আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষাঙ্গনে ফ্যাসিজম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো আইন

মানুষের সমাজে এক মুহূর্ত বাঁচতে চাই “ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায় সংগত দাবী-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে তাদের স্ট্রাইকের অধিকারকে বিশ্ববিদ্যালয় অস্বীকার করে না”- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আচরণ বিধির ধারা-২.১০ এ কথা বলা হয়েছে । তার মানে স্ট্রাইক শুধুমাত্র তখনই করা যাবে যখন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে “ন্যায় সংগত” মনে করে। গত বছরের বেতন-ফি বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র-ছাত্রীদের নামে ৪টি মামলা করেছিল কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে আসামী করে। অর্থাৎ, তারা সে দাবীকে ন্যায় সংগত মনে করেনি তাই স্ট্রাইক করা বে-আইনী!! “ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায় সংগত” স্ট্রাইক করার অধিকার আছে, কিন্ত আর যেসব ব্যবস্থা তারা রেখেছে তাতে আর স্ট্রাইক করার সুযোগ কোথায় থাকলো!!! ১৮ই ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে প্রক্টর অফিস থেকে প্রকাশিত হয় এই “ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্য পালনীয় আচরণ বিধি”। এই বিধিমালা শিক্ষার্থীদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে।

নানা ফ্যাসিস্ট অধ্যাদেশ ও “আচরণ বিধির” মাধ্যমে এক অগণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। । সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী ছাত্র রাজনীতির কাছে জিম্মি শিক্ষার্থীরা। হুমায়ূন আজাদ এখানে চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, “ওটা তো অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল”। কিন্তু কেন এই সব কালো অধ্যাদেশ, আচরণ বিধি ও অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে? এই প্রসঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।

বাংলাদেশের শাসকরা পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থ রায় সচেষ্ট এবং তার ফলে এদেশের গরীব ও মধ্যবিত্ত শোষণের শিকার হয়। পুঁজিপতি, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তথা সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারীতেই ব্যবস্থা থাকে বেশি। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের তারা যে ক্ষতি করে সে ব্যাপারটা তারা আড়াল করার চেষ্টা করে। যে বিষয়ে আড়াল করার সুযোগ থাকে না সেই ক্ষতিকে তারা সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী বলে প্রচার করে। এক্ষেত্রে তাদের ভাড়া করা দালাল বুদ্ধিজীবীরা বেশ বড় ভূমিকা রাখে।

এতকিছুর পরও যখন মানুষ তার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে তখন শাসকশ্রেণীর প্রয়োজন হয় শক্তি প্রয়োগের। রাষ্ট্র তার আইন-কানুন-সংবিধানের মাধ্যমে হরণ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের অধিকার। আন্দোলন সংগ্রামের উপর রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন তখন হয় আইন সম্মত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও একই ধারা অনুসরণ করা হয়। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরণের ফ্যাসিস্ট আইন-কানুন কঠোরভাবে জারি থাকে।

সমাজের অগ্রসর অংশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দুরে রাখতে পারলে শাসকশ্রেণী নিজেদের বেশ নিরাপদ মনে করে। সে কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জারি করা আছে অনেকগুলো ফ্যাসিস্ট অধ্যাদেশ। প্রক্টরিয়াল বিধিমালার ধারা-২.২ এ বলা হয়েছে “প্রশাসন ও পুলিশ যে কোন সময় একজন ছাত্রের ব্যক্তিগত দ্রব্যাদি তল্লাসি করতে পারবে এবং ছাত্রদের কোন আপত্তি দন্ডনীয় অপরাধ বিবেচিত হবে। ” ধারা-২.১৩ তে বলা হয়েছ “মাগরিবের আজানের সাথে সাথে ছাত্রীদের হলে প্রবেশ করতে হবে এবং এ নিয়ম যথাসম্ভব কঠোরভাবে পালন করা হবে। ” এ যেন মধ্যযুগের কোন মাদ্রাসা!! একবিংশ শতাব্দীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সূর্যাস্ত আইন!! অনেক প্রতিবাদের পরও প্রশাসন এই আইন পরিবর্তন করেনি।

ধারা-২.৩ এ আছে “একাডেমিক কার্যক্রম চলাকালে মিছিল, সমাবেশ, মাইক্রোফোন ব্যবহার ও স্লোগান দেয়া যাবে না। এর লংঘন দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। ” ধারা-২.৪ এ আরো এক ধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে “প্রক্টরের অনুমতি ব্যতীত কোন ছাত্র সংগঠন বা গ্রুপ সভা বা মিছিল করতে পারবে না। তবে অনুমতি নিয়ে সভা বা মিছিল করতে পারবে। ” তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষা কার্যক্রম থাকবে না অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা থাকবে না তখন প্রক্টরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যত ইচ্ছা তোমার অধিকারের কথা বলো!!! এছাড়া ধারা- ২.৫, ২.৭, ২.১১ তে বলা হয়েছে “হলে নির্ধারিত স্থানে অনুমতি নিয়ে সভা করতে হবে।

অন্যথায় অপরাধ গণ্য করা হবে। প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া মিছিল, সভা, সমাবেশ করা যাবে না। সকল সংগঠন প্রক্টরের দপ্তরে নিবন্ধিত হতে হবে। কমিটির এবং এক সপ্তাহের মধ্যে নব গঠিত কমিটি সদস্যদের সকলের ছবি প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। ধর্মঘট করার অধিকার থাকবে কিন্তু পিকেটিং করা যাবে না।

পোস্টার ও দেয়াল লিখন নিষিদ্ধ। ” মনে হচ্ছে সামরিক সরকার কর্তৃক জারিকৃত জরুরী অবস্থা! ধারা- ২.১৮ তে বলা হয়েছে “বাইরের কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাস ও হলগুলোতে কোন সংগঠন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারবে না। কোন সংগঠন কিংবা কোন ছাত্র-ছাত্রী এই ব্যাপারে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ” অর্থাৎ জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন ঘটনায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ বা সংহতি প্রকাশ করা যাবে না। সরকার যেহেতু ছাত্র সমাজ ও দেশের ব্যাপক অধিকাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না তাই তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

তাছাড়া শাসকশ্রেণীর প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ সকল সাম্রাজ্যবাদের দেশে দেশে আগ্রাসন ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধের প্রতিবাদের কন্ঠ তারা রুদ্ধ করবেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে তেল-গ্যাস-কয়লাসহ সকল জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়ার ও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের কাছে বন্দর, করিডোর তথা দেশ লিজ দেয়ার চুক্তির বিরুদ্ধে তারা কথা বলতে দিবে না। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়কে শাসকশ্রেণী সুপরিকল্পিতভাবে সীমাবদ্ধ চিন্তার কারাগার বানাতে চায়। এ তো গেল “আচরণ বিধি”। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জারি থাকা আরো কিছু কালো কানুনের একটি হল ভর্তি পরিক্ষার সময় কোন সংগঠন পরীক্ষার্থীদের জন্য “সহায়তা কেন্দ্র” করতে পারবে না।

তবে বাস্তবত এ আইন কার্যকর শুধু মাত্র প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে, ছাত্রলীগ বা শিবির তাদের কর্মকান্ড ঠিকই চালিয়ে যেতে পারে। গত সংসদ নির্বাচনের পর সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ তাদের দখল ও তান্ডব শুরু করে। শিবিরের সাথে ও তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্যাম্পাসে প্রায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে থাকে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে (সূত্র: সিনেটের ২১ তম বার্ষিক সভায় উপাচার্যের ভাষণ, ২৮ জুন ২০০৯), যা আজো তুলে নেওয়া হয়নি। এর ফলে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মকান্ড চালাতে কোন অসুবিধা না হলেও বন্ধ করা হলো শোষিত জনগণ ও শিক্ষার্থীদের পক্ষের কণ্ঠস্বর সমূহকে।

ক্যাম্পাসে কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনকেও অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হয়। এমনকি কোন ঘরোয়া অনুষ্ঠানও শর্ত ও প্রক্টরের অনুমতি সাপেক্ষে করতে হয়। শিক্ষার্থীদের তো বটেই দেশের ব্যাপক অধিকাংশ জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে শাসকশ্রেণীর যে কোন কর্মসূচীর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রসৈনিক। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তা খুব ভাল করেই জানে, কারণ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের ফলেই তো তাদের হাতে আজ রাষ্ট্র ক্ষমতা। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যদি শোষিত জনগণের পরে কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা যায় তবে তা পুঁজিবাদী শোষণ নির্বিঘ্ন করবে।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জারীকৃত সকল কালো অধ্যাদেশ, “ছাত্র আচরণ বিধি” ও অগণতান্ত্রিক পরিবেশ মূলত পুঁজির শোষণ নির্বিঘ্ন করার জন্যই সৃষ্টি। ["ছাত্র আন্দোলন" 'সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-১১' সংখ্যায় প্রকাশিত। ] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.