আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেড়াল অথবা আত্মহত্যার গল্প-২

শেষ বলে কিছু নেই

১ম পর্বের লিংক গোল্লাছুটপর্বে প্রায় প্রতিবার একচুলের জন্য বেঁচে যায় বেড়ালটা; কিন্তু আশপাশের প্রায় সবগুলো রুমের দরজা বন্ধ থাকায় এবং ডাইনিং টেবিল ব্যতীত অন্য কোন বিশেষ আড়াল না থাকায় সে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে না। ইতোমধ্যে বেড়ালের কমজোরি ফুসফুস হাঁফিয়ে উঠেছে, ধীরে ধীরে গতি শ্লথ হয়ে আসছে। পক্ষান্তরে ইলিয়াস আরো বেশি ক্ষীপ্র, আরো বেশি নিশানা-কেন্দ্রীক; শত্রুর পতন অবশ্যম্ভাবী। বেড়ালটা আত্মরক্ষার কোন পথ না পেয়ে অবশেষে মরিয়া, সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে ছাদের উদ্দেশে; পেছনে ইলিয়াস, হাতে বাগিয়ে ধরা হকিস্টিক। পরক্ষণেই দুপক্ষকে সিঁড়িঘরের খোলা দরজা পেরিয়ে ছাদে চলে যেতে দেখা যায়।

জিঘাংসার ঘোরে মত্ত ইলিয়াসের একবারও মনে হয় না, এই এত রাতে সিঁড়ির দরজা খোলা কেন। কার্নিশহীন খোলা ছাদ, হু হু করছে জোসনা, এলোমেলো বাতাস; জোসনার ঢেউয়ে সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে গিয়ে বেড়ালটা বসে ছাদের শেষ সীমানায়; সীমান্ত, জীবন এবং মৃত্যুর। বসেছে সে এদিকে ফিরে, সামনে ক্রমাগ্রসরমান ঘাতক, পেছনে ঝুলছে শূন্যতা... এখন দুইপক্ষ মুখোমুখি, মৃত্যু ছাড়া বেড়ালের সামনে আর কোন পথ নেই; ইলিয়াসের হকিস্টিক ধরা হাত মাথার উপর থেকে নিচের দিকে নামতে নামতে মাঝ-পথে থেমে যায়। কিছুক্ষণ সে তার কৌতুক ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে বেড়ালের ঘৃণাদগ্ধিত জ্বলজ্বলে চোখের দিকে; তারপর বেড়ালকে লক্ষ্য করে কেমন এক পরাবাস্তব কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তোর সামনে এখন দুটো পথ, একটা হত্যার অন্যটা আত্মহত্যার। কোনটা নিবি?’ বেড়াল দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সরোষে জবাব দেয়, ‘মি-ও-য়া-ও-ও-’; কণ্ঠ তার মৃত্যুভয়-ক্লান্তি-দ্বেষ-ক্রোধে আধিভৌতিক ইলিয়াস চাপা অথচ তীক্ষèকণ্ঠে হুংকার ছাড়ে, কোন পথ নিবি ব্লাডি বাস্টার্ড? আনছার মি...’।

তার হকিস্টিক নিচের দিকে নামতে থাকে; ততক্ষণে বেড়ালটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়; দ্বিতীয় পথটাই উত্তম মনে হয় তার কাছে; সাই করে ঘোরে; শূন্যে লাফ দেয়। একটা ডিগবাজি খেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন একটা শ্বাপদ-শরীর; নামতে নামতে এক পর্যায়ে হাইভোল্টেজ ইলেক্ট্রিক তারে পেঁচিয়ে যায় শরীরখানা; আর সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যার দৃশ্যটা একটা ভিন্নতর মাত্রা পেয়ে যায়; “দুম” করে কয়েকটা অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের ধারা ছিটকে পড়ে নিচের সড়কে, তদসঙ্গে বেড়াল; “থপ” করে একটা আওয়াজ হয়। ইলিয়াস মনে মনে বলে, আহ! কী চমৎকার আত্মহত্যা... ডাইং ইজ অ্যান আর্ট লাইক এভরিথিংএল্স। পেছনে হাসির শব্দ; কে হাসে এত রাতে খোলা ছাদে, হু হু করা জোসনায়? কোনও নারী? নারীকণ্ঠের হাসিই তো! নারী নাকি নারীর প্রেতাত্মা? নাকি পরী? জোসনায় নেমে এসেছে... সিঁড়িঘরের অন্ধকার ছায়া থেকে এক পলকে চন্দ্রালোকে বেরিয়ে আসে গুলবাহার। ওদের কাজের মেয়েটা; কিন্তু ওর তো এখন কিচেনে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর কথা; কাজের মেয়ের এত রাতে ছাদে কী? এসব কী হচ্ছে? ইলিয়াসের মাথার ভেতর ফ্লাইং সসারের মত উড়ে আসে একটা প্রশ্ন, এই চারদিকের মানুষগুলো এমন কি পশুকুল ক্রমাগত উদ্ধত হয়ে উঠছে- এর ফলাফল কী শুভ হবে? গুল হাসতে হাসতে বলে, ‘ভাইজান, বিলাইডারে মারে ফালাইলেন?’ ‘জ্বি।

কিন্তু তুই এভাবে হাসছিস ক্যান?’ ‘আপনে ঐডারে এমন করে মারলেন যেন আদমের বাচ্চা...’ ‘আদমের বাচ্চার চেয়েও ওটা ভয়ংকর। আর আমি মারিনি তো, নিজেই আত্মহত্যা করেছে। ’ এবার হে হে করে হেসে গুল বলে, ‘আত্মহত্যা? বিলাই আবার আত্মহত্যা করে না কি? ভাইজান আপনার কী মাথামুথা খারাপ হইসে?’ ইলিয়াস আবাক হয়ে লক্ষ্য করে, এই মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে তার কথা বলতে ভাল লাগছে; রক্তের মধ্যে ক্রোধের রাসায়নিকসমূহ থিতিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ... গুল ফের বলে, ‘কাজটা আপনি ঠিক করলেন না। আপা বিলাইডারে বড় ভালোবাসতো!’ ‘বাসতে পারে। বেড়ালটা ওর বন্ধু ছিল, আমার শত্রু।

শত্রুকে বধ করাটাই হচ্ছে নিয়ম। ’ ‘এইডা আপনি কী কন! সব শত্রুরে আপনি মেরে সাফ করতি পারবেন? কেউ পারে। এট্টা কথা আছে, ঠগ বাছতে গা উজাড়। তয় তো দুনিয়াডাই উজার হয়ে যাবে। ’ বাহ্, মেয়েটি তো চমৎকার কথা বলে।

প্রায় ২ বছর ধরে আছে এ বাড়িতে গুলবাহার, ইলিয়াস কখনও ভাল করে লক্ষ্য করে নি; কেন? হয়তো লক্ষ্য করার প্রয়োজন পড়ে নি অথবা হয়তো সঙ্গত মনে হয় নি তার। তবে মায়ের কাছে শুনেছে, স্বামীর অতাচারে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে গুল। আচ্ছা ওর স্বামী ওকে কী ধরনের অত্যাচার করত? শারীরিকভাবে না কি মানসিকভাবে? না কি দুভাবেই? আচ্ছা গুলের স্বামীর কী গুল ছাড়াও এক বা একাধিক নারীর সাথে শারীরিক সংশ্রব ছিল? যদি তা থাকে, তবে সেটাই ছিল গুলের উপর ভাইটাল অত্যাচার- দুর্বিষহ এক মানসিক আগ্রাসন- এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই ইলিয়াসের। ‘তুই এত রাতে না ঘুমিয়ে ছাদে কী করছিস?’ ‘ঘুম আসে না, ভাইজান...’ ‘ক্যান?’ আপনি ও তো রাতে ঘুমান না, ক্যান?’ মেয়েটির কণ্ঠস্বর ক্রমাগত ধারালো হয়ে উঠছে; চাঁদের আলোতে মেয়েটা ছুরির ফলার মত চকচক করছে। ‘আমি ঘুমাই না কে বলল তোকে?’ কেউ বলে নাই, আমি জানি।

আমার তো রাইতে ঘুম আসে না, তাই আমি টের পাই এ বাড়িতে কে ঘুমায় আর কে ঘুমায় না। ’ ইলিয়াস ভেতরে ভেতরে টের পায়, এই চাঁদের আলো শুষে নিয়ে জ্বলজ্বল করা মেয়েটাকে তার বেশ লাগছে; শেলী’র “সোল সিস্টার” কিংবা জীবনানন্দ’র “হৃদয়ের বোন” এর মত লাগছে; আর শরীরের ভিটায় কী যেন নড়াচড়া করছে দুষ্টু ইঁদুরের মত। খুব খারাপ সিম্পটম; পালাতে হবে; চিরকাল যেমন পালিয়েছে; কিন্তু পালানোর আগে মেয়েটাকে আর একটু নাড়তে ইচ্ছে করে ওর। ‘তুই আর কী টের পাসরে গুল?’ ‘অনেক কিছু। ’ ‘অনেক কিছু কী?’ ‘সংসারডা মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি ধ্বংস হবে, আমি টের পাই।

’ ইলিয়াস এবার সিঁড়ির দিকে পা চালিয়ে দেয়; পালানোটা এখন অনিবার্য। কিন্তু পেছন থেকে কামজ কণ্ঠে ডাক দেয় গুলবাহার, ‘ভাইজান কী চলে যান?’ ‘হ্যা। ’ একটু বেশিই জোর দিয়ে বলে ইলিয়াস; গতি তার ঈষৎ শ্লথ হয়ে আসে। চলবে...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.