একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা টানা কয়েকদিনের কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। দুদিনের ছুটি নিলাম, নৈমিত্তিক ছুটি। আজকে দ্বিতীয় দিন। আজকের সারাদিনটা কাটালাম শুয়ে বসে খিচুরী খেয়ে ঘুমিয়ে আর গান শুনে। আর কিছুনা।
ছুটির প্রথম দিন অর্থাৎ গতকাল একটা কান্ড করে ফেলেছি। একটা নাটকের আবহ সংগীত করেছি। যাকে কায়দা করে বলা হয় সংগীত পরিচালনা। একরকম হঠাৎ করেই কাজটার শুরু। অনেকটা এক্সপেরিমেন্টাল।
নিজেও বুঝিনি শেষ পর্যন্ত আদৌ পারবো কিনা।
নাটক বানায় রাজীব আমার বিশেষ স্নেহ ভাজন। ও নাকি আমাকে চেনে প্রায় তিন বছর, বন্ধুবান্ধব মারফত। কিন্তু সামনা সামনি পরিচয় হলো মাস তিনেক হল। পরিচয় পর্বটি নাটকীয়তায় ভরা।
সে প্রসংগ থাক। পরিচয়ের পর থেকেই ছেলেটি আমাকে “কেমন যেন একটা ” (!!) ভাবতে শুরু করেছে। আমি যাই বলি তাতেই সে মূগ্ধ, তাতেই তার আস্থা। কাজ না থাকলে প্রায়ই কোন কারণ ছাড়াই আমার অফিসে এসে বসে থাকে। অফিসে আমার পিসিতে হালকা সুরে গান বাজে, সেটা শোনে।
এমনি বসে থাকে, কোন ডিসটার্ব করেনা। কোন বইয়ের কথা যদি বলি ‘অমুক বইটা পড়েছো’? পরদিনই সে কিনে পড়ে ফেলে। অমুক ফিল্মটা দেখছো? পরদিনই দেখি ডিভিডির দোকানে গিয়ে ফোন দেবে “ ভাই ছবিটার নাম কি যেন বলছিলেন?” তো রাজীবকে একদিন কথায় কথায় বললাম, “তোমরা কি সব মিউজিক কর নাটকে, চরম বিরক্ত লাগে। কি এক ট্রেন্ড শুরু হল। ঢিস টাক ............শশশশশশশশশশশশশ.......ঝ্যাননননননননননননননন এই সব শব্দ।
করুন দৃশ্য মানে সেই একই মিউজিক। অথচ সত্যজিত রায় তার ফিল্মে কি দারুন ভাবে শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যবহার করেছেন। পথের পাঁচালিতে দূর্গার মৃত্যু সংবাদের সময় রবিশংকর যে পিসটা দিলেন, সর্বজয়ার কান্নার চেয়েও সেটা করুন হয়ে উঠেছিল। গান্ধী ছবিতে ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদটা কি অসাধারণ লেগেছে!গান্ধীর ভারত ভ্রমণ আর ট্রেনের শব্দের সাথে কি দারুন ভাবে মিশে গেছে! হীরক রাজার দেশেতে প্যারডী মত কতগুলি হাসির গান, সেখানেও শাস্ত্রীয় সংগীতের কি অসাধারণ ব্যবহার। বাঘমামা তুমি যে এঘরে কে তা জানতো, কিংবা দেখরে নয়ন মেলে .....হিন্দুস্তানী রাগ সংগীতের কি চমতকার ব্যবহার”।
রাজীব বলল “বস আমি মিউজিক বুঝিনা। এডিটিং এর পর মিউজিক ডিরেক্টররে দেই সে’ই বানায়া দেয় একটা কিছু”।
আমি ফট করে বলে ফেললাম তোমার নেক্সট নাটকে আমি মিউজিক করে দেব,দেখি। ওমা রাজীব সত্যি সত্যি কথাটা ধরে বসে আছে। রাজীব নতুন একটি কাজ ধরলো।
শ্যুটিং শেষ। এডিটিং ও শেষ। এবার মিউজিক। শেষ মূহুর্তে ভয় পেয়ে গেলাম। হবে তো?।
বেইজ্জতি না হই! রাজীব মুখে বলল অবশ্যই হবে। আগের দিন মনে হয় রাজীব ও ভড়কে গেল। বস আপনি না হয় কোন স্টুডিও কন্ট্রাক করে ফেলেন। একজন কি-বোর্ডিস্ট নিয়ে কাজটা করেন। আমি বললাম “নো কি বোর্ড।
আগে দেখি কি হয়। পুরাই ক্ল্যাসিকেল মিউজিকের উপর একটি কাজ হবে। একদমই না হলে মিউজিক ডিরেক্টর অমিত কে নিব। ”
অমিত আমাকে বেশ পাত্তা দেয়। ওকে কিছু বললে সাথে সাথে সাড়া দেয়, ঘুরায় না।
অমিত কে মনে মনে রিজার্ভ বেঞ্চে রেখে কাজে বসে গেলাম।
আলমারী খুঁজে খুঁজে ইয়াহুদী মেনুহিনের ভায়োলিন আর রবি শংকরের সেতারের যুগল বন্দি, পন্ডিত ভবানী শংকরের পাখোয়াজ, জাকির হুসেন এর তবলা, নাম না জানা একজনের জলতরংগ আর ওস্তাদ আমীর খান,রশিদ খানের তারানা নিলাম। পুঁজি হিসেবে খারাপ না। প্যানেলে বসে খুঁজে খুঁজে এর থেকেই একটু একটু করে পিস কেটে কেটে রেডী করলাম। এরপর বসাতে লাগলাম।
টেলিফিলমের একটি জায়গায় মোশাররফ করিম মানসিক দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত হয়ে একা গাড়ি নিয়ে চলে আসে একটা নির্জন জায়গায়। একরকম ভাঙাচোরা একটা অভিব্যক্তি নিয়ে ফোন করে তার স্ত্রী কে। তারপর আবার চলে যায় একটা বিভ্রান্ত মানুষের মত। নিজের ব্যক্তিগত পরাজয়ের সাথে মোশাররফ করিমের সেই অভিব্যক্তিতে যখন রশিদ খানের রাগ ঝিঁঝুটিতে (আসল নাম ঝিনঝোটি। এটা হিন্দি উচ্চারণ ।
বাংলায়ন করে ঝিঁঝুটি বলা। ) গাওয়া তারানা টা বসিয়ে দিলাম রাজীব একরকম চিৎকার করে উঠলো আনন্দে। আমি ও অবাক। এত অদ্ভূত ভাবে মিলে গেল কি করে! নাটকটি শেষ ও করেছি রশিদ খান দিয়েই।
এভাবে স্টক মিউজিক দিয়ে নাটক বা টেলিফিল্মের মিউজিক করার ভেতরে তেমন কোন কৃতিত্ব নেই।
এটা একরকমের চোরামী ও বলা চলে। ফারুকীর শিষ্য ছবিয়াল রা বিদেশী সিনেমা আর কিটারো থেকে নিয়ে এই কাজ অহরহ করে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আনন্দিত বাংলা নাটকের দর্শকদের কিছু ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মজা উপহার দিতে পারবো এই কথা চিন্তা করেই।
টেলিফিল্মটির নাম ‘টেস্ট’। সামনে ঈদে প্রচার হওয়ার কথা।
এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অপেক্ষায় রইলাম। দেখি কি হয় শেষ পর্যন্ত।
পুনশ্চ: এই টেলিফিল্মের নাট্যকার মোশাররফ করিম। অনেকেই জানেনা মোশাররফ করিম লেখক হিসেবে খুবই ভাল।
ভাল কবিতা লিখে । মাঝে মাঝে গান ও লেখে। প্রচুর পড়েন, ঘর ভর্তি বই। গানের রুচি ও ভাল। মেহেদী হাসানের গজল সে ভাল গায়।
অন্তত আমি মূগ্ধ হয়েছি। এই টেলিফিল্মটি সে নিজে লিখেছে। ডিরেকশনেও তদারকী করেছে। পুরো কাজটাতেই তিনি ভীষণ ভাবে ইনভলভ। কারণ এটা তার প্রথম লেখা।
মিউজিকে তার থাকবার কথা ছিল। একজন আ্যামেচার মিউজিক করবেন শুনে তিনি একটু চিন্তিত। তার থাকা হলোনা। তিনি এখন বিদেশে। তবে রাজীব কনফিডেন্ট।
তার ধারনা তার মোশাররফ ভাই নিশ্চিত এটা পছন্দ করবেন। ‘ভাই’ দেশে আসলে একটা পার্ট নিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে।
২৩.০৯.২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।