আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সভ্যতার অভিশাপ

শফিক হাসান

ধানি জমিতে বসতবাড়ি কিংবা দোকানপাট, কলকারখানা তৈরি নতুন নয়। ডিমের কুসুম আয়তনের এদেশে মানুষকে তাই ধানি জমির দিকে হাত বাড়াতেই হয়। এভাবেই গ্রাস হয়ে যাচ্ছে সবুজ। বিল-ঝিলের জায়গায় গড়ে উঠছে স্থাপনা। সবুজের সাথে ‘মীর জাফরি’ করার কাজটা কতকটা প্রয়োজনে, কতকটা লোভের বশবর্তী হয়ে করা হয়।

যেভাবেই করা হোক সেটা মুখ্য বিষয় না। কথা হচ্ছে, ‘বেদখল’ হয়ে যাচ্ছে চাষাবাদের জমি। এদেশের বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে এমনিতেই হিমশিম অবস্থা, তার ওপর যেভাবে ফসলি জমি অন্য কাজে ব্যবহারের মচ্ছব পড়েছে তাতে ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিউরে উঠতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রাক্কালে যাত্রীর চোখ জুড়ায় রাস্তার দুই পাশে ধানক্ষেতের সবুজ। অবশ্য রঙটা সবসময় সবুজ থাকে না।

ধানগাছ শৈশব-কৈশোরকালীন অবস্থায় থাকে সবুজ, এ বয়স পেরিয়ে গেলে সবুজ পরিণত হয় সোনালি রঙে। পাকা ধানের সোনাঝরা রঙে ছেয়ে যায় গাছ। বহুমূল্য সোনার মতো ঝুলে থাকে ধানের ছড়া। দেখেই মন আকুল হয়, ব্যাকুল হয়। ভিতর থেকে অজান্তেই বেরিয়ে আসে রবি বাবুর গান : ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা...।

সীতাকুণ্ড ক্রস করার সময় পথের পাশের পাহাড় দেখে কে না মুগ্ধ হয়! দূর থেকে পাহাড় দেখা যায়। কেমন সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে পাহাড়ের ওপর এখনো সেভাবে কারো চোখ যায়নি। আপাতত চোটপাট ধানক্ষেতের সাথেই! এবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় ভয়াবহ একটা দৃশ্য দেখতে হলো। তাও আবার ধানক্ষেতেই।

ধানক্ষেত এখন আর শুধু ধানক্ষেত নেই, হয়ে পড়েছে সাইনবোর্ড বুকে আগলে রাখার ক্ষেত্র। এই ধানক্ষেতের বুক ফালাফালা করে লাগানো হয়েছে সাইনবোর্ড। অমুক কোম্পানির প্রস্তাবিত অফিস, তমুক কোম্পানির ক্রয়কৃত জায়গা, ওর্ধণ এমর... শুধু ঘোষণা আর ঘোষণা। অর্থের দাপটে জমিন ক্রয়, তারপর সেখানে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে সাইনবোর্ড টাঙানো। ধানক্ষেতের দিন কি তবে শেষ হয়ে এলো? ভবিষ্যতে পথের দুইপাশে ফসলি জমির পরিবর্তে দেখতে হবে বিভিন্ন জাতীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির অফিস? এমন সাইনবোর্ড অতীতেও ছিলো।

কিন্তু এমন প্রকটভাবে, নগ্নভাবে এর আগে চোখে পড়েনি। সব ক্ষেতই বোধহয় কিনে নেবে ওরা। ধানক্ষেত দখলের নজির হিসেবে আপাতত আমরা কুমিল্লার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর কথা আমলে আনতে পারি। কী তা বটাই না চালাচ্ছে তারা! আশপাশে লোকালয় থাকলেও দোকানপাট নেই। সুতরাং এ সুযোগে যাত্রী নামধারী গ্রাহকের গলায় ভোঁতা ছুরি চালানো।

অন্য যে অফিসগুলো দাঁড়াবে তার সব হয়তো এই হোটেলের সমগোত্রীয় হবে না, কিন্তু কিছু তো হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতা আছে : সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে...। তেমনি ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কের সব রাস্তাই কি শিল্পপতি আর টাকাঅলাদের জিম্মায় চলে যাবে? কোথাও থাকবে না এক মুঠো সবুজ, কেবলই অর্থ, অর্থই লাগবে? এই অর্থের সীমাহীন লোভে আমরা আদিম থেকে আদিমতম হয়ে যাবো? কেউ ভাত খাবে না, ভাতের বদলে খেতে শুরু করবে ইট-পাথর? নাকি কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী! দালানকোঠা তথা পাকা বাড়ি নাকি সভ্যতার অংশ। এর নাম যদি সভ্যতা হয় তাহলে তো আমাদের অসভ্য থাকাই ভালো। ফয়’স লেকের পরিণতি আমরা দেখেছি।

ইট-কংক্রিটের ঠেলায় কী অবস্থা হয়েছে এটার। এখন সেখানে ঢালাই করে দেয়া হয়েছে অথচ এখানে আগে ছিলো ঝিল। ঝিলের পানিতে ফুটে আছে শাপলা, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? সেই শাপলাফোটা দিন আমাদের গত হয়ে গিয়েছে। গুটিকতক ব্যবসায়ীর ব্যবসা স্বার্থে। এটা ক্ষুদ্র একটা উদাহরণ মাত্র।

ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়, ইতিহাস সৃষ্টি করবে! হায় সভ্যতা, তুমি আর কত রূপে কত ভাবে ধরা দেবে! ইতিহাসের চাকাকে আর কতদিন উল্টোদিকে ঘুরতে দেবে!


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।