আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন না-মানুষ এবং ধর্ষিতার গল্প

ক্লান্ত অবন্তি । কিন্তু চোখে ঘুম নাই । পাশের লোকটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে । অবন্তির চোখের সামনে ঘুরেফিরে শুধু সেই সোনালী অতিতের ছবি ভেসে উঠছে । চোখ বন্ধ করতেই পুরানো সেই দিনগুলো ।

সুখের স্মৃতি কিন্তু বড় জ্বালা দিচ্ছে । জীবনের মোড় কীভাবে ঘুরে যায় তা কেও কখনো কল্পনাও করতে পারে না । যেমন পারি নি আজকের অবন্তি । এইতো কয় বছর আগে কত স্বপ্ন দেখতো । কত রঙ মেশানো স্বপ্ন ।

জীবনকে রাঙাতে কোনো রঙ সে বাকী রাখতো না । কিন্তু সেই স্বপ্ন কতদিনই বা স্থায়ী হয়েছিলো ? পাশে যে লোকটা মৃদু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সেই লোকটাই একদিন তাকে পাবার জন্য কী করে নি ? কিন্তু আজ ...? কেমন সব এলোমেলো হয়ে যায় অবন্তির এর বেশি ভাবতে গেলেই । এইচ এস সি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল সে । নিজেও জানতো সুন্দরী বলতে যা বোঝাই তার চেয়ে বরং বেশি কিছুই আল্লাহ তাকে দিয়েছিলো । তার নিটোল শরীরের প্রতি কার না আকর্ষণ ছিলো ।

কে তাকে পাবার চেষ্টা করে নি ? কিন্তু তাদের মধ্যে যে সফল হয়েছিলো সেই আজ তার পাশে শুয়ে আছে । কিন্তু অবন্তির মনে শান্তি নেই একটুও । বরং কে যেন তার মগজে গরম সিসা ডেলে দিয়েছে । মাথাটা দপদপ করছে । চোখ জ্বালা করছে ।

ওকে পাবার জন্য একুশটা চিঠি লেখে বলেছিলো, অবন্তি একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার । তাই তোমাকে আমি একুশটা চিঠি লেখলাম । আমি কি তোমার হাত ধরার অধিকার পাবো ? অবন্তি কোন উত্তর দিয়েছিলো না । যেদিন বায়ান্নটা চিঠি দিয়েছিলো সেদিন বলেছিলো, মুক্তভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো বায়ান্ন । বিজয় হয়েছিলো ভাষার প্রতি ভালোবাসার ।

আমি তোমার চোখে চোখ রেখে আকাশের সাদা মেঘ দেখতে চাই, আমি তোমার হাত ধরে সকালের সোনারোদে হাঁটতে চাই, সন্ধ্যায় তোমার সাথে কফি হাউজে বসবো বলে কতদিন কফি হাউজে বসি না । এরপর অবন্তি আর নিরুত্তর থাকতে পারে নি । নিজের সব দ্বিধা জেরে ফেলে দীপকে হ্যাঁ বলেছিলো । তারপর কিছুদিন কী আনন্দেই না কেটেছিলো । কত স্বপ্নই না দেখেছিলো ।

দীপ কতবার যে বলেছে , আমি মরণকে গ্রহণ করতে পারব কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না । কিন্তু সেই দীপ ...? খুব বেশি সময় লাগে নি দীপের আসল চেহারা জানতে । কত কিছুই তো ঘটে । অবন্তির জীবনেই তেমনি ঘটে গিয়েছিলো জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা । গৃহ শিক্ষক দিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো অবন্তি ।

চার বছর ধরে পড়াতো অবন্তীকে । কখনো কোনো খারাপ আচরণ করে নি । পরিবারের সবাই বিশ্বাস করতো । কিন্তু যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন কেউ বাসায় ছিল না । অবন্তিকে পড়াতে এসে হঠাৎ করেই ওর উপর চড়াও হয় শিক্ষক বেশে কুত্তাটা ।

জানোয়ারটা পশুবৃত্তি চরিতার্থ করেই শান্ত হয় না । অবন্তির অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে বিবস্ত্র ছবি তোলে ও ভিডিও করে । তারপর চলে যায় । জ্ঞান ফেরা অব্দি বাসায় কেউ ফিরেছিল না । অবন্তি ভেবেছিলো কেউ কিছু জানবে না ।

সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে । কিন্তু শুয়ারের বাচ্চা কয়দিন পর অবন্তির বাবার কাছে ফোন করে টাকা দাবি করে । দেবে কি দেবে না এই দোলাচলে দুলতে দুলতেই পাড়ার ছেলেদের হাতে অবন্তির ছবি আর ভিডিও পৌঁছে যায় । অবন্তির ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায় । ছোট ভাই আর বাবাকে কূটকথা শুনতে হয় ।

বাধ্য হয়ে বাসা পাল্টাতে হয় । সুখি একটা পরিবার কেমন এলোমেলো হয়ে যায় । অবন্তির বাবার সড়ক দুর্ঘটনাটা জীবনটাকে আরো নতুন করে চেনায় । হাসপাতালে ভর্তি বাবা সংসারে নাই টাকা । প্রতি মুহুর্তে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করা ।

জীবন থেক ছিটকে পড়ার তাড়না –জীবনকে এলোমেলো করে দিলো । এরমধ্যে অবন্তি অনেক চেষ্টা করে দীপের সাথে দেখা করেছিলো । সেখান থেকে যে উত্তরটা এসেছে সেটা ভাবনার অতীত । অবন্তি বলেছিলো, দীপ তুমি তো সব জানো , কী করবে এখন ? আমার কী করার আছে ? তুমি না আমায় ভালোবাসো । তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ? কেন এ কথা বলছো ? তুমি সমাজে এখন ঝুটা, তোমায় বিঁয়ে করলে নানাজনে নানা কথা বলবে ।

আমার দ্বারা সম্ভব নয় । তুমি তোমার পথ দেখো । পিছনে আর ফিরে তাকায় নি দীপ । আর জীবন থেকেও হারিয়ে যায় অবন্তি । বাসায় ফেরার পর বার বার মনে হয়েছে আত্মহত্যা করবে ।

কিন্তু কে যেন বার বার ফিরেয়েছে । কোনো এক অজানা কারণে পারে নি । কপালে যার অনেক দুঃখ থাকে সে মরবে কেন ? টাকা টাকা করে জীবন তাগিদ দিতে থাকে । টিউশনি বা চাকুরী করে নিজে চলা যায় । কিন্তু বাবার চিকিৎসার খরচ , ছোট ভাইয়ের স্কুলের বেতন কিংবা সংসার চলে না ।

বাসা ভাড়া বাকী পড়ে যায় তিনচার মাসের । বাড়িওয়ালা বাড়ী ছাড়তে বলে । ঠিক সেই সময়ে পাশের বাসার এক মহিলা ডাক দেয় অবন্তিকে । নির্লিপ্ত গলায় বলে, তুমি তো সুন্দরী তোমার আবার টাকার অভাব ? অবন্তি বড় বড় চোখে তাকায়, সুন্দরের সাথে টাকার সম্পর্ক কী ? মহিলা বলে, ও বোঝো নি ? এই দেখ আমার স্বামী আজ ছয় বছর ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে । কিন্তু আমার কোনো কিছুই আটকে নেই ।

ওর ওষুধ পত্র থেকে শুরু করে সবকিছু আমিই যোগাই । লোকে আমায় খারাপ বলে । বলুক তাতে কার কী ? আমি না খেয়ে থাকলে আমায় কেউ দিতে আসে না । তা হলে ? এই যে বাড়ীওয়ালা আমার নিয়মত খদ্দের । বাসায় বউ না থাকলেই আমার ডাক পড়ে ।

কেউ জানেনা । তোমাকেই বললাম । তুমি আসলে আসতে পারো । টাকা পাবে , জীবন পাবে । অবন্তি মাথা নিচু করে চলে আসছিলো ।

মহিলা মৃদু স্বরে ডেকে বললো, আমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছি । তারপর জীবনের মানে পাল্টে গেলো দ্রুত । এতসব চিন্তা করে হঠাৎ আজ অবন্তির মনে হলো সেই সময় ভালো একটা সঙ্গ পেলে আজ তাকে এই জীবনে আসতে হতো না । কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে পারলো না সে । দীপের ঘুম ভেঙ্গে গেছে ।

ওর দিকে তাকিয়ে বললো, কি ঘুমাও না কি ? অবন্তি বললো, না ঘুম আসে নি । ভালোই হয়েছে । আমি ডাকবো ভাবছিলাম । কথা বলা যাক । যেই আমার বেডে আসে তাঁর সাথে আমি এই কাজটা করি ।

শেষ রাতের দিকে গল্প করি । তোমাদের মত মেয়েদের জীবনের গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে । অবন্তির ঘোর লাগে । কাল রাতে যখন দীপের রুমে আসে । দীপ তখন একটু মাতাল প্রায় ।

এমনেই গত পাঁচ বছরে অবন্তির চেহারা যথেষ্ট পাল্টে গিয়াছে । প্রতি রাতে হাত বদল হতে হতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে আর খুঁজে পায় না অবন্তি । কিন্তু দীপও চিন্তে পারবে না সেটা ও ভাবে নি । বাসার ঠিকানাটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবেছিল আসবে কি না ? কী এক অচেনা টান তাকে টেনে এনেছিল কে জানে ? দীপ একটানা বকবক করে যাচ্ছে । অবন্তির কানে কিছুই ঢুকছে না ।

হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন ওকে কাঁপিয়ে দিলো, কীভাবে এই পথে এলে ? এ প্রশ্নের কী উত্তর দিবে অবন্তি ? সেদিন যদি ঐ ভাবে ফিরেয়ে না দিত তাহলে ... । আর ভাবতে ভালো লাগছে না । এতক্ষণে অবন্তির ঘুম পাচ্ছে । সে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল । কোনো উত্তর না পেয়ে দীপ পাশ ফিরে তাকিয়েই চমকে উঠলো, হঠাৎ করেই মনে হল এই মেয়েটাকে চেনে , জন্মে জন্মে চেনে ।

রাতে মাতাল ছিল বলে বুঝতে পারে নি । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন জাগলো মনে, অবন্তি এত নিচে নামতে পারে না । কার নিচে নামার কথা ভাবছি আমি ? দীপ নিজে নিজেকে প্রশ্ন করলো । ও নিচে নামলে আমি কি উপরে আছি ? কিভাবে ? ওর হয়তো জীবনের তাড়া ছিল । কিন্তু আমার ? আমার বউ আছে , বাচ্চা আছে ।

তারপরেও... । খুব ইচ্ছে করছিলো অবন্তির মুখটা দেখতে । আলতো করে হাতের উপর ভর দিয়ে অবন্তির মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো দীপ । এসি ছাড়া আছে তারপরেও অবন্তির ক্লান্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । দেখতে কী অদ্ভুত মায়াবী লাগছে ।

হঠাৎ করেই ইচ্ছে হল একটা চুমো খাওয়ার । কিন্তু কেমন ভয় ভয় লাগলো দীপের । কয় রাতে তো এমন হয় নি । উত্তরটা নেজের থেকেই পেয়ে গেলো, কামনা আর ভালোবাসা এক নয় । সকাল হয়েছে ।

শেষ পর্যন্ত চুমো খাওয়ার সাহস করে উঠতে পারে নি দীপ । অবন্তি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে । টাকা নেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে অবন্তি সংকোচ আজও কেটে উঠতে পারে নি । আজ আরো সেটা তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে । আশে পাশে দীপকে দেখাও যাচ্ছে না ।

অবন্তি... দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে দীপের ডাক । অবন্তি চমকে উঠলো । ভেবেছিলো চিন্তে যখন পারে নি তখন আর নিজের থেকে পরিচয় দিবে না । টাকাটা নিয়ে চলে যাবে । এখন কী করবে সে ? এক মিনিট ভাবলো ।

তারপর কণ্ঠে যতটা ঘৃণা দেওয়া সম্ভব দিয়ে বললো, চিন্তে পেরোছো তাহলে ? তারপরেই কী ভেবে নিজেকে শোধরালো, কেমন আছো দীপ ? ভাল । শুনেছি তুমি বিঁয়ে করেছো, তোমার বউকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল । দেখবে ? এইতো ছবি আছে । এইটা কে তোমার ছেলে ? হ্যাঁ । কী নাম ওর ? আরিয়ান ।

আচ্ছা ... না থাক । বলো সমস্যা নাই । তোমার বউতো সুন্দর । তারপরেও কেন অন্য মেয়ে খোঁজো ? জানিনা , আমি তৃপ্ত হয় না ওর কাছে । এটা দেখতে দেবে না , ওটা ছুতে দেবে না ।

বড্ড কু-ল, বড্ড বাঙ্গালীপনা । আমার ভালো লাগে না । উত্তর শুনে চমকে উঠে অবন্তি । রাতের কথা মনে পড়লো ওর । যে আচরণ ও করেছে তা কোনো বাঙ্গালী বউ এর দ্বারা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় ।

বিশাল একটা ধাক্কা লাগলো ওর, ও কখনো কারো বউ হতে পারবে না । আচ্ছা চলি । টাকা নেবে না ? হ্যাঁ, ওটা আমার পেশা । নির্লপ্তের মতো টাকা নিয়ে ব্যাগে রাখলো অবন্তি । চলি ? বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো অবন্তি ।

একটু যেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দীপের চোখের দিকে চোখ রাখলো । সাপের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টি যেন দীপকে ছোবল দেবে এখনি । একটু সময় নিয়ে বললো, কী অদ্ভুত ... দীপ বললো, কী ? এই সমাজ । একবার ধর্ষণ হলে তাকে ভালোবাসা যায় না, তাঁর সাথে সংসার করা যায় না কিন্তু প্রতি রাতে যে মেয়েটা ধর্ষিত হয় তাকে ঘরে নিয়ে এসে কামনা মেটানো যায় । বউয়ের বাঙ্গালীপনা ভালো লাগে না ।

আবার যখন বিয়ে করতে যাবে তখন শুদ্ধ মেয়ে ছাড়া বিঁয়ে করবে না । হা হা হা, ঘৃণার হাসি হেসে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো অবন্তি । আর বোবা শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো দীপ । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.