ব্লগার না পাঠক হওয়ার চেষ্টায় আছি রাত আটটার মত বাজে। হানিফ পরিবহনের একটি বাস খুলনা থেকে গাবতলী এসে থামল। বাস থেকে নামল মধ্য-বয়সী একটা ছেলে। হালকা ময়লা পোষাকে সামান্য মলিন চেহারার ছেলেটির নাম আনিস। উসখো চুলে মাঝাড়ি সাইজের একটা ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নামল।
নেমেই একটা বেনসন কিনল। আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকাল ও। প্রখর চান্নিতে আকাশ ফেটে যাচ্ছে। ভরা পূর্ণিমা বললে ভুল হবে না। ওর প্রাণের শহর খুলনা ছেড়ে ঢাকা আসার একমাত্র কারণ চাকুরী! স্কুল-কলেজ-ইউনি সবই খুলনাতে কাটানোর পরও তাকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ভাল একটা চাকুরীর জন্য ঢাকা আসতে হল।
তারপরে উঠা লাগবে মিরপুরে তার এক দূর-সম্পর্কের মামার বাসায়। এমনেতেই নিজ বাসা ছাড়া অন্য কারও বাসায় থাকতে তার ভাল লাগে না। মনটা খারাপ করে হাটতে হঠাত তার মনে পড়ল পকেটে সিগারেট। যেই সিগারেটটা ধরাতে যাবে সেই দেখল পকেটে কোন ম্যাচ নেই। মেজাজটা পুরোই বিগড়ে গেল আনিসের।
মন আরও বেশি খারাপ হতেই সিগারেটটা দূরে ফেলে দিল। ফেলে দিয়েই সামনে একটা টং দোকান দেখল। দেখেই মনে হল এই দোকান থেকেই সে একটা ম্যাচ কিনে নিতে পারত। নিজের গাধামীর জন্য নিজেকে সে মনে মনে বকতে লাগল।
রাত নটার দিকে সে ব্যাগ নিয়ে মামার বাসায় এসে উপস্থিত হল।
দু বছর আগে সে সর্বশেষ এসেছিল। কতই না পরিবর্তন না হয়েছে রাস্তা গুলোর। ভাঙ্গা রাস্তা ঠিক হয়েছে। মামার বাসার সামনের প্লটটা খালি ছিল, সেখানে বিরাট বাসা তৈরী হয়েছে। মানুষজনের টাকাপয়সার এই উঁচু গ্রাফের কথা চিন্তা করতে করতে সে মামার ফ্লাটে এসে উপস্থিত হল।
এসেই মোটামোটি খাবি খেল! বাসায় তালা মারা। সে কিছুক্ষণ তালগাছের মত দাঁড়িয়ে রইল। তার মামা জানত সে আসবে। নাকি খবর পায় নি! আর খবর পেলে এই কাহিনী করার মানে কি!! মামার মোবাইলে ফো দিয়ে ফোন বন্ধ পেল। এই ব্যাগ নিয়ে এত রাতে কই যাবে চিন্তা করতে লাগল।
ঢাকা শহরে তার তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন থাকে না। সে চিন্তা করল সে মালীবাগের খালার বাসায় চলে যাবে! যেই চিন্তা সেই কাজ। ব্যাগ তোলার ঠিক একটু আগে দুটি মেয়ের খিলখিল হাসির মত শুনল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পাশের বাসার দরজার কলিংবেল টিপার আগ মুহূর্তে তাদের একজন আনিসকে বলল “পাশের বাসায় যাবেন বুঝি?” আরেকটা মেয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল। এ কথায় হাসির কি আছে আনিস বুঝল না।
সে ভাল করে হাসতে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাল। অপূর্ব সুন্দরী, চোখে টিপটা ঠিক মত দেওয়া হয় নি। খানিকটা বেঁকে গেছে। আনিস ভাবল একবার টিপের ব্যাপারটা বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করল এই কথাটা বলা অশোভন।
হাসির ক্রমাগত শব্দ শুনা যাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করতে লাগল। তার এই আমতা আমতা দেখে মেয়েটি আবার বলল, “আপনার নাম মনে হয় আনিস। মিলিতো আপনার কথা প্রায়ই বলে। আর আমার এই বড় আপুর হাসিতে কিছু মনে করবেন না! ওর স্বভাবই হল সারাক্ষন হাসা।
হাসি ছাড়া ও একটুও থাকতে পারে না!” আনিস একটু হতভম্ব হল। এই মেয়ে এমনভাবে কথা বলছে যেন আনিস তার কত দিনের পরিচিত। আর মিলিও তার কথা অন্যদের বলে বেড়ায়! আজকে আসলে তার কানটা টেনে ধরতে হবে। কিন্তু মিলিরা না আসলে আনিস কি করবে সেটা ভাবতে লাগল।
-আপনি আসুন আমাদের বাসায়।
চা খান। মিলিরা আসলে তারপর যাবেন।
-না মানে, ইয়ে
-কি মানে মানে করছেন, আসুন বাসায়।
আনিস বাসায় ঢুকে মোটামোটি টাস্কিত হল। অনেক সুন্দর একটা বাসা।
বাসা তেমন সুন্দর না হলেও সাজিয়ে একেবারে সুন্দর বানানো হয়েছে। ড্রয়িং রুমে রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝুলছে। বাসায় কেউ একজন রবীদার বিশাল ভক্ত বোধ হয়। এ যুগে রবীদার ছবি দেখে হাসিই পেল আনিসের। সে এক পলকে ছবির দিকে রইল।
হঠাত করেই চা সহ রুমে ঢুকে পড়ল কথার রাণী ফারিয়া। আনিসকে ছবির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, “ভাইয়া, এইটা তো কোন মেয়ের ছবি না যে এমনে দেখছেন। ” বলে সে নিজেই মুচকি হাসল। আনিস বেচারা পুরোই হকচকিয়ে গেল। সে মনে করার চেষ্টা করল আজ সে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছে।
যেটা ভেবে মন আরও ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল সেটা হল সে আজ আয়নাতে নিজের মুখ দেখেই ঘুম থেকে উঠেছে! মিজাজটা হঠাত বিগড়ে গেল তার। কত্ত গুলো অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। উফফ! তার সংবিত ফিরল “বুবু, বুবু” ডাকে। বড় বোন আসলেই সে ট্রে টা বড় বোনের হাতে দিয়ে বলল “এই এটা নে, আমার একটু আর্জেন্ট কাজ আছে!” চাঁদনী ট্রে টা নিল এবং মনে মনে কিঞ্চিত বিরক্ত হল। ফারিয়া ইচ্ছে করলে ট্রে টা টেবিলে রাখতে পারত।
যত্তসব যন্ত্রণা! টেবিলে ট্রে রেখে চাঁদনী আনিসের দিকে তাকাল। তাকিয়েই খানিকটা দুঃখবোধ অনুভব করল। বেচারার চেহারা চুপসে আছে। বলল আগে হাত-মুখটা একটু ধুয়ে নিন। আর আমার বোনের কথায় কিছু মনে করবেন না! ও সারাদিন কথা বলবেই।
কথা ছাড়া ও থাকতেই পারে না। আনিসের মাথা আবারও গুলাতে লাগল। কথা না বলে কে থাকতে পারে না আর কে না হেসে থাকতে পারে না- এটা নিয়ে সে মোটামোটি প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেছে! জিলাপীর প্যাঁচ। লাগছে তো লাগছেই। সিঁড়িতে কে জানি ঠিক হবহু এরকম কথা বলেছিল! সে কি বেশি হাসার কথা বলেছিল নাকি বেশি কথা বলার কথা বলছিল কে জানে!
-আনিস সাহেব, এই আনিস সাহেব, কি চিন্তা করছেন? শরীরটা কি খারাপ?
-হুম হুম।
না না! ঠিক আছে।
-যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন।
আনিস ফ্রেশ হয়ে আসার পর ড্রয়িং রুমে কাউকে পেল না। হঠাত করেই তার প্রচন্ড ক্ষুদা বোধ হল। বিশাল জার্নি আর টায়ার্ডের কারণে সে চায়ের সাথে দেওয়া সব বিস্কুট আর চানাচুর গোগ্রাসে খেয়ে ফেলল! চাঁদনী আড়াল থেকে সবই দেখল।
সে মাঝে একবার দৌড়ে তার মাকে গিয়ে বলে আসল আনিসের জন্য ভাত রান্না করতে। তারপর আনিসের কাছে ছুটে গেল। বলল আজ রাতে আপনাকে খেয়ে যেতে হবে। কোন কথাই শুনব না! আর ভাল কথা, আপনি তো আমার নামই জানেন না। এতক্ষণ ধরে যেহেতু আছেন একবার হলেও তো জিজ্ঞাসা করার কথা নাকি?! আজীব! আনিস মুচকি হাসার চেষ্টা করল।
কিন্তু হাসতে পারল না! চাঁদনী হাসতে হাসতে বলল “আমার নাম চাঁদনী আর ওই যে ক্রমাগত বকবক করছিল ও আমার ছোট বোন ফারিয়া। ” আনিস আবারো হাসল। ওর প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। চায়ের সাথে পানি ছিল না কোন। আনিসের মনে হল ফারিয়া যে সারাদিন বকবক করে তাই না ও একটু বেশি মনভোলা।
আনিস লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেলল “একটু পানি খাব। ” চাঁদনী হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে টেবিলের সাথে ভাল রকমের একটা ধাক্কা খেল। এক ধাক্কায় চায়ের কাপ ভেঙ্গে হুলুস্থুল কাণ্ড। ফারিয়া, ফারিয়ার আম্মু, আব্বু এসে জড়ো হলেন ড্রয়িং রুমে! চাঁদনীকে নিয়ে টানাটানি শুরু হল। ওর পায়ে কাঁচের টুকরা ঢুকে রক্ত বের হচ্ছে! চাঁদনী কেবল একটাই কথা বলল “কেউ আনিস সাহেবকে এক গ্লাস পানি দাও!”
রাতের ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে চাঁদনীর আব্বু আনিসকে তার বৃত্তান্ত বলতে বলল।
আনিস বলতে শুরু করল। বোনাস হিসেবে যোগ করল সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী পেয়েছে। সেজন্যই ঢাকা আসা। প্রত্যেকটা মূহুর্তেই চাঁদনী আড়চোখে তাকিয়ে ছিল আনিসের দিকে। খাওয়ার পর আনিস জানতে পারল মিলিরা এসেছে! অতঃপর শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও!
পরদিন অফিস থেকে সন্ধ্যায় মিলিদের বাসায় এসে কিছু পরে বাসা থেকে বের হতেই আবার চাঁদনীর মুখোমুখি হল আনিস।
চাঁদনী বলল, “আপনি কিছু মনে না করলে আপনাকে নিয়ে একটু ফার্মগেট যেতাম। রাত করে একা ফিরতে সমস্যা! বাদল বাইরে গেছে। ওর ফিরতে দেরী হবে। ” আনিস সামান্য ভেবাচেকা খেয়ে রওনা দেয়...সেই শুরু ওদের বিরামহীন পথচলা।
আনিস আর চাঁদনী ঘুরে নি এমন কোন রেস্টুরেন্ট বোধহয় ঢাকা শহরে নেই।
আনিস সারা দিন পরিশ্রম করে অফিস করে রাতে এসে পাগলীটাকে নিয়ে খেতে যায়। রাতে অবশ্য একে নিয়ে বুফেতে খাওয়া আনিসের কাছে কেমন জানি লাগে! এইটা খাওয়া যাবে না ঐ টা না...উফফ!! বাচবে আর কয়দিন আর বলে কি না বিয়ের পরে ছেলে-পুলেদের জন্য হলেও এইসব খাওয়া-দাওয়া কমাতে হবে... এভাবেই রুটিন-মাফিক নিয়মে টুকিটাকি ঝগড়ার মাঝে কেটে যায় দুটি বছর। মাঝে মাঝেই মিলি সব্বাইকে বলে বেড়ায় তার ভাই নাকি আগুন সুন্দরী এক মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে!
এই দুই বছরে যা যা হয় তা হল মোটামোটি আনিস ঢাকায় বেস বড়-সড় একটি ফ্লাট ভাড়া নেয়। ওর মা-বাবাকে এসে খুলনা থেকে ঢাকাতে তোলে। আর এদিকে আনিসের মা-বাবা আনিসের বিয়ের জন্য হঠাতই পাত্রী খোঁজা শুরু করে।
কিছুদিনের মধ্যেই ধুমধাম করে মহা আনন্দের মাধ্যমে আনিস আর চাঁদনীর বিয়ে হয়ে যায়।
যেদিন আনিসের বিয়ে হয় সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। ঠিক এরকম একটা ভরা পূর্ণিমাতে আনিস ঢাকায় এসে চাঁদনীদের বাসায় উঠেছিল। সময় কতটা না বদলে গেছে...বাসর রাতে গল্প করা বাদ দিয়ে আনিস আর চাঁদনী দরজা খোলে আনিসদের বারান্দায় চলে আসে। একটানা জ্যোৎস্না দেখতে শুরু করে।
আনিস এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে চাঁদনিকে। ধরে রাখুক, পৃথিবীর কেউ তাদের এই বন্ধনকে ভাঙ্গতে পারবে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।