আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানস চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি: উত্থান এবং তিরোধান প্রসঙ্গে মানস চৌধুরী # ৯০-এর প্রেক্ষাপট# এরশাদের পতনের পরিস্থিতিটাকে গণ-অভ্যুত্থান বলা হয়ে থাকে। এটা বেশ সমস্যাজনক। এর কারণ কেবলমাত্র এই নয় যে আধুনিক রাষ্ট্রে ঠিক গণ-অভ্যুত্থান হবার কোন পরিস্থিতি নেই। বরং ব্যাপারটা এই যে এরশাদের গদিহীন হওয়াটা গণ-অভ্যুত্থানের ফসল নয়।

এটা বুঝতে তেমন বেগ না পেলেও চলে। পরবর্তী কালে এরশাদের রাজনৈতিক মিত্র অর্জন এবং আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন Ñ এই দুইয়েই এটা বোঝা যায়, বোঝা দরকার। গণ-অভ্যুত্থান যদি হতই তাহলে, এটা পানির মত পরিষ্কার, এরশাদের বিরুদ্ধে জোরদার মামলা হত Ñ যেটা অন্তত বর্তমান কালে হতে পারে। কিংবা আরও সহজ কোন উপায়ে তার পাওনা গণ্ডা মানুষজন চুকিয়ে দিত। অঞ্চল বিশেষে তার তুমুল জনপ্রিয়তা, সেটা আমাদের উচ্চারণ করতে খারাপ লাগুক আর যাই হোক না কেন, ছাড়াও এরশাদ গদি হারিয়ে ভালই ছিল, এখনও আছে।

এখানে নিছক সতর্কতার কারণে আমাকে বলতেই হচ্ছে যে, এইরকম নৈরাশ্যবাদী আমি নই যে গণ-অভ্যুত্থানের যে কোন সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেব। আমার বক্তব্য সাদামাঠা। এরশাদের গদি ছাড়ার ব্যাপারটা নিছক সিভিল সমাজের উত্থান পর্ব বৈ কিছু নয়। সেই সিভিল সমাজ যা এরশাদকে গদি থেকে নামতে সাহায্য করে আরও বড় একটা রাজনৈতিক লক্ষ্যে এরশাদ ও অন্য অনেক সম-বর্গীয়দের সাফল্য হাছিলে বিপুল মদদ দিয়েছে। সেটা হল: সামরিক বাহিনীকে এবং, আরও নিরীখ করে বললে, সামরিক মনস্কতাকে যাবতীয়ভাবে মওকুফ করে দিয়ে, উল্টো আরও আপন করে নিয়ে মধ্যবিত্ত-আত্মপ্রতিকৃতি মজবুত হবার বনিয়াদ তৈরি করা।

সেটা নিশ্চয়ই সকলের আকাঙক্ষাপ্রসূত ছিল না, কিন্তু তা নিয়ে কথা হচ্ছে না। এরশাদ বিরোধী বিভিন্ন লড়িয়ে গোষ্ঠীর স্পৃহা নয়, কথা হচ্ছে ঘটনা পরম্পরার পরিণতি নিয়ে। আমাদের মনে পড়বে যে বছর শ খানেক বা শ দেড়েক আগে আমাদের পূর্বসূরী(পুরুষ)গণ বৃটিশ প্রভুদের হাত থেকে ‘খান বাহাদুর’ ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব পাবার পর হাতে সেই ফরমান গুটিয়ে নতুন বসা স্টুডিওতে গিয়ে মোঁচ পাকিয়ে একখানা ছবি তুলতেন, আর সেটা উত্তরপুরুষদের বিরাট গর্বের ধন হয়ে উঠেছে বটে। বর্তমান আলোচ্য আত্ম-প্রতিকৃতি তার থেকে শক্তিশালী এবং ঐতিহাসিকভাবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। মানে হ’ল ’৯০-এর প্রোপটের সবচেয়ে বড় দিক সিভিল সমাজের উত্থান।

এখন পরিষ্কার হওয়া দরকার, এরশাদের গদিবিহীন ক্ষমতার ফর্মুলা আবিষ্কার হওয়ার একটা উত্থানপর্ব আর আম-মানুষের এরশাদ বিরোধী চেতনা ও স্পৃহাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গুলিয়ে ফেলার কোন কারণই নেই। এ কথা উঠছে এই কারণে যে কিছু আগেই অঞ্চল বিশেষে এরশাদের তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আম-জনতার এরশাদ বিরোধী চেতনার বা স্পৃহার কোন পাঠযোগ্য আলামত পাওয়া যাক বা না যাক তা সম্পর্কিত হচ্ছে এরশাদ কোন্ ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করত Ñ তার সঙ্গে। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে যে এইভাবে ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মেলা জটিল হয়ে যাচ্ছে প্রসঙ্গটা এবং অনেক অনেক নাগরিক মানুষের খুশী হবার মত পরিস্থিতি থাকছে না। কারণ এর পরপরই এই প্রশ্ন চলে আসে: খুব একটা ভিন্ন ধরনের প্রতিনিধিত্ব কি এরশাদের পতনের পর তৈরি হয়েছে?! এটি, সন্দেহ নেই, খুবই বিপজ্জনক প্রশ্ন।

বিশেষভাবে তাঁদের জন্য যাঁরা, কোন পরিবর্তন হোক বা না হোক, এরশাদের পতন(!) ঘটাবার কৃতিত্ব এবং নেতৃত্বের স্বীকৃতি খুবই চান। এখানে, আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যকার টানাপোড়েনকে আমাদের সামনে যত গুরুত্বপূর্ণ করেই দেখানো হোক না কেন, আর অতীতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিক থেকে এ দুই দলের মধ্যে যতটাই পার্থক্য থাকুক না কেন, কথা আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নিয়ে হচ্ছে না। ‘নাগরিক মানুষ’জনকে নিয়ে কথা হচ্ছে, আর বিশেষভাবে অবশ্যই এঁদের একাংশ। # গণআদালত: শ্রেণী সংহতির পাটাতন# গণ আদালতে আসলে কোন্ ধরনের ‘গণ’ সামিল হতে পেরেছিলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে মুখ্য প্রসঙ্গ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া।

এমন নয় যে আমি পাতলা করে দিতে চাইছি মুখ্য সংগঠকদের নেতৃত্ব এবং গুরুত্ব প্রসঙ্গ। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষতির কথা যদি আমরা মনে রাখি তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইবার চেতনা নিয়ে সারা বাংলাদেশে নানান প্রান্তে যাঁরা প্রস্তুত হয়ে আছেন তাঁদের চেহারা স্মরণে রাখা জরুরী। তাঁদের কোন ধরনের অংশগ্রহণ ছিল না Ñ এমন সরল ধরনের বক্তব্য দেয়া আমার আগ্রহ নয়। কিন্তু তাঁদের অংশের প্রতিনিধি নাগরিক নেতৃত্বে ছিল কিনা Ñ সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের আশু উত্তর আমাদের জানা আছে।

নাগরিক অংশের নেতৃত্ববানেরা সকলেই ছিলেন নির্দিষ্ট কতগুলি এজেন্ডা নিয়ে। সেই এজেন্ডা হচ্ছে: নিজেদের একটা সংহত জমিন। এই সংহত জমিনের নির্দিষ্ট এবং ঐতিহাসিক অর্থ আছে। এমন নয় যে এরশাদের পূর্বকালের শ্রেণীগত সুযোগ ও সুবিধাদি বড়সড় রকমের হাতছাড়া হয়েছে এই সময়ে Ñ মানে এরশাদের শাসনামলে। কিন্তু একটা পরিসরগত লড়াই চলছিল সারাক্ষণ Ñ যে লড়াইটা নেতৃস্থানীয় সিভিল মানুষজনের জন্য সম্মানজনক নয়।

আর তাঁদের প্রত্যাশিত আত্মপরিচয় গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। পরিসরের এই লড়াইটা চলেছে দেশের সামরিক শাসকবর্গের সঙ্গে। সামরিক বাহিনীর শাসকবর্গের সদস্যরা যেভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব গড়ে তুলেছিল সেটাকে মেনে নেয়া আলোচিত এই গোষ্ঠীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ফলে সামরিক প্রতিনিধির সঙ্গে লড়াইকে একই সঙ্গে সামরিক স্বার্থের সঙ্গে লড়াই হিসেবে পাঠ করবার গলদ্ করা কোনভাবেই ঠিক হবে না। এখানে নিছক ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্য একটা ব্যাপার বলবার আছে।

‘গণ-আদালতের নাগরিক উদ্যোক্তাদের’ মধ্যে বাংলাদেশের নানান প্রান্তের মানুষের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না Ñ এই বক্তব্যের একটা ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। এটা ঠিক যে, আদালতের প্রান্তরে Ñ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা নিছক শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কেবল নন। এসেছিলেন পোড় খাওয়া নানান মুক্তিযোদ্ধা Ñ যুদ্ধের পর যাঁদের বড় রকম কিছুই পাওয়া হয়নি। এসেছিলেন শ্রমিক পেশার নানান মানুষ Ñ শহর এবং শহরতলী থেকে, যাঁরা চোখের সামনেই দেশীয় শিল্পের যাবতীয় মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন Ñ সেই মৃত্যু ভাল-মন্দ যাই হোক। এসেছিলেন ছোট শহরের নানান উদ্যোক্তা-সংগঠক নারী-পুরুষ যাঁরা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে কিছু একটা অখণ্ড আছে বলে এখনও মনে করেন।

তাই, কথা এই সরল সত্য নিয়ে হচ্ছে না। ওই দিনের ওই বিশেষ জমায়েতে কয়েক লাখ লোকের মধ্যে নানান সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন Ñ তা পরিষ্কার। এমনকি এটাও স্পষ্ট যে, গণ-আদালতের পর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তৎপরতার দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষজনেরা তাকিয়ে ছিলেন। একটা কোন অর্থ ছিলনা এই তাকানোর, নানান অর্থ ছিল, তবুও। তাই, কথা এ নিয়েও হচ্ছে না।

কথা হচ্ছে মহানগরের সেই তাঁদের নিয়ে যাঁরা ’৯০-এর দশকে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নাগরিক পাটাতন তৈরি করেছিলেন। আর এই পাটাতনের ভিত্তি, সেটাই এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাইছি, ’৯০ দশকের প্রাক্কালে গড়ে ওঠা সিভিল সমাজ বলে কথিত শহুরে মধ্যবিত্তের সংঘের উত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। ফলে বিষয়টাকে আন্ডারলাইন করে রাখা যেতে পারে। ভাবতে কষ্ট হলেও একটা ব্যাপার আমাদের স্মরণে আনা দরকার পড়ছে।

এরশাদের গদি ছাড়া এবং পরপরই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি Ñ এ দুয়ের সাথে সম্পর্কিত সেই ব্যাপারটা। স্মৃতি একটু খতিয়ে দেখলে মনে পড়বে যে এরশাদের সময়কালে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ঘাঁটিতে অনেক বাম চিন্তক নজরে আসতেন। হ্যাঁ, এই প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই আসতে পারে সেই চিন্তকগণ কতটা খোল-নলচে দ্বারা গঠিত ছিলেন আর কতটা রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দ্বারা। কিন্তু, সেই প্রশ্নের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হল: আমাদের মনে হয়েছে যে কাগজে কলমে দেশের সিংহভাগ বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন বাম বা কাগুজে বাম। নির্বাচনের প্রাক্কালে, নির্বাচনের পর কিন্তু সেই ঘাঁটি হঠাৎ বেবাক খালি হয়ে পড়ল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.