আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অগভীর ভাবনা ৫

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

সিগন্যালের একেবারে শেষে পৌঁছানোর সময়ই ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে থামালো। মনটা খচ করে উঠে এমন মুহূর্তগুলোতে। মনে হয় আর একটু আগে পৌঁছালে হয়তো এই দুরাবস্তা হতো না। এখন পাক্কা ৫ মিনিট বসে বসে দেখো, চৌরাস্তার এই পাশ দিয়ে গাড়ী যাবে, ওপাশ দিয়ে গাড়ী যাবে, কিছু গাড়ী বাঁক নিয়ে রাইট টার্ন নিবে, তাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে কোনো এক সাহসী ড্রাইভার আড়াআড়ি ঢুকে যাবে, এই সময়েই অন্য দুই নিশ্চল রাস্তার যানবাহনগুলো একটু একটু করে রাস্তার ভেতরে মাথা ঢুকাবে। রাস্তা সংকীর্ণ হবে, এবং একটা পর্যায়ে বিকট একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে ফলে ট্রাফিক বাধ্য হয়েই সিগন্যাল উঠিয়ে নিবে।

এই অনিয়ম পছন্দ হয় না বলেই আমি রিকশাকে বলে সামনে যেয়ো না, তবে আমার কথা বাকী সবাই শুনে না, তাই আমার রিকশাকে পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় প্রাইভেট কার, তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মোটরসাইকেল, সেই মোটর সাইকেলে সানগ্লাস পড়া ছেলে এবং একটু টাইট জামা পড়া মেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। তাদের দিকে একটু বেশী মনোযোগী হতে হয়। প্রাইভেটগুলোর ভেতরে অফিস শেষে তেমন সুন্দরী মেয়ে থাকে না। এদেরই প্রশ্রয় পেয়ে আরও কিছু রিকশা সেখানে মাথা ঢুকায়। তখনই ট্রাফিক পুলিশ কর্মক্ষম হয়ে উঠে, তেড়ে এসে প্রথমেই রিকশাওয়ালাকে একটা বাড়ি দেয় লাঠির, হারামজাদা, চুতমারানি সামনে সান্ধাইছো ক্যান? পিছনে থাকতে মন চায় না, পিছা হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মোটর সাইকেলের পেছনে বসা আঁটোসাটো পোশাকের মেয়েটার চেহারা লাল হয়ে যায়, পরবর্তী টার্গেট তারাই, তবে পুলিশ খরচোখে তাকিয়ে থেকে তাদের কিছু না বলে মনোযোগ দেয় প্রাইভেট কারের ড্রাইভারের দিকে। ঐ মিয়া গাড়ীতে চড়লে কি হুঁশ থাকে না? নিয়ম মানতে মন চায় না। রাস্তাটা কি কিন্যা নিছেন? আশে পাশের রিকশাওয়ালাদের ভেতরে গুঞ্জন উঠে, হ মিয়া পারবেন তো খালি রিকশাওয়ালা পিটাইতে। পিটান না দেখি প্রাইভেটের ড্রাইভারগো, সেই সাহস তো নাই, খালি পারেন আমাগোর উপরে বাইড়া বাইড়ি করতে। সিগন্যালটা ছেড়ে দেয়, আরোহী মহিলা বিরক্ত চোখ পেপার থেকে নামিয়ে ট্রাফিক পুলিশকরে ভস্ম করে দিয়ে চলে যান, মোটর সাইকেল যতটা দ্রুত সম্ভব পার হয়ে যায় রাস্তা।

রিকশার ইঞ্জিল নাই তাই টেনে টেনে রাস্তা পার হয়। অথচ শ্রেণী সচেতনতা না কি নেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের। যদিও প্রকৃত মিল শ্রমিক, শিল্পবিপ্লবউত্তর শ্রমিক শ্রেণী বিকশিত হয় নি বাংলাদেশে। প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে নি বাংলাদেশে, এখানে অধিকাংশ শ্রমিক কায়িক শ্রম বিক্রীতে অভ্যস্ত। এখানে শ্রমিকের চেতনা উন্নয়নের সম্ভাবনা নেই।

এরা নিজেরাই সচেতন নয়, তবে তারা পারস্পরিক সহমর্মিতার পাঠ জীবন থেকেই পড়ে নিয়েছে। রিকশাওয়ালা অন্য রিকশাওয়ালাকে নিজের প্রতিদন্ডী ভাবে না, বরং তারা একটা বৃহৎ শ্রেনীর অংশ এবং তারা যে ক্ষমতা এবং অর্থে নির্যাতিত এই বোধটাও তাদের আছে। পারবেন তো রিকশাওয়ালাগো পেটে লাত্থি মারতে। আমি বিরক্ত হই। শালার নিয়মিত ভাড়া যা তার চেয়ে বেশী দিচ্ছি কদিন ধরেই, চালের দাম বেড়েছে, আনাজের দাম বেড়েছে, কিন্তু ৮ টাকার ভাড়া ১২ টাকা দেওয়ার পরেও দেখি এই ব্যাটা বাড়তি কথা বলে।

সাম্যবাদের পাঠ প্রয়োজনীয় মনে হয় সময় সময়, তবে যখনই শুনি লড়াই ছাড়া মেহনতি জনতার মুক্তি নাই, তখন আবারও একটু ঝামেলায় পড়ি, কার লড়াই, কার স্বার্থে লড়াই, কে লড়বে? শ্রমিক নিজে খেতে পায় না, তার অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হবে এটা সে বুঝে তবে সে বেতনভুক যোদ্ধা হতে পারবে না। সার্বক্ষণিক বিপ্লবী এবং পেশাদার রাজনৈতিক হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা বাম রাজনীতি কর্মীদের থাকে। পার্টি সামান্য মাসোহারা দেয় কিছু নিবেদিত কর্মীকে। সংখ্যাটা জানা নেই, তবে কয়েকটি বামপন্থী দলে এই মাসোহারা প্রথা আছে। এরা নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবী, বিপ্লবের সংগঠক।

এরাই লড়াই করবে মেহনতি মানুষের হয়ে। রাশিয়ার ২ বার বিপ্লব হয়েছিলো ১৯১৭তে। প্রথম বার কিছু মৃদু বামপন্থী ক্ষমতা দখল করলো এবং তাদের হটিয়ে অক্টোবর বিপ্লবে ক্ষমতা দখল করলো কট্টরপন্থী বলশেভিকেরা। এবং একদা আন্দোলনের সহকর্মী সামান্য মতভেদের কারণে গণশত্রু এবং প্রতিবিপ্লবী হয়ে গেলো। এইসব প্রতিবিপ্লবীদের সাথে পরবর্তী সময়ে নিয়মিত গৃহযুদ্ধ হয়েছিলো রাশিয়া।

কিছু শ্রেণীচ্যুত আলোকিত নিবেদিত প্রাণ বামপন্থী বিপ্লবীরা লড়াই করে মেহনতি জনতার মুক্তি আনবে, তবে লড়াইটা হতে হবে সশস্ত্র লড়াই। রক্তাক্ত বিপ্লবই প্রকৃত বিপ্লব। বিপ্লব আদতে কোন পন্থায় আসবে এটা নিয়ে নানাবিধ বক্তব্য আছে বিপ্লবীদের ভেতরে। মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী, মাওবাদী, লেলিনবাদী, নকশালবাদী, বিভিন্ন তাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন জনপদের বিপ্লবের কায়দা উদ্ভাবন এবং এর প্রয়োগ করেছেন। একটা বিষয় সত্য- একই কায়দায় সব জায়গায় বিপ্লব সম্ভব না, সমাজ পরিস্থিতি সেখানের শ্রমিকদের অগ্রসরতার উপরে নির্ভর করে বিপ্লবের ধরণ।

আমাদের মতো সামান্য শিল্প কারখানা সমেত জনপদে শ্রমিকের শ্রম শোষণ এবং উদ্বৃত্ব শ্রমের গল্প বলা যায় না, এখানে বেশীর ভাগ শ্রমিকই স্বনিয়োগপ্রাপ্ত, তারা কোদাল, টুকরি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, আলোচনা করেই নিজের শ্রম বিক্রী করে, যদি এই শ্রম বিক্রী করে সে ঠকে তবে সেটা তার নিজের গাফিলতি। রিকশাওয়ালাও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই রিকশা নিয়া বাইরে আসে, এখানে রাস্তায় তার শ্রম শোষণ করবে কে? সে তার পারিশ্রমিক নিজেই নির্ধারণ করছে। তবে বিজ্ঞ বামেরা বলে এখানেও লোকচক্ষুর অন্তরালে শ্রমশোষণ চলে। মাওবাদী না মার্ক্সবাদী না লেলিনবাদী হয়ে উঠবে বিপ্লবী দলগুলো তা ঠিক ঠাওড় করতে পারে না তাই দল ভাঙতে ভাঙতে পরমাণু দল গড়ে উঠে, তাদের তাত্ত্বিক নেতা জন্মায়, সেই নেতার আদর্শে মুগ্ধ নিবেদিত প্রাণ কর্মীরাও জন্মায়। তারা নেতার ব্যখ্যায় জীবন ও সমাজ বিশ্লেষণ করে।

ষাটের দশকে দক্ষিণ আমেরিকায় হঠাৎ করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জোয়ার তৈরি হয়। এ জন্য দায়ী এক রোমান্টিক মানুষ, চে গুয়েভারা, বেচারা কতগুলো মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে সেটা বোধ হয় তার নিজের জানা নেই। কিউবার ক্যাস্ট্রো এখনও শুনেছি জনপ্রিয়, তবে তার দেশের মানুষ ঠিক এমন জীবন চায় না। প্রচার মাধ্যমে সত্য কখনই উঠে আসে না, বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, চিলি, কোথায় না বিদ্রোহ আর বিপ্লব হয়েছে। মানুষ মানুষের সাথে লড়াই করেছে, বিপ্লব বিপ্লব খেলায় দেশের কিছু অংশ দখল করে রেখেছে বিপ্লবীরা, কোনো সময় তারা সম্পূর্ণ দেশ দখল করতে পেরেছে।

এবং সে সময় তারা স্ট্যালিনবাদে মত্ত, তাই প্রতিবিপ্লবীদের সোভিয়েট স্টাইলেই দমন করেছে কঠোর ভাবে। মানুষ মরেছে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। তবে চে গুয়েভারা রোমান্টিক তরুনের স্বপ্নের নায়ক হয়ে ঠিকই বেঁচে আছে। আমি চে গুয়েভারাকে পছন্দ করি না তার মানবতাবিরোধী এই ভুমিকার জন্য। আমার এখন মনে হয় তার মানসিক সমস্যা ছিলো, সার্বক্ষণিক উত্তেজনার চাহিদা ছিলো তার জীবনে।

কিছু কিছু মানুষ নেশা করে জীবন ধ্বংস করে, কোনো গঠনমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে না। গুয়েভারা তেমনই এক বিপ্লবের নেশায় মত্ত ছিলো। তার নেশা ছিলো বিপ্লব, কিংবা হত্যা করা। আদর্শের কারণে হত্যা করা কিংবা লড়াই করা হয়তো কারো কারো কাছে বীরত্বের কিংবা মহত্তর কাজ তবে একজন সিরিয়াল কিলারও খুন করার আনন্দে খুন করে। তাকে আমরা খুনী বলেই সম্বোধিত করি, তাকে সামাজিক ক্ষতির কারণ ভাবি।

চে গুয়েভারা গুলি ছুড়ে শ্রেণীশত্রুদের কতল করছে, লড়াই করছে গেরিলা পন্থায়, তার আড্রোনলিন নিঃসরিত হচ্ছে, এই উত্তেজনার নেশাই মানুষকে রেসিং কারের ড্রাইভার বানায়, ফর্মুলা ওয়ানের নিবেদিত প্রাণ দর্শক বানায়। হয়তো যদি পাওয়ার রেসিং কিংবা এনএসএস আর কম্পিউটার থাকতো তবে চে গুয়েভারার কারণে এত প্রাণ এবং এত মানুষের অপচয় হতো না বিশ্বে। প্রযুক্তি সব সময় খারাপ নয়, মাঝে মাঝে কিছু মানসিক সমস্যার সমাধানও দিয়ে দেয়। ষাটের দশকের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি দক্ষিণ আমেরিকা, সেখানে নানা ধরণের কুটনীতি সমরনীতির প্রয়োগ হয়েছে। সমাজতন্ত্রকে পূঁজিবাদের শত্রু ভেবে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন উপায়ে সমাজতন্ত্রকে দমনের চেষ্টা করেছে।

নিজেদের ভেতরে কেজিবির চর, সিআইএ র চর খুঁজেছে দেশগুলো। শ্রেণীশত্রু, প্রতিবিপ্লবী আর বিপ্লবীদের ভেতরে সংঘাত হয়েছে , মানুষ মরেছে। বিকল্প ধারায় এগিয়েছে মাওবাদ, সেও একটা পর্যায়ে গিয়ে কৃষককে সংগঠিত করে ক্ষমতা দখল করেছে। তবে সব আদর্শিক রাষ্ট্রই একটা পর্যায়ে গিয়ে দমন ও নিপীড়ণের রাষ্ট্রনীতি তৈরি করেছে। আমাদের মেহনতি জনতার জন্য কোন নীতিতে বিপ্লব প্রয়োজন এটা নিয়ে ভাবতে পারছে না বামপন্থী পকেট দলগুলো, তাদের নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের বাইরে তাদের সমর্থক কয় জন? বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৬ টা বামপন্থী দল আছে, এদের ভেতরে কয়েকটা দলের সবাই পার্টির বিভিন্ন অংশের নেতা।

সাধারণ সম্পাদক, আহ্ববায়ক, পাঠাগার সম্পাদক, নারী সম্পাদক, এই পার্টি মেম্বার লিস্টের সবাই সংগঠনের কোনো না কোনো পদে আছে, এবং এর বাইরে আসলে এই দলটার কোনো অস্তিত্ব নেই। একটা দল ছিলো আমাদের সময়ে, সেই দলের তাত্ত্বিক নেতা, সাধারণ সম্পাদক এবং প্রচার সম্পাদক ছিলো এবং পার্টির সদস্য ও কর্মী ছিলো মনে হয় ৩ জন। চমৎকার একটা বামপন্থী দল ছিলো এটা, কোনো লোকালিজম ছিলো না, কোনো পদ দখলের লড়াই ছিলো না, নিরুপদ্রব নেতৃত্ব, ভোট দিয়েও আমি সাধারণ সম্পাদক আমি প্রচার সম্পাদক আমি তাত্ত্বিক নেতা। তাদের বিভিন্ন বিপ্লবী মন্ত্র শুনে আমি উদ্বুদ্ধ হতে পারি নি। কেউ উদ্বুদ্ধ হয়েছে এমনও দেখি নি, তবে তারা যে বিশাল মাপের নেতা এটা তাদের বেশবাস দেখেই বুঝে যেতো।

গণ জাগরণেই মেহনতি জনতার মুক্তি, বিদ্রোহ জাগতে হবে শ্রমিকের রক্তে, একটা সময় নির্যাতিত জনতা জেগে উঠবেই, তপন ভাইয়ের কথাগুলো ভাববার মতো ছিলো। এবং তার উৎসাহ ছিলো, তোমাদের মতো শিক্ষিত মানুষেরাই আসলে মানুষের কষ্টকে অনুভব করতে পারে, মানুষের জন্য কাজ করবে না তো কার জন্য কাজ করবে। বড় কোনো লক্ষ্যের জন্য জীবন দিয়ে দেওয়ার উৎসাহ একটা পর্যায়ে তারুণ্যের থাকে, তারা সমাজ পরিবর্তনের নেশায় যুক্ত হয়ে যায়। এবং এরপরে একটা পর্যায়ে গিয়ে তুমুল ক্যারিয়ারিস্ট বিপ্লব করে, তবে পেশাদার বিপ্লবী হয়ে উঠে না। পেশাদার বিপ্লবী হওয়ার নেশায় কেউ কেউ অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে।

চমৎকার রোমান্টিক সময় কাটে তরুণের। সেই তরুণদের বিপথে চালিত করে গুয়েভারা। সে মোটর সাইকেলে চড়ে বিপ্লবের হর্ণ বাজাতে বাজাতে যায়। লাশ আর লাশের মিছিল যায় পিছনে পিছনে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।