নিজের সম্পর্কে কিছুই লিখার নাই। প্রথম পর্বঃ দেবীর অভিশাপ
ঘুম এসে কখন চোখে লেগে গেল, চোখ বন্ধ হয়ে গেল, এরপর সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন দেখি পাখিরা কিচিরমিচির করে আমাকে ভোর পার হয়ে সকাল হয়ে যাবার খবর চুপিচুপি দিয়ে যাচ্ছে, সর্দারের ব্ঊ এর রান্নার ঘ্রাণ বলে দিচ্ছে খিদে লেগেছে। আশেপাশে নির্জনতা বলে দিচ্ছে আপু নেই। আমার তো আর ধরাবাধা কোন কাজ নেই তাই আমাকে তুলে দেয় নাই। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে চলে এলাম।
নাস্তার টেবিলে একধরনের আটার রুটি বানিয়ে রেখেছে অনেকটা আমাদের দেশের তন্দুর রুটির মতো তবে ওরা এটাকে বলে খাইয়েশ, আর সেই সাথে ভুটেকো কোখারা কো মাসু, সর্দারের কাছ থেকে নাম জেনে নিলাম, এটার ঘ্রান পেয়েই আমার ঘুম ভেঙ্গেছে নিশ্চয়ই, চিকেন দিয়ে বানানো এই পদটা ছিলো অসাধারন। ভরপেট খাচ্ছি আর ভাবছি সর্দারের বউয়ের কাছ থেকে রেসিপিটা জেনে নিতে হবে। এতো মজার ছিলো এই রান্না এখনো মুখে স্বাদ লেগে আছে, আর মনে পড়ে যাচ্ছে আমার আম্মু আর চাচীর রান্নার কথা। তারাও এতো চমৎকার রান্না করতে পারেনা। এই গ্রাম্য মহিলার রান্নার হাত কি অসাধারন।
খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো সর্দারের সাথে, উনিই জানালেন আপু সকালেই পাশের একটা ছোট্ট তাবুতে গেছে ওখানেই ডঃ শীধু রায়ের যত গবেষণা চলছে। ওদের সাথে জয়েন করতে ইচ্ছা করছিলো কিন্তু তার চেয়েও বেশি টানছে আশে-পাশের প্রকৃতি। আমি এ কথা সর্দারকে জানালাম আর বললাম আমার সাথে একজন লোক দিতে। সর্দার কথা রেখেছেন, উনি একটা ছেলে ধরে নিয়ে এলেন যে কিনা বাংলায় কথা বলতে পারে নাম কালিম্পং। আমি অবশ্য পছন্দ মতো ওর নাম শর্ট করে নিয়েছিলাম, কালি, এই কালি পরবর্তীতে অনেক কাজে এসেছে এবং এখনো আসছে, আজ ও না থাকলে আমি কোন অবস্থায় থাকতাম, চিন্তা করতে পারি না।
কালির সাথে বের হয়ে এলাম সর্দারের ঘর থেকে আর ভাবছিলাম সর্দারের বউ আমার সামনে একবারের জন্যেও আসেনি, আর সর্দার নিজেও খুব অদ্ভুত আচরন করছে, চোখের দিকে তাকাচ্ছে না, আর যা বলছি সেটাই করার জন্যে আপ্রান চেষ্টা করছে। উনার এই বাড়তি আগ্রহ একদম ভালোভাবে নিতে পারছিলাম না, কিন্তু যেহেতু উপকারেই আসছে তাই আর মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না কারন তাতে যদি হিতে বিপরীত হয়।
হটাত করেই চোখের সামনে পড়লো নদী, পাহাড়ি নদী। এত্ত সুন্দর আমি সব চিন্তা ওখানেই স্থগিত করলাম। আর পাশে তাকালাম হায় ! কালি নেই।
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটা উপুড় হয়ে আমাকে প্রনাম করছে। আমি একবারেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম, ওকে টেনে তুললাম। কালির বয়স হবে কমপক্ষে ২৫ থেকে ২৬, তাগড়া জোয়ান এই ছেলে একটা ১৬ বছরের কিশোরীকে প্রনাম করবে এটা মেনে নেয়ার মতো নয় তা যত সংস্কারই থাকুক। তখন কি ভাবতে পেরেছিলাম, আমার চমকাবার এই শুরু, যার শেষ আজ অবধি হয়নি। ওকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এমন করলা কেন? ও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েই আছে কিছুই বলছে না।
কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরও কোন উত্তর যখন পেলাম না। বুঝলাম, এ রহস্যের আপাতত সমাধান আশা করা বৃথা। তাই কথা চালিয়ে তাকে সহজ করার জন্য আমাদের সামনে অবিরাম বইতে থাকা নদীটার নাম জিজ্ঞেস করলাম। । ও এবার প্রথম কথা বলল এটা হচ্ছে মেছি নদী, এর উৎপত্তি হিমালয়ে সেখান থেকে এই নদী নেপাল এবং ভারতের সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়েছে, একসময় ভারতের ভিতরে প্রবেশ করে মহানন্দার সাথে মিশে গেছে।
মাথা থেকে সব চিন্তা বাদ দিয়ে অপরূপ এই পাহাড়, নদী, চা বাগান আর গোর্খাদের জীবন ধারা দেখতে লাগলাম। সেই সাথে কালির কাছ থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে খোজ নিচ্ছিলাম। যতটা জেনে নেয়া যায়, তত ভাল।
কালি গোর্খা পরিবারের ছেলে হলেও সে পড়াশুনা করেছে এখানকার একটা মিশনারী স্কুলে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক দিয়েছে, আর এই চা বাগান গুলোর বেশিরভাগ কর্মকর্তা, কর্মচারী বাঙ্গালী হবার কারনে বাংলা ভাষাও শিখে ফেলেছে।
ওর কাছ থেকেই জানলাম গোর্খাল্যান্ডের ইতিবৃত্ত। ওরা একটি স্বাধীন প্রদেশ চেয়েছিলো ভারত সরকারের কাছে, ওদের এই চাওয়া অযৌক্তিক কিছুই নয়, কারন যেসব শর্ত পুরন করলে ভারতে স্বাধীন রাজ্যের সন্মান পাওয়া যায় তার সবগুলোই ওরা পূর্ণ করেছে। ওরা আশাবাদী খুব শীঘ্রই ওরা একটা স্বাধীন প্রদেশ পেয়ে যাবে। ভাবছিলাম ছেলেটা বেশ রাজনীতি সচেতন। হাঁটতে হাঁটতে চা বাগানের মধ্য দিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছি কখন জানি, আসলে এতো সুন্দর প্রকৃতি এখানে যে সময়ের হিসেব থাকে না, আমারো থাকতো কিনা কে জানে যদি ঐ বুড়িটা সামনে না আসতো।
হটাত করেই একটা বুড়ি লাঠি হাতে নিয়ে দৌড়ে এসে নাকি উড়ে এসে আমাদের চমকে দিল। কোথা থেকে এল সে কে জানে। একদম কাছে আসার আগে না আমি, না কালি, কেউই বুঝতে পারি নি তার অস্তিত্ব। এসেই সামনে গড় হয়ে প্রনাম করলো আর মা পুনি, মা দেবী আরো কিসব গোর্খা ভাষায় বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রথমটা তো ভেবেছিলাম বুঝি লাঠি দিয়ে আঘাত করেই বসবে কিন্তু কিসের কি।
বুড়িকে এটা সেটা বলে অনেক কষ্টে ফেরত পাঠিয়ে দিলো কালি। আমি কালিকে এবার চেপেই ধরলাম, আমাকে জানতেই হবে, কি এমন রহস্য আমাকে ঘিরে। এবার আর সে চুপ করে রইলো না, ততক্ষনে বেশ সহজ হয়ে এসেছে আমার সাথে। খুব ভক্তি ভরে সে বলল মা আপনি কাল এর সব কথার উত্তর পাবেন। অবাক হলাম আমাকে মা ডাকার জন্যে, এমনকি ঐ বুড়িটাও আমাকে মা ডেকেছে।
ফেরার পথেই পেলাম আরো কিছু চমক, দেখি পুরো রাস্তার দুই পাশে অজস্র পাহাড়ি গোর্খা গড় হয়ে প্রনাম জানাচ্ছে আমাকে। জানিনা এমন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় কিংবা কি করা উচিত। তবুও জানিনা কেন অমন একটা কাজ করলাম, ওদের প্রত্যেকের মাথায় হাত রাখলাম, আর ওরা একজন একজন করে উঠে দাঁড়ালো, ওদের চোখের কোণে চিকচিক করা পানি দেখতে পাচ্ছিলাম, সন্ধ্যের লাল মায়াবী আলোয় সে এক অপার্থিব দৃশ্য। একজন কোথা থেকে জানি একটা লম্বা কাঠের বাক্স এনে দিলো। আমি নিতে অস্বীকৃতি জানালাম, কিন্তু কালি বলল মা এটা নিন, এটা আপনার।
আমার মানে? আমি আবার কালিকে জিজ্ঞেস করি। ও আবার বলল কাল এর উত্তর পাবেন। লম্বা বাক্সটা নিয়েই সোজা সর্দারের বাসা অভিমুখে রওনা দিলাম। কিন্তু সর্দারের বাসায় গিয়ে দেখি সর্দারের বউ ছাড়া আর কেউ নেই, ভদ্রমহিলা সামনে এসে প্রনাম করে নিলো তারপর হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলতে লাগলো মা ও দেবী মা আমার বাচ্চাদের ফিরিয়ে দাও।
কালিও ততক্ষনে বিদায় নিয়েছে কাজের কথা বলে। আমি অনেক কষ্টে সর্দারের বউটাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলাম।
একটু পরেই সবাই এলো। আপুরা সম্ভবত কোথাও গিয়েছিলো সার্ভে করতে। আপু সেটা বলার জন্যেই উদগ্রীব হয়ে আছে আর আমি আমার ঘটনা বলার জন্যে।
মুলত আমি আর আপু সর্দারের ঘরে থাকি আর ভাইয়া আর ডঃ শিধু থাকেন ক্যাম্পেই। রাতে খাওয়া দাওয়া কোন মতে মুখে দিয়ে শেষ করেই আমাদের ছোট্ট রুমে চলে এলাম, আপু একটু পরেই আসবে, আপুর জন্যেই অপেক্ষা করছি, একটু গরম লাগছে, তাই জানালা খুলে দিলাম একটু বাতাসের জন্যে। এই অঞ্চলে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। জানালা দিয়ে ছাদের আলোতে পাহাড়ি ঢাল দেখতে পাচ্ছি, হটাত করেই আমি ওটা দেখলাম। গতরাতে যে জিনিস স্বপ্নে দেখেছি।
মাত্র এক পলক আর তারপরেই ওখানে কিছু নেই। হ্যালুশিনেশন ভাবতে পারতাম খুব সহজেই কিন্তু এতো এতো অদ্ভুত ঘটনা আজ ঘটেছে যে কোন কিছুই আর অসম্ভব মনে হচ্ছে না। অপলক জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি এর মাঝেই আপু চলে এলো। আপু এসে কিছু বলতে গিয়েও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। তারপর এক এক করে আপুর কাছে সব বললাম।
আপু শুনে ভীষণ চিন্তা করতে লাগলো। তারপর আপুই মনে করিয়ে দিলো তাহলে এক কাজ করি দেখি ঐ কাঠের বাক্সে কি আছে, আসলে এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম সর্দারের বউয়ের জন্য। টিক কাঠের তৈরি অতি পুরানো একটা বাক্স। কিন্তু ওটাতে লকার ব্যবহার করা হয়েছে। বেশ অদ্ভুত একটা ভাষায় লেখা কিছু শব্দ কিন্তু আমি ওটা বেশ ভালোভাবেই পড়তে পারছি , কেন কোন ব্যাখ্যা খুজে পাচ্ছি না।
আমি শুধু নিজের অগোচরেই কিছুটা অরধচেতনে নিজের ডাক নাম কোড হিসেবে ব্যবহার করলাম কারন ইতিমধ্যে গোর্খারা আমাকে এই নামেই ডেকেছে। পুনি ! কিরকির একটা আওয়াজ করেই খুলে গেলো হাজার বছরের পুরানো বাক্স। ওর মাঝে দেখলাম মখমলে জড়ানো, মনি মুক্তো খচিত অতি ধারালো একটা তরবারী।
বিঃ দ্রঃ পরবর্তী পর্ব সোমবার রাতে দেয়া হবে তবে সুযোগ এবং সময় পেলে কালকেও দিতে পারি। আর লেখা নিয়ে যেকোনো সমালোচনা সাদরে গৃহীত হবে।
বানান ভুল কারো চোখে পড়লে দেখিয়ে দিবেন শুদ্ধসহ। আমি শুধরে নিবো। সবাইকে ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্য। ভাল থাকুন। এডিটিঙের কাজ চলছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।