শেষ বলে কিছু নেই
২য় পর্বের লিংক
‘আজ খুউব জোসনা, তাই না ভাইজান?’
‘হ্যাঁ। ’ গতি আরো একটু শ্লথ হয়ে আসে ইলিয়াসের।
‘আজ খুউব হাওয়া, না?’
‘হ্যাঁ। ’ গতি আরো একটু শ্লথ হয়ে আসে।
‘আজকের রাত্তির কেমন যেন আলাভোলা, না?’
‘হ্যাঁ।
’ গতি আরো একটু শ্লথ হয়।
‘আপনি কী চলে যান?’
‘না। ’ ইলিয়াস দাঁড়ায়। কেন পালাবে? চিরকাল কেবল পালিয়েই যেতে হবে এমন তো কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। পৃথিবীতে কে আর চিরকাল নিরবচ্ছিন্নভাবে কেবল পালাতে থাকে? ইলিয়াস ফিরে আসে।
এখন জোৎস্নায় দুজন মুখোমুখি; কিন্তু কেউ জোৎস্না দেখছে না; দুজনেই অন্ধ হয়ে গেছে; কী সুন্দর অন্ধ! অন্ধকারে ওরা একজন আরেকজনের শরীর থেকে চন্দ্ররেণু কুড়োয়...
ঘরে ফিরে আসতেই ফোনটা বেজে ওঠে।
‘হ্যালো। ’
‘ইলিয়াস? আমি তোর মা বলছিরে-। ’
‘বলো। ’
‘ঘুমাসনি বাবা?’
‘প্রস্তুতি নিচ্ছি।
’
‘কিসের প্রস্তুতি?’
ইলিয়াসের খুব ইচ্ছে করে বলতে, আত্মহত্যার প্রস্তুতি; কিন্তু বলতে পারে না এবং অপ্রকাশের ভার বুকে নিয়ে কিছুই না বলে চুপ করে থাকে।
ওপাশ থেকে মা বেশ একটা মশকরার ভঙ্গিতে বলে, ‘খুব টেনশনে আছিস বুঝি?’
‘কই না তো! কিসের টেনশন?’
‘বাবা হতে যাচ্ছিস, টেনশন তো একটু হবেই...’
‘ ওহ্ মা! বাবা হলে হব। প্রকৃতির নিয়মেই হব, এতে টেনশনের কি আছে?’
‘তোর গলা এমন ঠান্ডা কেন?’
‘একটু আগে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেয়েছি তো...’
‘স্টুপিড! শোন, একটা গুড নিউজ আছে। এই মাত্র তোর একটা ছেলে হয়েছে। ’
‘খুউব ভালো হয়েছে।
মাঃ ভৈ!’
‘এমন ঠান্ডা করে বলছিস কেন? ছেলে হওয়াতে খুশি হোস নি? মেয়ে এক্সপেক্ট করেছিলি নাকি?’
‘কিছুই এক্সপেক্ট করি নি...’
‘মানে কি?’
‘একটা বেড়ালের বাচ্চা হলেও খুশি হতাম। ’
ওপাশে ক্রোধান্বিত মা মোবাইলটা কেটে দেয়। ইলিয়াস ভাবে অন্য কথা; তার খুব ঘুম পাচ্ছে; অনেকদিন পর শরীর ভেঙে ঘুম আসছে; যেন এ যাবৎ অবাঞ্ছিত কোন চোরাপাথর ঘুমের অমোঘ প্রবাহকে ঠেকিয়ে রেখেছিল, আজ পাথর খসে পড়েছে আর বাঁধভাঙা পানির মত ছুটে আসছে ঘুমস্রোত। ইলিয়াসের মনে হয়, কেন যেন মনে হয়, বুকের ভেতর একটা দাড়িপাল্লার অসম পাল্লা দুটি হঠাৎ সাম্যবস্থায় এসে গেছে।
পরদিন সকালে উঠে ফিটফাট হয়ে ইলিয়াস যায় নাসিং হোমে ছেলেকে দেখতে; সে এখন পুত্র-সন্তানের পিতা, পিতাদের অনেক দায়িত্ব থাকে; ফিটফাট হওয়ার পর আয়নায় নিজেকে দেখে খুশি হয় ইলিয়াস, চেহারায় তার বাবাসুলভ একটা শান্ত সমাহিত লুক এসে গেছে...
নার্সিং হোমের নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে ইলিয়াস দেখে নাসরিনের কোলে একটা মানবশিশু কেমন মাছের মত কলবল খলবল করছে; তার প্রতিটি অঙ্গ প্রক্ষেপণে এক আশ্চর্য নিরাপরাধ সারল্য।
হুট করে পিতৃত্ব জেগে ওঠে ইলিয়াসের এবং খুব সম্ভবত পিতৃত্বের দায়ভার থেকে সে সন্তানের মাকে প্রশ্ন করে, ‘কেমন আছো নাসরিন?’
‘ভালো। ’ নাসরিন মাতৃত্বের দায়ভারে সহজ এবং অহিংস। তারপর কলবল করে অনেক কথা বলে যায় সে, ‘এই দেখেছ, তোমার ছেলে একদম কিন্তু তোমার মত হয় নি। কেমন নিগার নিগার চেহারা হয়েছে না? নাকটা কেমন বোঁচা বোঁচা! তোমার তো আবার কপাল ছোট, ছেলের কপাল দেখ কি রকম চওড়া...। ছেলে আমার বড়কপাল্যা হবে গো।
আর নাকের ডান পাশের তিলটা, থ্যাঙ্কস গড! আমি তো এমনই চেয়েছিলাম। লাভলি তিল। কিন্তু এই রেলগাড়ি যাওয়া নাক আমি চাই নি। দেখ দেখ, একদিনও বয়স হল না কেমন ঘন চুল, ভ্র“...’
হাসতে থাকে নাসরিন। হাসির গমকে সমস্ত শরীর তার কেঁপে কেঁপে ওঠে, ফুলে ফুলে ওঠে; কাঁচা শরীরে তার আনন্দের বান ডাকে যেনবা; আর ইলিয়াস মৃত্যুর পূর্বে বেড়ালের রূপান্তরিত মুখাবয়বের সাথে সন্তানের মুখাবয়ব মেলাতে থাকে; ফিরে আসে পুরোন সেই ক্রোধ; টগবগে ক্রোধকে অভিনয়ের পাষাণ-খণ্ড দিয়ে চাপা দিয়ে ইলিয়াস কেমন শীতল নৈর্ব্যক্তিক কণ্ঠে ঘোষণা দেয়, ‘নাসরিন, তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।
তোমার বেড়ালটা কাল রাতে সুইসাইড করেছে, আমার চোখের সামনে, বিলিভ মি, দৃশ্যটা দারুণ শৈল্পীক ছিল। সিলভিয়া প্লাথের সেই কবিতাটা মনে আছে তোমার-
Dying is an art like everything else
I do it exceptionally well
I do it as it seems the hell
I do it as it seems the real…
আবৃত্তি করতে করতে ইলিয়াস নাসরিনের বিস্ফারিত চোখের সম্মুখে রূপান্তরিত হয় এক সিদ্ধান্তহীন বেড়ালে; যার সামনে দণ্ডায়মান ঘাতক- হাতে উদ্যত হকিস্টিক, পেছনে ঝুলন্ত শূন্যতা; সামনে মৃত্যু, পেছনে আত্মহত্যার আহ্বান; দেবে না কি শূন্যতায় এক লাফ??
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।