বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সোনালী ইতিহাস ছাত্রদের আন্দোলনের কাছে অসাধারন ঋনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্বাধীনতার পরে ছাত্ররাজনীতির কোনো স্বচ্ছ এবং গঠনমুলক ধারা গড়ে উঠে নি আমদের শিক্ষাপ্রতিস্টানে। দলীয় রাজনীতি আর আধিপত্য প্রতিস্টার লড়াইয়ে শিক্ষাপ্রতিস্টানগুলো পরিনত হয়েছে বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে। এর সাথে চাদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ভর্তিবানিজ্য এসব তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষে ছাত্র ছাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা সারা পৃথিবীতে বিরল হলেও বাংলাদেশে প্রায় নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোর সেশন জট নামক বিষয়টা কত অদ্ভুত আর অপরিচিত তা কেবল বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসলেই টের পাওয়া যায়।
সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিস্টানগুলো আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে মারা যান শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি নোমানী। এর ধারাবাহিকতায় গত ৯ ফেব্রুয়ারী একই ধরনের আরেকটি সংঘর্ষে মারা যান ছাত্রলীগ নেতা ফারুক। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আরেকজন অরাজনৈতিক ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একজন কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় সরকার সারা দেশে শিবিরের বিপক্ষে অভিযানে নেমেছে। শিক্ষাপ্রতিস্টানে সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য দমনের লক্ষ্যে এবং হত্যাকান্ডের মত দুখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্ত্রির রোধে সরকারের যে কোনো আন্তরিক প্রচেস্টা এবং কঠোর পদক্ষেপ অবশ্যই সাধুবাদ যোগ্য। কিন্তু কেবল একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করেই কি এই নৈরাজ্যমুলক অবস্থা থেকে উত্তরন সম্ভব? শিক্ষা প্রতিস্টানে এই নৈরাজ্য এর জন্য কি একক ভাবে শিবির দায়ী? শিবির দমন করলেই যদি শিক্ষাপ্রতিস্টানে সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই অবশ্যই আমরা এই অভিযানের পক্ষে। কিন্তু এই নৈরাজ্যের দায়ভার যদি পুরোপুরি শিবিরের না হয়, তাহলে এটি কি রাস্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমনের মত বর্বরতায় পরিনত হবে না?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একজন কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় সরকার উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের খুজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করবে এমন টাই আশা ছিল সবার। কিন্তু তা না করে কোনো প্রকার তদন্ত হওয়ার আগেই সরকার ঘোষনা দিয়ে সারা দেশে শিবিরের বিপক্ষে একটা ঢালাও ধড়পাকড়ের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশবাহিণীকে।
করিতকর্মা পুলিশ শিবিরের এক নেতাকে গুলি করেও মেলে ফেলেছে ইতমধ্যে। পুলিশ নিজেই যখন একই সাথে বিচারকের আসনে বসে যায় তখন আইনের শাসন ভুলুন্ঠিত হওয়ার আর বাকি থাকে কি?প্রথম হত্যাকান্ডের পর সরকার যন্ত্রের উদাসীনতা আর দ্বিতীয় হত্যাকান্ডের পর সরকারের অতি উতসাহী হয়ে সারা বাংলাদেশে অভিযান চালানো সামগ্রিক ভাবে নিরপেক্ষ আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আরেকজন অরাজনৈতিক ছাত্র হত্যার ঘটনায়ও সরকারের নিস্পৃহভাব আমরা খে্যাল করেছি। নোমানী হত্যার ঘটনায় সরকারের এবং বিশ্যবিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর ভুমিকা না নেয়াই কি আরেকটি হত্যাকান্ডকে অনিবার্য করে তোলে নাই?এখন ফারুক হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ বিচার না হলে এবং এর রাজনীতিকরন হলে ভবিষ্যতে আইনের শাসনের প্রতি যে অবিশ্বাস জন্ম নেবে তাকি আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে না?
একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দেয়। একটি হত্যাকান্ড আরেকটি হত্যাকান্ডের পথ প্রস্তুত করে।
একটি অবিচার আরেকটি অবিচার আর আইন হাতে তুলে নেবার পরিস্থিতি তৈরি করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ২৪ জন ছাত্র প্রান হারিয়েছে বিভিন্ন সংঘর্ষে। এর মধ্যে ১৬ জন ছাত্রশিবিরের, ৮ জন অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের হামলায় শিবিরের ৮ জন মারা যায়। এই সময় শিবিরে হাতে অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কেউ মারা যায় নাই।
১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শিবিরের ৬ জন এবং শিবিরের হাতে অন্যদের ৭ জন মারা যায়। ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত শিবিরের ১ জন মারা যায় কিন্তু শিবিরের হাতে কেউ মারা যায় নি। এই পরিসংখান থেকে কয়টি বিষয় স্পস্ট ভাবে উঠে আসে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংঘর্ষের যে রাজনীতি, শিবির তার একটি অংশ। অধিকাংশ সংঘর্ষ শিবিরের সাথেই অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের হয়েছে।
এই রাজনীতিতে শিবির যতটা সন্ত্রাস করেছে তার চাইতে অনেক গুন বেশী সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে সে। লক্ষনীয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হাতে অন্যদের যে পরিমান নিহত হয়েছে তার দ্বিগুন নিহত হয়েছে শিবিরে্র নিজের লোক অন্যদের হাতে। ১৯৮২ সালের ১১ই মার্চ শিবিরের নবাগত সংবর্ধনা অনুস্টানে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রির ব্রাশ ফায়ারে একসাথে ৪ জন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই হত্যার রাজনীতি শুরু হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শিবির একতরফা ভাবে সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের হামলায় শিবিরের ৮ জন নিহত হলেও শিবিরের হামলায় একটাও হত্যাকান্ড ঘটে নাই।
১৯৯০ এর পরে শিবির সমান তালে জড়িয়ে পরে এই সংঘর্ষ আর হত্যার রাজনীতিতে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত শিবিরের নিহত হয়েছে ৬ জন আর শিবিরের হাতে নিহত হয়েছে ৭ জন। ৯০ দশকে শিবিরের এই সংঘর্ষ আর হত্যার রাজনীতিতে জড়িয়ে পরা কি আত্মরক্ষামুলক অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াস ছিল নাকি সন্ত্রাসী হয়ে উঠার লক্ষন? ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত জামাতে ইসলামী ৪ দলীয় জোটের অংশীদার ছিল। এই সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের একজন মারা গেলেও শিবিরের হাতে অন্য কোনো সংগঠনের কেউ নিহত হয় নাই। শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ই না, এই সময়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারনে কোনো নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে নাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিস্টান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কখনই আধিপত্য প্রতিস্টার সুযোগ পায় নাই। এখানে বেশীরভাগ সময়ই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য থাকে। শিক্ষাপ্রতিস্টানে সন্ত্রাস যদি শুধু শিবিরের সাথে সংশ্লিস্ট বিষয়ই হবে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর থেকে মুক্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ৭৫ জন ছাত্র নিহত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠনের পারস্পরিক এবং আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সংঘর্ষে।
এর মধ্যে শিবিরের সাথে সংশ্লিস্ট ঘটনা নেই একটি ও। ঢাবির এই হত্যাকান্ডের সংখ্যা দেশের অন্যান্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট হত্যকান্ডের যোগফলের চাইতেও বেশী। কাজেই বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অধপতিত এই চেহারাটা দীর্ঘদিনের অবক্ষয় আর জাতীয় রাজনীতির দেউলিয়াত্বেরই বহিপ্রকাশ। যারা একে শুধুমাত্র ছাত্রশিবিরের সাথে জড়িয়ে দিতে চান তারা সামগ্রিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র। বর্তমান সরকারের প্রথম বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নৃশংস ভাবে খুন হয়েছে ২৫১ জন যাদের অধিকাংশই সরকারী দলের সন্ত্রাসের কারনে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগের হামলায় খুন হয়েছে শিবিরের সেক্রেটারী, ছাত্র মৈত্রির একজন কর্মীও মারা গেছে কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের হামলায়। আমরা সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনাই এই ঘটনায়,সংবাদপত্রগুলোকেও দেখিনাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে। যাদের কাছে নোমানীর হত্যাকান্ডে মানবতা লুন্থিত হয় না কিন্তু ফারুক হত্যাকান্ডে যাদের বিবেক হঠাত করে জেগে উঠে, যাদের কাছে ছাত্রলীগের কর্মীর জীবনের মুল্য আর ছাত্রশিবিরের কর্মীর জীবনের মুল্য সমান না,যারা একটি হত্যাকান্ডের বিচারের পরিবর্তে অব্যাহত ভাবে বিচার বহির্ভুত প্রতিশোধের হত্যাকান্ডকে উতসাহিত করেন তাদের দ্বারা আর যাই হোক একটা গনতান্ত্রিক সমাজ বিনবির্মান আদৌ সম্ভব না বলেই মনে হয়।
ছাত্রলীগ বাংলাদেশের অনেক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এদেশের অনেক অর্জনের সাথে তাদের নাম জড়িয়ে আছে।
ছাত্রদল একসময় জিয়ার তারুন্যকে ধারন করে তরুন প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছাত্রশিবির এর নেগাটিভ ইমেজ এর পাশাপাশি অনেক ভাল দিক ও আছে। ছাত্রলীগ,ছাত্রদল, ছাত্রশিবির- এই সব ছাত্র সংগঠনগুলো আ্মাদের রাজনীতির অংশ, আমাদের ভবিষ্যত। এদেরকে মেধার প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সন্ত্রাসের প্রতিযোগিতায় টেনে নামানোর মধ্যে আমাদের কারো কোনো লাভ হবে না। অথচ বর্তমান সরকার ছাত্রলীগকে প্রশ্রয় দিয়ে আর বিরোধী দলকে দমন নিপীড়নের মাধ্যমে সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সবাইকে।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই ছাত্রলীগ চাদাবাজী, টেন্ডারবাজী,গ্রুপিং আর প্রতিপক্ষ হত্যার খেলায় মেতে উঠেছে। রাজশাহীতে নোমানী হত্যায় আর ঢাবিতে আবুবকর হত্যায় সরকার যে উদাসীনতা প্রদর্শন করেছে আর ছাত্রলীগের পক্ষ হয়ে যেমন করে অন্যান্য ছাত্রসংগঠন দমনে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছে, তাতে ছাত্রলীগকে আরো বেশী উতসাহ দেয়া হল অধপতনের পথে। এর মধ্য দিয়ে সাময়িক ভাবে হয়তো ক্ষমতা কিছুটা প্রলম্বিত হবে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মৃত্যু ঘটবে গৌরবজনক ছাত্ররাজনীতির। মরনের পালা বোধহয় আগেই শেষ, এবার লাশের গায়ে শেষ পেরেক ঠুকার পালাই শুধু।
ছাত্রলীগের এই নৈতিক অধপতন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকার ছাত্রশিবির আর ছাত্রদলকেও দমন নিপিড়নের মাধ্যমে নির্মুল করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরপেক্ষ প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিস্টার মাধ্যমে সহাবস্থান আর পড়াশুনার নিশ্চিত পরিবেশ তৈরির পরিবর্তে নৈরাজ্যের শর্ত বজায় রাখছে। তার সাথে সরকার যন্ত্র আর পুলিশ প্রশাসনের দলীয় ব্যবহার জন্ম দিচ্ছে অনাস্থা আর প্রতিবাদের। এর ফলাফল কখনই ভালো হবে না। একটি সম্ভাবনাময় জাতি হিশাবে আমাদের যে অগ্রযাত্রার সুজোগ ছিল তা ব্যহত হবে মাত্র। সরকারের কাছ থেকে তাই প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ কাম্য না।
সকল ছাত্র সংগঠনের প্রতি নিরপেক্ষ দৃস্টিভঙ্গী প্রয়োজন। সরকার কাউকে প্রশ্রয় দিয়ে শেষ করে দিচ্ছে, কাউকে দমন নিপিড়ন চালিয়ে শেষ করতে চাচ্ছে। আখেরে ক্ষতি হচ্ছে সমগ্র ছাত্র রাজনীতির, ছাত্রসমাজের, দেশের, মানুষের। আমদের সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।