আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (২৬তম পর্ব)

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে শাহেন শাহ তার প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মহল থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। সর্বশেষ সাক্ষাতের সময় তিনি কোনো কিছু না বলেই নূরজাহানের মহল থেকে চলে আসছিলেন। সে রাতের জ্যেৎস্না প্লাবিত আকাশ, বসন্তের মিষ্টি বাতাস এবং প্রিয়তমার অপরূপ রূপ মাধুর্য তাকে প্রায় পাগল করতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই মনে পড়ে গিয়েছিল আফসানার কথা। আনার কলির সঙ্গে সম্র্রাটের বিরহের জন্য তিনি দুনিয়ার অনেককে দায়ী করতে পারেন। ফলে তার প্রসঙ্গ আসলে মনে রাগ দানা বেঁধে ওঠে।

কিন্তু আফসানার প্রেম, পরিণয় এবং মৃত্যু- পুরোটাই যেন অলৌকিক ঘটনা। হঠাৎ করেই এসেছিল আবার হঠাৎ করেই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। অতি অল্প সময়ের স্মৃতি, কিন্তু প্রবলভাবে বেদনাহত করে। কোনো সুন্দরতম মুহূর্ত কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণে আফসানার কথা মনে হতেই শাহেন শাহ নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

গত ১৩/১৪ দিন সম্রাট বলতে গেলে কোনো কাজই করেননি কেবলমাত্র রাজ দরবারে হাজিরা দেওয়া ছাড়া।

সম্রাটের পাত্র-মিত্র উজির-নাজির, সবাই বুঝেছিলেন হুজুরের মন ভালো নেই। সম্রাজ্ঞীও বুঝেছিলেন তার প্রিয় স্বামীর কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু হেরেমের গণ্ডি পেরিয়ে সম্রাটের কাছাকাছি যাওয়ার কোনো বিধান ছিল না। তাদের বিয়েও হয়েছে অতি অল্পকাল আগে- এক মাসও হয়নি। প্রথম কয়েকদিনের প্রেমের প্রবল বন্যায় ভাসার পর হঠাৎ করেই এই বিরহ সম্রাজ্ঞীর কাছে একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠল। তিনি মনে মনে কত কথার ফুলঝুরি যে সাজিয়ে রেখেছিলেন তার হিসাব মেলানো কঠিন।

স্বয়ং সম্রাট তার কাছে সুবেবাংলা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও জানতে চেয়েছিলেন আরবি কবি ইমরুল কায়েসের প্রেম ও কবিতা সম্পর্কে। এর বাইরে আরও কত গান, কবিতা এবং কথামালার ডালি সাজিয়ে সম্রাজ্ঞী বসে আছেন, কখন তিনি আসেন। কিন্তু তিনি আর আসেন না, সম্রাজ্ঞীর আস্থায় চির ধরল। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন।

তবে কী তার কোনো ত্রুটি! অসৌজন্যমূলক আচরণ যা কিনা সম্রাটকে বিচলিত করেছে।

সম্রাজ্ঞী কি মনে করে যেন আয়নার সামনে গেলেন। বার বার নিজের দিকে তাকালেন- এই মাধুর্য তিনি কোথায় পেলেন। নিজের ঠোঁট, চোখ, ভ্রূ, ললাট, গণ্ডদেশ এবং ত্বকের সৌন্দর্য দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তারপর বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজে নিজেই বললেন, কি হবে এসব দিয়ে যদি তিনিই না ভালোবাসেন।

হাতে তালি বাজিয়ে খাদেমাকে ডাকলেন এবং লেখার সরঞ্জাম হাজির করার হুকুম দিলেন। সম্রাজ্ঞী লিখতে বসলেন- হিন্দুস্তানের বাদশাহ, জমিনে মহান আল্লাহর খলিফা, মহামতী নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সমীপে সেবিকা- নূরজাহানের আরজ- দাসী ইদানীংকালে বড়ই পেরেশানিতে আছে। মনে হচ্ছে, মাথার ওপর পুরো আসমানই বোধ হয় ভেঙে পড়েছে। হৃদয় হাহাকার করতে করতে সমগ্র দেহমন যেন একটা আস্ত মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কেবল ধু-ধু মরুভূমি কোথাও মরূদ্যান নেই, তপ্ত মরুভূমি যেরূপ বৃষ্টির জন্য হাহাকার করতে থাকে তদ্রূপ আমিও নিরন্তর আপনার প্রতিক্ষায় দিনাতিপাত করছি।

প্রতিদিন সকাল হয়, আমি আমার কামরা থেকে বের হয়ে সূর্যোদয় দেখি। সকালের পাখির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রকৃতির অপার রঙের সঙ্গে রং মেশানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমার মরুভূমিতে ফুল ফোটে না, কোনো পাখি যেন ভুলক্রমেও আমার দিকে তাকায় না। পুরো প্রকৃতিই মনে হয়, আমাকে ত্যাগ করেছে, কারণ আমার মালিক যে আমার কোনো খোঁজ-খবর রাখছেন না। কেবল ফরিয়াদ কী আমার অপরাধ! যদি অন্যায় করে থাকি, তবে শাস্তি দিন।

আমায় মেরে ফেলুন। কিন্তু যতদিন জীবিত আছি ততদিন আপনার সানি্নধ্য থেকে বঞ্চিত না করার আকুল প্রার্থনা নিয়ে আজ রাতে হৃদয় উজাড় করে হুজুরের অপেক্ষায় থাকব, বিনীত নূরজাহান।

সম্রাজ্ঞীর চিঠি পেয়ে শাহেন শাহ দারুণভাবে উতলা হয়ে পড়লেন। বার বার নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন। আপন মনে বলতে থাকলেন, আমার দুর্বলতার জন্য অন্য কাউকে কষ্ট দেওয়া মোটেই উচিত হয়নি।

নিজের বহুগামিতার জন্য নিজেকে কয়েকবার ধিক্কার দিলেন। নিজের ওপর অবিচার করতে করতে তিনি কি তাহলে ন্যায় বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন? নিজের ভগ্ন স্বাস্থ্য এবং ভগ্ন মনের দীর্ঘশ্বাসের দায় কেন নূরজাহানকে বইতে হবে, কেন তিনি অন্তত একটি বারের জন্য সম্রাজ্ঞীকে জানাননি, কয়েকটি দিন তিনি হেরেমে যাবেন না! তিনি অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন, তার চরিত্রে কতগুলো একগুঁয়েমি এবং গোয়ার্তুমি রয়েছে।

এসব বদ অভ্যাস যদিও তার পদ-পদবির জন্য মানানসই কিন্তু মানুষ হিসেবে এগুলোর অধিকারীকে সমাজে কেউ ভালোবাসে না। রাজপদ, সিংহাসন এবং মানবিক গুণাবলী একসঙ্গে সমানতালে বিকশিত না হলে ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায় না। সম্রাট সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, তিনি নিজেকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতার বাইরে রাখবেন না।

তিনি সম্রাজ্ঞীর চিঠিটি বার বার পড়লেন এবং পাল্টা চিঠিতে স্ত্রীকে লিখলেন-

'প্রিয়তমা নূরজাহান, আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি নিজের কৃত ভুলের জন্য। আমি এ কথাও স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার উচিত হয়নি সে রাতের প্রণয় বাসর ছেড়ে হঠাৎ করেই তোমাকে একলা ফেলে হেরেম থেকে চলে আসা। আমি অনুতপ্ত নিজের কৃতকর্মের জন্য। তোমার পত্র পাওয়ার পর আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছি, পূর্বে আমার মনে হতো, আমার ক্ষমতা, আমার ইচ্ছা, আমার লোভ কিংবা লালসা সীমাহীন এবং অবারিত। আমার এও মনে হতো, আমি যা ইচ্ছা করতে পারি।

যার যা কিছু মালিকানায় রয়েছে কিংবা দখলে রয়েছে তা রাজ্যের মালিক হিসেবে আমি ভোগ বা ত্যাগ করতে পারি। কিন্তু আজকের পড়ন্ত বিকালের রক্তিম সূর্যের বর্ণালী আভার সংমিশ্রণে তোমার চিঠির শব্দমালা পড়তে গিয়ে বার বার নিজে নিজেই প্রতিজ্ঞা করছি-না, আমি এখন থেকে আগের মতো চলব না।

আমার কলিজার টুকরা, আমার পাখি, আমার চাঁদ-তোমার পত্র পাওয়ার পরই মনে হয়েছে প্রতিটি মানুষের উচিত সার্বক্ষণিকভাবে তার প্রিয়জনের খোঁজ করা- একে অপরের সঙ্গে দায়বদ্ধ থাকা এবং স্বামী-স্ত্রীর উচিত বেশি বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়া। তোমার পত্র পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমি ব্যস্ত ছিলাম নিজেকে নিয়ে। নিজের জীবনের এক বিষাদময় ক্ষত যা কিনা বহু বছরের পুরনো এবং স্বাভাবিকভাবেই ভরাট হয়ে যাওয়ার কথা, আমার নির্বুদ্ধিতা পুনরায় সেই বেদনার ক্ষতটি সযত্নে খনন করে গত দুই সপ্তাহ সবকিছু ভুলে সেখানে ডুব মেরে বেদনার অমৃতস্বাদ গ্রহণ করে জারে জার হচ্ছিলাম।

তোমার চিঠির মর্মবাণী আমাকে বেদনালোক থেকে আনন্দলোকে টেনে নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে তুমি যদি আমাকে কোনো প্রশ্ন কর, সে ক্ষেত্রে আমার লজ্জিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তোমার চিঠি পড়ার পর আমি অনেকদিন পর প্রাসাদ বেদিতে গেলাম। পড়ন্ত বিকাল। অন্য দিনের তুলনায় আজকের বিকালের বাতাস ছিল ঠাণ্ডা।

বাতাসের ঝাপটায় মনটা হালকা হয়ে গেল। গত কয়েকদিনের বেদনা আর কষ্টবোধের কারণে আমি একবারের জন্য আকাশের দিকে তাকাইনি, দেখিনি কোনো মেঘের ভেলা। জমিনের কোনো বৃক্ষরাজি কিংবা ফুল-ফলও আমার দৃষ্টিতে আসেনি। কোনো পাখির গান বা প্রকৃতির নানা নাম না-জানা কীট-পতঙ্গের বাহারি কথা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তোমার চিঠির ওপর দৃষ্টি পড়া মাত্র আমার হৃদয় প্রসারিত হয়ে গেল- আমার চক্ষু খুলে গেল এবং আমি শুনতে পেলাম প্রকৃতির অনবদ্য প্রেমসংগীত।

আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাকে না জানিয়ে তোমা বিহনে আর কখনো অন্ধ, বধির এবং অনুভূতিহীন মানুষ রূপে সেধে সেধে বেদনার সাগরে ডুব দেব না।

আমার নূরজাহান, এখন শুধু সূর্য ডোবার পালা। অস্তগামী সূর্যের বর্ণিল আভা আকাশের পশ্চিম কোণে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আমি পেঁৗছে যাব তোমার মহলে। তুমি অনুগ্রহ করে আয়োজন কর প্রয়োজনীয় সব কিছু, যাতে আমাদের স্বপ্নবাসর যেন পূর্ণতা পায় নিবিড় সানি্নধ্যের পরম ঘনিষ্ঠতায়। আজ আমি মিশে যাব তোমার সঙ্গে।

তোমার হৃদয়ের সঙ্গে এবং তোমার ভাবনার সঙ্গে একান্ত অনুভবে। আজ আমি তোমার কথা ভাবছি এবং উত্তেজনায় ছটফট করছি। জীবনের প্রথম প্রেমের স্বাদ আস্বাদনের পূর্বে তলপেটে যেরূপ চিনচিনে বেদনার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, তেমনি আমারও আজ যেন কেমন কেমন লাগছে। তোমার নাম স্মরণ করা মাত্র ব্যথাটির তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। শুভ বিকাল

ইতি তোমারই সেলিম।

'

সম্রাজ্ঞী চিঠি পাওয়ার পর খুশিতে পাগল হয়ে গেলেন। একবার দুইবার নয়-বহুবার তিনি চিঠিটি পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্ত করে ফেললেন। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু দুষ্টু চোখে একা একা ভুবন মোহিনী হাসি হাসলেন বহুক্ষণ। নিজের হাত বার বার নিজের মুখমণ্ডলে ঘষতে লাগলেন আর আপন মনে বলতে থাকলেন, ওরে আমার সোনামণি রে! আহারে আমার জাদুমনির তলপেটে ব্যথা করছে, ও পাখি! কোন জায়গায় ব্যথা, আমায় একটু দেখাও তো। আমি ভালো করে আদর করে দেই, দেখবে সব ব্যথা নিঃশেষ হয়ে গেছে! আরে নাহ! এত তাড়াতাড়ি ব্যথা নিঃশেষ করা যাবে না।

আরও কিছুক্ষণ ব্যথাটা থাকুক না, আর আমি বেদনার স্থানে সেবা করে মস্তবড় কবিরাজ হয়ে যাই! সম্রাজ্ঞী আপন মনে বিড় বিড় করে এসব কথা বলছিলেন এবং কিশোরী মেয়ের মতো চুলের বেণি দুলিয়ে নাচছিলেন। ঠিক এই সময় তার বিশ্বস্ত বাঁদি কামরায় ঢুকল। সম্রাজ্ঞী যথাসম্ভব সংযত হয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

আমার মালেকা-ই আলিয়া, সময় খুবই অল্প! আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সবকিছু ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন করার জন্য। এখন শুধু দরকার আপনার সদয় সহযোগিতা-বিনয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলে বাঁদিটি সম্রাজ্ঞীকে কুর্নিশ করল।

আসলেই তো! এখনো অনেক কিছু বাকি আছে- লোকজন না হয় গৃহকর্ম করল। কিন্তু তারও তো অনেক কিছু করার আছে। নিজস্ব পয়ঃপরিষ্কার, গোসলাদি-সাজসজ্জা-আরও কত কি! সম্রাজ্ঞী মনে মনে এসব কথা স্মরণ করা মাত্র কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। সূর্য অস্ত যাওয়ার আর বেশি সময় বাকি নেই- তিনি পারবেন তো!

সম্রাট সাধারণত দিনের প্রথম প্রহরেই হেরেমে তার আগমনী সংবাদ পাঠিয়ে থাকেন। আজকের দিনটা সব দিক থেকে ব্যতিক্রম।

ইতোপূর্বে মোগল শাহী খান্দানের কোনো সম্রাজ্ঞী একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি নিয়েও সম্রাটকে পত্র লেখা দূরের কথা- লেখার কথা কল্পনাও করতে পারেননি। শরীর, মন, কাম-ক্রোধ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা বা ইচ্ছার কথা কোনো সম্রাট যেমন তার স্ত্রীর কাছে বলেননি, তেমনি স্ত্রীগণও কখনো নিজেরা বলেননি, বলতে পারেননি বা চাননি। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী খান্দানের রক্তের ধারক-মোগল শাহীর দিলি্ল হেরেম তো বটেই, অপরাপর হেরেমেও নারীরা কোনো দিন তাদের শাহেনশাহকে পত্র লেখেননি- কেবল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ছাড়া। আর সম্রাজ্ঞীর পত্র পাওয়া মাত্র সব কাজ ফেলে শাহেনশাহ হেরেমে চলে আসবেন এটাও কেউ কোনো দিন ভাবতে পারেননি। অথচ ১৬১১ সালের জুন মাসের পড়ন্ত বিকালে ভারতবর্ষের রাজধানী আগ্রার নিকটবর্তী ফতেপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদে সেই ঘটনাটি ঘটল।

সম্রাজ্ঞীর বিয়ের বয়স এক মাসও হয়নি। মে মাসের ২৫ তারিখ বিয়ে হওয়ার পর অল্প কয়েকটি রাত তারা স্বপ্নবাসরে কাটাতে পেরেছিলেন মাত্র। উভয়েরই ইচ্ছে ছিল শহর ছেড়ে কোথাও বেরিয়ে পড়ার-হয়তো কাশ্মীর, না হয় লাহোর কিংবা দাক্ষিণাত্য। উভয়েই চাচ্ছিলেন নিবিড়ভাবে পুরোটা সময় একে অপরের সানি্নধ্যে থাকার জন্য। সারাটা দিন এবং সারাটা রাত সাধারণ গৃহস্থ ঘরের স্বামী-স্ত্রীর মতো তারা আয়েশী ভঙ্গিতে কাটাবেন।

সম্রাজ্ঞী রান্না করবেন আর সম্রাট মেঝেতে বসে খাবেন, খাওয়ার পর চাম্বুল, জাফরান এবং মৃগনাভির সুগন্ধিযুক্ত মসলার পান মুখে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দিকে মহব্বতের দৃষ্টি নিয়ে তাকাবেন। একজন অন্যজনকে নিয়ে হালকা ঠাট্টা মশকরা করতে গিয়ে টুকটাক খোঁচা বা সুড়সুড়ি দেবেন- আর অন্যজন খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবেন। সময়টা যদি মধ্যাহ্নভোজের পরে হয় তবে হাসতে হাসতে সম্রাজ্ঞীর পেট ব্যথা করবে। আর সম্রাট তাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেবে। পেটে নিজ হাতে গরম তেল মেখে দেবেন এবং কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে নানা উপদেশ দিয়ে তার কান ভারী করে ফেলবেন।

মূলকথা ভরা পেটে হাসতে নেই। ভরা পেটে কঠিন কর্ম করতে নেই। এসব কথা বলবেন এবং পেটে গরম তেল মালিশ করবেন। এরই মধ্যে কোনো এক সময় সম্রাটের ভরা পেট গরম হয়ে যাবে আর সম্রাজ্ঞী সেই দৃশ্য দেখে আবার খিল খিলিয়ে হেসে উঠবেন।

চমৎকার একটি কবি মন এবং মরমী হৃদয় নিয়েও সম্রাট পারেন না অনেক কিছু করতে।

তেমনি পারেন না সম্রাজ্ঞীও। হেরেমের বিধিবদ্ধ নিয়ম এবং ঐতিহ্য মানতে গিয়ে তাদের উভয়কেই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হয়। ফতেপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদে কম করে হলেও হাজার পঞ্চাশেক লোক বসবাস করেন। রাজপরিবারের সদস্য ছাড়াও দাস-দাসী, সৈন্য সামন্ত, দ্বাররক্ষী থেকে শুরু করে সামরিক বেসামরিক বহু কর্মকর্তা-কর্মচারী সপরিবারে এখানে বাস করেন। মূল প্রাসাদের বাইরে রয়েছে আরও অনেকগুলো প্রাসাদ, সেনা ব্যারাক, সেনা চৌকি, বাইজি মহল, বাগানবাড়ি এবং জায়গীর মহল।

এসব এলাকায় কম করে হলেও এক লাখ লোক বাস করেন, যাদের সবাইকে শাহী প্রাসাদের অংশ মনে করা হয় এবং তাদেরও প্রায় একই ধরনের আইন মেনে চলতে হয়। প্রাসাদ, হেরেম, রাজদরবার এবং প্রাসাদ সংযুক্ত এলাকায় সব নিয়ম-কানুনের আধার হলেন স্বয়ং সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী। ফলে অন্য সবাইকে আইন মানতে উৎসাহী, উদ্বুদ্ধ এবং বাধ্য করানোর পূর্বে স্বয়ং সম্রাট-সম্রাজ্ঞী নিজেরা কঠোরভাবে আইন মেনে চলতেন। এত সব আইনের গ্যাঁড়াকলের মধ্যে সম্রাট-সম্রাজ্ঞী এবং যুবরাজ ও তার স্ত্রী কখনোই স্বভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। কিন্তু রাজধানীর বাইরে সম্রাট যখন ভ্রমণে বা অন্য কোন কর্মে বের হন তখন তারা একই তাঁবুর নিচে একই বিছানায় ঘুমান- যদি স্বয়ং সম্রাটের কোনো আপত্তি না থাকে।

বিয়ের পর থেকেই সম্রাট-সম্রাজ্ঞী পরিকল্পনা করছিলেন শহর ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসার জন্য। সম্রাট বলেছিলেন লাহোর বা কাশ্মীরের কথা। সেখানে যেতে পথে নাকি বেশ কয়েকটি বড় বড় জঙ্গল পড়ে। সেই জঙ্গলের ধারে তাঁবু গেড়ে জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে সম্রাজ্ঞীর মুখে আরবীয় কবি ইমরুল কায়েসের কবিতা এবং প্রেমের কাহিনী শোনার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন শাহেনশাহ। কিন্তু হঠাৎ করে কি ই বা এমন হলো যে ওই রাতে সম্রাট মুখ গোমরা করে সেই যে চলে গেলেন, আর এলেন না।

গত প্রায় দুই সপ্তাহ কোনো খোঁজ নেই। আজ সৌভাগ্যক্রমে তিনি আসছেন- ভাবতেই সম্রাজ্ঞীর দেহমন পুলকিত হয়ে উঠল।

সম্রাজ্ঞী তার প্রিয় বাঁদিকে হাম্মামখানা প্রস্তুত করতে বললেন। হাম্মামে ঢোকার পূর্বে তিনি পুনরায় আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করালেন। হাত-পায়ের নখের দিকে নজর করলেন।

না ঠিকই আছে কাটতে হবে না। শরীরের অবাঞ্ছিত লোমের কথা ভাবলেন এবং স্মরণ করলেন শাহেন শাহের রুচিবোধের কথা। ওসব তিনি একদম পছন্দ করেন না। সম্রাজ্ঞী নিজেও ওসব বিষয়ে খুতখুতে স্বভাবের। দাঁত মাজা, মুখ পরিষ্কার, সময় নিয়ে প্রাতঃকর্ম সম্পাদন, পুষ্টিকর এবং সহজ প্রাপ্য খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত চুল, ত্বক এবং হাত-পায়ের আঙ্গুল ও নখের পরিচর্যার পাশাপাশি তিনি সব সময় খেয়াল করেন যেন তার ঘাম, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে নূ্যনতম দুর্গন্ধ না ছড়ায়।

প্রকৃতিগতভাবে ওসব কাজ পশুদের করতে হয় না। স্বয়ং আল্লাহ পশুদের শরীরে এমন সব রাসায়নিক বস্তুর নিঃসরণ ঘটান যাতে করে তাদের দাঁত ময়লা হয় না-জিহ্বা পরিষ্কার থাকে। কিন্তু মানুষকে সব কিছুর তদারক করতে হয়। আর তা না করলে মানুষের বর্জ্য আর দুর্গন্ধে পৃথিবীতে কোনো পশু-পাখি বাস করতে পারত না।

একান্ত ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো শেষ করে সম্রাজ্ঞী এবার শাহী হাম্মামখানায় ঢুকলেন।

সময়টা গ্রীষ্মকাল- কিন্তু বিকালে বা সন্ধ্যার মাঝে মধ্যে বসন্তের আমেজ পাওয়া যায়। এ সময় আগ্রার বাতাসে প্রচুর ধুলাবালু থাকে। পার্শ্ববর্তী রাজস্থানের মরুভূমি থেকে বালির ঝড়ও আক্রমণ করে বসে আগ্রাবাসীকে। তবে আশার ব্যাপার হলো, আবহাওয়া শুষ্ক থাকার কারণে ঘাম কম হয়। তবুও সম্রাজ্ঞী সকালে এবং সন্ধ্যায় হাম্মামে ঢোকেন।

অন্যান্য দিন প্রথমে হালকা গরম পানির চৌবাচ্চায় বেশ কিছুক্ষণ নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন। এতে করে শরীরের লোমকূপগুলো খুলে যায়। ত্বকে লেগে থাকা ময়লাগুলো আলগা হয়ে যায়। এরপর শরীরে প্রাকৃতিক ভেষজ মেখে ত্বকের ময়লা দূর করেন এবং তুলনামূলক বেশি গরম পানি দ্বারা শরীর ধৌত করেন। মাথা এবং মাথার চুল পরিচর্যার জন্য রয়েছে অন্য ব্যবস্থা।

সবশেষে তিনি নিজেকে ঠাণ্ডা পানির চৌবাচ্চায় বেশ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর যখন উঠে আসেন তখন মিহি সূতায় তৈরি বস্ত্রখণ্ড গরম পানিতে সিক্ত করে তার শরীর মুছে দেয় বাঁদিরা। এরপর সারা শরীরে মাখেন বিশেষ ধরনের তেল। কিন্তু আজ সম্রাটের আগমন উপলক্ষে তিনি বিশেষ উপায়ে গোসল সারবেন। পারস্যের রাজকুমারীরা হাজার বছর ধরে 'ইখওয়াত' নামের বিশেষ গোসলটি করেন রাজপুরুষদের সঙ্গে বাসর শয্যার পূর্বে। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ভারতবর্ষের মোগল হেরেমে সর্ব প্রথম ইখওয়াতের প্রচলন করেন এবং সেই দিন ছিল তার দ্বিতীয় ইখওয়াত।

(চলবে)

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.