সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২৮ জনে। এর মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে ৫১৯টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি নয়জন জীবিত উদ্ধার হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যান।
ধ্বংসস্তূপ থেকে গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত ৯৪টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই উদ্ধার করা হয় ভবনের পেছনের অংশ থেকে।
যন্ত্র দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরালেই মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। রোববার রাত থেকে যন্ত্র দিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
উদ্ধারকর্মীরা জানান, পোশাক কারখানার সিঁড়ির একাংশের ধ্বংসস্তূপ বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত সরানো হয়েছে। সিঁড়ির আরেকটি অংশের ধ্বংসস্তূপ এখনো সরানো যায়নি। সেখানেও অনেক মৃতদেহ থাকতে পারে।
ভবনধসের ১০ দিন পর গতকাল যেসব মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, তাঁদের সবই বিকৃত হয়ে গেছে। অনেক লাশের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক স্বজন দিনভর অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অপেক্ষা করেও লাশ পাননি। ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর সেগুলো হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৪৩৯টি মৃতদেহ। বাকি মৃতদেহগুলো বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গ ও অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে রয়েছে।
ধ্বংসস্তূপ সরালেই লাশ পাওয়া যাচ্ছে: ধ্বংসস্তূপ সরালেই পাওয়া যাচ্ছে মৃতদেহ। কারও পুরো দেহে মাংস নেই, আছে শুধু হাড়। কারও আবার পুরো মাথাটাই রয়ে গেছে ধ্বংসস্তূপে, যন্ত্রের টানে বেরিয়ে আসছে একাংশ।
বিকৃত হয়ে যাওয়া যে দু-একটি লাশের সঙ্গে পরিচয়পত্র পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। যেসব লাশের সঙ্গে পরিচয়পত্র পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের স্বজনদের ডিএনএ পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। কারণ, অধিকাংশ স্বজনই এখন লাশের দাবি করছেন পরনের কাপড় ও অলংকার দেখে।
উদ্ধারকর্মীরা জানান, যন্ত্র দিয়ে উদ্ধার অভিযান চালানোর পর থেকে যে ১২৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রায় ১১৪ জনই ধসে পড়া ভবনের পেছনের অংশে ছিলেন। ওই দিকে ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ওঠানামার সিঁড়ি।
রানা প্লাজার নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার মার্কেটের সিঁড়ি ছিল সামনের দিকে।
গতকাল দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপের পেছনের অংশে প্রথমে হাইড্রোলিক হ্যামার দিয়ে কংক্রিটের স্লাবগুলো ভাঙা হচ্ছে। এরপর লাশের সন্ধান পেলে হ্যামারের সামনের সরু অংশ দিয়ে টেনে নামানো হচ্ছে। সেখান থেকে উদ্ধারকর্মীরা স্ট্রেচারে করে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন। হ্যামার দিয়ে নিচে নামানো ধ্বংসস্তূপ বুলডোজার দিয়ে দূরে ফেলা হচ্ছে।
তবে বড় বড় ক্রেন দিয়ে কংক্রিটের স্লাব কেটে টেনে আনার কাজ গতকাল বন্ধ ছিল।
বুলডোজার ও হাইড্রোলিক হ্যামার দিয়ে নবম তলার ছাদের স্লাব কেটে আনা হচ্ছে। এ পর্যন্ত অর্ধেক ছাদ কাটা হয়েছে। আটতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত ছাদগুলো গুঁড়িয়ে যাওয়ায় সেগুলো ক্রেন দিয়ে টেনে আনতে সমস্যা হচ্ছে।
গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর সেখানে আটকে পড়া লোকজনকে জীবিত উদ্ধারের লক্ষ্যে ভারী যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।
হাতুড়ি, শাবল আর ড্রিল মেশিন দিয়ে ছাদ খুঁড়ে খুঁড়ে উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার রাত ১২টার পর ভারী যন্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। এরপর আর জীবিত কাউকে উদ্ধার করা যায়নি।
লাশের পরিচয় মিলছে না: ‘ভাই, আমার স্ত্রীর পায়ে নূপুর ছিল। চুল মাঝারি আকারের।
দাঁতের পাটি সমান। জামা পেস্ট কালারের। সবই ঠিক আছে। আমি নিশ্চিত, এটাই আমার স্ত্রী। তার পরও আমাকে লাশ দেওয়া হচ্ছে না।
ফাটা ভবনে ডেকে এনে আমার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এখন হাড়-হাড্ডিগুলোও দেওয়া হচ্ছে না। বলছে, ডিএনএ পরীক্ষা করা লাগবে। আমি আর কী করতে পারি?’—কথাগুলো বলার সময় আমিনুল ইসলাম অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি সাভারের জি কে পোশাক কারখানায় কাজ করেন।
স্ত্রী রহিমা বেগম কাজ করতেন রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায়।
আমিনুল জানান, ২৪ এপ্রিলও তাঁরা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাজে বেরিয়েছিলেন। বিভিন্ন হাসপাতাল, ধ্বংসস্তূপ আর অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু স্ত্রীর সন্ধান পাননি। গতকাল সকালে প্রায় বিকৃত একটি লাশ তাঁর স্ত্রীর বলে নিশ্চিত হন।
লাশ নিতে গেলে কর্তৃপক্ষ জানায়, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য শ্বশুরকুলের লোকজন লাগবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজন সব রংপুরে থাকেন। কখন আসবেন আর লাশ গ্রহণ করবেন, সেই অনিশ্চয়তায় কান্না থামছে না তাঁর।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় যেসব লাশের সঙ্গে পরিচয়পত্র পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের লাশ দেওয়া হচ্ছে না। ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় নিশ্চিত হলে দেওয়া হবে।
উদ্ধারকর্মী ও স্বজনেরা জানান, অধিকাংশ নারী কর্মী তাঁদের পরিচয়পত্র সাইড ব্যাগে রাখেন। পুরুষেরা রাখেন পকেটে বা মানিব্যাগে। জীবিত যাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও এমন দেখা গেছে। কিন্তু ঘটনার ১০ দিন পর সাইড ব্যাগ বা মানিব্যাগ পাওয়া দুষ্কর। গতকাল সকালে কামরুল ও মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের সময় তাঁদের পরিচয়পত্রও পাওয়া যায়।
কামরুলের মানিব্যাগে আর মুনিয়ার গলায় পরিচয়পত্র ঝোলানো ছিল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।