আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অগভীর ভাবনা ১৮ ঘ- মধ্যবিত্ত চিহ্নিতকরণ প্রকল্প ::০::

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

আমাদের ভাষা বিশেষত সাহিত্যের ভাষা নির্মিত হয়েছে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে এসে। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা গদ্যের সূচনা হয়েছিলো এমনটাই প্রচলিত, এবং ইংরেজি শিক্ষিত মানুষেরা তখনকার প্রচলিত ধারাকেই অনুসরণ করেছেন। সুতরাং আমাদের গদ্যভাষায়ও ইংরেজি ছাপ, নিত্য স্ত্রীবাচক এবং নিত্যপুরুষবাচক শব্দের উপস্থিতি থাকলেও তৎকালীন প্রচলিত ইউরোপীয় ঘারানার লৈঙ্গিক চেতনসমেত শব্দের অনুপস্থিতি এ বিষয়টাকে চিহ্নিত করে। ফরাসী, স্পেনীয়, ইতালিয় কিংবা পর্তুগীজ ভাষায় স্ত্রীবাচক এবং পুরুষবাচক প্রত্যয় বিদ্যমান। সম্বোধন নয় বরং হিন্দি ভাষার মতোই এখানে ক্রিয়াপদ লিঙ্গ বৈষম্য ধারণ করে।

ক্রিয়ার স্ত্রী ও পুরুষবাচক রুপ, শব্দের লিঙ্গবিভাজন বাংলা ভাষায় নেই, একেবারেই অনুপস্থিত এমনটা বলা যাবে না, বরং কবিরাজ নিত্য পুরুষবাচক শব্দ, পেশাগত বিবেচনায় মহিলাদের কবিরাজ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বাংলায়, তেমন ভাবেই শাকচুন্নী শব্দটাও নিত্য স্ত্রী-বাচক, পুরুষ কেউ শাকচুন্নী হতে পারবে না। ভিক্টোরিয়ান যুগ এবং ভিক্টোরিয়ান কেতার চর্চা হচ্ছিলো বলেই শরীর এবং যৌনতাভিত্তিক একটা অলিখিত ট্যাবু বাংলা মধ্যবিত্ত মানসে নির্মাণের সাথে সাথেই প্রবেশ করেছে। এই মধ্যবিত্ত মানস নির্মান করলো কারা? কারা মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিকে নির্মাণ করলো, একটু শিক্ষিত হয়ে উঠা বাঙালীবাবুদের পরিধেয় এবং বাচনিক কাঠামোটা কারা নির্ধারণ করে দিলো। কোনটি গ্রাম্যটা, কোনটি অশিক্ষিত আচরণ, কোনটি কোনো রুচিশীল ব্যক্তি করলে তার আলোকিত রুপটি অন্ধকারাচ্ছন্ন বিবেচিত হবে এইসব কেতা নির্দিষ্ট করে দিলো কারা? এবং পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর কোনো রকম পরিবর্তন ব্যতিরকেই এটার অনুসরণ হলো বাঙলা ভাষাভাষিদের ভেতরে। আমাদের সুশীলতাবোধ, আমাদের মানবিকতাবোধ, আমাদের কৃষ্টি এবং উৎসব মধ্যবিত্তের নির্মিত নয় মোটেও।

ইশ কি ভীষন রকম অনাসৃষ্টি- যদিও মধ্যবিত্ত মানুষেরা ধারনা করছে এটা তারাই নিজেরা ভালো মনে করেছে বলেই গ্রহন করেছে, তবে এই ভালো কিংবা খারাপের ধারণাটাও আদতে পুরোনো মানুষেরা ঠিক করে দিয়েছিলো। এই ফাঁকিটা ধরতে না পেরে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের জায়গাটাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে মধ্যবিত্ত বাঙালী। ঠাকুর পরিবার বাংলাদেশের পোশাক সংস্কৃতিতে বিপ্লব এনেছে। বাঙালীকে শাড়ী পড়তে শিখিয়েছে অন্তর্বাসসমেত। বডিসের অনুকরণে ব্লাউজ আর সায়ার ধারণাও এসেছে ঠাকুর পরিবারের নেতৃত্বে।

আমাদের শাড়ী পড়বার কেতা কিংবা পোশাক সংস্কৃতিতে ঠাকুর পরিবারের অবদানও অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু ঠাকুর পরিবার কি আদৌ মধ্যবিত্ত? প্রেম শিখিয়েছে কে বাঙালীকে? বাঙালী কি প্রেম করতে শিখেছে? আধুনিক ইমদাদুল হকের বই পড়ে প্রেমের পাঠ নিয়েছে কে? বাঙালী উপন্যাসে দারিদ্রকে চিত্রিত করেছে কিংবা বিশেষায়িত করেছে বিভুতিবাবু, পথের পাঁচালির দারিদ্রের বর্ণনা অন্য কোনো সমসাময়িক উপন্যাসে নেই। তবে মধ্যবিত্ত মানসিকতায় মেয়েলীপনাকে রীতিমতো চর্চার বিষয় করে তুলেছিলো শরৎচন্দ্র। আমাদের চিরায়ত মেয়ে রুপটি, যা ভেবে মধ্যবিত্ত শান্তি পায়, এবং মধ্যবিত্ত যুবক ঠিক যে কেতায় তার প্রেয়সীকে দেখতে চায় সেটা শরৎচন্দ্রীয় কেতা। কোমল, সুশীলা, বিবেচক এবং কষ্টসহিষ্ণু যে প্রেম-ভালোবাসায় কাতর। সামান্য অনাদরে যে কেঁদে অস্থির হয়, সামান্য ভালোবাসায় যে হাওয়ায় ভাসতে থাকে, রবীন্দ্রনাথ তার উপন্যাসে কিংবা ছোটো গল্পে আদতে কোনো মেয়ে রুপকে স্পষ্ট করতে পারে নি।

অন্তত আমার পড়া রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ছোটো গল্পে মেয়েদের রুপটি প্রচলিত সমাজে দেখতে পাই না। কিংবা মেয়েলী চরিত্র বলে দেওয়া অনুযোগগুলোর কোনোটাই রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নায়িকার গুণাবলীর ভেতরে পড়ে না তেমনভাবে। নজরুলের নিজস্ব গল্পগুলো আমার নিজের পছন্দ না। অনেকই হয়তো পছন্দ করতে পারে। এবং এর বাইরে মুসলিম উপন্যাসিকের উপস্থিতি নেই।

অন্তত যে সময়ের কথা আমি বিবেচনা করছি, মুসলীম লীগ জন্ম নিয়েছে, এবং বাঙালী বাবুরা কলিকাতা অসম কিংবা রেঙ্গুনে গিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তণের চেষ্টা করছে, শিক্ষিত হয়ে তারা অর্থ উপার্জন করে সামাজিক মই বেয়ে উপরে উঠবার চেষ্টা করছে- এবং ক্রমশ একটি সংস্কৃতিকে অনুসরণ করছে- এবং বাঙালী মধ্যবিত্ত নামক আহম্মক শ্রেণীটি তৈরি হচ্ছে- এই ৩০ বছরের ব্যপ্তিতে মুসলিম উপন্যাসিক যে বাংলা ভাষাভাষীদের ঘরের বইয়ের তাকে অধিষ্ঠিত হয়ে তার মানসিকতাকে নির্মাণ করছে এমন উদাহরণ কোথায়? বঙ্কিম তার আধাসংস্কৃত বাংলা উপন্যাসে অন্তত সামান্য ব্যতিক্রমী, সেটা বাদ দিলে বাংলা উপন্যাস মানেই আদতে ছিচকাঁদুনে এলানো ভাষণ। সচ্ছল বাঙালি পরিবারে, কিংবা আমরা শহুরে মানুষেরা এখনও যেসব মূল্যবোধের চর্চা করি পবিত্র জ্ঞানে সে সবের নির্মাণ হয়েছে মূলত ১৮৯৫ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তবে এসবের সাথেই অন্য কথাগুলোও বলা প্রয়োজন, হীনমন্যতার সূচনাও সচ্ছলতার সাথেই এসেছে। শিক্ষা যেহেতু নিজের সামাজিক স্তর বদলানোর পরীক্ষিত হাতিয়ার, সুতরাং কেরানি হয়ে উঠতে চাওয়া বাঙালীদের অধকাংশই আদতে সামাজিক স্তরটাকে বদলাতে চেয়েছে। কৃষকের ঘর থেকে বের হয়ে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করেছে , সেখানে ইংরেজি ভিক্টোরিয়ান যুগে প্রকাশিত উপন্যাস- কবিতা পাঠ করেছে বাঙালী, এবং ভিক্তোরিয়ার যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরপরই রোমান্টিক যুগে প্রবেশ করেছে বাঙালী।

এবং এই উপন্যাসবাহিত মূল্যবোধগুলো বাঙালী পবিত্রজ্ঞানে চর্চা করেছে। বাঙালী মধ্যবিত্তকে যে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আমরা দেখি, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে যেই সাধারণ সংস্কৃতি অনুসরণ করতে দেখা যায়- সেগুলো মূলত ইউরোপিয় ভিক্টোরিয়ান মানসিকতা এবং রোমান্টিক মানসিকতার প্রলম্বিত চর্চা। রোমান্টিক মানসিকতাকে বাংলা ভাষান্তর করেছে একদল মানুষ, অন্য একদল মানুষ ভিক্টোরিয়ান মানসিকতাকে বাঙালায় রুপান্তরিত করেছে। সুতরাং বাঙালি মধ্যবিত্ত মানেই কিছুটা কৈশোরাচ্ছন্ন এবং কিছুটা মানবিকতার মানসিক বিকারে ভোগা যৌনতাকে নিষিদ্ধ এবং আলোচনঅযোগ্য বিষয় বিবেচনা করা একদল মানুষ, যারা অন্তত অবদমনে কার্পন্য করে না। যারা একটু সত্যিকারের ভালোবাসার খোঁজে জীবন ব্যয় করে অবশেষে উপলব্ধি করে আদতে তাদের মূল চাহিডা কোমল মুখশ্রী এবং একটি যৌণাঙ্গ- সেই যৌণাঙ্গে সে পরবর্তী প্রজন্ম আবাদ করবে।

বাঙালী প্রেমে তেমন দায়বদ্ধতা নেই, দায়িত্বশীলতাবিহীন কুৎসিত একটি মানসিকতা কিংবা মানসিক বিকার যেখানে চিরায়ত বিষয়াদি উপস্থিত, জনমও জনম ধরি তোমারে বাসিবো ভালো দিয়ে যেই পাগলামীর সূচনা হয়। এবং তোমার বিহনে আমি বাঁচিবো না মরে যাবো, একাকী যৌনঅবদমনকে যে প্রেম অতি পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। এবং কিছুটা দীর্ঘশ্বাস যে প্রেমে বর্তমান থাকে, ইশ আর একটু হলেই হয়তো.....। তবে জীবন মানেই আদতে নিজের সামাজিক স্তরটাকে বদলে ফেলার চেষ্টা, আরও একটু ক্ষমতাবান হয়ে উঠবার লড়াই- সুতরাং যুগে যুগে একটা নির্ধারিত সামাজিক কেতায় এই পরিবর্তনগুলো সম্পাদিত হয়। একটি নির্দিষ্ট সামগ্রীক কেতা থাকে, যেই কেতা সবার জন্য একই রকম, কিন্তু ব্যতিক্রম এই সীমিত বিবর্তিত হওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালীর জীবনে।

এখানে সামগ্রীক সামাজিক বিষয়াদি মধ্যবিত্ত কিংবা যারা আউট বই পড়েছে, তাদের জন্য এক রকম এবং অন্য সবার জন্য আরেক রকম, উপদেশমূলক, নৈতিকতানির্মিত এইসব পূঁথি, উপন্যাস এবং উপদেশমালাকে অন্ধ অনুসরণ করে যাওয়া সংস্কৃতিকে আমি অগ্রাহ্য করছি না। তবে মধ্যবিত্ত প্রসঙ্গে আমার সিদ্ধান্ত- বিশেষত বাঙালী মধ্যবিত্ত যেই সংস্কৃতি এবং যেই ট্যাবুকে অনুসরণ করে সেটা - প্রথমত ইউরোপিয় মানবিকতাবাদ, ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতি এবং উনবিংশ শতকের ইউরোপ জুড়ে চলতে থাকা রোমান্টিক ভাববাদের সংশ্লেষিত রুপ। এবং এই সংশ্লেষিত রূপটা নির্মান করেছিলো তৎকালীন উপন্যাসিকেরা। এবং এটার সাথে যেইসব বিষয়াদি বর্তমানে সংযুক্ত হচ্ছে সেটাও আদতে আমদানি করা চেতনা। নিজস্ব একটা স্বাধীন মূল্যবোধ এখন মধ্যবিত্ত নির্মান করতে পারে নি।

এরা মূলত পরজীবি মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচে এবং পরবাসী মূল্যবোধকে নিজস্ব জ্ঞানে পূজা করে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।