আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রমনী রহস্য ও বিজ্ঞান

নারী সম্পর্কে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পূজারিণী কবিতায় লিখেছেন- “এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি! ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ। ” আবার লিখেছেন- “নারী তুমি ছলনাময়ী, দেবতারাও বুঝেনি তোমাদের মন। ” অন্যদিকে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি- “আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি। ” আবার অন্য এক জায়গায় তিনিই লিখেছেন- “বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। ।

” তিনি নারীকে এক শক্তিশালিনী আত্মগরিমায় অভিভূত হিসেবে প্রদক্ষিণ করেছেন। নিজের জীবনেও নারী এক মহিমান্বিত রূপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নারীকে ভালোবেসেছেন এবং নারীর কাছে নানাভাবে ঋণ স্বীকার করে কবিত্ব শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন। লুৎফর রহমান সরকার লিখেছেন- নারী হলো অনবদ্য শিল্প সৃষ্টির প্রধান অনুপ্রেরণা, যুবতীর দেহের ভাজেঁ ভাজেঁ শত শত কবিতা লুকিয়ে থাকে। কোন এক জায়গায় কারো একটি লেখা পড়েছিলাম- “নারী! তোমার পানে চেয়ে থেকে আমি হাসতে হাসতে নরকে যেতে পারি।

” কথায় বলে- নারীর ষোল কলা। আবার এও বলা হয়- যে জীবনে কখনও নারীর ষোল কলার রূপ দর্শন করে নাই, কিইবা মূল্য আছে তার জীবনের? এছাড়া এমন কোন কবি সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যিনি নারীর রহস্য সম্পর্কে দু’চার লাইন লিখেননি। কালান্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- “প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টিপ্রক্রিয়া গভীর গোপন, তার স্বতঃপ্রবর্তনা দ্বিধাবিহীন। সেই আদিপ্রাণের সহজ প্রবর্তন নারীর স্বভাবের মধ্যে। সেইজন্য নারীর স্বভাবকে মানুষ রহস্যময় আখ্যা দিয়েছে।

তাই অনেক সময়ে অকস্মাৎ নারীর জীবনে যে সংবেগের উচ্ছ্বাস দেখতে পাওয়া যায় তা তর্কের অতীত-- তা প্রয়োজন-অনুসারে বিধিপূর্বক খনন করা জলাশয়ের মতো নয়, তা উৎসের মতো যার কারণ আপন অহৈতুক রহস্যে নিহিত। ” নারী কখনও করুণাময়ী, মমতাময়ী, কখনও রুদ্রমূর্তি। কখনও আবেগী, কখনও উচ্ছাসী, কখনও লাস্যময়ী, আবার কথনও ছলনাময়ী, কখনওবা অগ্নিমূর্তি। কখনও ভালবাসা, কখনও প্রেম, কখনও বিষন্নতার কাল ছায়া, আবার কখনও ভালবাসার নীল দংশন। বাস্তবিকই দেবতারাও বুঝেনি তাদের মন।

নারী কেন এমন রহস্যাবৃত? পুরুষ কেন নয়? কি এর কারণ? মানব-মানবীর সম্পর্ক, মিল-অমিল কিংবা প্রেম-অপ্রেম নিয়ে সাহিত্যিক বা গবেষকরা অনেক ভেবেছেন, অনেক লিখেছেন সত্যি, তবে বিজ্ঞানীরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে ‘জেনেটিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে তারা মানব-মানবীর মিল-অমিলের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কারে সার্থকও হয়েছেন। নারী-পুরুষের জিনগত তারতম্যই শুধু নয়, বৈজ্ঞানিকরা এও খুঁজে বের করতে চেয়েছেন, ‘বহুরূপী’ উপাধি কেন শুধু নারীরই প্রাপ্য! এক্ষেত্রে সাহিত্য আর বিজ্ঞান কিন্তু একাট্টা! নারী যদিও কেবল ‘X’ ক্রোমোসমই ধারণ করে, তারপরও তার আচরণগত বৈশিষ্ট্য খুবই বৈচিত্র্যময়। কেবলমাত্র দু’জন ভিন্ন ভিন্ন নারীর মধ্যেই নয়, একজন নারীর মধ্যেই জিনের কার্যকারণ খুবই রহস্যমণ্ডিত। লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য একজন নারী তার বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকে একটি করে ‘X’ ক্রোমোসম পেয়ে থাকে, আর একজন পুরুষ মার কাছ থেকে পায় একটি ‘X’ ক্রোমোসম এবং বাবার কাছ থেকে একটি ‘Y’ ক্রোমোসম।

ধারণা করা হতো, যেহেতু নারী দুটো ‘X’ ক্রোমোসম বহন করে, কাজেই তার জেনেটিক বৈশিষ্ট্য হবে ভিন্নধর্মী ‘X-Y’ ক্রোমোসমধারী পুরুষের চেয়ে সরল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণা এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। নারীর বহুরূপতার(!) বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা ‘X’ ক্রোমোসমকেই দায়ী করেছেন। বিখ্যাত ‘সায়েন্স জার্নালে’ প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ‘X’ ক্রোমোসমটি নারী-পুরুষে কমন হলেও নারীর দুটো ‘X’ ক্রোমোসমের মধ্যেই রয়েছে বিশাল জেনেটিক তারতম্য। ফিমেল সেক্স ক্রোমোসম ‘X’-এর জিনের কার্যকারিতায় রয়েছে নাটকীয় ভিন্নতা যা ‘Y’ ক্রোমোসমে অনুপস্থিত।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখাচ্ছে, ‘X’ ক্রোমোসমটি ‘প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা’, ‘ভ্রান্তি সৃষ্টির সূক্ষ্মতা’সহ নানা কর্মক্ষমতায় পটু। ‘ঘটন-অঘটন পটিয়সী’ হিসেবে নারীকে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এ গবেষণালব্ধ ফল অগ্রণী ভূমিকা রাখবে! “নারীর ‘X’ জিনের দ্বৈত সেটের ক্রিয়ায় যে কোনও বিষাক্ততা বা বিরূপতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য নারীর কোষগুলো ‘X’ ক্রোমোসমের একটি কপিকে ‘নীরব ভূমিকায়’ রেখে দেয়” দীর্ঘকাল ধরে এটাই ছিল বিজ্ঞানীদের মত। তবে ‘ডিউক ইউনিভার্সিটির জেনেটিক এক্সপার্ট উইলার্ড এবং পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মলিকুলার বায়োলজিস্ট ক্যারেল’ তাদের গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, ‘নীরব ভূমিকায়’ থাকা ‘X’ ক্রোমোসমটি কার্যক্ষেত্রে মোটেই নীরব থাকে না। এই ক্রোমোসমের ২৫ ভাগেরও বেশি জিন কার্যকর থাকে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরির ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে কাজ করে। ৪০ জন নারী থেকে সংগৃহীত কোষের প্রায় একশ’টির মতো জিনের ওপর গবেষণা করে তারা এ ফলাফল পেয়েছেন।

কিছু নারীর ক্ষেত্রে এই ২৫ ভাগের বাইরে আরও অতিরিক্ত ১০ ভাগ জিন নানা কার্যকারিতায় ব্যস্ত। ২০০৬-এ মানবদেহের ‘জিনোম ম্যাপিং’-এর কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ‘X’ ক্রোমোসম ‘Y’ ক্রোমোসমের চেয়ে অনেক অনেক বেশি জিন ধারণ করে। এ কারণেই বাবার কাছ থেকে প্রাপ্ত ‘Y’ ক্রোমোসমে জেনেটিক উপাদান কম থাকায়, পুত্র সন্তানের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য মার সঙ্গেই মেলে বেশি। এক্ষেত্রে ‘মায়ের প্রতি ছেলের টান বেশি এই প্রচলিত ধারণারও একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ‘ফিমেল সেক্স ক্রোমোসম ‘X’ অনেক বেশি জিন ধারণ করায়, একে বেশকিছু ‘মারাত্বক’ রোগ যেমন নানা প্রকারের ক্যান্সার, মাসকুলার ডিসট্রফি, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বর্ণান্ধতা, হিমোফিলিয়া ইত্যাদির জন্যও দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা।

তবে মজার ব্যাপার হল, নারীর মধ্যে দুটো ‘X’ ক্রোমোসম থাকার পরেও এসব রোগে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এর কারণও ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। নারী তার ‘X’ ক্রোমোসমের মধ্যে ‘X-inactivation’ নামের একটা বিষয় ঘটায়, যার ফলে তার কোষ ‘X’ ক্রোমোসমের অতিরিক্ত জিনগুলো বন্দি করে ফেলে। এ ব্যাপারটি পুরুষ তার ‘Y’ ক্রোমোসমের বেলায় ঘটাতে পারে না বিধায় ‘X’ ক্রোমোসম ঘটিত রোগগুলোতে পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। রসিক বিজ্ঞানীদের মন্তব্য, “এক্ষেত্রেও ‘X-inactivation-এর মাধ্যমে প্রকৃতি নারীর জন্য একটি ‘ব্যাকআপ প্ল্যান’ করে রেখেছে, যেখানে দুর্ভাগা পুরুষ একেবারেই নিরূপায়।

” কবি লিখেছিলেন, ‘রমণীর মন, সহস্র বছরের সাধনার ধন’। গতিময় বিজ্ঞান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রহস্যময়ী নারী-জীবনের আরও নতুন নতুন তথ্য আমাদের কাছে উম্মোচন করবে। হয়তো এজন্য সহস্র বছরও লেগে যেতে পারে। কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ড. কাশফিয়া আহমেদ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।