না।
তারা যে অঞ্চলের অধিবাসী ছিল, সেখানে তারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল। মোটামুটি তারা অগ্রসর জাতি। সেখানে হয়তো বা স্থানীয় যুদ্ধবিগ্রহ বা কোন উপজাতীয় সংঘাতের কারণে একটা গ্র“প স্থানান্তর হতে হতে প্রথমে আমাদের কক্সবাজার অঞ্চলে আসে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে এখন তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে। দীর্ঘকাল সমতলবাসী মুসলিম ও হিন্দু বাঙালির সঙ্গে থাকায় তারা এ অঞ্চলে ন্যাচারালাইজড হয়ে গেছে। তাদের ভাষাও প্রান্তিক বাংলা ভাষার রূপ নিয়েও।
তারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে খ্রিস্টান মিশনারিরা বহু চেষ্টা করেও এ অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম বিস্তার করতে পারেনি। বৌদ্ধদের তারা খ্রিস্টান বানাতে পারেনি। আমাদের চাকমা ও মার্মা যে দুটি বড় সম্প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে তারা এখনও বৌদ্ধধর্মমত আঁকড়ে ধরে আছে। চাকমাদের সম্পর্কে আমরা যা আলোচনা করেছি, বান্দরবানের মার্মা, আমাদের পার্বত্য এলাকার দ্বিতীয় বৃহৎ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য।
আমাদের পার্বত্য এলাকায় যারা টিপ্রা আছে, তারা মূলত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে অতীতে কোন এক সময়ে এখানে এসেছে।
১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লার নাম ছিল ত্রিপুরা এবং আজকের ত্রিপুরা রাজ্যের নাম ছিল ‘পার্বত্য ত্রিপুরা’। যেমন চট্টগ্রাম এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’। কুমিল্লা এবং নোয়াখালী দীর্ঘদিন ত্রিপুরা রাজার অধীনে ছিল। ত্রিপুরা একটা শক্তিশালী দেশীয় রাজ্য ছিল। মোগলরা বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালী অংশটা ত্রিপুরা রাজার কাছ থেকে দখল করে নেয়।
সম্ভবত সুলতানি আমল থেকেই এটা এদিকে চলে আসে। ইংরেজরা সেভাবে দখল পেয়ে যায়।
টিপ্রা জনগোষ্ঠী যারা কোন বিশেষ কারণে আমাদের চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয় তারা এখন বাংলাদেশের অধিবাসী। এরা মূলত হিন্দু। ত্রিপুরার রাজধর্ম ছিল হিন্দুধর্ম।
অতীতে ত্রিপুরা রাজ্যের জনগণের অধিকাংশ ছিল টিপ্রা। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ভারত হওয়ার পরে আমাদের এ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ হিন্দু ত্রিপুরায় চলে যায়। এখন ত্রিপুরার বেশির ভাগ লোক বাঙালি, বাঙালি হিন্দু। মুসলমানও সেখানে কিছু ছিল। তাদের অনেকে আবার এদিকে চলে এসেছে।
সেখানে এখনও কিছু মুসলমান আছে। তবে ত্রিপুরা এখন বাঙালি হিন্দুদের রাজ্য হয়ে গেছে। টিপ্রারা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। এজন্য ৩০-৪০ বছর ধরে টিপ্রা উপজাতীয়রা সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করছে।
এর মধ্যে পাশের মিজোরাম অঞ্চলের মানুষ ব্যাপকভাবে খ্রিস্টান হয়ে গেছে।
তারা এসে টিপ্রাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করল এবং এখন দেখা যাচ্ছে যে তাদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটেছে। এটা কিন্তু ব্রিটিশ আমলে হয়নি। গত ৩০-৪০ বছরেই বেশি হয়েছে। এর ফলে আমাদের বাংলাদেশী টিপ্রাদের মধ্যেও তার ব্যাপক প্রভাব এসে পড়ছে। (আগামীবার সমাপ্য)
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২, রাষ্ট্রচিন্তা পাঠচক্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘রাষ্ট্রচিন্তা বক্তৃতামালায় প্রদত্ত বক্তৃতা
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।