আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অগভীর ভাবনা - বামান্দোলনের ব্যর্থতা

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

আমি অনেক চেষ্টা করেও ডানপন্থী উজবুক এবং যৌক্তিক বামপন্থীদের ভেতরে তফাত খুঁজে পাই না। একদলের নবী নাম মুহাম্মদ আর অন্য দলের নবীর নাম নাম মার্ক্স, এই নামের পার্থক্য যতটুকু ঠিক ততটুকুই পার্থক্য এই দুই ধারণার অনুসারীদের ভেতরে। ১৪০০ বছর আগে মুহাম্মদের প্রয়ানের পর ইসলাম অনেক ভাগে অনেক বিশ্বাসে বিভক্ত হয়েছে, এক একটা মজহাব তৈরি হয়েছে, সে সব মজহাবের ইমাম আছে এবং সেই মজহবের অনুসারীরা সেই তরিকা মতো জীবনযাপন করে, তাদের জীবনদর্শণ সেই মজহাব নিয়ন্ত্রন করে। ২০০ বছর আগে মার্ক্স যখন নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং সমাজবিশ্লেষণের তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন তারপর থেকেই এই তত্ত্বকে যাচাই করবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ইমামের জন্ম হয়েছে, সেসব ইমামের কারিশমা এবং কৌশল এক একটা মজহাবের জন্ম দিয়েছে। একজন হলেন মহামতি লেলিন, তার অনুসারীরা নিজেদের দলের সাইনবোর্ডে লিখে রাখে কম্যুনিস্ট পার্টি[ মার্ক্স-লেলিন], ১৯১৭তে রাশিয়ায় বিপ্লবের পরে এই মজহাবের অনুসারীরা ব্যপক সম্মানিত হয়েছিলো এবং বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার দানছত্র এবং একক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছিলো।

ট্রটস্কি, স্ট্যালিন, ব্রেজনেভ এসব বিরলকেশ বৃদ্ধদের কারণে এক সময় রাশিয়ায় কম্যুনিস্ট তন্ত্র পরিণত হয়েছিলো বৃদ্ধতন্ত্রে, তখন সেখানের সংসদকে বলা হলে বৃদ্ধাশ্রম। সেই বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলো বিভিন্ন দেশে সাম্যবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলো, এবং লাল বিশ্ব গড়ে তুলবার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা ও কুটনৈতিক সহায়তা দিচ্ছিলো নিয়মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন মজহাবের উৎপত্তি হলো, কিংবা নতুন সফল মতবাদের উৎপত্তি হলো, মজহাবের সাফল্য হলো রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারা, সে হিসেবে চীনে মাও সে তুং সফল হলো, এবং বামপন্থী ঘারাণার নতুন ইমামের অনুসারীও তৈরি হলো বঙ্গে। তারা নিজেদের সাইনবোর্ডে লিখে রাখতো কম্যুনিস্ট পার্টি [ মার্ক্স- মাও সে তুং] কিউবায় সাফল্যের পর রাতারাতি ক্যাস্ট্রো এবং চে গুয়েভরা বামপন্থী সাম্যবাদের নায়ক হয়ে উঠলেও বঙ্গ দেশে ঠিক তারা ইমামের মর্যাদা পেলেন না। আমরা বরং চে গুয়েভারাকে বললো ইমাম হানিফা, যার গালগল্প আমরা সবাই জানি।

মুলত মার্ক্স-লেলিন পন্থী এবং মার্ক্স মাওপন্থীদের ভেতরে সাম্যবাদ এবং শ্রমিক এবং কৃষকের ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক রকম থিসিস এন্টি থিসিস চলেছে এবং প্রতিদিন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ধারণায় এদের পথনির্দেশনা দুটি ভিন্ন দিকে চালিত হয়েছে, এবং এরই একটা পর্যায়ে এই দুই মতবাদের অনুসারীরা শিয়া সুন্নী বিরোধের মতো নিজেদের ভেতরে মজহাব এবং ইমামজনিত বিভেদের সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। বঙ্গদেশে একদা চীন এবং রাশিয়ার দুতাবাসের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো হবু বামপন্থী বিপ্লবীগণ, তাদের নিজেদের ঘাড়ের উপরে একটা মাথা থাকলেও সেটা ব্যবহারের আগ্রহ তাদের সম্ভবত ছিলো না , সুতরাং যুগোস্লোভাকিয়ায় কম্যুনিস্ট সম্মেলনে রাশিয়ার বামপন্থী বস্তুবাদী বিশ্লেষক এদেশে বিপ্লব সম্পর্কে কি ভাবছেন সেটা জানবার জন্য তারা দুতাবাসের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেন , রাষ্ট্র ভ্রমনে যেতেন, দুতাবাসের চিপা জানালা দিয়ে খয়রাত হলো সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার উপকরণ এবং দিকনির্দেশনা। সেসব চব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় আস্বাদন করে অবশ্য আমাদের কথিত বামপন্থীদের শীর্ণ শরীরে চর্চির আস্তরণ বেড়েছে, বেড়েছে খাদির চাদর আর পাঞ্জাবির ঝুল, কিন্তু মূলত যেটা অভিলক্ষ্য ছিলো, সে লক্ষ্য অর্জিত হয় নি, সমাজ থেকে ধনবৈষম্য এবং শ্রেণীঘৃণা এবং শোষণ উন্মুল হয় নি, বরং সর্বহারার সংখ্যা বেড়েছে, এবং নতুন থিসিস এসেছে, দেশে সর্বহারা বাড়লে তারাই একদিন বিপ্লব করবে, এবং এই বিপ্লবের নেতৃত্ব সবসময়ই মধ্যবিত্তদের হাতে থাকতে হবে, যারা হোগা মারা খাচ্ছে তাদের বেদনা বুঝবে কতিপয় হোগামারা দেওয়া পাব্লিক, এই ধারণাটা যথেষ্ট রোমান্টিক, কংসের কারাগারের কৃষ্ণের জন্মের মতো অলৌকিক একটা সান্তনাবানী, যেখান থেকে শোষণের জন্য, সেখানেই শোষণ প্রতিরোধকারীর জন্ম হবে একদিন। এদেশে বামপন্থীদের ভাবধারা সম্পর্কে সম্যক অবহিতি আমার নেই, আমার জ্ঞান উপরিতলের, অতিগভীরে গিয়ে মুক্তা কিংবা থিসিস আহরণের সাফল্য অর্জন করি নি, সুতরাং এই হালকার উপরে ঝাপসা জ্ঞান নিয়ে আমি যা বুঝি তাই বলি- সমাজে বৈষম্য আছে, এই অর্থনৈতিক বৈষম্য মূলত পূঁজি এবং ক্ষমতার অসমবন্টনের কারণে উদ্ভুত হয়, সেই বন্টন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করলেই সমাজে অসাম্য এবং বৈষম্য নির্মূল করা সম্ভব । আরও কিছু বামপন্থী বুলি আছে, পাতিবুর্জোয়া, বুর্জোয়া, শ্রেণীশত্রু ,ডিক্লাসড এবং সর্বহারা- এইসব সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করা উচিত হবে না।

এখানে যারা কর্মী বিশেষত যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখে থাকতে ভুতেকিলানো পোলাপাইন, তাদের কাজ হলো মূলত দিক নির্দেশনা দেওয়া, সমাজের যে শোষণ এবং অনাচার সেটা সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা এবং এর স্বরুপ বিশ্লেষণ করে যারা হোগা মারা খাচ্ছে তাদের এটা বুঝানো যে তুমি বাবা কিন্তু হোগা মারা খাচ্ছো, তোমার হোগা ফাক্কি ফাক্কি হয়ে গেলো, একটু ব্যথায় চিৎকার করো বাবা। সেই এই সংবেদ তৈরি করবে, সমাজের অব্যবস্থা উপলব্ধি করবে এবং নিজের শ্রেণীচেতনার বিপরীতে গিয়ে শ্রমিক কিংবা কৃষক কিংবা সর্বহারার ভেতরে গিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করে তাদের দিয়েই এই বৈষম্য দুর করবে এবং এই আলোকিত মধ্যবিত্ত বালকেরা পরবর্তীতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করবে। এবং সর্বহারাদের চালিত করবে সাম্যবাদের পথে। মাওবাদ কিংবা নকশালদের সাথে লেলিনবাদীদের বিপ্লবের পন্থা নিয়ে যে বিভেদ তৈরি হলো তাতে একদল শোধনবাদী এবং অন্যদল প্রকৃত বিপ্লবী হয়ে উঠলো, তারা কিংবা এই রোমান্টিক ধারণার বশবর্তী হয়ে ভবিষ্যতের সাম্যবাদী নায়ক হিসেবে অবিস্মরণিয় হয়ে উঠবার তাড়নায় অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কোমলমতি তরুণ এবং যুবক শ্রেণীশত্রু খতমের রাজনীতিতে নাম লেখালো। যদিও আমি এখনও বুঝি না পুলিশের কনস্টেবল কিংবা গ্রামের চৌকিদারকে খুন করে কিভাবে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব , তবুও এদের কাছে রাষ্ট্রের শোষণের মুর্তিমান চরিত্র ছিলো এই উর্দি, মূলত লড়াইটা একটা মনোগ্রামের বিরুদ্ধে লড়াই, রাষ্ট্রের শোষণের নিদর্শণ যেখানে আছে, সেটাকেই প্রতিহত করতে হবে- থানায় রাষ্ট্রের শোষণ কেন্দ্রীভুত হয়, সে শোষণে সক্রিয় অংশগ্রহন করে পুলিশ কনস্টেবল, সুতরাং একজন ১২০ টাকা বেতনের পুলিশের গলা কেটে ফেললেই বিপ্লব ত্বরাণ্বিত হবে, হতেও পারে বলা যায় না, যে মানুষটা অনায়াসে কৃষক হতে পারতো, তার নতুন কর্মক্ষেত্রে তার উর্দির কারণে গলা কেটে ফেললে বিপ্লব হতেই পারে, মহাজনের পরিবার খতম করো, তার গোলা লুট করো, চৌকিদারকে খুন করো, এভাবেই রাষ্ট্রে অব্যবস্থা তৈরি করলে রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে, এবং সাম্যবাদী লালঝান্ডা দেশের অনক অংশের নিয়ন্ত্রনে থাকবে, এটা ভীতিপ্রদর্শন করে ক্ষমতা অর্জনের তরিকা বলা যায়।

সেটা পরবর্তীতে ভ্রান্ত প্রমাণিত হলেও এই তরিকার অনুসারীদের ফেরানো যায় নি, তারা সাম্যবাদী সবক ভুলে চিরায়ত লুন্ঠক হয়ে উঠেছে, তারা লালঝান্ডা পুতে চাঁদবাজী করছে, এবং প্রাক্তন বিপ্লবী নেতারা পুনরায় খদ্দর পড়ে মাটির নীচ থেকে উপরে উঠে এসেছেন, কেঁচোস্বভাবের কিছু বামপন্থী নেতা কিছু সময় মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকছেন, বাইরে আসছেন, লাদি ছড়াচ্ছেন, থিসিস এন্টিথিসিস করছেন, তাদের গবেষণা শেষ হচ্ছে না এখনও। এত গবেষণা শেষেও সাম্যবাদ চাওয়া মানুষগুলোর ভেতরে কোনো ঐক্য নেই, একদল অন্য দলকে শোধনবাদী এবং গণমানুষের শত্রুজ্ঞান করে, এদের প্রত্যেকেই একএকজন মতাদর্শিক উজবুক হয়ে যায়, মজহাবের বাইরের কোনো ধারণাই তাদের কাছে ভ্রান্ত ধারণা এবং শোধনবাদী আপোষ। মূলত গণবিচ্ছিন্নতা কিংবা সাধারণ মানুষের বিচারবুদ্ধির প্রতি শিক্ষিত অবজ্ঞা এখানে কোনো সাম্যবাদী আন্দোলনকে সফল হতে দেয় নি। যে কৃষক বাস্তুবাদী দর্শণ পড়ে নি তার সমজবিশ্লেষণ নিয়ে সংশয় থাকা, কিংবা যরা হোগা মারা খাচ্ছে তাদের নিজস্ব উপলব্ধি যে পরিশুদ্ধ নয় এবং উন্নাসিকতা যেমন দায়ী সাম্যবাদী আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে তেমনই দায়ী আসলে আমাদের বামকর্মীদের পরবর্তী প্রাতঃস্মরণীয় সাম্যবাদী নায়ক হয়ে উঠবার তীব্র লোভ, এরা সবাই ভবিষ্যতের সাম্যবাদী লড়াইয়ে এক একজন চে গুয়েভারা, এক একজন ফিডেল এক একজন লেলিন ট্রটস্টি কয়ে উঠতে চায়, হয়ে উঠতে চায় পাভেক কারগাচিন, এইসব চটি বই পড়ে সেসব চটি বইয়ের নায়কদের ব্যাপারে চিরন্তন ফেটিশ থেকে বের হয়ে সত্যিকারের কর্মি হয়ে উঠতে পারলো হয়তো কিঞ্চিৎ বামপন্থী সাফল্যের সংবাদ আমরা পেতাম। তা হয় নি আফসুস।

এবারও একটি গণআন্দোলন সফল হতে গিয়েও হলো না, তার কারণ কিন্তু এই নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব, কাদের হাতে নেতৃত্ব থাকবে এবং কেনো তাদের হাতে নেতৃত্ব থাকাটা আবশ্যক এবং সেটা কিভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত এইসব বাখোয়াজিতে দেখা গেলো, মাইক নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে করতে ময়দানের সাধারণ মানুষেরা সবাই অন্য দিকে চলে গেছে। ভবিষ্যতেও এমনই ঘটবে, ডানপন্থী উজবুকদের মতো যতদিন মজহাব ধরা কুশিক্ষিত বামপন্থী উজবুকেরা জীবিত থাকবে এবং নেতৃত্ব নিয়ে হানাহানি করবে, ততদিন এদেশে বামপন্থী আন্দোলন সফল হবে না। এটা আমি যেকোনো মূল্যের স্ট্যাম্প পেপারে লিখে সই দিতে পারি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।