আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘেটুপুত্র কমলার অস্কার নমিনেশন ওরফে প্রথম আলোর বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অফ ইনফরমেশন

মুভি ক্রিটিক ব্লগ (প্রথম বাংলা মুভি ব্লগ) ★★★★★ © ২০০৭ - ২০১৩ ওয়েবসাইট: www.saifsamir.com গত শুক্রবারের আগের শুক্রবারের (২১.৯.১২) কথা। আমার এক বন্ধু ফোন দিয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর সে বললো, 'হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা ছবিটা দেখছিস? ওটা নাকি অস্কার নমিনেশন পাইছে?' ছাদ থেকে পড়ার পর আমার চকিত প্রতিক্রিয়া, কি? দূর বোকা! এখনও বছর শেষ হয় নাই আর কিনা অস্কার নমিনেশন! তোরে এই ভুয়া খবর কে দিছে? বন্ধু: আরে কালকে প্রথম আলোতে দেখলাম। আমি: কি দেখছিস? বন্ধু: আনন্দ পাতায় চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর লিখছেন যে ঘেটুপুত্র কমলা অস্কার নমিনেশন পাইছে। আমি: লেখাটা আমি দেখি নাই, তবে আমার মনে হচ্ছে তুই ভুল পড়ছিস।

আসল কথা হলো, প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে অস্কারের সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য মুভি পাঠানো হয়। ওখান থেকে সেরা মুভিগুলোকে পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। সবচেয়ে সেরা মুভিটিকে দেয়া হয় অস্কার। এ বছর বাংলাদেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা প্রতিযোগিতায় পাঠানো হবে বলে সিদ্ধান্ত হইছে। সাগর সাহেব মনে হয় এটাই লিখছেন।

তুই বুঝস নাই। বন্ধু: আরে না! তুই যেভাবে বলতোছস ওভাবে কিছুই লিখে নাই। উনি লিখছেন যে এর আগে শ্যামল ছায়া অস্কার নমিনেশন পাইছিল এবার ঘেটুপুত্র কমলা মনোনয়ন পাইছে। ছাদ তো অনেক কাছে, এবার চাঁদ থেকে পড়ার পর বন্ধুকে বললাম, ওয়েট! ওয়েট! আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি ঘটনা কি হইছে! দাঁড়া, আমি আগে লেখাটা পড়ে পড়ে নিই তারপর তোর সঙ্গে কথা বলবো। এখন রাখি।

ফরিদুর রেজা সাগর 'অপারেশন অস্কার' শিরোনামের লেখাটি শুরু করেছেন এভাবে, 'ঘেটুপুত্র কমলা অস্কারে যাচ্ছে এ বছর। ' কিন্তু 'অস্কারে যাওয়া' মানেটা যে আসলে কি সেটি সাধারণ পাঠকদের জন্য পরিষ্কার করে কিছু লিখেন নাই। তারপর এক প্যারায় লিখলেন, 'সবাই জানেন, এর আগে হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ থেকে অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল। ' একটু নড়েচড়ে বসলাম। কি ট্রিকি লাইনরে বাবা! আমাদের মস্তিষ্ক একটি তথ্য ভাণ্ডার।

কিন্তু আমরা যা করি, যা দেখি, যা পড়ি সবই মনে রাখতে পারি না। আমাদের মস্তিষ্ক এই তথ্যগুলোকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিল্টার করে নেয়। ফ্যাক্টগুলোকে সংরক্ষণ করে। সাগর সাহেব একজন আস্থাভাজন মানুষ। ওনার লেখাটি যদি আপনি আস্থা নিয়েই পড়েন, শেষ উদ্ধৃত করা অংশটির আসল ফ্যাক্ট যদি আপনার জানা না থাকে, যে ফ্যাক্টটি আপনার মস্তিষ্ক এবার সংরক্ষণ করবে সেটি হলো - 'শ্যামল ছায়া অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল'।

যারা প্রকৃত সত্য জানেন, তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কিভাবে একটি মিথ্যা/ভুল মেসেজ দেয়া হলো। এই বাক্য গঠনের মধ্যে নিশ্চিত একটা ফাঁকিবাজি আছে। একজন সাধারণ পাঠক (যেমন আমার বন্ধুটি), যিনি অস্কারের অত-শত খবর জানেন না, শুধু এটুকু জানেন যে অস্কার চলচ্চিত্র শিল্পের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার, তিনি হয়তো ভাববেন- ওয়াও, শ্যামল ছায়া অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল, জানতাম না তো! যিনি এমনটি ভাবলেন, তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ লেখকের বাক্যটিতেই এই ভাবনার উদ্দীপনা আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এতে সাগর সাহেবের স্বার্থ কি? তিনি শ্যামল ছায়ার একজন প্রযোজক।

মুভিটির সঙ্গে যদি অস্কারের তকমা লাগে অনুভূতি মন্দ নহে। সাগর সাহেব তার লেখাটির শেষ দিকে লিখলেন, 'সেই উচ্ছ্বসিত মুখ-চোখ আমি ঘেটুপুত্র কমলা অস্কারে মনোনয়ন পাওয়ার ঘোষণার পরও দেখতে পাচ্ছি। ' - শাবাশ! প্রিয় পাঠক আপনারাই দেখুন, এবার মিথ্যা/ভুল মেসেজ দেয়ার উদ্দীপনার ষোলকলা পূর্ণ হলো! আমার ঐ বন্ধুটিকে কিভাবে দোষ দিব বলেন? আপনারা হয়তো বলবেন, আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। আমার কথা বাদ দিন। অসংখ্য লোক চোখ বুলিয়ে পত্রিকা পড়ে, তাদের জন্য এই ভুল/মিথ্যা তথ্য গ্রহণের আশংকা আরও ভয়ানক! মূল পাতার সংবাদ সবাই পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে পড়েন না, একটু খোলা মনে পড়ে থাকেন।

কারণ আমাদের দেশে সংবাদে মিথ্যাচার নতুন কিছু না। কিন্তু সাপ্লিমেন্ট বা বিশেষ পাতার লেখা বা ফিচারে মানুষের সন্দেহটা কম কাজ করে। তার উপর লেখাটা যদি হয় প্রথম আলোর বিনোদন সাপ্লিমেন্ট আনন্দ পাতায় ফরিদুর রেজা সাগরের লেখা যিনি ঘেটুপুত্র কমলা মুভিটিরও একজন প্রযোজক, তবে তো সাধারণ পাঠকের মাথায় সন্দেহ আসে না। একজন কুশলী লেখক যখন কোন বাক্য রচনা করেন তিনি সেটা অনেকভাবে করতে পারেন। তার তথ্যের যদি কোন ঘাটতি থাকে তিনি তা অসাধারণ বাক্য গঠনের মাধ্যমে পুষিয়ে দিতে পারেন।

তথ্যের প্রাচুর্য থাকলে একাধিক বাক্যের বদলে একবাক্যেই সাবলীলভাবে বলতে পারেন। কিন্তু লেখক যদি কোন তথ্য গোপন করতে চান? কোন তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন চান? সম্পূর্ণ পক্ষপাতি না করেও বাক্য গঠনের চাতুর্যে সেটা সফলভাবে করা সম্ভব। পুরো বিষয়টা নির্ভর করে লেখক পাঠকদের সঙ্গে কতোটুকু সৎ থাকবেন তার উপর। কিছু লেখক পাঠকদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সৎ থাকতে চান, কেউ একেবারেই চান না আবার অনেকে সততা-অসততার জগাখিচুড়ি করে পাঠকদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে চান। তবে তথ্যের সাহিত্যরূপ দেয়া আমার এই বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত নয়।

কৌশলী লেখক যেমন আমাদের আছে, বুদ্ধিমান পাঠকও আমাদের আছে। একজন বুদ্ধিমান পাঠক একজন কুশলী লেখকের কয়েকটি লেখা পড়েই তার আদর্শ বুঝে ফেলতে পারেন। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ভালো আদর্শের লেখকও অনেক সময় উদ্দেশ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে বাক্য গঠনে বা ভাষার পরিবেশনে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে থাকেন। দুঃখজনকভাবে, প্রায় প্রতিবারই আমি লক্ষ করেছি যে, যখনই বাংলাদেশ থেকে কোন মুভি অস্কার প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়- তখন সেই মুভির সংশ্লিষ্টরা তথ্য বা খবরটা এমনভাবে প্রচার করেন যে, মুভিটি যেন অস্কার নমিনেশনই পেয়ে গেছে! যেখানে মুভিটি স্রেফ একটি প্রতিযোগী মাত্র। অস্কার নমিনেশনের বিষয়টা তো অনেক পরের ব্যাপার।

সত্যিই অস্কার নমিনেশন পাওয়াটা দিল্লী বহু দূরের মতো। কিন্তু এতো সহজভাবে প্রতিযোগী মুভিটির সংশ্লিষ্টরা এমন বিভ্রান্তিকর প্রচার করেন কিভাবে? তারা ভালোভাবেই জানেন, অস্কার নমিনেশন মোটেও সহজ ব্যাপার না। কিন্তু প্রতিযোগিতার জন্য পাঠানোটা অপেক্ষাকৃত সহজ। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগীর স্বল্পতায় সেটা আরও সহজ। প্রভাবশালী ইমপ্রেস গ্রুপের জন্য সেটা সহজতর।

ফরিদুর রেজা সাগর ইমপ্রেস মিডিয়ার একজন হর্তাকর্তা। মুভি অস্কার প্রতিযোগিতায় পাঠানোর মধ্যেই জড়িতরা সত্যিকারে অস্কার নমিনেশন পাওয়ার স্বাদ ও খ্যাতি উপভোগ করে ফেলতে চান। এই মোড়কটা কাজে লাগিয়ে বাড়াতে চান মুভি ও নিজের প্রচার, প্রসার ও ব্যবসা। বাগাতে চান দেশীয় পুরষ্কারগুলো। আমি যদি ব্যাপারটাকে শিল্পী মনের হীনমন্যতা বলে উল্লেখ করি, মনে হয় না যে এতে পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করা হবে।

আমরা চাই প্রতি বছর বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো মুভি নির্মিত হোক। বছরের সবচেয়ে সেরা মুভিটি অস্কার প্রতিযোগিতায় পাঠানোর জন্য নির্বাচিত হোক। আমরা চাই বাংলাদেশি মুভি অস্কারে নমিনেশন পেয়ে দেশকে গর্বিত করুক। আমরা চাই আমাদের চলচ্চিত্র একদিন অস্কার জিতে আমাদের অহংকারে পরিণত হোক। কিন্তু আমরা চলচ্চিত্রকর্মীদের মধ্যে কোন শঠকারী হীনমন্যতা দেখতে চাই না! ধরে নিলাম সাগর সাহেব আত্মপ্রচার করলেন।

কিন্তু প্রথম আলো এটি কি করলো! আনন্দ পাতাটির বিভাগীয় সম্পাদকের কি কোনই দায়িত্ব ছিল না? সাগর সাহেব একটা লেখা পাঠালেন, পড়ে না দেখেই লেখাটি ছেপে দিলাম - বিষয়টা কি এমন? 'সাগর সাহেব একজন বিখ্যাত মানুষ, তার লেখায় এডিটিংয়ের দরকার নেই, চলচ্চিত্র শিল্পের নতুন কোন ছেলে-পিলে যদি লিখতো তবে না হয় এডিট করতাম' - বিভাগীয় সম্পাদকের চিন্তা-ভাবনাটা যদি আনুমানিক এমন হয় তবে তো আশঙ্কাজনক! বুঝলাম প্রথম আলো ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম/চ্যানেল আইয়ের মধ্যে একটা পারষ্পরিক পিঠচাপরানি মার্কা সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা ড্রয়িংরুমেই সীমাবদ্ধ রাখুন প্লিজ! আমরা মিডিয়ায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল অফ ইনফরমেশন দেখতে চাই না। তথ্যের বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মানে হলো, তথ্যের মিশ্র উদ্দীপনা, সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে তথ্য উপস্থাপন, আংশিক সত্য, অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য, অসম্পূর্ণ তথ্য - মোট কথা তথ্যের এমন পরিবেশন যা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয় । আমার ঐ বন্ধুটিকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পর সে একটা গালি দিল। আমাকে না, যার বা যাদের জন্য প্রযোজ্য।

_______ ☛ নিজের প্রতি অবিচার, পাঠকের সাথে প্রবঞ্চনা ☛ প্রথম আলোর 'আনন্দ' পাঠকদের বিভ্রান্ত করেছে  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.