আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইফ ইসমাইল এর গল্প 'সুখেন'

এক. ঃ ‘আঁর পোয়ারে অনরার কাছে আর রাখিত্ পাইতাম্মন্। আঁরে এহনই ছাড়ি দন’। ঃ কিন্তু, আপনার বাচ্চার অবস্থা তো ভালো না। বাসায় নিয়ে গেলে অক্সিজেন পাবে কোথায়? আপনি তো বাচ্চা হারিয়েই ফেলবেন। ঃ অনরা ডাকাইত্।

আঁর পোয়ারে পাতাইজ্জ্যা ইঞ্জেকশন দিয়েনে তো শেষ গইজ্জুন। ইয়ার পরেও অনরারে দিএনে পোয়ার চিকিৎসা গরাইতো কন নিকি?! ঃ স্যরি, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে এ অবস্থায় আপনার বাচ্চা নিয়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। বাচ্চা মারা যাবে। অনেকক্ষণ ধরে ক্লিনিকের ম্যানেজার আর জনৈক অভিভাবকের বহাস কানে আসছিল নাসিমের।

কাজের সময় এরকম শোরগোল হলে কাজ করা যায়! মনে মনে খুব বিরক্ত অসীম। অনন্যোপায় হয়ে এ রকম বাতচিত্ মাঝে মধ্যেই শুনতে হয়। আজও শুনছিল আর বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু ম্যানেজারের শেষ কথা কানে আসতেই চমকে যায় সে। কী বলে ব্যাটা!? দুই. অসীম পেশায় ব্যবসায়ী।

বয়েস পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা হলেও চেহারার আর্য গঠন যেকোন তরুণীর বুকে কাঁপন তোলে এখনও। এককথায় সুপুরুষ। ব্যবহারও অমায়িক।

কোন একক ব্যক্তির মাঝে শৈর্য-বীর্য-আভিজাত্যের পাশাপাশি মিষ্টভাষী আর আন্তরিকতার মতো গুন কদাচিৎ মেলে। অসীম ব্যতিক্রমদেরই একজন। বুদ্ধিমত্তা আর ব্যক্তিত্বের জোরে গণ্যমান্য হিসাবে সমাজে গ্রহণযোগ্য। পয়সাপাতি রোজগারও নেহায়েত কম করেনি। সহায় সম্পদ যা কামিয়েছে তাতে একপুরুষ বসে খেতে পারবে।

তবে তাঁর আচার ব্যবহারে সে রকমটি প্রকাশ পায়না। মানবতাবাদী। বেশ কিছু সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। যেমন, তার অফিসের সাথে লাগোয়া ক্লিনিক। অসীমরা কয়েক বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন।

উদোক্তাদের অধিকাংশই ডাক্তার। শিশু বিশেষজ্ঞ। শুধু অসীম ছাড়া। সে-ই একমাত্র ব্যবসায়ী। কিন্তু ক্লিনিকের মা-বাপ হিসাবে যদি কারো নাম বলতে হয়, সে অসীম-ই।

নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসকে আয়তনে ছোট করে তাতে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা তারই। নিজের সন্তানের মতো করে প্রতিষ্ঠানটি সে গড়ে তুলেছে। মধ্য ষাটের দশকে উত্তর চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে অসীমের জন্ম। মোটামুটি স্বাচ্ছন্দে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বাপ-দাদার ভিটে মাটিতে। মেধাবী, চৌকস অসীমের জীবনে ঝড় আসে বিয়ের পর।

বৌ নিয়ে খুবই সুখী দিনযাপন করলেও লোকজনের চোখে সম্পর্কটাকে ঠিক একটা মানানসই বলে মনে হয় ন্। া অসীমের শারীরিক মানসিক ম্যাচিউরিটির সাথে বউটাকে বেমানানই বলা চলে। তার বন্ধু বান্ধবেরা বুঝে উঠতে পারে না এই মেয়েটার সাথে অসীমের প্রেমঘটিত প্রণয় হয় কী করে! ঘনিষ্টজনদের কেউ কেউ প্রশ্ন করলে সে মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “আসলে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিতে ভারসাম্য রক্ষার জন্যই সম্ভবতঃ এমনটি করেছেন। ”Ñ একথা বলেই আবার তার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাচ্চাগুলোর কথা স্মরণ করে।

দু’টো বাচ্চাই তার প্রতিবন্ধী। একজন শারীরিক আরেকজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বন্ধুদের কেউ কেউ ভাবে, ‘সত্যিই তো’। যদি অসীমের পরিবারের সদস্যগুলো তার মতো মানবদরদী সামর্থ্যবান লোকের না হয়ে অন্য কারো হতো, তাহলে কী হতো?! স্রষ্টা সত্যিই মেহেরবান। ’ বাচ্চাগুলোকে নিয়ে অসীমের কষ্ট নেই।

অপ্রাপ্তির হাহাকার নেই। তবে, সন্তানদের কষ্ট দেখলে প্রাণ কাঁদে। তাই বিশাল ব্যবসায়ী হয়েও দিনের বেশ কিছুটা সময় সে বাচ্চাদের সাথে কাটায় কোন রকম ব্যতিক্রম ছাড়া। সন্তানদের চিকিৎসা করতে গিয়েই তার মাতায় শিশু হাসপাতালের আইডিয়া আসে। সে দেখে, আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশে বিশেষতঃ চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য চিকিৎসার ভাল জায়গা নেই।

যা আছে তা চট্টগ্রামের জন্য কিছুই না। তিন. ম্যানেজার আর রোগীর অভিভাবকের মধ্যে কথা কাটাকাটির এ পর্যায়ে অসীম তার পিয়নকে বলে, ‘হাসপাতালের মানেজার সাহেবকে আমার সালাম দাও’। এক্ষুনি। স্যারের তলব পেয়ে ম্যানেজার রঞ্জন হন্তদন্ত অথচ ভীরু চিত্তে অসীম সাহেবের রুমে প্রবেশ করে। ঃ কী ব্যাপার, শোরগোল হচ্ছে কেন? ঃ স্যার ১০নং বেডের গার্ডিয়ান বলছেন রোগীকে এক্ষুনি নিয়ে যাবেন, কিন্তু বাচ্চাটার অবস্থা ভালো নয়Ñ নেবুলাইজার চলছে, আম্তা আম্তা করে রঞ্জন জানায়।

ঃ কেন নিয়ে যেতে চান?! ঃ স্যার, গতকাল বাচ্চাটার শিরদাঁড়া থেকে ফ্লুয়িড কালেকশান করার সময় সমস্যা হয়েছিল। রাত হতে প্রচন্ড জ্বর। অক্সিজেনও দিতে হচ্ছে। Ñ ভয়ে ভয়ে জানায় ওঞ্জন। ঃ কেন, কী সমস্যা হয়েছিল? ঃ কাচুমাচু করতে করতে রঞ্জন জানায়, ‘ধীরেন স্যার গতকাল সকালে বাচ্চাটাকে লাম্বার ফ্লুয়িড টেস্টের জন্য এডভাইস করেছেন।

বাচ্চাটা সামান্য জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। সম্ভবতঃ সিজনাল জ্বর। বাবা-মা একটু বেশী সিরিয়াস বলে পাঁচ মাসের বাচ্চাটাকে বাসায় রাখার রিস্ক নেন নি। আর আমরা যে এক্সপার্টকে ডাকি তাঁকে বাদ দিয়ে এক বন্ধুকে দিয়ে স্যার ফ্লুয়িড কালেকশান করিয়েছেন। তাঁর বন্ধু নতুন ডাক্তার।

কয়েকবার নিড্ল পাঞ্চ করাতে বাচ্চাটার জ্বরের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। সাথে শ্বাস কষ্ট। মনে হয় বাঁচবে না। ’ ম্যানেজার রঞ্জনের কথায় অসীমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কী বলে ব্যাটা! তিল তিল করে হাসপাতাল গড়া হলো শিশুদের সূচিকিৎসার মাধ্যমে জীবন দেয়ার জন্য আর এরা আজ জীবিত সুস্থ শিশুকে মেরে ফেলার জোগাড় করছে!? রাগে-ক্ষোভে চারপাশটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ইচ্ছা জাগে তার।

জীবনে এ এক নতুন অনুভূতি। প্রশ্রয় দেয় না। ধীরস্থির চিত্তে কর্তব্য নির্ধারণের চেষ্টা করে। পারে না। মুখে কথা আসে না।

চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রাখে কিছুক্ষণ। এদিকে রঞ্জন ভয়ে জামা কাপড় ভিজিয়ে ফেলে, না জানি আজ কী হয়? চার. রঞ্জনের গ্রামের বাড়ী মীরসরাই। অসীম সাহেবের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এক হারা গড়ন। মেধাবী, চৌকষ, কর্মধ।

খুবই বিশ্বস্ত। যোগ্য এ লোকটিকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অসীম যোগাড় করেছেন। এরকম সুযোগ্য লোক সচাচর পাওয়া যায় না। সমাজে মাকাল ফলের সংখ্যাই বেশী। ভাগ্যিস, দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল।

ওঞ্জনের পরিবার নাকি অসীমদের পরিবারের কাছে ঋণী। কারণ অবশ্য বলেননি কেউ। দারুন ব্যস্ত অসীম সুন্দর শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ওঞ্জনের দক্ষ হাতে পূরণ করে। রঞ্জনের নিঃস্বার্থ অথচ কঠোর পরিশ্রমে আর অসীমের দূরদৃষ্টি ও অকৃপণ নিলোর্ভ উৎসাহ উদ্দীপনায় হাসপাতালটি চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণে জায়গা করে নিয়েচে প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায়। রঞ্জন তার মনিব অসীম সাহেবকে খুবই শ্রদ্ধা করে, ভয়ও পায়।

কারণ লোকটা খুবই ভাল। আমাদের সমাজে সচরাচর এমন লোক পাওয়া যায় না। পয়সাওয়ালা হলেও চলেন সাধাসিধে ভাবে। মদ-নারী-অর্থের পেছনে ছুটে বেড়ান না। তার চোখে কোন বদ অভ্যাস ধরা পড়েনি নাসিমের।

রীতিমত ভয়ে রূপ নিচ্ছে আদিলের। রঞ্জনও বিষয়টি খেয়াল করেছে। কিন্তু কোন কুল কিনারা খুঁজে পায়নি তার এ বিচিত্র বোধের কারণ কী। রঞ্জনের ভয় আজ সবমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জানে, অসীম সাহেবের কাছে এ হাসপাতাল কী, রোগীদের মর্যাদা কী।

কখন যে প্যান্ট ভিজে গেছে খেয়ালই করেনি রঞ্জন। অসীম সাহেব চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দেয়ার পরই তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয় সে। অবস্থা দেখে ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায় রঞ্জনের। অপেক্ষায় থাকে অসীম স্যার কী বলেন তার জন্য। সময় যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে।

পাঁচ. সুভাষ বড়–য়া পেশায় ড্রাইভার। বয়স ছত্রিশ। মঙ্গোলিয়ান চেহারা। বোচা নাক, গোলাকার অবয়ব। মায়ের মতো লম্বা হওয়ায় কিছুটা শংকর রূপ পেয়েছে।

স্বাস্থ্য ভালোই বলা চলে। দু’বছর আগে সুপ্রিয়ার সাথে ঘর বেঁধেছে। সুভাষ বৌদ্ধ আর সুপ্রিয়া হিন্দু। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। দু’জনের পরিবার থেকেই অনেকটা বিচ্ছিন্ন, একা।

প্রথম বসন্তের ভালো লাগায় সুভাষ-সুপ্রিয়ার সাক্ষাৎ র্চাচ স্কুলে। দর্শনেই প্রেম। গাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর। বৈরি পরিবেশের কথা ভেবে এতগুলো বছর ধৈর্য্য ধরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেমেরই জয়।

রক্তের সব বাঁধনকে দূরে ঠেলে হৃদয়ের কথা শুনেছে দু’জনে। বিয়ে করেছে। সুখেন তাদের একাকী যুগল জীবনে যেন শান্তির বারতা নিয়ে এসেছে। পাঁচ মাসে দু’জনের জীবনে এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বিগত বছরগুলোর মন খারাপ ভাবটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

গেল সপ্তাহে সুখেনের শারীরিক কিছু পরিবর্তন আবারো তাদের বিষাদের সাগরে ছুড়ে ফেলেছে। জ্বর এসেছিল। পাড়ার ডাক্তারকে দেখিয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে পরশু শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। টানাটানির সংসারে।

তবুও আনন্দের আধার বাচ্চার সুস্থতার আশায় টাকার হিসাব করেনি। হাসিখুশি সুখেন গত দু’দিনে হঠাৎ করে যেন নেই হয়ে গেল! গতকাল ডাক্তার সুখেনকে দেখেছে। বিকালে ইঞ্জেকশন দিয়ে কি যেন নিয়েছে ওর শরীর থেকে। বলেছেন, ‘আজ পরীক্ষা করলেই বুঝা যাবে আসলে ঠিক কি হয়েছে সুখেনের’। সুপ্রিয়া অস্থির হয়ে গেছে দু’দিনে।

গতরাতে সুখেনের প্রচন্ড জ্বরসহ কাঁপুনিতে ডাক্তাররা অক্সিজেন লাগিয়েছে। সেই থেকে সুপ্রিয়ার বুকটা কেমন যেন করছে। ঠিক বুঝতে পারছে না যে। খালি ভয় হচ্ছে। সুভাষকে কিছু বলেনি।

এমনিতেই বেচারার কাহিল অবস্থা। দিনে ডিউটি, ড্রাইভিং আর রাতে হাসপাতালে বাচ্চাকে পাহারা দেয়া। এদিকে ঔষধপাথ্য আর হাসপাতালের বিলের পাহাড় সুভাষকে রীতিমত পাগল করে তুলেছে। গতরাতে সুখেনের জ্বর আসার পর আজ আর ডিউটিতে যায়নি। সুপারভাইজার যদিও মানতে চায়নি কারণ গত সপ্তাহেই সুভাষ অফিস থেকে দু’মাসের অগ্রিম বেতন তুলেছে।

ফোনে সুপারভাইজারকে ‘আসতে পারবে না’ বলেই আর কথা বাড়ায়নি। সুভাষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাচ্চাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাবে। কারণটা দ্বিবিধ। একে তো বাচ্চার অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে অন্যদিকে পরিজনহীন জগৎ সংসারের প্রধান উপাদান টাকাও তেমন আর নেই। গত দু’দিনে ডাক্তার ধীমান চৌধুরী এই টেস্ট ওই টেস্ট, নানান রকম ঔষধপাতির বহর জুড়ে দিয়েছেন।

আচার-আচরণে লোকটাকে সুভাষের ঠিক পছন্দ হয়নি। সুপ্রিয়ারও না। পাড়ার লোকদের কাছে হাসপাতালটি সম্পর্কে যা কিছু শুনেছিল বাস্তবে তার ছিঁটেফোঁটাও পাচ্ছে না। দু’দিনেই ক্লিনিকের বিল এক লাফে সতের হাজারে পৌঁছেছে। সুভাষের কাছে অফিস থেকে নেয়া দু’মাসের অগ্রিমসহ সব মিলিয়ে আছে হাজার পঁচিশেক টাকা।

এ দিকে মাসের বাজারও করা হয়নি সুখেনের অসুস্থতায়। এখন চিন্তা করছে পরিবেশ নোংরা হলেও মেডিকেলে নিয়ে যাবে। অল্প যে কয়টা টাকা হাতে আছে সেগুলো দিয়ে বাচ্চাটার চিকিৎসা করা যাবে। ওখানে তো সিট ভাড়া আর অক্সিজেন বিলের বালাই নেই। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে একটু অসুবিধা হবে, এই আর কি।

বাচ্চাটার চিকিৎসাতো করা যাবে! সুপ্রিয়াকে জিনিসপত্র গোছাতে বলে হাসপাতাল অফিসের দিকে পা বাড়ায় সুভাষ। ছয়. ধীমান চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে দু’বছর আগে ইন্টার্ন শেষ করেছে। দাদা বাবুর কল্যাণে ক্লিনিকে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের চাকুরীটি পাওয়ার জন্য তেমন বেগ পেতে হয়নি। বড়দি’র স্বামী এ হাসপাতালের ডিরেক্টর। এমনিতে মেধাবী।

পাড়ায় প্র্যাকটিস করে প্রতি সন্ধ্যায়। শিশু হাসপাতালের ডাক্তার, সে সুবাদে চেম্বারও বেশ চলে। রোদ-বৃষ্টি-শীত হলে তো পোয়া বারো। গভীর রাত অব্দি চেম্বারে কাটাতে হয়। ডাক্তারী পাশ করার বছর দু’বছরের মধ্যে এমন পসার দেখা যায় না।

কপাল বলতে হবে ধীমানের। দু’বছরে কম কামায় নি। পৈত্রিক উত্তরাধিকার হিসাবে বাবার দেয়া মোটর সাইকেল বেচা টাকার সাথে জমানো টাকা দিয়ে লাল রঙের প্রাইভেট কার কিনেছে গেল মাসে। নিজেই ড্রাইভ করে। থার্টিফার্স্ট নাইটের পার্টিতে কল্যাণী’র সাথে পরিচয়ের পর এখন নতুন চিন্তা তার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরপাক খায়Ñ খুলশীতে একটা ফ্ল্যাট কেনা যায় কত তাড়াতাড়ি।

‘ফ্ল্যাট কেনার আগে কোনভাবেই বাবার কাছে প্রপোজাল পাঠানো ঠিক হবে না, মুখের উপরই না করে দেবেন’Ñ কল্যাণীর কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খায়। ফ্ল্যাটের স্বপ্নে বিভোর ধীমান নতুন পন্থা আবিস্কার করেছে বেশী বেশী টাকা কামানোর। ক’দিন আগে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার থেকে পেটমোটা খাম পাওয়ার পর আইডিয়াটা ভালভাবে কাজে লাগানোর চিন্তা করে সে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সব রোগীকেই পাঁচ ছয়টা টেস্ট এর ‘এডভাইস স্লিপ’ ধরিয়ে দেয়। অনাগত খামটাকে রীতিমত আটমাসের গর্ভবতী বলেই অনুমান করে ধীমান।

খামটা হাতে দেয়ার সময় মার্কেটিং ম্যানেজার বলে গেছে সম্ভব হলে ক্রিটিক্যাল কিছু টেস্টও পারলে তাদের কাছে পাঠাতে; পয়সা বেশী। টেস্ট কেস হিসাবে আজ সকালেই হাসপাতালের দশ নম্বর বেডের বাচ্চা রোগীটাকে ‘লাম্বার ফ্লুয়িড’ টেস্টের জন্য ‘এডভাইস’ করেছে। বাচ্চাটার জ্বর; যতটুকু বুঝেছে সম্ভবতঃ ভাইরাল ফিভার। জেনেছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টার হতে লোক এসে ফ্লুয়িড কালেকশান করে নিয়ে গেছে। ডিউটি অফ করে ফলো-আপ রিপোর্টে দেখেছে বাচ্চাটার প্রচন্ড জ্বর, সাথে শ্বাসকষ্ট।

ঠান্ডা স্রোতধারা শিরদাঁড়া দিয়ে বেয়ে যায়। কোন রকমে রোস্টার বুঝিয়ে দিয়ে সে চেম্বারে আসে। মন বসাতে পারে না কিছুতেই। সবকিছু এলোমেলো মনে হয়। অজানা এক ভীতিকর অনুভূতি তাকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ।

তড়িঘড়ি করে চেম্বার শেষ করে। ঘরে ফিরেই এক গ্লাস দুধ আর একটা রিলাক্সেন খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কাল সকালেই বাচ্চাটাকে দেখতে যেতে হবে। রাতভর ছটফট করে অপেক্ষায় থাকে সূর্য ওঠার। আঁধারকে ভয় করে।

আজ আরো বেশী। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই করেনি ধীমান। মোবাইলে এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়িতে দেখে সকাল দশটা। দীর্ঘ একঘন্টা এলার্ম বেজেছে!Ñ নিজেই আশ্চর্য হয়।

সাড়ে নয়টায় ডিউটি ধরার জন্য নয়টায় এলার্ম সেট করেছে। মোবাইলের সুবিধা হলো যতক্ষণ না সে অফ করছে ততক্ষণ এলার্ম দশ মিনিট পর পর বাজতেই থাকবে। পড়িমড়ি করে টয়লেট আর ব্রাশ সেরেই হাসপাতালের পানে দৌঁড়। গতরাতে জামাকাপড় না ছেড়ে বিছানায় গিয়েছিল, খেয়ালই করেনি। সাত. ‘আসতে পারি? স্যার’Ñ ডাঃ ধীমানের গলার আওয়াজে অসীমের তন্দ্রা ছুটে যায়।

চোখ মেলে দরজায় দাঁড়ানো ধীমানের দিকে চোখ যায়। ঘরের কোনায় রঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমিয়ে গিয়েছিল নাকি সে! কতক্ষণ হলো! ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে সকাল ১০টা ৫০মিনিট। মনে মনে ভাবে, না মাত্র তিন মিনিট। পাশের চেয়ার দেখিয়ে ইশারায় ধীমানকে বসতে বলে।

ম্যানেজার ওঞ্জনকে বলে, ‘রোগীর গার্ডিয়ানকে পাঠান তো একটু। আর আপনি বাইরে দাঁড়ান। ’ ‘জ্বি আচ্ছা’, বলে রঞ্জন তাড়াতাড়ি বসের রুম ত্যাগ করে। অসীম আর ধীমান ঘরে বসে আছে। চুপচাপ।

কারো মুখেই কথা নেই। দু’জনেই খেয়াল করে সামনের মানুষটির এই চেহারা তাদের পরিচিত নয়। যেন অন্য কেউ। যেন ভিনগ্রহের আজানা অচেনা কোন প্রাণী। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা ঘোরার শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ নেই।

হন্তদন্ত হয়ে সুভাষ ঢোকে। উস্কো খুস্কো চুল, অগ্নিমূর্তি। শারীরিক-মানসিক ধকলের ছাপ স্পষ্ট। কীভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পায়না অসীম। মনে মনে স্রষ্টাকে স্মরণ করে অভিভাবকটিকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে।

ঃ অন’র বাড়ী কনডে? (আপনার গ্রামের বাড়ী কোথায়)Ñ কথা শুরুর চেষ্টা করে অসীম। ঃ আঁর বাড়ী দিয়েরে অ’নে ক্যান গরিবেন? (আমার গ্রামের বাড়ী দিয়ে আপনি কি করবেন?) খেই হারিয়ে ফেলে অসীম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য টেবিলে রাখা পানির গ্লাস সুভাষের দিকে এগিয়ে দেয়। অসীমের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সুভাষের নজর এড়ায় না। সংবিৎ ফিরে পেয়ে সুভাষ নড়েচড়ে বসে।

বলে, ঃ মাফ গইজ্জুন। বাইচ্চ্যাউয়্যার মিক্ক্যা চাই মন্নান বেশী খারাফ। (ক্ষমা করবেন। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে মন ভালো নেই) ঃ না ঠিক আছে। শুদ্ধ বাংলায় শুরু করে অসীম।

ঃ এবার কন, কিয়োর লাই ডাইকক্যুন? (এবার বলেন, কেন ডেকেছেন?) ঃ আপনার বাচ্চার অবস্থা তো ভালো না, আপনি জানেন। আমাদেরও দোষ আছে। কিন্তু এখন দোষ-গুণ বিচার না করে বাচ্চাটাকে আগে বাঁচানো দরকার নয় কি? আপনি ওকে নিয়ে যেতে চাইছেন কেন? অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলে সুভাষ। আদ্যোপান্ত খুলে বলে। এই লোকটার মাঝে বোধ হয় অলৌকিক কিছু আছে, মনে মনে ভাবে সুভাষ।

অল্পতেই আপন করে নিতে পারেন। সবকিছু শোনার পর অসীম বলে, আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু বাচ্চার ঔষধের খরচগুলো দেবেন, বাসায় কিংবা অন্য কোথাও নিয়ে গেলেও তো আপনাকে তা-ই করতে হবে, তাই না? সুভাষ ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা দোলায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তার বিশ্বস্ত সহচর রঞ্জনকে ডেকে নেয়। চার ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটির জন্য ‘মেডিকেল বোর্ড’ গঠন করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বুঝিয়ে দেয়।

আর বলে, হাসপাতালে থাকা-খাওয়াসহ সব একোমোডেশন বিনামূল্যে সরবরাহ করে বাচ্চাটিকে দ্রুত সারিয় তোলার ব্যবস্থা নিতে। স্যারের কথায় চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রঞ্জনের। তার মনের কথাই যেন স্যারের মুখে শুনছে। হাতে করে নিয়ে আসা ডাক্তার ধীমানের ফাইলটি বসের দিকে ঠেলে দেয়। পাশে বসে থাকা ধীমানকে গা করে না।

অনেক দিনের বিশ্বস্ত সহযোগীটি যেন তার মনের কথাই বলতে চাইছে! ফাইলটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে রঞ্জনকে দ্রুত কাজ শেষ করে ফলোআপ দিতে বলে। জ্বি স্যার, বলে রঞ্জন পা বাড়ায়। চোয়াল শক্ত। হাত মুষ্টিবদ্ধ। প্রমাণ করতে হবে যে, ‘মানুষই বড়’! সুভাষকে বুঝতে দেয় না কিছু।

বলে, ‘আপনি বাচ্চার পাশে বসুন। ’ বুকফাটা সুতীব্র চিৎকারে চমকে ওঠে সবাই। শব্দের উৎস শিশু ওয়ার্ড। চেয়ার উল্টে পড়ে। ঝনঝন শব্দে পানির গ্লাস ছিটকে পড়ে মেঝেতে।

সুপ্রিয়ার গলার আওয়াজ ঠিক ঠিক চিনতে পারে সুভাষ। প্রাণপন ছুট দেয়। ২০ নভেম্বর ২০১১, রাত ২টা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।