সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোরে আর আজকের এই অন্ধকারে করিম সাহেবের বাসায় ভয়াবহ গন্ডগোল হচ্ছে।
গন্ডগোলের কারন খুবই তুচ্ছ। এতো তুচ্ছ কারন নিয়ে গন্ডগোল হতে পারে সেটা কারো জানা ছিল না। সেজন্যই তারা গন্ডগোল করে খুবই মজা পাচ্ছে। তবে এই মুহুর্তে গন্ডগোল আর মজার পর্যায়ে নেই।
মজার গন্ডগোল রক্তারক্তির পর্যায়ে পৌছে গেছে।
গন্ডগোলের জন্য দায়ী করিম সাহেবের ছোট ছেলে অয়ন। তার অদ্ভুত একটা রোগ হয়েছে। এই রোগ এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। নতুন বছর, নতুন কাপড় মনের মাঝে ফুর্তি আনে।
নতুন রোগটি অয়নের মনে ফুর্তি আনতে পারে নি। সে খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। বিব্রত অবস্থা তার মাকে নিয়ে। বাবা কিছু না বুঝে মায়ের গায়ে হাত তুলেছে। সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।
কথা বলার চেষ্ঠা করেছিল। বলতে পারে নি। তার অদ্ভুত রোগটা তাকে বলতে দেয় নি।
রোগটা হয়েছে কয়েকদিন থেকে। রোগের প্রধান লক্ষন হচ্ছে কোন বাক্য একেবারে শেষ করা যাচ্ছে না।
বাক্য মাঝখানে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। এমন যায়গায় থেমে যাচ্ছে, যে অবস্থায় মানুষ শুধু ভুল বুঝতে পারে। এই অবস্থার পর সে চারিদিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে। চোখ পিটপিট করছে। কিছুক্ষন আগেও সে এই রোগে একবার আক্রান্ত হয়েছিল।
করিম সাহেব তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি? সারাদিন ডেকেও তোরে পাই না কেন?’
অয়ন তখন বাসায় ঢুকছিল। সে সকাল থেকে বাইরে ছিল। দুপুর বেলায় বাসায় ফিরছে। বাবার প্রশ্ন শুনে তড়িঘড়ি করে উত্তর করল,
‘ব্যস্ত ছিলাম। জুঁইদের বাসায় গিয়েছিলাম।
জুইকে রেপ...’
‘রেপ’ কথাটা বলেই অয়ন আটকে গেল। নতুন রোগটা তাকে আক্রমন করেছে। আশ্চর্য! আগের দুইটা বাক্য শেষ করা গেল। এটা গেল না?
রেপের কথা শুনে করিম সাহেবের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন।
হাত পা ছুড়াছুড়ি করতে লাগলেন।
‘এই শুয়োর কয় কি? এরে আমি পয়দা করি নাই। যে ছেলে দিনে দুপুরে একটা মেয়েকে রেপ করতে পারে সে আমার ছেলে না। ’
করিম সাহেবের স্ত্রী শায়রা বানু পাশেই ছিলেন। কাথা সেলাই করছিলেন।
স্বামীর জন্য। করিম সাহেবের ইদানিং সখ হয়েছে তিনি নাকি হাতে কাজ করা কাঁথার নিচে শুয়ে থাকবেন। মখমলের কম্বলের নিচে শুয়ে থাকলে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মখমলের কম্বল নাকি তাকে চেপে ধরে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে।
অয়নকে দেওয়া গালি শুনে শায়রা বানুর মেজাজ বিগড়ে গেল।
বৃদ্ধ বয়সে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। ভীমরতি ধরে। এই লোকের মাথায় ভীমরতি ধরেছে। অনেক হয়েছে- আর সহ্য করা যায় না। কিছু একটা করতেই হবে।
মাথায় একটা ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা যায়। এই কাজটা করলে অন্য সমস্যা আছে। পরকালে বেহেসত নসীব হবে না। স্বামীর পায়ের নিচে যে বেহেসত আছে সেটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। অন্য কিছু করতে হবে।
কথার যোগ্য জবাব, কথা দিয়েই দিতে হবে। ছায়রা বানু কঠিন কন্ঠে বলেন,
‘সন্দেহের কারন নাই। অয়ন তোমারই ছেলে। তুমিই ওর বাপ। ’
ছায়রা বানু স্বামীকে ‘তুই’ করে বলতে চেয়েছিলেন।
পারলেন না। শেষ সময় ‘তুই’ টা তুমি হয়ে গেছে।
‘কখনোই না। এই হারামজাদা আমার ছেলে হতেই পারে না। অন্য কারো বীজ আছে এই ছেলের মাঝে।
’
‘ওরে আল্লাহরে এই লোক বলে কি! বুড়াটা পাগল হয়ে গেছে। মাথায় সিট হয়েছে। ’ বলেই ছায়রা বানু ডুঁকরে উঠলেন।
‘খবরদার আমাকে পাগল বলবে না। আমি এই হারামীর ডি.এন.এ. টেস্ট করাব।
প্রমান করেই ছাড়ব এই ছেলে আমার না। ’
‘তোমার ছেলে না হলে কার ছেলে বলে মনে কর?’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন শায়রা বানু।
‘এই হারামজাদা মনিরুলের ছেলে। নাক-মুখ সব মনিরুলের মতো দেখতে হয়েছে। মনিরুল ব্যাটা টাকের টাক-মেদ-ভুড়ির বস্তা।
’
এই কথা শোনার পর ছায়রা বানু স্বামীর সাথে যুদ্ধে নেমে গেলেন। কোমর বেঁধে যুদ্ধ যাকে বলে। হেস্ত-নেস্ত একটা করতেই হবে। বাড়ীর সবাই তার পক্ষ নিল। কাজের ছেলে-মেয়ে সবাই এখন তার পক্ষে।
আর ভয় নেই। দল ভারী হয়েছে। বুড়োর ভীমরতি দূর করতেই হবে।
করিম সাহেব একা একদিকে পড়ে গেলেন। এরা সবাই হারামজাদার দল।
প্রতিদিন সবাই ওই পক্ষে যোগ দেয়। তাতে কি? তিনিও কম যান না। সবাইকে দেখে নিবেন।
যুদ্ধ চলছে। একপক্ষ আরেকপক্ষকে ভয়াবহ আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে।
দুই পক্ষই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দে সুচাগ্র মেদিনী” টাইপের পণ করেছে।
শায়রা বানু রনাঙ্গিনী রুপ ধারন করে বললেন,
‘তুমি যদি আরেকবার মনিরুলকেকে গালি দাও তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। ’
‘ভালো না হলে না হবে। আমি এর চাইতে আর ভালো করতে পারি না। ’
‘তুমি মনিরুলকে কেন আমাদের মাঝে আনছ?’
‘আনব নাতো কি চুমু দিয়ে রেখে আসব।
বিয়ের আগেই আমার মান-সন্মান ডুবিয়েছে। বিয়ের পর আরেকটা অভিশাপ রেখে গেছে। ’
ছায়রা বানু এ পর্যায়ে এসে আর কথা যোগ্য অস্ত্র খুজে পেলেন না। থেমে গেলেন। রণে ক্ষান্ত দিলেন।
মনের মধ্যে আঘাত পেলেন। পচিশ বছর ঘর করেও স্বামীর কথার অভিশাপ থেকে তিনি বের হতে পারছেন না।
বিয়ের আগে পণ করেছিলেন স্বামীকে খুব ভালোবাসবেন। কখনো কোন কথা নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখবেন না। নিজের অতীত ভবিষ্যত সব স্বামীর সাথে ভাগ করে নেবেন।
বাসর রাতে মনিরুলের সাথে বিবাহপুর্ব সম্পর্কের কথা কথা বলে ফেললেন। তেমন কোন ভয়াবহ কথা না।
মনিরুলের সাথে একদিন স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছেন। সিনেমার নাম ছিল “তিন কন্যা”। সিনেমা হলের অন্ধকারে তারা একসাথে বসেছেন।
কাহিনী এগিয়ে চলছে তরতর করে। কাহিনীর সাথে সাথে এগিয়ে চলছে মনিরুলের ক্ষিপ্রতা। মনিরুল অনেকবারবার তার শরীরে হাত দেবার চেষ্ঠা করছে। তিনি বারবার হাত সরিয়ে দিচ্ছেন। সরিয়ে দিতে অনেক কষ্ট হয়েছিল শায়রা বানুর।
মনিরুলের হাতে অনেক শক্তি।
মনিরুলের দেওয়া চিঠিগুলোও তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন। বাসর ঘরে তিনি চিঠিগুলো করিম সাহেবকে দেখালেন। অনেকদিনের জমানো চিঠি করিম সাহেবের হাতে তুলে দিলেন।
ছায়রা খাতুন ভয় পেয়ে গেলেন।
করিম সাহেব কথা বলছেন না। তিনি কি তার স্ত্রীর সত্যবাদীতায় মুগ্ধ হননি?
করিম সাহেব রাগ করলেন না। হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসির শব্দে খাট কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছায়রা বানু লজ্জা পেয়ে গেলেন।
ঘরের বাইরে শ্বশুরবাড়ীর লোকজন। হাসির শব্দ শুনলে তারা তাকে বেহায়া ভাবতে পারে।
করিম সাহেব শুধু হেসেই শেষ করলেন না। মনিরুলের সব চিঠি তিনি একটা একটা করে খুলে ছায়রা বানুকে নিয়ে পড়লেন। বানানের ভুল বের করে অট্টহাসিতে তিনি ফেটে পড়লেন।
বারবার বলছেন,
‘স্বতীত্বই বড় কথা। তুমি স্বতী নারী। গায়ে হাত দিতে দাও নাই। আমি আমার বউয়ের স্বতীত্বে মুগ্ধ। এই রকম স্বতী বউ কয় জনের ভাগ্যে জোটে? হা হা হা...’
শায়রা বানুর মনে হলো করিম সাহেব ভালো মানুষ।
দেবতার মতো মানুষ। এইরকম দেবতা স্বামী পাওয়া তার সাত পুরুষের ভাগ্য।
তিনি ভুল করলেন। করিম সাহেব দেবতার মতো মানুষ নন। তিনি রাবনরুপী দানব।
অয়নের জন্মের পর থেকে উঠতে বসতে এই রাবন তাকে মনিরুলের কথা বলে খেঁপাতে লাগল।
তিনি দেরীতে হলেও বুঝতে পারলেন কিছু কথা গোপন রাখা উচিৎ ছিল। মেয়েদের নিজস্ব একটা জগত থাকবে। গোপন কথা নিয়ে হবে এই জগত। এই জগতে অন্য কারো প্রবেশাধিকার থাকবে না।
পিতা-মাতা স্বামী-প্রেমিক সবাই এই জগতের জন্য নিষিদ্ধ। অবস্থা ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশাধিকার বিবেচরা করা যেতে পারে।
ছায়রা বানু বুঝতে পারলেন তিনি তার নিজের জগতটাকে হারিয়ে ফেলেছেন। করিম সাহেব তার এই জগতটাকে বাজারে বেঁচে দিয়েছে.........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।