যে মুখ নিয়ত পালায়......। ।
রোদ পড়ে গেছে। সূর্য এখন আস্তে আস্তে রঙ বদলাবে। তারপর মিলিয়ে যাবে।
কাঠবিড়ালীদের সূর্য চন্দ্র ইত্যাদি নিয়ে বোধহয় কোন আদিখ্যেতা নেই। মানুষের আছে। তেরাব আলী বারান্দায় বসে ভাবেন। ইদানীং তার হাতে নতুন কাজ আসছে না। কাজ না থাকলে তার হাঁসফাঁস লাগে।
তখন তিনি কবিতা লিখেন। অথবা গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে বসে থাকেন বেশীরভাগ সময়।
এসময় কাঠবিড়ালীরা তার চিন্তার অধিকাংশ জুড়েই থাকে। তিনি কাঠবিড়ালী সম্প্রদায়ের সাথে মানুষের মিল খুঁজেন। বেশীরভাগ সময়ে হতাশ হন।
তার বারান্দার পাশের লম্বা গাছটিতে কতকটা কাঠবিড়ালী লাফিয়ে বেড়ায়। তাকে বারান্দায় বসতে দেখলে চোখ বড় বড় করে চোখের দিকে তাকায়। অথচ তেরাব আলী জানেন মানুষেরা বেশী চোখের দিকে তাকায় না। এর একটা কারন অবশ্য বের করেছেন তিনি। তার ধারনা চোখের শক্তি অপরিসীম।
ভালভাবে চোখের দিকে তাকালে একটা মানুষকে পুরো দেখে নেয়া যায়। মানুষের অবচেতন সত্ত্বা এই জিনিসটা জানে। তাই সে মানুষকে অন্য মানুষের চোখের দিকে তাকাতে বাঁধা দেয়। পাছে বের হয়ে যায় গত জীবনের পাপ কিছু। মানুষ একটি ভীতু প্রাণী।
তেরাব আলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। মানুষ ভীতু প্রাণী এতে তার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার খারাপ লাগে। মানুষের উচিত ছিল প্রকৃতিগত ভাবে কাঠবিড়ালীদের মত সাহসী হওয়া।
চোখ সংস্লিষ্ট ব্যাপারে তেরাব আলী অনেক সিরিয়াস।
তিনি প্রথমেই মানুষের চোখের দিকে তাকান। মানুষ বার বার বিভিন্ন ছুঁতায় চোখ সরিয়ে নিতে চায়। আর তিনি বারবার চোখ দিয়ে ঝাঁপটে ধরেন। এতে তার কাজের সুবিধা।
আজকে তিনি কবিতা লিখবেন ঠিক করলেন।
তার কবিতা গুলো অদ্ভুত। তিনি একবার ছাঁপতে দিয়েছিলেন। পত্রিকাওয়ালা তাকে বলেছিলেন, কি লিখেছেন এসব? এগুলো কোন মানুষ লেখতে পারে? আপনি কবিতা লিখবেন না প্লিজ। ইচ্ছে হলে মানুষ মারুন। তবু বাংলা কবিতাকে মারবেন না।
বাংলা কবিতার প্রতি দরদবান এই সম্পাদকের প্রতি অবশ্য তার কোন ক্ষোভ জাগে নি। তার নিজের ও ধারনা ছিল তিনি ছাঁপার মত কিছু লিখেন নি।
তেরাব আলী কবিতা লিখবেন ঠিক করে কাগজ নিয়েছেন এর ঠিক সাথে সাথেই তার ফোন বেজে উঠল। পরিচিত নাম্বার। তেরাব আলী কেটে দিলেন।
বারান্দা থেকে ঘরে আসলেন। আলনায় ঝুলানো পাঞ্জাবি টা গায়ে জড়ালেন। খাটের নিচ থেকে স্যান্ডেল বের করলেন। বের হলেন ঘর থেকে। আজ ঘরে বসে কবিতা লেখা হবে না।
আজকের আকাশ বিষন্ন আকাশ। বিষন্ন আকাশে একদল কবি বাইরে বের হন।
গলি দিয়ে হাঠছেন তেরাব আলী। ছোট গলি। পাশে পাশে লোকজন ময়লা ফেলে রেখেছে।
তবুও মানুষের ভীড়। মানুষের চোখে মুখে ব্যস্ততা। সবাই ব্যস্ত। তেরাব আলী এখানেও কাঠবিড়ালীদের সাথে মানুষের কোন মিল পান না। কাঠবিড়ালীরা মানুষের চেয়ে দ্রুত চলে।
কিন্তু তাদের চলায় ব্যস্ততা নেই। ছন্দ আছে। এক ধরনের সৌন্দর্য আছে। দেখলে মনে হয় চার্লস বুকোস্কির কবিতা। বুকোস্কি কে কি ঈশ্বর হায়ার করেছিলেন কাঠবিড়ালীদের তৈরী করার সময়? তেরাব আলীর মনে উদ্ভট চিন্তা চলে আসে।
তিনি নিজেই অবাক হন। এসব জিনিস আসার কথা না। তবে তিনি কি আসলেই কবি? আসলেই সেই কবিদের একজন যাদের কবিতায় আটকে থাকে বাতাস,সময় এবং কয়েক কোটি মহাবিশ্বের সমান মুগ্ধতা?
আজ মনে হয় বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টি ভাল জিনিশ। কবিদের জন্যও, তার জন্য ও।
তিনি ই তো কবি। জীবনানন্দের মত আমি ই সেই কবি বলে কোন পংক্তি হয়ত লিখেন নি। কিন্তু তাতে কি! বৃষ্টির শব্দ সব সময়েই কবিদের সাহায্য করে কবিতায়। অমোঘ সত্য পৃথিবীর।
তেরাব আলী গলি পার হয়ে কয়েকটা চায়ের দোকান ফেলে লাইট হাউজ সিডি এন্ড ডিভিডি শপের উলটা দিকে ভাঙা মুরগীর ফার্মের পিছনের আধভাঙা দালানটায় গিয়ে ঢুকলেন।
এখানে খুব দূর্গন্ধ। মুরগীর ফার্মের বেশীরভাগ বর্জ্য ফেলা হয় এদিকটায়।
তেরাব আলী স্বাভাবিক ভাবেই গিয়ে ঢুকলেন। গলায় লাল গামছা দেয়া এক লোক বসে ছিল। তেরাব আলী যেতেই উঠে পড়ে।
আসছেন বস। কতক্ষণ আপনের জন্য খাঁড়ায়া আছি।
তেরাব আলী বললেন, একটা কথা বলি। আমারে বস বলবেন না। কবি বলবেন।
আমি একজন কবি। বুকোস্কির মত বড় কবি।
বুকোস্কি কে? আচ্ছা যাক কবি ভাই, এসব জ্ঞানের কথা বাদ। আমি মূর্খ লোক। কাজের কথায় আসি।
হ্যা আসো। কোথায় ?
মহল্লাতেই। বাজারে।
মহল্লাতে কীভাবে। এখানে আমি ছয়মাস ধইরা আছি।
জায়গাটা ভাল লাগছে।
কবি ভাই, আরো ভাল জায়গা দুনিয়াতে আছে। আর সেসব দায়িত্ব তো আমাদের ভাই। আপনের কাজ আপনে করবেন। আমাদের টা আমরা।
ঠিক আছে। নাম কি?
সোহরাব। এইবার ইলেকশনে। কমিশনারী তে। চিনেন তো?
হ চিনি।
পোস্টারে দেখছি। মোচওয়ালা না?
হ্যা। চিনতে পারছেন। মোচওয়ালা। কালা।
চেক শার্ট পইড়া ঘুরে। হালায় বউত হারামী। রেপ করছে কয়টা।
হুম। এরে দেখতে কাঠবিড়ালী দের মত লাগে।
কিছু কাঠবিড়ালীরে দেখলে মনে হইব ডোরাকাটা। যেন রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
ভাই কি কন এইসব? বুঝি না?
তোমার বুঝার দরকার নাই। এখন বাকী কথা বলো?
বাকী কথা হইল কাজ শেষে এইখানে চইলা আসবেন। বাকীটা আমরা দেখব।
আর কিছু নিয়া তো কথা কইতে হইব না। আমরা হইলাম গিয়া পুরান মানুষ। । হে হে হে...
তেরাব আলী এই লোকের কাল কাল দাঁতের হাসি দেখতে অপছন্দ করেন। তিনি মাথা ঘুরিয়ে চলা শুরু করলেন।
তার গন্তব্য এখন বাজার। বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। তেরাব আলী হাটছেন। তার মনে হাটছে কয়েকশো কাঠবিড়ালী।
তারা সবাই কবি। কবিদের মতো উজ্জ্বল চোখ নিয়ে তারা মার্চ করছে। তেরাব আলী এদের অনুভব করতে করতে চলেছেন। যেন তিনি নিজেই আপাদমস্তক কবিতা। মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত না অমিত্রাক্ষর- বিভিন্ন ছন্দের নাম শুনেছেন।
তিনি আসলে কোন ধরনের কবিতা? কাঠবিড়ালীরা কোন ধরনের কবিতা লিখে? তাদের কি কোন পেত্রাক বা মধুসুধন ছিল? পেত্রাক না থাকলে তো সনেট হবে না। তেরাব আলী জানেন ইটালীয় কবি পেত্রাক সনেটের জনক। জনক না থাকলে সন্তান থাকবে না। যেমন তার বাপ তৈয়বুর রহমান না থাকলে তিনি হতেন না। তৈয়বুর রহমানকে তার মনে পড়ে।
হালকা লম্বা ধরনের লোক। শেষ বয়সে কুঁজো হয়ে গিয়েছিলেন কিছুটা। তার নাম রেখেছিলেন শহীদুর রহমান। তেরাব আলীর সেই নাম হারিয়ে গেছে। তেরাব আলীর অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।
তিনি হারানো জিনিশ খুঁজেন ও না। যে জিনিস নিজ থেকে হারিয়ে যায় তা খুঁজতে নেই।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তেরাব আলী তার কাজ সম্পন্ন করলেন। এরপর বাজারে কমলা মিষ্টান্ন ভান্ডারের পাশের খুপড়ী চায়ের দোকানে গেলেন। সন্ধ্যায় এক কাপ চা খাওয়া দরকার।
তা না হলে গা ম্যাজ ম্যাজ করে।
চায়ের কাপ দিয়ে গেল ছোট এক ছেলে। খুপড়ী দোকানটাতে তিনটা বেঞ্চি। মাত্র তিন চার জন লোক বসে আছে। একজন বসেছে তার সামনে।
সেও চা সামনে নিয়ে। তেরাব আলী লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আৎঁকে উঠলেন। লোকটিও একই রকম তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের শক্তি এবং স্পর্ধা দেখে অবাক হলেন তেরাব আলী। এই প্রথম কেউ থাকে চোখ দেখে বুঝে নিল।
তিনিও অবশ্য বুঝেছেন। আগে জানলে একটু সাবধান হওয়া যেত।
হয়েই যখন গিয়েছে তখন আর বণিতা করলেন না তেরাব আলী। মুচকি হেসে বললেন, আইজ কবিতা লেখার দিন, ঠিক না ভাই?
লোকটা চায়ের কাপ নামিয়ে বলল, হ। লেখছেন?
তেরাব আলী মাথা নেড়ে বললেন, একটু আগে।
আপনে?
লোকটা বলল, আমি গত কালকে। এলাকা ছাইড়া এই
জায়গায় আইলাম। এলাকাটা কেমন?
তেরাব আলী চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, ভাল।
আমি মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়া যে গলি তার ডান দিকে থাকতাম। বাসার পাশে গাছ আছে।
গাছে কাঠবিড়ালী। ভাই কি কাঠবিড়ালী পছন্দ করেন? আপনি আমার ঘরে উঠতে পারবেন। এক বছরের ভাড়া দেয়া।
লোকটা বলল, দেখি।
তেরাব আলী উঠে পড়লেন।
বললেন, যাই ভাই। সবাই বসে আছে।
তিনি হাটা শুরু করলেন। রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমেছে। শুষ্ক মাটির কনা বৃষ্টির পানিতে মিশে ছোঁপ ছোঁপ কাদায় পরিনত।
স্যান্ডেলের ছিটা পিছন দিক টায় এসে লাগছে তেরাব আলীর। প্রতি পদক্ষেপে স্যান্ডেলের সাথে ভেজা মাটি ও পানির ঘর্ষনে শব্দ ও হচ্ছে। সেই শব্দকে মধুর মনে হচ্ছে তার। এবার ভিতরের কবি কাঠবিড়ালীদের মার্চের সাথে শব্দ ও যোগ হলো। তেরাব আলী প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
এই বুঝি যাদু বাস্তবতা!
ইতিমধ্যে বাজারে হইচই পড়ে গেছে। কমিশনার পদে দাঁড়ানো সোহরাব হুসেনের লাশ পড়ে আছে বাজারের দক্ষিণ দিকে নিউ হেয়ার কাটিং সেলুনের সামনে। কে বা কারা এই কাজ করে গেল এই নিয়ে বাজার পুরো গরম। আধ ঘন্টা পর পুলিশ এল গাড়িতে করে।
আর ওদিকে গাড়িতে করে চলে যাচ্ছেন তেরাব আলী।
অন্য কোথাও। গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর তিনি বললেন, ড্রাইভার গাড়ি থামাও। আমার জন্য পাশের দোকান থেকে কাগজ কলম নিয়ে আসো। আমি কবিতা লিখব। কথামত কাগজ কলম নিয়ে এসেছিল ড্রাইভার।
তেরাব আলী কাগজ কলম নিয়ে গাড়িতে বসে আছেন। তার মাথার ভেতরে এখন কাঠবিড়ালীরা আর অপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মার্চ করে যাচ্ছে না। এখন তারা ট্যাংকে করে যাচ্ছে। যুদ্ধ যুদ্ধ সাজে সাজানো ট্যাংক। ট্যাংক চলার সাথে সাথে খস খস আওয়াজ হচ্ছে।
তেরাব আলী হাতে কাগজ কলম নিয়ে বসেই আছেন।
গাড়ির হেডলাইটে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা । হেডলাইটের ভাঙা এক কোণ দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল এক খয়েরী রঙের ছোট ঘাসফড়িং। লাইটের কাচে পানির ফোঁটা জমায় ভিতর থেকে বাইরেটা ঝাপসা দেখছে খয়েরী ঘাসফড়িং। লাইটের উত্তাপে তার শরীর জ্বালাপোড়া করছে।
কিন্তু সে নির্বিকার।
সে খবর জানেন না তেরাব আলী, জানে না পুলিশ,ড্রাইভার বা অন্য কেউ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।