মিথ্যার পতন সন্নিকটে.......... প্রারম্ভ:
আমাদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে এদেশে কায়েম হবে একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। খাদ্য-বস্ত্রে দেশ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটবে। গড়ে উঠকে স্বাধীন জাতির পুঁজি। মানুষের মান-সম্মান এবং জানমালের থাকবে নিশ্চিত নিরাপত্তা।
দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে আইনের শাসন। সকল জনগণই হবে মর্যাদার অধিকারী, কর্তব্য ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন। কিন্তু হাতের মুঠোয় পেয়েও যেন আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পেলাম না!
আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও আমাদের কোন অভাব তো দূর হলোই না, বরং যত দিন যাচ্ছে ততই যেন জাতি হিসেবে আমরা মর্যাদাহীন হয়ে পড়ছি, নিস্তেজ হয়ে পড়ছি। বুক ভরা আশা-স্বপ্ন আজ রূপান্তরিত হয়েছে গ্লানি ও হতাশায়। সম্মান, জাতীয়তাবোধ, মর্যাদাবোধ, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ এ সবকিছুই যেন বিধ্বস্ত।
এক কথায়, বিবেক আজ বিভ্রান্ত। সুবিধাবাদ এবং অযোগ্যতার মহড়ায় গোটা জাতি আজ নীরব, নিশ্চল, অসহায় ও যিম্মী।
স্বাধীনতার পর বিগত বছরগুলোতে যারাই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারাই দেশ ও জাতিকে নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করেছে। দেশ ও জাতিকে নিজেদের ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত জমিদারী হিসেবে ব্যবহার করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। এ ব্যাপারে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের তো জুড়িই নেই।
আজ বিদেশীরা নয়, আমরা নিজেরাই যেন আমাদের শত্রু! ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাচ্যুত শাসক মহল সমূহের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের নাটক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছে আজ অপরাধী এবং আসামীর চেহারা অত্যন্ত পরিষ্কার। দেশের ১৬ কোটি মানুষ নিশ্চয়ই অপরাধী কিংবা আসামী নয়।
কারচুপিমূলক নির্বাচন আর ষড়যন্ত্রমূলক বন্দুকের নলের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কেউই এদেশের জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়নি। মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরার শপথ নিলেও স্বাধীনতা ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবধি প্রত্যেকটি সরকারই কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্মূল করার লক্ষ্যেই বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।
শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করার কঠিন শপথসম্পন্ন চেতনার নামই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
তাই মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিতরণ করা কিছু জমি, বাড়ি, টাকা, তাদের কিছু পদোন্নতি, গড়ে তোলা লাল ইটের কিছু স্তম্ভ। ব্যস! মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা রক্ষাকারীদের জীবন ধন্য! এভাবে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত চেতনা লালনকারীদের নাটক। এ জাতির উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে ব্যক্তি, দলীয় এবং গোষ্ঠীর স্বার্থে অতি নির্দয়ভাবে ঠেলে দিয়েছে বিলাসের পথে, ধ্বংসের পথে। গণ-মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থান এ সবের কোনো বিহিত না করেই শাসকগোষ্ঠীসমূহ আত্মমগ্ন রয়েছে নিজস্ব ভোগ-বিলাসে।
শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান প্রমুখের যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্ন না টেনে এ সত্যটি আজ নির্দ্বিধায় আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতাই উভয় নেতার অস্বাভাবিক তিরোধানের অন্যতম কারণ।
তবে তাদের হত্যার সুষ্ঠু বিচার হওয়া দরকার। তবে, কে করবে কার বিচার? এদেশে কি আজ পর্যন্ত আইনের শাসন কায়েম হয়েছে?
‘খুনের বিচার চাই’ ‘রক্তের প্রতিশোধ চাই’ এ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে ধাঁচের রাজনীতি জন্ম দেয়া হচ্ছে, সে রাজনীতি পারবে কি সমস্যা জর্জরিত দেশের ১৬ কোটি মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধান দিতে? অন্য কিছু নয়, শাসক-শোষক এবং রাজনীতির প্রতি জনগণ আজ চায় প্রথমত তাদের মৌলিক সমস্যার সমাধান।
আইনের শাসনের অবর্তমানে এ জাতির রক্ত ঝরেই চলেছে, সমান গতিতে চলছে নারীধর্ষণ, নির্যাতন। বিচার নেই, আছে শুধু হাহাকার- কান্না। এই ন্যায় বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই আজ প্রয়োজন সাহসী-দুর্বার গণ-জাগরণ।
শোষণমূলক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে আইনের শাসন বলতে যা বুঝায় তা কেবল শাসকগোষ্ঠীর জন্যই আইন লংঘন এবং আইন অপপ্রয়োগ করার বেশুমার ক্ষমতা।
আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন জনগণকে প্রশাসনমুখী করে তোলে, প্রশাসন এ অবস্থায় কখনো জনমুখী হয় না। এ প্রশাসন জনশক্তির বিকাশ সাধনে ব্রতী নয়, জনশক্তিকে অসহায়ভাবে প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল করে তোলাই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের লক্ষ্য।
তাই সত্য আজ দিবালোকের মতই পরিষ্কার যে, বিগত বছরগুলোতে গঠিত সরকারসমূহ সুপরিকল্পিতভাবেই একটি স্বাধীন জাতিকে আত্মবিধ্বংসী পথে ঠেলে দিয়েছে। এ জাতির স্বপ্নিল ভবিষ্যতকে করে তুলেছে অনিশ্চিত ও অন্ধকার।
প্রচলিত রাজনীতি বুলি সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যর্থতা থেকে কোন সংগঠনই মুক্ত নয়। ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে বহু সংখ্যক নেতা ও কর্মী হারিয়েছে রাজনৈতিক চরিত্র। আত্মনিবেদিত রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সার্বিক মুক্তির প্রশ্নটি জনগণের কাছে আজ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
জুলুম, নির্যাতন, মেশিনগান, ট্যাংক যে জাতির যাত্রাপথকে করতে পারেনি রুদ্ধ, সেই জাতিটিই আজ অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধে ঝরানো তাজা রক্তের বিনিময়ে এটাই কি ছিল এ জাতির প্রাপ্য?
জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ উপহাস, কৌতুক ও করুণার পাত্র। ভাবখানা এমন যেন মুক্তিযোদ্ধারা ছিল এক শ্রেণীর কামলা যাদের কাজ ছিল হানাদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে দেশীয় কিছু অসৎ সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিক এক শ্রেণীর রাজনীতিকদের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেয়া। সবরকম মানবিক, সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েও তারাই হবে দেশের প্রভু এবং মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে তাদেরই কামলা!
মুক্তিযোদ্ধাদের আজ একটা কথা পরিষ্কারভাবে জেনে রাখতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া জাতির মুক্তিযোদ্ধারা কারো দ্বারা পুনর্বাসিত হয় না, বরং মুক্তিযোদ্ধারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়। তাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে তারাই সমাজের পুরানো কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিনির্মানের মধ্য দিয়ে সমাজের শোষিত-নিগৃহীত শ্রেণীসমূহকে পুনর্বাসন করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নে ব্যাপারটি ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো।
মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের লোকদেখানো চীৎকার কোন সদিচ্ছার চীৎকার নয়, এটা হচ্ছে প্রকৃত পাওনাদারকে তার প্রাপ্য থেকে প্রতারিত করার এক গভীর ষড়যন্ত্র। পুনর্বাসন প্রয়োজন কাদের? অক্ষম শ্রেণীরই পুনর্বাসন প্রয়োজন হয়। যোদ্ধারা কোনদিনই পুনর্বাসনের পর্যায়ে পড়ে না। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের সমতুল্য কোন বিনিময়ও নেই। যে জাতির যোদ্ধারাই পুনর্বাসনের স্তরে নেমে যায়, সে জাতির পুনর্গঠন তো দূরে থাক, তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বই হয়ে পড়ে বিপন্ন।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরব কোন বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা কোন দল বিশেষের নয়। এমন একটি ঐতিহ্যময় গৌরবকে যখন কোন বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা কোন রাজনৈতিক দল কিংবা মুক্তিযুদ্ধে সহকারী কোন দেশ বা জাতি একক কৃতিত্বের দাবিদার হয়, তখনই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল বিতর্কিতই হয়ে ওঠে না, জনমনেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জন্ম নেয় নানারূপ সংশয় এবং সন্দেহ। মূলত বাস্তবে ঘটেছেও তাই।
স্বাধীনতা অর্জনের দাবীদার আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতার ঘোষক বলে কথিত জিয়া সরকারের আমলেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই মুক্তিযোদ্ধারা হয়েছে নাজেহাল! মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযোদ্ধারাই হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের চরম শত্রু।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি একই হয়ে থাকে, তাহলে এই দু:খ ও লজ্জাজনক বিভক্তি, শত্রুতা এবং নিধন প্রক্রিয়া কেন? তাহলে এই মুক্তিযুদ্ধের পেছনে আসল রহস্যটা কী?
মুক্তিযুদ্ধপূর্ব তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান:
আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি-ভিত্তিক নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় লাভ সমগ্র জাতিকেই উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের বিজয় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী নয় এবং আওয়ামী লীগ বহির্ভূত সাধারণ জনগণও আওয়ামী লীগের বিজয়ে অভূতপূর্ব উল্লসিত হয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল কেবল তারাই, যারা ১৯৭০ এর সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত হয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিল। তারা আওয়ামী লীগের বিজয়ে খুশি তো হতে পারেইনি, বরং শংকিত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।
তখন থেকেই তাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূত বিজয়ের পেছনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কারসাজি ছিল।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমার (লেখক) মত একজন সাধারণ লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার মনে এ প্রশ্নগুলো নিভৃতে উঁকি-ঝুঁকি মারে এ কারণেই যে, ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতের হিংস্র ছোবলের সাথে সাথেই (তৎকালীন) পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যবর্গ কি করে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে পরিচিত ভারতের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণের জন্য ছুটে যেতে পারল? কোন সাহসে, কিংবা কোন অবস্থার উপর ভর করেই বা তারা দলে দলে ভারতের মাটিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল? তাহলে কি গোটা ব্যাপারটিই ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত? তাহলে কি স্বাধীনতাবিরোধী বলে পরিচিত ইসলামপন্থী দলগুলোর শঙ্কা এবং অনুমান সত্য ছিল? তাদের শঙ্কা এবং অনুমান যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে দেশপ্রেমিক কারা? আমরা মুক্তিযোদ্ধারা না রাজাকার- আলবদর হিসেবে পরিচিত তারা? এ সংশয় ও প্রশ্ন সত্ত্বেও যুদ্ধ করার কারণ হল- ষড়যন্ত্রের কালোহাত না দেখলেও দেখা গেছে গণহত্যা। তাই রুখে দাঁড়ানোকে দায়িত্ব মনে হয়েছে।
সত্তুরের শেষ এবং একাত্তুরের শুরুর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনগণের মাঝে বিজাতীয়দের প্রতি চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হলেও ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি, অথবা ধর্মহীনতা তাদের পেয়ে বসেনি। তৎকালীন সময়ে কট্টর আওয়ামী লীগার বলে পরিচিত নেতা-কর্মীদের মুখে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নাম-গন্ধও খুঁজে পাইনি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দামাল তরুণ-যুবকদের অধিকাংশই ছিল এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সন্তান-সন্ততি। যুদ্ধের রক্তাক্ত ময়দানেও আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি নামায পড়তে, দরূদ পাঠ করতে।
আজ যারা ইসলামের কথা শুনলেই পাগলা কুকুরের মত খিঁচিয়ে ওঠেন তারা কি আদৌ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী নাকি প্রায় ৯০% মুসলিমের এই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন-মানসিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী?
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের আচার-আচরণ, উৎসব-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধের এক খোঁচায়ই কি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? এটা কি কারো খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল, না বাস্তবতা-নির্ভর?
সশস্ত্র গণবিষ্ফোরণ:
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘পিপলস পাটি’ এবং পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে- নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় লাভ করে। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত পক্ষে পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় অঞ্চলের জনগণই যে স্পষ্ট রায়টি দিয়েছিল তা ছিল ‘আর এক রাষ্ট্র নয়, আমরা দুটি ভিন্ন রাষ্ট্র, আমাদের আশা-আকাংখা, স্বপ্নসাধ এবং চাহিদা ভিন্নতর’।
উভয় দেশের জনগণের রায়ই যেন দুই দেশের জন্য দুটি ভিন্ন পতাকা রচনার সিদ্ধান্ত দিয়ে দিল।
জাতির জন্য স্বাধীনতা অর্জনই যদি শেখ মুজিবর রহমানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে ৭ মার্চের এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদানের পর তিনি কি করে শত্রুপক্ষের সাথে বৈঠকে বসার আশা পোষণ করেছিলেন? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল সামরিক সরকার প্রধান ইয়াহিয়া খানের সাথে স্বাধীনতা ঘোষণার পরে পুরনায় শেখ মুজিবুর রহমান কেন বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণাকারী শেখ মুজিবুর রহমান এর কি ধরনের প্রত্যাশা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে? যার যা আছে তাই নিয়ে জাতিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ প্রদান করার পরে কোন ভরসায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে আপোসরফার আলোচনার টেবিলে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? তাহলে কি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা চাননি? তিনি কি চেয়েছিলেন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে পৌঁছতে? জাতিকে চূড়ান্ত ত্যাগের জন্য নির্দেশ দিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো তাগের প্রস্তুতি না নিয়ে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কেনই বা শত্রুপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন? এখানেই খুঁজতে হবে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণ। তাঁর নেতৃত্বের সংকট স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয়েছ উঠেছে এখানে।
অধিকতর ত্যাগের দৃষ্টান্ত পেশ না করে কেবল নেতৃত্ব দানের লোভ এবং মোহ থাকলেই কি প্রকৃত নেতা হওয়া যায়?
শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার দোদুল্যমানতা এবং সংশয়ই তাঁকে স্ববিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত করেছে। তাই ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’ এ ধরনের মন্তব্য করতে যেমন তার বাধেনি, তেমনি বাধেনি মুক্তির সংগ্রাম ঘোষণা করা পরেও শত্রুপক্ষের সাথে আলোচনার টেবিলে বসার জন্য অপেক্ষা করতে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে এক বৈঠকে তিনি প্রকাশ্যে বলেও ফেলেছিলেন, “আমি যদি আপনার কথামত কাজ করি, তাহলে ছাত্র নেতারা আমাকে গুলি করবে, আর আমি যদি ছাত্র নেতাদের কথামত চলি তাহলে আপনি আমাকে গুলি করবেন, বলুন তো এখন আমি কি করি। ” শেখ মুজিবুর রহমান একদিকে ছাত্র নেতৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন, ঠিক তেমনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্ববিরোধী ভূমিকার জন্য ইতিহাস একদিন তাঁকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করালে তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
তবে, শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্ববিরোধী ভূমিকার জন্য জনগণের যুদ্ধ থেমে থাকেনি। ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী বাহিনী হিংস্র বর্বরদের মত নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সাথে সাথেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরোধের বারুদ জ্বলে উঠেছিল।
সে অবস্থায় নিরস্ত্র বাঙালিদের সশস্ত্ররূপ ধারণ করতে সময় লাগেনি। গণ-আন্দোলন অবশেষে রূপান্তরিত হলো সশস্ত্র গণ-বিস্ফোরণে। তবে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি বাঙালিদের জন্য ছিল দুর্ভাগ্য এবং ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য ছিল রাজনৈতিক বিপর্যয়।
১৯৭১ সালের সশস্ত্র গণ-বিস্ফোরণ শেষ পর্যন্ত যে একটি সফল মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিতে সক্ষম হয়েছে, তার কৃতিত্ব কোন একক নেতৃত্বের নয়, সমগ্র সংগ্রামী জনগোষ্ঠীই সে কৃতিত্বের দাবিদার। জনগণের সশস্ত্র বিস্ফোরণই প্রয়োজনের তাগিদে বিকল্প নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা:
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রচন্ড বাক-বিতন্ডা হয়ে থাকে। তর্কের কারণও রয়েছে প্রচুর। একটি নেতৃত্বহীন স্বতস্ফূর্ত গণ-বিস্ফোরণকে যে যার মত পুঁজি করার চেষ্টা চালালে তর্ক তো সৃষ্টি হবেই।
এই সশস্ত্র গণ-বিস্ফোরণটি যে মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেবে, সে ধারণা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বসহ অনেকেরই ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনীও ঐ রকম বর্বর হামলা পরিচালনা করবে তেমন ধারণাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে ছিল না।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কোন ধরনের প্রস্তুতিই ছিল না, তাদের মনে ছিল কেবল ক্ষমতা দখলের রঙিন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। তারা যখন নির্দ্বিধায় মন্তব্য করেন যে, পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ ছিল আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত, এ ধরনের মন্তব্যই কি প্রমাণ করে না যে, তাদের মধ্যে যুদ্ধের চেতনা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত?
আওয়ামী লীগের বেশ উচ্চস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মন্তব্য পর্যালোচনা করে দেখলেই ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধের বিদ্যমান ধ্যান-ধারণার অধিকারী হলে আওয়ামী লীগের এ সকল উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই সতর্ক হয়ে যেতেন এবং যুদ্ধের জন্য নিদেনপক্ষে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বস্তুটি আসলে কি এবং কোথায় এর উৎপত্তি- সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বা ব্যাখ্যা কারো কাছেই পাওয়া যায় নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেক মহারথীই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক এক ধরনের ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার প্রয়াস নিয়েছেন।
যার যার মত সবাই সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যাও দিয়ে যাচ্ছেন। তবে, বক্তব্য-বিবৃতিতে সকলেই এক কথা- ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করতে হবে। ’ কারণ এত্থেকে সামান্য একটু হেরফের হয়ে গেলেই অমনি প্রমাণিত রাজাকারও একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ দাঁড় করাবে যে, অমুক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা যে কি এবং কাদের তা নিয়ে ‘রাজাকার’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আর কেউ তা তলিয়ে দেখতে চাচ্ছে না।
অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে নিতান্তই বাধ্য হয়ে- প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে, কেউ কেউ করেছে সুবিধা অর্জনের লোভ-লালসায়, কেউ করেছে পদ-যশ অর্জনের সুযোগ হিসেবে, কেউ করেছে তারুণ্যের অন্ধ আবেগ এবং উচ্ছ্বাসে এবং কিছু লোক অংশগ্রহণ করেছে ‘এডভ্যানচার ইজম’-এর বশে।
এসকল ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও সততারও তীব্র তারতম্য ছিল, কারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও যারা যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় এবং যুদ্ধোত্তর কালে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ করেছে, অপর বাঙালির সম্পদ লোপাট করেছে, বিভিন্নরূপ প্রতারণা করেছে, ব্যক্তিগত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রকৃত ও নির্দিষ্ট চেতনা যে সম্পূর্ণরূপেই অজানা ছিল তাতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই।
অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই বিস্তারিত জানত না তারা কোন কোন (আদর্শিক) লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে ঐ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কেবল একটি কথাই জানত- পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীসহ সকল অবাঙালিকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেশকে মুক্ত করতে হবে এবং পুনরায় বাপ-দাদার ভিটায় স্বাধীনভাবে ফিরে যেতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা এ কথাটি জানত না বা বুঝত না যে, কেবল অস্থানীয় শোষক গোষ্ঠী বিতাড়িত হলেই দেশ ও জাতি শোষণহীন বা স্বাধীন হয় না। অস্থানীয় শোষকের স্থানটি যে স্থানীয় শোষক এবং সম্পদলোভীদের দ্বারা অতি দ্রুত পূরণ হয়ে যাবে এ বিষয়টি সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জ্ঞান ও বোধশক্তির বাইরেই ছিল।
এ সত্যটি কেবল তারা তখনই অনুধাবন করল, যখন সদ্য স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরাসরি প্রত্যক্ষ করল শাসক আওয়ামী লীগ এবং তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ও সম্পদ ভাগাভাগি এবং লুটপাটের দৃশ্য ও মহড়া। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রকৃত ও সুনির্দিষ্ট চেতনায় যারা সমৃদ্ধ ছিল, তারা যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল আওয়ামী লীগের আচার-আচরণ দেশে ফিরে কি হবে।
সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাধারী সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তিসমূহ স্বাধীনতা উত্তরকালে আর আওয়ামী লীগের সহযোগিতা করে চলতে তো পারেইনি বরং স্বার্থপর এবং ভোগী আওয়ামী লীগের বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল না বা হতেও পারেনি, তারা মুক্তিযুদ্ধের পরে চরমভাবে আশাহত হয়েই বাধ্য হয়েছে যার যার পুরানো সামাজিক অবস্থানে ফিরে গিয়ে অতৃপ্ত আত্মার কেবল পরিতাপই ভোগ করে চলতে। সংখ্যায় তারাই অধিক এবং তাদের সাথে রয়েছে সমস্ত জনগোষ্ঠী, যারা পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের হয় সমর্থক ছিল, না হয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের সুফল লাভের বুকভরা আশায় অপেক্ষমান।
মুক্তিযুদ্ধে যারা তাদের আপনজনকে হারিয়েছে তারা যখন প্রত্যক্ষ করল স্বাধীনতা কেবল শাসক আওয়ামী লীগের লোকজনের জন্যই ভোগ এনেছে, তাদের জন্য নয়, তখন তারা রাতারাতিই আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই- যেখানেই প্রত্যাশা, সেখানেই হতাশা। এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় যারা আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থক ছিল, তারা দেশে প্রত্যাবর্তন করে যখন দেখল আওয়ামী লীগই তাদের ভিটে-ভূমি ‘শত্রু সম্পত্তি’র নাম দিয়ে দখল করে নিচ্ছে, তখনই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। বেকার ছাত্র-যুবক যখন দেখল স্বাধীনতা তাদের যোগ্য স্থান কিংবা কর্মসংস্থান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, শিক্ষক যখন দেখল স্বাধীনতা তার মান-মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হচ্ছে না, বুদ্ধিজীবী যখন দেখল সমাজে তাদের মূল্য নেই, সেনাবাহিনী যখন দেখল স্বাধীনতা তাদের গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হচ্ছে না, তখনই কেবল তারা নিজ নিজ মানসিকতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাখ্যা প্রদান করা শুরু করল।
মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন কিংবা সহযোগিতা করলেই কেবল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধা প্রকৃতপক্ষে তারাই কেবল হতে পারে, যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় পরিপুষ্ট।
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় যারা পরিপুষ্ট, তাদের মধ্যে হতাশা নেই, তাদের মধ্যে রয়েছে নবতর সংগ্রামের তীব্র যাতনা-দাহ।
মুক্তিযুদ্ধের জনক হিসেবে পরিচিত মরহুম জনাব শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে অবগত থাকলেও সেই চেতনায় তিনি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই ক্ষমতা লাভের পরে তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে মারাত্মক দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতা, যার ফলে তিনি কখনো হয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবার কখনো বা দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীত্বের। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের প্রায় সকলেই কেবল ক্ষমতার সখ মিটিয়েছে, কারণ, মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে ছিল কেবল ক্ষমতা লাভের হাতিয়ার মাত্র, চেতনার উৎস নয়।
এর বাইরে রয়েছে জনগোষ্ঠীরই আর একটি বিরাট অংশ যারা আদর্শগতভাবে পাকিস্তানের পক্ষে থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছে। এদের কাছে সেই ৭১ এও যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন মূল্য ছিল না, আজও তেমনি নেই।
এরা বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে কথিত শাসক গোষ্ঠীর ব্যর্থতা অবলোকনের পরে নিজস্ব যুক্তি, আদর্শ এবং অবস্থানের দিক দিয়ে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে বিরাজ করছে বর্তমানে। স্মরণ রাখা দরকার, যে মুক্তির জাগরণ মানুষকে একবার নিরাশ করেছে, সে মুক্তির আহ্বানে নতুন করে সাড়া না দেয়াটাই স্বাভাবিক। মুক্তির নতুন আহ্বানে সাড়াদান কেবল নতুন চেতনা জাগরণের মাধ্যমেই সহজ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকৃত অবস্থা:
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকৃত অবস্থা ছিল অনেকটা এ রকম: বাঙালির ভয়ে বিহারী পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আর বিহারী-পাকিস্তানীদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বাঙালি। অথচ কারো সঙ্গে কারো কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই, তবু ৭১-এর ২৫ মার্চের পরে শত্রুতার যেন কোন শেষও নেই।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিতে হামলা করছে বিভিন্ন শহরে বন্দরে। টার্গেট হচ্ছে মূলত তরুণ, যুবক, ছাত্র এবং শ্রমিক সমাজ। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। কেউ কেউ বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী থেকে ছুটে আসা তরুণ অফিসারদের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শিবির।
দলে দলে তরুণ ছাত্র যুবকেরা যোগ দিচ্ছে ট্রেনিং শিবিরে। সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ। সমগ্র রণক্ষেত্রকে ৯ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং নবম সেক্টরের দায়িত্ব অর্পিত হয় আমার (লেখকের) উপর। প্রায় সমগ্র দক্ষিণ বাংলা নিয়েই গঠিত হয়েছিল এই ৯ নম্বর সেক্টর। বৃহত্তর বরিশাল জেলা, ভোলা, পটুয়াখালী, ফরিদপুর এবং খুলনা সহকারে ৯ নং সেক্টর বস্তুত-পক্ষে ছিল বৃহত্তম সেক্টর।
কোন সেক্টরের আওতাধীন নয় এমনও অনেক স্বাধীন গ্রুপ ছিল যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় তৎপর ছিল। আরো কিছু বামপন্থী দল তাদের নিজস্ব উদ্যোগেই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। তারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেনি।
দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি দানা বাঁধতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি জন্ম নিল পুরাতন মুসলিম লীগ, নেজাম-ই-ইসলাম, জামায়াত-ই-ইসলামী সহ অন্যান্য ইসলাম ভিত্তিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনসমূহ থেকে।
তাদের যুক্তি হলো যে, তাঁরা বাঙালির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, তবে তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করার পক্ষে মোটেও নয়। কারণ হিসেবে তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন যে, পাকিস্তানী শাসক-শোষকের শোষণ-যুলুম থেকে মুক্ত হয়ে ভারতীয় শাসক-শোষকদের অধীনস্ত হওয়াকে স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচনা হওয়ার কোন যুক্তি নেই। তাঁরা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তিকে পাকিস্তানী আধিপত্যবাদী শক্তির তুলনায় অধিকতর বিপজ্জনক গণ্য করেছেন। তাদেঁর মতে, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মুসলমানদের বাসভূমি সৃষ্ট পাকিস্তানকে কেবল দ্বিখণ্ডিত করতে আগ্রহী নয়, বরং দ্বিখণ্ডিত করার পরে পূর্ব অঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশকে সর্বতোভাবেই গ্রাস করার হীন পরিকল্পনায়ও লিপ্ত। এমন যুক্তিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় সাধারণ দেশবাসী মনেপ্রাণে মেনে না নিলেও একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারেনি, কারণ এ কথা অতীব সত্য যে, এদেশের জনগণের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ভারতভীতি বিদ্যমান।
তবে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে তাড়া খাওয়া বাঙালি আত্মরক্ষার স্বার্থে ৭১ এর সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে ভারতের বুকেই নির্দ্বিধায় ঠাঁই নিয়েছিল এবং ঠাঁই সেথায় পেয়েছিলও। এই ঠাঁই লাভের পেছনে উভয় পক্ষেরই স্বার্থ জড়িত ছিল। স্বার্থ ছাড়া সাধারণত কখনো সন্ধি হয় না। বাঙালির স্বার্থ ছিল ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে দেশ মুক্ত করা, আর ভারতের স্বার্থ ছিল দেশ মুক্ত করার নামে তার চিহ্নিত এবং প্রমাণিত শত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে শত্রুপক্ষকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখা এবং মুক্ত বাংলাদেশের উপর প্রাথমিকভাবে খবরদারী করে পরবর্তীতে সময় ও সুযোগমত ভারতের সাথে একীভূত করে নেয়া। এটাকে শুধু কেবল তাদের নিছক স্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে, বরং এটা ছিল তাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন।
কেবল মনোবল এবং মানসিক প্রস্তুতিই যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট নয়, সাথে সাথে আধুনিক সমর অস্ত্রও যুদ্ধ জয়ের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। তাই, সমগ্র ৯ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব সেক্টরে বিভক্ত করে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা চালু রেখে আমি (লেখক) ২১ এপ্রিল কয়েকটি মোটর লঞ্চ সহকারে সুন্দরবনের পথ ধরে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। প্রধান লক্ষ্যই ছিল ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা। লে: জেনারেল জগজিৎ শিং অরোরা আমাকে (লেখককে) প্রথম সাক্ষাতে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারলেন না। স্বাক্ষী প্রমাণ দাবি করলেন আমার (লেখকের)।
তখনই আমাকে (লেখককে) সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন এবং সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী সাহেবের নাম নিতে হয়েছে। উত্তরে জেনারেল অরোরা সাহেব আমাদের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে যা বাজে মন্তব্য করলেন, তা কেবল ‘ইয়াঙ্কী’দের মুখেই সদা উচ্চারিত হয়ে থাকে। সোজা ভাষায় তাঁর উত্তর ছিল “ঐ দু’টা ব্লাডি ইঁদুরের কথা আমি জানি না, ওদের কোন মূল্য নেই আমার কাছে। অন্য কোন সাক্ষী থাকলে আমাকে বলো। ” অমনি আমি (লেখক) জেনারেল অরোরাকে অতি স্পষ্ট ভাষায় একজন বিদ্রোহীর সুরে জানিয়ে দিলাম যে, আমার অস্ত্রের কোনই প্রয়োজন নেই, আমি শূন্য হাতেই দেশের অভ্যন্তরে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করব তবু তাঁর কাছে আর অস্ত্রের জন্য আসব না।
চারদিন বন্দী অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাকে (লেখককে) বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে কোলকাতার সেই বৃটিশ রচিত দুর্গ ফোর্ট উইলিয়ামের অন্ধকূপ থেকে আমি (লেখক) মুক্তি পেয়ে জনাব তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাই।
দেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণকে হিংস্র দানবের মুখে ঠেলে দিয়ে কোলকাতার বালিগঞ্জের আবাসিক এলাকার একটি দ্বিতল বাড়িতে বসে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভা সহকারে (খন্দকার মোশতাক আহমদ বাদে) নিরাপদে তাস খেলছিলেন দেখে আমি (লেখক) সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রতি চরমভাবে আস্থাহীন এবং বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমি (লেখক) আমার সকল ক্ষতিকে নীরবে মাথা পেতে নিয়েই আওয়ামী লীগের এই দায়িত্বহীন, উদাসীন এবং সৌখিন মেজাজসম্পন্ন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। যে জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণকে যুদ্ধের লেলিহান শিখার মধ্যে নিক্ষেপ করে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বেকার, অলস যুবকদের মত তাস খেলায় মত্ত হতে পারে, সে জাতির দুর্ভাগ্য সহজে মোচন হবার নয়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আচরণে এ ধরনের ভূরি ভূরি নমুনা রয়েছে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় তাদের আরাম-আয়েশী জীবনধারা কোলকাতাবাসীদেরকে করেছে হতবাক।
এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঔদার্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উত্তরোত্তর কলংকময় করে তুলতে সহায়তা করেছে। অপরদিকে, কোলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের অফিস থাকলেও ক্ষমতার সকল উৎসই ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী সাহেব একজন ‘সম্মানিত বন্দীর’ জীবন যাপন করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার সুযোগ ছিল না তাঁর।
সেক্টর পরিদর্শন করা তো দূরেরই কথা তাঁর তরফ থেকে লিখিত নির্দেশও তেমন কিছু পৌঁছতে পারেনি সেক্টর কমান্ডারদের কাছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র প্রদান নয়, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জরুরী তথ্য সংগ্রহই ছিল যেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মূল উদ্দেশ্য। তাঁদের এ ধরনের আচরণই তাদের গোপন লালসা পূরণের ‘নীল নকশা’ তৈরি করার ইঙ্গিত প্রদান করেছে। আমার (লেখকের) এ সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি।
ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবির:
তরুণ-যুবকদের ভীড় যতই বৃদ্ধি পেতে লাগল, ততই আমি (লেখক) আশাবাদী হয়ে উঠলাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সম্পর্কে।
ভেতো বলে ঘৃণিত একটি জাতি রাতারাতি যে কোন ‘মার্শাল রেস’ বা যোদ্ধা জাতির ন্যায় সগর্বে দাঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্যে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কেবল আহমকই বনে যায়নি, দারুণভাবে ভীত-সন্ত্রস্তও হয়ে পড়েছিল। বর্ডার অতিক্রম করতে সক্ষম হলেই ট্রেনিং ক্যাম্প এর সন্ধান লাভের আশায় ‘চলো চলো বর্ডার চলো’ শ্লোগানের মধ্য দিয়ে দিন-রাত ছুটে গিয়েছিল মুক্তিপিপাসু কিশোর, তরুণ, যুবক।
কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শিবির স্থাপনের ব্যাপারে কোন ধরনেরই অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। এই ট্রেনিং শিবিরগুলোই মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়ার ক্ষেত্রে ‘নিউক্লিয়াস’ বা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। এই কৃতিত্বের দাবিদার ঐ সকল দেশপ্রেমিক বাঙালি আর্মি অফিসার এবং ব্যক্তিবর্গ, যারা সবরকম ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ‘নিউক্লিয়াস’ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
এক্ষেত্রে বাংলাদ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।