পাটের সোনালি দিনের গল্প রূপকথার বইয়ে চলে গিয়েছিল। মাঝখানে একের পর এক পাটকল বন্ধ হওয়ায় পাটের দাম পড়তে থাকে। কমতে থাকে চাহিদা। কৃষকরাও পাট উৎপাদন থেকে সরে আসে। সব মিলিয়ে সোনালি আঁশের গৌরব বিলীন হয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করায় পাটের সুদিন আবার ফিরতে শুরু করেছে।
সরকারের উদ্যোগে গতিশীল হয়েছে বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। চালু হয়েছে, হতে যাচ্ছে বন্ধ থাকা বেশ কয়েকটি পাটকল। আদমজী নতুন রূপে চালুর জন্যও কার্যক্রম চলছে। কৃষকরা যাতে পাট উৎপাদন বাড়ায়, সেজন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
উৎপাদিত পাটের দাম যাতে কৃষকরা ঠিকমতো পায় সেজন্য সরকারি তত্ত্বাবধানে সরাসরি মাঠপর্যায়ে পাট কেনা কর্মসূচি চলছে। বিশ্ববাজারে পাটের নতুন বাজার খুঁজে বের করতে চলছে দৌড়ঝাঁপ। দেশের অভ্যন্তরে পাটের ব্যবহার বাড়াতে করা হয়েছে নতুন আইন।
তবে বিশ্ব রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশ্বব্যাংকের চাপ, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার মতো কিছু কারণে এখনো এ খাতে কাক্সিক্ষত সাফল্যের দেখা মিলছে না। তবে সরকারের দায়িত্বশীলদের মতে, বিজেএমসি এখন একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
পাট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে তৎপর। নানা কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
বন্ধ মিল চালু
বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের অধীনে বর্তমানে ২৭টি পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি হচ্ছে নন-জুট মিল, যারা পাটকলের যন্ত্রাংশ ও পাটভিত্তিক বিভিন্ন দ্রব্য বানায়।
বাকি ২৪টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে ১৮টি সচল রয়েছে। এগুলোতে এখন উৎপাদন উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ লাখ টন পাটপণ্য। এর বাইরে দুটি পাটকল এখনো লিজে আছে। সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় মোট ৭টি পাটকল লিজে ছিল। এর মধ্যে পাঁচটি ইতোমধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বিজেএমসি।
এখনও বন্ধ থাকা বাকি ৪টি পাটকল শিগগিরই চালু করতে চায় সরকার।
বন্ধ পাটকল চালু বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দুটো পাটকল চালু করা গেছে। তবে আশার কথা, পর্যায়ক্রমে বাকি মিলগুলো চালুর কাজ চলছে। চালুর অপেক্ষায় আছে চট্টগ্রামের আর আর জুট মিল। এর বাইরে চলছে রাজশাহী জুট মিলের বর্ধিতকরণের কাজ।
চট্টগ্রামের এম এম জুট মিল এবং খুলনার দৌলতপুর জুট মিলও চালু হবে আগামী বছরেই। এছাড়া আদমজীর ২নং ইউনিটটি চালু করার জন্যও পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
৫ মার্চ, ২০১১ পিপলস জুট মিল চালু করা হয়েছে খালিশপুর জুট মিল নামে। যেহেতু বিশ্বব্যাংকর অর্থায়নে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে এ পাটকলটি বন্ধ করা হয়েছিল তাই আগের নামে এটি আর চালু করা যায়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার লোকসানের অজুহাতে ২০০৭ সালের ২১ জুলাই এই পাটকলটি বন্ধ ঘোষণা করে।
২০০৮ সালের ১৫ জুলাই লিজের মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে মিলটি চালু করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস এক বছর চালানোর পর মিলটি বিজেএমসির কাছে হস্তান্তর করে।
৯ এপ্রিল, ২০১১ বন্ধ থাকা সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কওমী জুট মিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। মিলটির নাম পরিবর্তন করে জাতীয় জুট মিল করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই প্রায় ১’শ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত দেনা ও লোকসানের কারণে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পাটকলটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
দৌলতপুর জুট মিল বন্ধ করে দেয় চারদলীয় জোট সরকার। ৪৮ কোটি টাকা দেনার অজুহাত দেখিয়ে ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর এ মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে এটি আবার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। গুদাম মেরামত ও অবকাঠামোর কাজ এগিয়েছে। মন্ত্রিসভা এ পাটকলটির জন্য ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান অ্যালেক্স ওয়ার্কস কোম্পানির পরিচালনায় নেচার ব্যাক নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০০৮ সালের শুরুতে লিজ দেয়া হয় চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়ায় অবস্থিত আর আর জুট মিল ও এম এম জুট মিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ওই লিজচুক্তি বাতিল করে। ফলে পাটকল দুটি আবার ফিরে পায় বিজেএমসি। আর আর জুট মিল ইতোমধ্যে উৎপাদনে গেছে বলে জানা গেছে। শুধু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষা।
এম এম জুট মিল চালুর জন্যও কাজ চলছে। এর বাইরে এখনো চট্টগ্রামের কর্ণফুলি জুট মিল ও ফোরাত কর্ণফুলি কার্পেট ফ্যাক্টরি লিজে আছে।
বিজেএমসির পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ আলি চেীধুরি জানান, ‘বন্ধ পাটকল চালু এই সরকারেরই নীতি। আমরা নীতি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। প্রয়োজনমাফিক অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে।
অর্থ পেতে অধিকাংশ সময়েই আমাদের দীর্ঘসূত্রতার মুখোমুখি হতে হয়। তবে আমরা বসে থাকছি না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নিজেরাই ঋণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করে দিচ্ছি। এখন যেভাবে বিজেএমসি চলছে আমার বিশ্বাস পাট খাত সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হবে। ’
আদমজী বাঁচানোর চেষ্টা
বর্তমান সরকার আদমজী জুট মিলকে পুনরায় চালুর স্বপ্ন দেখছে।
সরকারের পরিকল্পনার শেষের দিকে আছে আদমজী। বিজেএমসি দাবি করেছে, আদমজী জুট মিলের দুই নম্বর ইউনিটের পাটপণ্য উৎপাদনকারী ৫০টি তাঁত চালিয়েই বছরে ১২১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এর জন্য ৩০৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকার তহবিল চাওয়া হয়েছে।
তবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির শর্ত মোতাবেক আদমজী নামে আর কোনো পাটকল চালু করা যাবে না। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যারা স্বেচ্ছা অবসরে গেছেন তাদেরও আর নিয়োগ দেয়া যাবে না।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাটকল আমদজী বন্ধ হয় ২০০২ সালের ১ জুলাই। এরপর নারায়ণগঞ্জের ওই এলাকায় বেপজার অধীনে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) গড়ে তোলা হয়েছে।
পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এই সরকারের আমলেই নতুন রূপে আদমজী চালুর পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে কাজ এগুচ্ছে।
মূল সমস্যা বেপজার কাছ থেকে আদমজীর জন্য জমি ফেরত পাওয়া নিয়ে। ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকার আদমজী বিলুপ্ত করে পাটকলের জমি বেপজার কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু সেখানে ২২ একর জায়গা এখনো অব্যবহৃত রয়েছে। এই জায়গাতেই নতুনরূপে আদমজী চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পাট মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্ধ আদমজী জুট মিলের দুই নম্বর ইউনিটটি চালু করতে প্রয়োজনীয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
তবে কি নামে আদমজী মিল ফের চালু হবে সে ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সাবেক আদমজীর এই ইউনিটটিতে উন্নতমানের রপ্তানিযোগ্য পাটসুতা ও পাটের বিভিন্ন ধরনের বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা হবে। দুই নম্বর ইউনিটের শেড ১১.৬০ একর এবং এর দক্ষেণ পাশের খালি ১১ একরসহ মোট ২২.৬০ একর জায়গা বেপজার কাছ থেকে পুনরায় বিজেএমসিকে ফেরত প্রদানে এবং এই প্রকল্পের টাকা সংস্থানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে তার কার্যালয়ে ইতোমধ্যেই সার-সংক্ষেপও পাঠানো হয়েছে।
পাট সচিব আব্দুল মজিদ জানান, আদমজীর ২ নম্বর শেডের ১১ একর ও আশপাশের আরো ১১ একর জায়গায় ১ হাজার লুমের পাটকল চালু করতে মোট ৬০৯ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে প্রথম পর্যায়ে ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জুট ইয়ার্ন ডাইভারসিটি’ পদ্ধতির রপ্তানিমুখী ৫শ’ লুমের মিলের কাজ শুরু করা হবে।
পরবর্তী পর্যায়ে ১ হাজার লুমের পাটকল চালু করা হলে ৫ হাজার ৭২০ জন শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হবে।
চাষীদের থেকে পাট ক্রয়
পাটশিল্পকে বাঁচাতে বর্তমান সরকারের উদ্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ হচ্ছে সরাসরি মাঠ পর্যায়ের চাষীদের কাছ থেকে পাট কেনা। বিজেএমসির তথ্যমতে, বর্তমানে ১০৮টি বেসরকারি পাট ও পাট সংশ্লিষ্ট কারখানা চালু আছে। জানা গেছে, এসব কারখানার মালিকদের যোগসাজশে তৈরি হয় সিন্ডিকেট। যারা পরিকল্পনামাফিক পাটের বাজারদর কমিয়ে আনতে চেষ্টা করে।
এতে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের মধ্যে তৈরি হয় হতাশা। এই সমস্যা সমাধান করতে সরকার প্রতি বছর ৩০০ কোটি টাকা দিচ্ছে বিজেএমসিকে। এই টাকা দিয়ে বিজেএমসি কর্মকর্তারা সরাসরি মাঠ পর্যায় থেকে পাট কিনছেন।
বিজেএমসির পরিচালক (উৎপাদন ও পাট) লেনিন কামাল বলেন, ‘কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্যই সরকারের এই উদ্যোগ।
আগে যেখানে এক কুইন্টাল (১০০ কেজি) পাট বিক্রি হতো দেড়-দুই হাজার টাকায়, এখন সেখানে কুইন্টালের দাম চার হাজার টাকাও আমরা দিচ্ছি। কৃষকদের আয় ভালো না হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা নিম্নগামী হয়ে পড়ে। তখন আর তারা ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে পাট উৎপাদনে যেতে চাইবে না। পাটের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী নতুনভাবে দেখা দিয়েছে। পাট চাষকে উৎসাহিত করতে তাই সরকার সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছে।
’
কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেয়ার সরকারি এই চেষ্টা বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হলেও ২০১০ এ শুরু হওয়া এ প্রকল্পের তেমন কোনো সুবিধা কৃষক সমাজ পাচ্ছে না। বিজেএমসির একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা তিন হাজার টাকায় ১০০ কেজি পাট কিনছি। কোথাও কোথাও এর চেয়েও কমে। এই দামে কৃষকদের পোষানোর কথা না। তার মানে বাজার আগে থেকেই প্রভাবিত।
সরকার এখানে টাকা খরচ করছে কিন্তু ভালো কিছু করতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ মাসে দক্ষিণবঙ্গে পাট বিক্রি হয়েছে প্রতি কুইন্টাল দুই হাজার টাকারও নিচে। প্রতি মনে কৃষকদের গচ্চা প্রায় ৩০০ টাকার মতো। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে প্রতি কুইন্টাল বিক্রি হয়েছে দেড় হাজার টাকারও নিচে।
প্রতি মণে গচ্চা ৬০০ টাকারও বেশি। এবার বৃষ্টিজনিত সমস্যায় অলনও তেমন ভালো হয়নি। পাটের চারা বড় হতে পারেনি। পাট ঠিকমতো জাগ দেয়া যায়নি। ফলে অধিকাংশ এলাকার পাটের রঙও অনুজ্জ্বল।
সব কিছু মিলিয়ে কৃষকরা এ বছর চরমভাবে হতাশ।
এর আগের বছরটা মোটামুটি ভালো গেলেও এ বছর কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। পাটের অব্যাহত দরপতন চাষীদের নিরুৎসাহিত করছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এসব কারণে এ বছরই কমে যাবে পাটের উৎপাদন। যা আগামীতে এই খাতের সঙ্কটগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।
থোক বরাদ্দ-ঋণ মওকুফ
পাটশিল্পকে টেনে তোলার জন্য সরকার ক্ষমতায় এসে এ পর্যন্ত থোক বরাদ্দ দিয়েছে ২১০ কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে খুলনার পিপলস জুট মিল ও সিরাজগঞ্জের কওমি জুট মিল চালু করা হয়েছে। এছাড়া বিজেএমসির অধীনস্থ যে সকল কারখানায় যত বকেয়া ছিল তার সব পরিশোধ করা হয়েছে। কোনো কোনো কারখানায় ৯ মাসের বকেয়াও ছিল।
ব্যাংক ঋণে বিজেএমসি এক সময় ডুবতে বসেছিল।
সরকার সেখানেও বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। বিজেএমসির মোট ৩২০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণকে সরকারি ঋণে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এতে করে টাকা জমা হলেই ব্যাংক কর্তৃক পুরনো বকেয়া দেখিয়ে তা কেটে নেয়ার আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে বিজেএমসি।
পাশাপাশি এর মধ্যে সরকার পাটকল শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করেছে। অস্থায়ী অনেক শ্রমিককে স্থায়ী করা হয়েছে।
মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের ফলে শ্রমিকদের গড় আয় ৬০ ভাগ বেড়েছে বলে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দাবি। যদিও এই মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয়েছিল।
বিজেএমসির পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ আলি চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। পাহাড় সমান ব্যাংক ঋণের চাপ। মিলগুলোতে শ্রমিকদের বকেয়া, যন্ত্রপাতির খরচ, পাট কেনা, সব মিলিয়ে ব্যাপক অর্থসঙ্কট।
এর ওপর আবার ব্যাংকে টাকা জমা পড়লে তা কেটে নেয়া হতো। ফলে শ্রমিকদের বকেয়া আরো বাড়ত। কিন্তু সরকারের সহযোগিতার ফলে এখন আর সেসব সঙ্কট নেই। বিজেএমসি এখন মোটামুটি সচ্ছল একটি প্রতিষ্ঠান। ’
বিশ্বব্যাংকের চাপ উপেক্ষা
পাট শিল্পের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিশ্বব্যাংক।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘এখানে প্রধান কালপ্রিট বিশ্বব্যাংক। ১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শে তৎকালীন সরকারের পাটমন্ত্রী লোকসানের অজুহাতে ওয়াশিংটনে আদমজী জুট মিল বন্ধের চুক্তিতে সই করেন। অথচ একই সময়ে ভারতে নতুন নতুন পাটকল চালু করা হচ্ছিল। আদমজী যখন বন্ধ করা হয় তখন বিদেশে ১৫ হাজার কোটি টাকার পাটক্রয়ের চাহিদা ছিল। অথচ ১২শ’ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলে আদমজী বন্ধ করা হয়েছিল।
’
তিনি আরো বলেন, ‘বন্ধের সময় আদমজী সরকারকে শুধু ১৫শ’ কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল ও ৬শ’ কোটি টাকার গ্যাস বিলই পরিশোধ করেছিল। এর বাইরে আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদিসহ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা তো ছিলই। প্রকৃতপক্ষে আদমজী লোকসান নয় বরং ২ বিলিয়ন ডলার বা ১৪ হাজার কোটি টাকা লাভে ছিল। ষড়যন্ত্র করেই আমাদের পাটশিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এখন পাট নিয়ে কিছু করতে গেলেও তারা বাধা দিচ্ছে।
’
অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৮২-৮৩ সালে বিশ্বব্যাংকের স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (স্যাপ) আওতায় প্রথম ৩৫টি পাটকল বেসরকারিকরণ করা হয়। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে জুট সেক্টর অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (জেস্যাপ) নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে কর্মসূচির আওতায় ৯টি পাটকল বন্ধ, ১৭টি বেসরকারিকরণ, আদমজীসহ বড় দুটি মিলের উৎপাদন সংকোচন, ২৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ওই কর্মসূচির আওতায় ১৯৯৩-৯৪ সালে ৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়। সেগুলো হলো- ময়মনসিংহ জুট মিল, বাওয়ানি জুট মিল, মনোয়ার জুট মিল, পূর্বাচল জুট মিল ও হাফিজ টেক্সটাইল।
১৭টি মিল পর্যায়ক্রমে টেন্ডার দেয়া হয়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য দাম ও ক্রেতার অভাবে এর কোনোটিই বিক্রি করা যায়নি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলনের কারণে ওই কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। তবু এর আওতায় ৬টি পাটকল বন্ধ করা হয়।
পরে ১৯৯৭ সালে নারায়ণ জুট মিল স্থায়ীভাবে বন্ধ এবং আগেই বন্ধ হওয়া হাফিজ টেক্সটাইল ও পূর্বাচল জুট মিলসহ ৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলকে ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়।
২০০২ সালের ৩০ জুন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মাত্র ৫ দিনের নোটিশে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়। একইসঙ্গে খুলনার দৌলতপুর জুট মিল, টঙ্গীর নিশাত জুট মিল বন্ধ করা হয়। খুলনার পিপলস, স্টার, ইস্টার্ন জুট মিলে লে-অফ ঘোষণা করা হয়। অবশিষ্ট পাটকল থেকে ৬ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়।
অবশ্য শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলনের ফলে পরবর্তীকালে বন্ধ মিলগুলো আবার চালু করা হয়।
২০০৭ সালের ১৬ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাটশিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। আমলা ও এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাহীন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এ টাস্কফোর্স মূলত বিশ্বব্যাংকের সংস্কার কর্মসূচিরই পুনরাবৃত্তি করেছে।
এ টাস্কফোর্সের সুপারিশেই খুলনা পিপলস জুট মিলস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাত কর্ণফুলী কার্পেটস ফ্যাক্টরি এবং সিরাজগঞ্জের কওমী জুট মিল বন্ধ করা হয়। এ চারটি মিলের ৬ হাজার ৩৭৩ এবং বাকি ১৮টি মিলের ৭ হাজার ৬২৭ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়।
গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে এসব শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকরি থেকে বিদায় করতে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খুলনার পিপলস জুট মিলের পাশাপাশি ক্রিসেন্ট জুট মিল ও স্টার জুট মিল কয়েক দফা লে-অফ করে রাখা হয়। এ তিনটিসহ প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলিম জুট মিল বন্ধ করে দেড় হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। একই সঙ্গে চালু রাখার ঘোষণা দেয়া ২০০৭ সালের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির অধীনে ৬টি পাটকল লিজ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসব পদক্ষেপের ফলে দেশের পাটশিল্পে ধ্বংসের ধারা অব্যাহত থেকেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাটশিল্পের অবস্থান আরও দুর্বল হয়েছে। তবে বর্তমান সরকার সেই চক্র থেকে পাটকে বের করে আনছে বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই।
পাটের ওপর বড় একটা আঘাত এসেছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। বস্ত্র ও পাট ছিল তখন উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরীর হাতে।
তিনি সুষ্ঠুভাবে খুব যোগ্যতার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের অনৈতিক, বাংলাদেশবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেন। পাটকল বন্ধ করতে গিয়ে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, কোনোভাবেই এসব পাটকল চালানো সম্ভব না। এ বক্তব্য ছিল মূলত বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি।
‘কোনোভাবেই য চালানো সম্ভব নয়’ বর্তমান সরকার প্রমাণ করেছে আন্তরিকতা থাকলে সম্ভব, লাভজনকভাবেই চালানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক অস্থিরতার প্রভাবে এ বছর পাটের বাজার একটু এদিক সেদিক হলেও গত দুই বছর অধিকাংশ পাটকলই লাভে ছিল।
এ বিষয়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই এ রকম কোনো কথা বলিনি। আমি বলেছিলাম প্রোপার ম্যানেজমেন্ট, পুরনো যন্ত্রপাতি ও বাজেট সমস্যার কথা। এগুলো সমাধান করতে পারলে অবশ্যই পাটকলকে লাভজনক করা সম্ভব। ’
কিন্তু আপনার তখনকার ওই বক্তব্য তো মিডিয়ায় এসেছিল?
‘আমাকে মিসকোটেড করা হয়েছিল। ’
আপনার টিভি ফুটেজের সেই বক্তব্য তো এখনো আছে...
‘আমার যতদূর মনে পড়ে আমি এরকম কিছু বলিনি।
তাহলে ওই ফুটেজটা পুরোপুরি দেখতে হবে। তাহলে হয়ত বলতে পারব কোন প্রসঙ্গে বিষয়টা এসেছিল। তবে আমার মতটা কি ছিল তা কিন্তু আমি আগেই স্পষ্ট করেছি। ’
আপনি প্রোপার ম্যানেজমেন্ট, পুরনো যন্ত্রপাতি ও বাজেট সমস্যার কথা বলেছেন। কিন্তু এগুলো না করে আপনারা পাটকল বন্ধের দিকে এগুলেন কেন? এটা কি বিশ্বব্যাংকের চাপে?
‘আমাদের সরকার ছিল অনেক কাজের চাপে।
অনেক কম সময়ে অনেক বেশি সমস্যা সমাধান করতে হচ্ছিল আমাদের। পাটকল এত বেশি ভর্তুকি দিয়ে চালানো তখন আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিশ্বব্যাংক ছিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে। তবে আলাদা কোনো চাপ ছিল না। ’
পাটখাতে বিশ্বব্যাংকের প্রভাবের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংককে এসব বিষয়ে টেনে এনেছিল আমাদের সরকারগুলোই।
তারা চাইলেই বিশ্বব্যাংকে এড়াতে পারত। কিন্ত তা করেনি। আদমজী নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সব চুক্তির মেয়াদ শেষ। এখন আদমজী চালু করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তবু বিশ্বব্যাংক চাপ অব্যাহত রেখেছে।
তারা চায় না আদমজী নামে কিছু চালু হোক। আদমজী সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পাটশিল্পের ব্র্যান্ডিং। আদমজী বন্ধ করে তারা সারা বিশ্বের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিল যে, বাংলাদেশের পাটশিল্প মরে গেছে। তারা চায় না পাটের পুনর্জাগরণ কারো চোখে পড়–ক। তবে বিশ্বব্যাংকের চাপ বা পাটের পুনর্জাগরণ নিয়ে আমাদের আজ মাথা ঘামাতে হতো না, যদি আমাদের সরকারগুলো নিজস্ব শিল্প বন্ধের মতো এমন জনবিরোধী সিদ্ধান্ত না নিতো।
’
পাটের জীনতত্ত্ব আবিষ্কার
বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানেই কিছুকাল আগে আবিষ্কৃত হলো পাটের জীনতত্ত্ব। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল উদ্যমী গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জীন নকশা। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। ২০১০ সালের ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। দীর্ঘমেয়াদে বিবেচনা করতে গেলে এটাই পাটে সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন।
এর আগে ড. মাকসুদুল আলম ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে ও ২০০৯ সালে মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পাটের জিনোম আবিষ্কারের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবন করা যাবে। পাটের গুণগত মান ও বিপুল মাত্রায় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পানিতে জাগ দেয়ার সময় কম লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
আমাদের দেশের একেক অঞ্চলে একেক উচ্চতা ও পুরুত্বের পাট হয়।
নতুন জাতের বীজ হলে সব জায়গায় একই রকম উন্নত মানের পাট উৎপাদনের উপযোগী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। এর আঁশ দিয়ে কাপড় তৈরির উপযোগী মিহি সুতাও তৈরি করা যাবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতিতে পাট চাষ করতে সম্প্রতি বেশ কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে পাটের আঁশ জাগ দেয়ার জন্য পানি নিয়ে প্রতিবছরই সমস্যা দেখা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পেঁপে।
এখন এমন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা পোকামাকড়ের আক্রমণ সহ্য করতে পারে। ফলে উৎপাদন বেড়ে ওই অঞ্চলের আয় বেড়ে গেছে। মালয়েশিয়ায় রাবারের ক্ষেত্রে একই ধরনের সফলতা এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিনোম আবিষ্কারের পর প্রয়োজনীয় বীজ উৎপাদন করতে চার বছরের মতো সময় লাগে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, বীজ উৎপাদনের কাজ এগিয়ে চলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আগুন এখানেও
পাটশিল্প এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি বাজারের সংকোচন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সিরিয়া, ইরাক, ইরান, সুদান ছিল বাংলাদেশের পাট রপ্তানির বড় বাজার। যেহেতু ডলারে এলসি খুলতে হয় তাই মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সিরিয়ার সঙ্গে এখন কোনো লেনদেন করা যাচ্ছে না।
বিশ্ব রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু সঙ্কট। যা পাট খাতকে বিপদে ফেলছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর দেশে সাত লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ৮০ লাখ বেল পাটের উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর চাষের জমি এক ধাক্কায় ৬০ হাজার হেক্টর কমে গেছে। উৎপাদনও সর্ব সাকুল্যে ৭০ লাখ বেলের বেশি হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অন্যদিকে, তিন বছর ধরে টানা পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ও আয় বেড়েছিল। চলতি বছর রপ্তানি বাজারও মন্দা, আয় কমেছে ১৩ শতাংশ।
২০১০-১১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে তা ৯৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। দেশের পাটের দাম নির্ভর করে কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর। এক বছর ধরে কাঁচা পাটের রপ্তানিতে ধস নেমেছে। কাঁচা পাট রপ্তানি কমেছে ৩১ শতাংশ।
রপ্তানির তুলনায় অভ্যন্তরীণ পাটের বাজারই বেশি হতাশাজনক। বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, ভারতে পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশে তা ১৫ শতাংশেরও নিচে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন, ২০১০’ অনুমোদন করে। আইনে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যে ৭৫ শতাংশ পাট আছে, এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রয়েছে।
কিন্তু দেশে পাটের ব্যাগের ব্যবহার না বেড়ে বরং কমে গেছে। গত অর্থবছর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্যের মোড়ক হিসেবে ২৬ হাজার ৫৬০ টন পাট ব্যবহার করেছিল। চলতি বছর তা কমে ১৩ হাজার ৬৫০ টনে নেমে এসেছে। আইনটি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া সরকার কাঁচা পাট কেনার জন্য যে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে তা সরকারি ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান, উভয়টির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
যেখানে বেসরকারি পাটকলগুলো ৭ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারে সেখানে সরকারি পাটকলগুলোকে ১৪ শতাংশ বা আরো বেশি সুদে ঋণ নিতে হয়। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাট শিল্পের নামে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে ব্যয় করছে কি-না তা খতিয়ে দেখারও কেউ নেই।
পাট রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও এর সুফল বাজারে দেখা যাচ্ছে না। মৌসুমের শুরুতে ১১শ’/১২শ’ টাকা ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা পাট ফড়িয়াদের হাতে তুলে দিচ্ছে। ফড়িয়াদের কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা পাট নিয়ে গুদামজাত করে রেখে পাটের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে।
মধ্যস্বত্বভোগীরাই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। পাট পাচার হচ্ছে।
একটি সূত্র জানায়, গত এক বছরে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার কাঁচা পাট ভারতে পাচার হয়েছে। এছাড়া দেশে মজুদকৃত আড়াই হাজার কোটি টাকার পাটের একটি বড় অংশ ভারতীয় মাড়োয়ারিয়া এদেশি মজুদদার ও আড়তদারদের ঘরে কিনে রেখেছে। যা পাচারের অপেক্ষায় আছে।
পাট নিয়ে মাড়োয়ারিদের এ গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া জ্বালানি সমস্যা, নষ্ট যন্ত্রপাতির সময়মতো ঠিক না হওয়া, মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ চালানোর ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা যাচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বড় আকারের পাটকলের চেয়ে বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি করতে পারে, এমন ছোট ও মাঝারি পাটকল বেশি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বিদেশে নতুন বাজার খোঁজার ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা আছে। যদিও এখন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম আমাদের পাট কিনছে।
এরকম আরো বাজার বের করতে হবে। সরকারের উচিত বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন এবং এর বাজারজাত করার ব্যাপারে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া।
এক সময় পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। পৃথিবীব্যাপী কদর ছিল বাংলাদেশের তৈরি পাটজাত পণ্যের। রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস ছিল এই পাট।
অথচ এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজীসহ অন্যান্য পাটকলও একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পেছনে একটি স্বার্থানে¦ষী মহল সর্বদাই সক্রিয় ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পাটের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বন্ধ পাটকলগুলো আবার চালু হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক তন্তুর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পাটের আন্তর্জাতিক বাজার আরও বিস্তৃত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে কথার তুলনায় কাজ হয়নি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পাট শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রশাসনে জবাবদিহিতা, যথাযথ গবেষণা, অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণে প্রচার-প্রচারণা, আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে পরিকল্পনা ও গবেষণার প্রতি জোর দিতে হবে। শুধু বন্ধ কারখানা নয়, নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হবে। পুরনো পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন ঘটাতে হবে।
পুরনো যন্ত্রাংশ পরিবর্তন, সংস্কার, মেরামতের জন্য এ খাতে আরো অনেক বেশি নতুন বিনিয়োগ দরকার। যা করতে হবে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার সঙ্গে, দেশের স্বার্থে।
আগের সরকারগুলো পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল লোকসানের অজুহাতে। লোকসানের কারণ সেই পুরনো যন্ত্রপাতি এখনো আছে। এগুলো মেরামত, সংস্কারের পাশাপাশি নবায়নও দরকার।
নইলে আবার লোকসানের দায় চাপবে পাটকলগুলোর কাঁধে। পাট ক্রয়, যন্ত্রাংশ ক্রয়, মেরামত, সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে বড় আকারের দুর্নীতি এখনও আছে পাটকলগুলোতে। পাটের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে এগুলো থামানো অপরিহার্য। তা না করা গেলে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় পুনরায় আক্রান্ত হতে পারে এই খাত। সরকারকে এক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যেতে হবে।
‘প্রতিশ্রুতি পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর’
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
মন্ত্রী, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
সাপ্তাহিক : পাট শিল্পের বিকাশে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী : প্রধান বাধা অর্থপ্রবাহে। আমরা পাট সমস্যার সমাধান ঘটাতে পারি আট হাজার কোটি টাকা পেলে। গড়ে প্রতিটি মিলে ৩০০ কোটি টাকা করে দরকার। এটা বাজেটের চার শতাংশ। এত টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
ফলে আমরা ছোট পরিকল্পনা করে এগুচ্ছি। আমরা এখন কৃষকদের একটা সাপোর্ট দিচ্ছি। শ্রমিকদের সময়মতো বেতন দিচ্ছি। কিছু মিল চালু করেছি। নতুন আরো চালুর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু টাকা থাকলে আরো অনেক কিছু করা যেত।
সাপ্তাহিক : এখন যে টাকা দিয়ে এ খাতের উন্নয়ন হচ্ছে, এই পরিমাণ টাকা সব সরকারই খরচ করতে পারত। আগের আমলেও আপনারা এই খাতে ততটা গুরুত্বারোপ করেননি।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী : বিষয়টি নীতির। একেক সময় একেকটা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
পাট খাতকে আমরা আঁকড়ে ধরেছি কারণ এটা আমাদের নিজস্ব শিল্প, গৌরবের একটি দিক। আগের আমলে এভাবে কাজ করার দরকারও পড়েনি। তখন অবস্থা এমন নাজুক ছিল না।
সাপ্তাহিক : অভিযোগ উঠছে, সরকার বন্ধ পাটকল চালু করছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব মাথায় না রেখেই।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী : অর্থনীতির হিসাব করেই কাজ করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনাও এখানে খাটো নয়। আগের সরকার পাটকল বন্ধ করেছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। আর আমরা রাজনৈতিক বিবেচনায় তা চালু করছি। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের চরিত্র প্রকাশ পায়।
সাপ্তাহিক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পাটের ওপর একটা বড় আঘাত এসেছিল। তখন শোনা গিয়েছিল, কোনোভাবেই এসব পাটকল চালানো সম্ভব নয়। এখন আপনারা কি শুধু ভোটের রাজনীতির হিসাব করেই পাটকল চালু করছেন নাকি এগুলো আসলেই লাভজনক করা সম্ভব?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী : আমরা অবশ্যই লাভ-ক্ষতির হিসাব সামনে রেখেই কাজ করছি। এই মুহূর্তে সব হিসেব বলতে পারব না। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে পাটকলগুলো।
এখনো আমরা লাভের ধারায় আছি। গত বছর মার্চে চালু হয় খালিশপুর জুট মিল। প্রথম চার মাসেই ওই মিলটি লাভ করেছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। এখন আবার ওই মিলটি তার লোকবল, তার কেনা পাট দিয়ে সহযোগিতা করছে দৌলতপুর জুট মিলকে দাঁড় করাতে। এগুলো করা যায় সদিচ্ছা থাকলে।
আর এই সদিচ্ছা তো আসে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যাদের কোনো রাজনৈতিক অবস্থানই ছিল না, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশমাফিক চলাটা তাদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক।
সাপ্তাহিক : আদমজীর ক্ষেত্রে কি করলেন?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী : আমরা আদমজী নস্টালজিয়ায় ভুগি না। আমরা অর্থনৈতিক হিসেবটাকে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে আদমজী বন্ধ করে জোট সরকার।
আদমজী বন্ধের সময় বিশ্বব্যাংক ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নয়টি পাটকল চালুর জন্য ৩০ কোটি ডলার দিয়েছে। এখন আমরা বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করেই আদমজীর ২নং ইউনিটটি চালুর চেষ্টা করছি। যদি আমরা ওই বিশাল কারখানা চালু করতে যাই তা কতটা লাভজনক হবে? সব হিসাব করেই আমরা কাজ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।