সামনে মহা লড়াই পেছনে মৃত্যু! গেলাম কুয়াকাটা দেখতে। হয়ে গেলাম জেলে! ধরতে গেলাম ইলিশ। আহ! লোকমুখে কত শুনেছি ইলিশ নাকি সূর্যের আলো দেখার সাথে সাথে মারা যায়। আমরা অবিশ্বাসীর দল; শুধু শোনা কথায় আমাদের মন উঠেনা। বহুদিনের ইচ্ছা জ্যান্ত ইলিশ দেখব।
সেই ইচ্ছা এভাবে হঠাৎ পূরণ হয়ে যাবে চিন্তাই করতে পারিনি। এবার কুয়াকাটা ভ্রমণে গিয়ে সেই ইচ্ছা পূরণ হলো।
ভ্রমণের নেশা আজন্ম। তবু সামর্থ্য, সুযোগের অভাবে খুব একটা ঘোরা হয়নি। এবার রমজানে ঈদের আগে পরে মিলিয়ে প্রায় এগার দিন ছুটি পাওয়া গেল।
পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হল। ঠিক হল ঈদের আগের ৫দিন কাজে লাগাব। তিন জন তিন জায়গায় থাকি। একসাথে মিলিত হয়ে যাত্রা শুরু করতে গেলে প্রায় দুদিন এর মত নষ্ট হয়। তাই ঠিক করলাম আলাদা আলাদা ভাবে যাব।
গিয়ে একসাথে মিলব। আমার যাত্রা শুরু হল ফেনী থেকে। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭.৫০ এ মেঘনা এক্সপ্রেসে উঠলাম। গন্তব্য চাঁদপুর। রাত ১২ টায় পৌঁছলাম চাঁদপুর।
তার পর বরিশালগামী রকেটে উঠলাম। উফ কী ভয়াভহ। বসা দূরে থাক দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই। জীবনের প্রথম নৌ ভ্রমণ! রাত বাজে একটা। চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে ট্রেন ভ্রমণ করে শরীর চাইছে বিশ্রাম! আর এখানে দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই।
বাধ্য হয়ে রেলিংয়ের বাইরে দাড়িঁয়ে শক্ত করে রেলিং ধরে রইলাম। রেলিংয়ের বাইরে ফুট খানেক জায়গা। তারপর কালো নদী। এই ফুট খানেক জায়গাতেই আমি দাঁড়ানো। রেলিং থেকে হাত ফস্কে গেলেই হলো আরকি! দুচোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে।
ঘুমের ঘোরে না আবার হাত ফস্কে যায়! বরিশাল পৌঁছতে সকাল ৭.৫০-৮.০০। ৬-৭ ঘন্টা কীভাবে কাটাবো এই ভয়ে আতংকে আমার ভ্রমণের সাধ চিরতরে মিটে গেল। যারা রকেটে বা লঞ্চে ভ্রমণ করেছেন তারা জানেন যাত্রীরা ডেকে চাদর বিছিয়ে শুয়ে বসে আরাম করে যায়। আমাদের রকেটেও যারা আগে আগে উঠেছেন তারা কী সুন্দর চাদর বিছিয়ে শুয়ে বসে ঘুমাতে ঘুমাতে যাচ্ছেন! আর আমি হতভাগা রেলিংয়ের বাইরে একফুট জায়গায় দাঁড়িয়ে আতংকে কাঁপছি। যা হোক দু ঘন্টা কোন মতে পার করলাম।
এমন সময় আমার পাশে মেঝেতে যারা বসেছিল তারা একটু নড়ে চড়ে বসায় আধা বর্গফুটের মত জায়গা বেরুল। সুযোগ নষ্ট না করে তৎক্ষনাত বসে গেলাম! ঘুমের ঘোরে কেউ আপত্তি করল না। এবার আমার শরীর ভেতরে; পা দুটো রেলিংয়ের বাইরে । আহ! কী শান্তি! এতক্ষণ যে জার্নি কে মনে হচ্ছিল কখন শেষ হবে! কথন শেষ হবে! এখন মনে হতে লাগল চলুক যতক্ষণ চলতে পারে!
বিপদ!
রকেটের ভিতর এক বর্গ ইঞ্চি জায়গাও কেউ খালি রাখেনি। তাই এমাথা উমাথা যাতায়াত করতে চাইলে রেলিংয়ের বাইরে দিয়ে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেই একফুট জায়গা দিয়ে বিপজ্জনকভাবে যাতায়াত করতে হয়।
এই করতে গিয়ে যে কয়েকটি যুবক বারবার আসা যাওয়া করছিল তাদের একজন পানিতে পড়ে গেল। একদম আমার সামনে থেকে। প্রথমে ঘুমের ঘোরে কেউ খেয়াল করেনি। শুধু ঝুপ করে একটা শব্দ হল। তারপর শুরু হল হৈ চৈ! পূর্ণ গতিতে এগিয়ে যাওয়া রকেট থামাতে থামাতে অনেক সময় লেগে গেল।
তারপর উল্টো পথে ফিরতে লাগল সার্চ লাইট মারতে মারতে। একসময় পওয়া গেল লোকটাকে। আমার পক্ষে অন্ধকার নদীতে আধঘন্টা সাঁতার কেটে বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব হত। লোকটার দক্ষতার প্রশংসা করতেই হয়।
সকাল ৭.৩০ এ বরিশাল পৌঁছলাম।
সেখান থেকে বাসে পটুয়াখালী। আমার বন্ধুরা এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের সাথে বাসে করে কুয়াকাটা গেলাম। কুয়াকাটায় ঈদের আগে সব হোটেল মোটেল খালি। সরকারি একটা মোটেল আছে খুব সুন্দর।
কিন্তু আমাদের সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় জেলা পরিষদ ভিআইপি ডাকবাংলোতে উঠলাম। নামে ভিআইপি হলেও খুবই শস্তা। এটাও সরকারি। তারপর গেলাম বিচে। এখানে অনেক মোটরসাইকেল কুয়াকটায় দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য ভাড়ায় চলে।
একে রমজান তারউপর দুদিন পর ঈদ। পুরো সৈকতে পর্যটক নেই বললেই চলে। সব মটরসাইকেল চালক আমাদের পিছনে ঘুরতে লাগল। বিকেলের জন্য আমরা দুটি মোটর সাইকেল ঠিক করে ফিরে এলাম।
বিকেলে গেলাম পশ্চিম দিকে ।
এখানে সুন্দরবনের শুরুর অংশ দূর থেকে দেখা যায়। বীচের এদিকেও হালকা বন আছে। বনের অংশে বীচের শেষ মাথায় একটি ঝুপড়ি দোকান আছে। এখানে ইলিশ মাছ, কাঁকড়া পাওয়া যায়। আপনার সামনে কাঁকড়া ভেজে দেবে।
রাতে্ আবার গেলাম বীচে। ২০-২৫ টি নৌকা ছিল বালুর উপর। রাত ১১ টার মত বাজে। একটা নৌকার উপর বসে আছি। তারপর দেখি জেলেরা এসে একটা একটা করে নৌকা চালু করে সাগরে যা্চ্ছে।
জিজ্ঞাসা করে জানলাম সাগরে জাল পাতা আছে। সেখানে যাচ্ছে ইলিশ ধরা পড়েছে কি না দেখতে। দিনে দুবার যায় একবার রাতে এই সময়। আরেকবার দিনে ১২টার দিকে। শুনেই তো মন চঞ্চল হয়ে উঠল।
আমাদের নেবেন সাথে?জেলেরা বলল আমরা চাইলে দিনের বেলায় নিতে পারে।
আর কি চাই! পরদিন ১২ টার আগেই মাথায় গামছা বেঁধে আমরা তিনজন হাজির হলাম। নৌকার নিচে চাকা লাগিয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয় পানি পর্যন্ত। যখন যাচ্ছি তখন ভাটা। সমুদ্র অনেকটা দূরে।
তারপর খোলা নৌকায় ঘন্টা খানেকের যাত্রা। যে পর্যন্ত গেলাম সেখান থেকে তীর সরু রেখার মত দেখাচ্ছিল। মোট ২৫টা জাল পাতা ছিল। সবগুলো একটা একটা করে টেনে দেখা হল। ইলিশ পাওয়া গেল মোটে ৬টা।
তার মধ্যে চারটা মৃত। দুটা জীবন্ত! জাল থেকে ছাড়িয়ে নৌকায় নামানোর পর দুই বার মাত্র ঝাকি দিল। তারপর শেষ। তাহলে কথা সত্য । ইলিশ মাছ সূর্যের আলো দেখার সাথে সাথে মারা যায়।
আমাদের জীবন্ত ইলিশ দেখার সাধ পূর্ণ হলো!
তবে ইলিশ ধরা অত্যন্ত কষ্টকর মনে হলো। এবং কম মাছ ধরা পড়লে খরচেও পোষায় না! যাতায়াতে শুধু জ্বালানীই লাগে ৫ লিটার। মানুষ তিনজন । নৌকা, জাল। মাছ ধরা পড়ল মোটে ৬টা।
আর কী রোদ! উফ শরীরের চামড়া স্পষ্টত দুই রংয়ের হয়ে গেল। যেটুকুতে কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল সেটুকু এক রং। বাকী অংশ আরেক রং!আমরা জেলেদের ৩০০ টাকা দিলাম। এবং সেই সাথে আমাদের সাথে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। এর পর আরও একরাত একদিন কুয়াকাটায় থেকে সবগুলো দর্শনীয় স্থান দেখে ঢাকায় ফিরে এলাম।
একদিন পরেই ঈদ। এবার বাড়ি না গেলেই নয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।