আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ সুখ



১. চালকুমড়ার পাতা আর সরিষা দিয়ে শাকের বড়া বানিয়েছিল হালিমা বেগম। বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে হেলেঞ্চা, কলমি আর কচুর কচিপাতা কুঁড়িয়ে এনে পাঁচমিশালী শাক রান্না করেছিল। দুটোই খুব পছন্দ করে সেলিম। বেচারার আর তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া হল না। ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হেডমাস্টার সাহেব বাড়ির উপর এসে এমন তাগাদা দেওয়া শুরু করল, কোনো রকমে নাকে মুখে খেয়ে মাস্টার সাহেবের সাথে বেরিয়ে পড়ল।

ওদের পিছে পিছে বাহির বাড়ি পর্যন্ত এলো হালিমা বেগম। সাথে সাথে এলো তাঁর ছয় বছর বয়সের মেয়ে হাফসা। যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলের আবছা ছায়া দেখা যায়, ততক্ষন পর্যন্ত তাঁকিয়ে থাকল সে। এরপর আঁচলে চোখ মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলল হালিমা বেগম। ছেলেটি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় এবার ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়েছে।

তাই, সার্কিট হাউসে ওকে সম্বর্ধনা দেবে ডিসি সাহেব। পড়ালেখার প্রতি অনেক আগ্রহ ছেলেটার। কিন্তু টাকার অভাবে এখনো ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত হয়ে আছে। ওর বাবা সোলেমান শেখের তেমন সামর্থ্য নেই। বাড়িটার বামদিকে ছয় কানি জমি আছে।

ওখানে বছরে দুইবার ধান আর একবার পিয়াজ লাগিয়ে যে টাকা পয়সা আসে, এতে কোনো রকমে দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে চারটে মুখের সংসার চলে যায়। সেলিম স্কুলের সময়টুকু বাদে, বাকি সময় বাপকে কাজে সাহায্য করে, লোক জনের গালাগাল খেয়েও দূর-দূরান্ত থেকে গাভিটার জন্য ঘাষ কেটে আনে, বাছুরটাকে দেখে দেখে রাখে, নিজে নিজেই দুধ দুইয়ে বট তলার বাজারে বেঁচতে নিয়ে যায়। এই করেই দিন ফুরিয়ে যায়। রাতে যদিওবা একটু অবসর মেলে, সোলেমান শেখের অতটা সামর্থ্য নেই কেরোসিন তেল পুড়িয়ে ছেলেকে পড়াবে। হালিমা বেগমের সময় সময় কষ্টে বুক ফেটে যায়, বাচ্চা দুইটা বড় হচ্ছে।

অথচ কোনোদিনও ভালো মন্দ দুইটা কিছু খাওয়াতে পারল না। পোলাও, মাংস, পিঠা-পুলি; কিছুই চোখে দেখে নি বাচ্চা দুইটা। সেলিম যখন গাভীর দুধ দোহায়, হাফসার শিশু চোখ লোভী দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে অপলক তাঁকিয়ে থাকে অমৃত তৃষ্ণায়। হালিমা বেগম সব জানে, সব বুঝে; তবুও পাষণ্ডর মত নির্লিপ্ত থাকে তাঁর চোখ, তাঁর ঠোট। কিন্তু হায়! কেউ যদি একবার হালিমা বেগমের অন্তরটা পড়ে দেখতে পাড়ত।

কত ঝড় বয়ে যায় রোজ সেখানে! কত নদী কান্নার বসবাস সেখানে, কেউ যদি বুঝত! এই দুধ বেঁচা টাকা দিয়েই যে তেল, নুন, মরিচের যোগার আসে ওদের সংসারে! গত মৌসুমে পিয়াজের দাম হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় লাভের মুখ দেখতে পারে নি সোলেমান শেখ। তাই গত রোজার ঈদে বাচ্চা দুইটাকে নতুন পোষাক কিনে দিতে পারে নি সে। বছরে একবারই জামা জোটে ওদের দুই জনের। গত ঈদে জোটে নি। সেলিম কিছু বলে নি।

সেলিম কখনো কিছু বলে না। পেটে ক্ষুধা থাকলেও বলে না, মা আর এক মুঠ ভাত দাও! কিন্তু হাফসা কিছু মানতে চায় না। ছোট মানুষ! পৃথিবীর কি সে বুঝে! নতুন জামা না পেয়ে সারাদিন চিল্লাচিল্লি করে কেঁদে গলা ভেঙেছে। হালিমা বেগম সেদিন আর নির্লিপ্ত থাকতে পারে নি। কাঁচা কঞ্চি দিয়ে দুই জনকেই ইচ্ছামত পিটিয়েছে, ওদেরকে আরো কাঁদিয়েছে, নিজে কেঁদেছে।

একটাই মাত্র হ্যাফ প্যান্ট সেলিমের। দুই বছর ধরে ক্রমাগত পড়তে পড়তে বেশ কয়েক যায়গায় হালিমা বেগমের হাতের সযতন তালি পড়েছে। এক মাত্র শার্ট, পেছনের দিকটায় ভাঁজ হয়ে কুচকে গেছে। সেলিম অবশ্য শার্টটা শুধু স্কুলে যাওয়ার জন্যই পড়ত, আর বাকিটা সময় খালি গায়ে থাকত। সমাপনী পরীক্ষার সময় সোলেমান শেখ নতুন একজোড়া স্পঞ্জের রূপসা স্যান্ডেল কিনে এনে দিয়েছিল।

এই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়াটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল সেলিমের এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেলের অভাবে। তালি পড়া হাফ প্যান্ট কুচকে যাওয়া শার্টের আড়ালে হয়ত ঢেকে যাবে, কিন্তু স্পঞ্জের স্যান্ডেল পড়ে এত বড় বড় অতিথীর সামনে কীভাবে যাওয়া যায়! সেলিম অবশ্য বাবার কাছে স্যান্ডেলের কথা তুলে নি। ওর অনুষ্ঠানে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে যেন কোনো আগ্রহ নেই। হালিমা বেগম ভিতরে ভিতরে বিষয়টি মেনে নিতে পাড়ছিল না, তবুও স্বামীর কাছে স্যান্ডেলের কথা তোলে নি। তুলেই বা লাভ কি, তাঁর স্বামীর অবস্থা তাঁর চেয়ে আর কেইবা ভালো বুঝবে।

কাল যখন সোলেমান শেখ ছেলে-মেয়ের জন্য নতুন জামা আর এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল নিয়ে এলো, হালিমা বেগম এতই অবাক হয়েছিল, কথাই বলতে পারছিল না। বার বার শুধু কেঁদে ফেলছিল। হয়ত সোলেমান শেখও কেঁদে ছিল, স্যান্ডেল জোড়া কেনার সময়, ছেলের হাতে দেওয়ার সময়। পুরুষ মানুষও সুখের সময় কাঁদতে জানে, পুরুষ মানুষেরও বুকের মাঝে একটা কান্নার নদী থাকে। -মা, ম্যাভাইরে খুব সোন্দর লাগতাছে না? হাফসার ডাকে যেন সম্বিত ফিরে পায় হালিমা বেগম।

তাঁর ঠোটের কোনায় ম্লান একটা হাসি মুক্তোর দানার মত ঝরে পরে। -হ রে মা! হালিমা বেগমের হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যায়। -কিরে! তরে তো অহনো খাইতে দিলাম না! মানুষটায়ও খায় নাই। চল দুইটা খায়া, তর বাপজানের লাইগা ভাত লইয়া যাবি। ২. হালিমা বেগম হাড়িতে নিজের জন্য দুই এক মুঠো ভাত রেখে বাকিটা থালায় সুন্দর করে সাজাল।

এক পাশে দুই ফালি কাটা পিয়াজ, দুইটা কাঁচা মরিচ, কিছু লবন রাখল। সকালের বানানো চালকুমড়া পাতার দুইটা বড়া, পাঁচ মিশালী শাক কড়াইয়ে যেটুকু ছিল সবটুকু রাখল আরেক পাশে। এরপর আরেকটা থালা দিয়ে খাবার ঢেকে দিয়ে গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে গিট দিতে দিতে হাফসাকে বলল, তর খাওয়া শ্যাষ হইলে বাজানের লাইগা লইয়া যাইস। শ্বাস নেওয়ার জন্য কিছুক্ষন থেমে আবার বলল, দাঁড়া, আগেই যাইস না। গেলাসটা মাইজা লইয়া আসি, হেয়ার পরে যাইস।

হাফসার খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে। আঙুল দিয়ে থালার খাবারের শেষ কণাগুলো চেটে খাওয়ার পর, ওর চোখ পড়ল পাটিতে পড়ে থাকা দুই চারটা ভাতের দিকে। একটা একটা করে মুখে পুরে নিচ্ছিল ও। এতক্ষণে হালিমা বেগম ফুরসুরৎ পেল হাফসার দিকে তাঁকানোর। মেয়েটার কাজ-কারবার দেখে মৃদু হাসল সে।

-কিরে হাফসা? প্যাটে এহনো ক্ষিদা আছে? হাফসা কিছু বলল না। সম্মতির মতো করে লাজুক হাসি হাসল। হালিমা বেগম হাড়ির শেষ ভাতটুকু হাফসার থালায় ঢেলে দিল। স্বামীর ভাতের থালার গিট খুলে একটা বড়া হাফসার থালায় রাখল। অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু পেলে মানুষের চোখ যেমন ঝিলিক দিয়ে ওঠে, দেবশিশুটির চোখেও যেন সেই খুশির ঝিলিক খেলে গেল।

হালিমা বেগমের বুকের ভিতর যেন কেমন একটা অনুভূতি খেলে গেল। কোথায় যেন একটা সুখ সুখ অনুভূতি তাঁকে মোহিত করে তুলছিল। -বোকা মাইয়া! তর এহনো ক্ষিদা আছে আগে কইবি না? হালিমা বেগম মনের সুখে দেবশিশুটির খাওয়া দেখে চলল। পৃথিবীর সকল মা তাঁর সন্তানকে খাওয়ানোর মাঝে যে সুখ পায়, তার চাওয়া-পাওয়া পূরন করে যে আনন্দ পায়, এ সুখ, এ আনন্দ এমন, আর কিছুর সাথে তার তুলনা নেই। হালিমা বেগমের চোখে কখন যে জল চলে এসেছে, একটুও টের পায় নি।

নাহ! গতকাল থেকে তাঁর সুখের রোগে পেয়ে বসেছে। পোড়া চোখে জল আসে, যতই লুকোতে চায়, বাঁধা দিতে চায়, ওরা বাঁধ ভেঙে জোয়ারের মত বারে বারে ফিরে আসে। ৩. সোলেমান শেখের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলের সাথে যাবার। মাস্টার সাহেবও ধরেছিল যাবার জন্য। কিন্তু জীবনযুদ্ধে ক্রমশ পরাজীত হয়ে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল নিজের কাছেই, তাই সাহস করে মাস্টার সাহেবকে হ্যা বলতে পারে নি।

নানা কাজের বাহানা দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে। নতুন শার্ট, প্যান্ট, চামড়ার স্যান্ডেলে ছেলেকে কেমন দেখায়, সেটা দেখারও খুব ইচ্ছে ছিল। সোলেমান শেখ সে ইচ্ছেকেও পাত্তা দেয় নি। পরাজীত মানুষদের যেন কোনো সখ থাকতে নেই, ইচ্ছে থাকতে নেই। ক্ষেতে পিয়াজ লাগানোর মৌসুম চলে যাচ্ছে।

তাঁর পক্ষে কলের লাঙল ভাড়া এনে জমি চাষ দেওয়া সম্ভব নয়। ক্ষেতে লাঙল দেওয়ার জন্য রহিম সরদারের ষাড় ভাড়া নেয়া, আর সেচের জন্য হাতে ক’টা টাকা ছিল। অন্য চাষীরা আগেই ভাড়া নিয়ে নেয়ায়, তাঁর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এর মধ্যেই সেলিমের পরীক্ষার রেজাল্ট এলো। মাস্টারদের কাছে ছেলের অনেক প্রশংসা শুনেছে সে, সেলিমের মাথা ভালো।

তাঁর ধারনা ছিল সেলিম পরীক্ষায় পাশ করবে। কিন্তু এমন রেজাল্ট করতে পারবে ভাবতেও পারে নি। ছেলের কথা ভাবলেই গর্বে বুক ভড়ে ওঠে সোলেমান শেখের। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতে চায় না সে। সারাটা জীবন ধরে যে মানুষটা দুঃখ-কষ্ট সয়ে এসেছে, সে হঠাৎ পাওয়া আনন্দে আর সবার মত উল্লাসে মেতে উঠতে পারে না।

এ আনন্দে সে আরো বিনয়ী হয়ে ওঠে, একা একাই নিজের মাঝে ডুবে থেকে আনন্দে মেতে ওঠে। সেখানের সবটুকু আনন্দই, সবটুকু সুখই তাঁর। কাউকে ভাগ দিয়ে হয় না এতটুকুও। সেই টাকা দিয়ে ছেলে মেয়ের জন্য নতুন জামা কাপড়, চামড়ার স্যান্ডেল কিনে এনেছে সোলেমান শেখ। সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর এতটুকুও সময় লাগে নি।

সুখের রোগ তাঁকেও পেয়ে বসেছে। জীবনের চুয়াল্লিশটা বছর পেরিয়ে হঠাৎ করেই যেন বদলে যেতে ইচ্ছে করে তাঁর। সুখের জন্য কাঙাল হয়ে ছটফট করে তাঁর মন, ছেলেটার হাসি দেখবার সুখ, মেয়েটার উচ্ছলতা দেখবার সুখ। ফজরের নামাজ পড়েই হাতে কোদাল তুলে নিয়েছে সে। জমি কুপিয়ে কুপিয়ে ক্ষেতের মাটি আলগা করছে, বাশের মুগুর দিয়ে বড় বড় মাটির দলা ভাঙছে।

শরীর থেকে ঘাম ঝরছে, সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তবুও থামতে পারছে না। সুখ! আহা সুখ! তাঁর সুখের রোগে পেয়ে বসেছে। অদ্ভুত এ রোগ! কোদালের প্রতিটা কোপে সুখ বেয়ে নামে শরীরে, মুগুরের প্রতিটি বাড়িতে সুখ খেলা করে শরীরে। হিল্লোল তোলে সুখ টুপটাপ ঝরে পড়া ঘামের তালে তালে। -আব্বা তুমার লাইগা খাওন আনছি।

এহনি খাইয়া লও। ক্ষেতের আলের পাশে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে চলে হাফসা। মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হাসে সোলেমান শেখ। -আইছস মা! খাড়া! আইতাছি। সে মেয়ের কাছে চলে এলে, হাফসা পানির জগ কাত করে ধরে।

ময়লা হাতদুটো ধুয়ে নেয় সে। এরপর নিজেই জগ হাতে নিয়ে মুখে, ঘাড়ে, গলায় পানির ছিটা দেয়। কোমরে গিট বাঁধা গামছাটা খুলে হাতমুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে, মারে! সেলিম কি চইলা গ্যাছেগা? হাফসা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। -নুতন জামা কাপড়ে ওরে ক্যামন দেহাইতেছিল রে? -ম্যাভাইরে ম্যালা সোন্দর লাগতাছিল। কথাটা বলে যেন খুব আনন্দ পায় হাফসা।

-কিরে! তর জামাডা পছন্দ হইছে তো? -হু, খুব ভালা হইছে। সোলেমান শেখ ভাতের থালা খুলতে খুলতে বলে, তুই খাইছস তো? -আমি তো খায়ায় তুমার লাইগা খাওন লইয়া আইলাম। -বুড়ি, তর মায় খাইছেনি রে? -মা পরে খাইবোনে। তুমি আগে খায়া লও। সোলেমান শেখ মৃদু হেসে ওঠে।

মেয়েটা তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সে জানে, তবুও বারে বারে নতুন করে জেনে নিতে ইচ্ছে করে তাঁর। সে ভাত মাখিয়ে মেয়ের মুখে তুলে দেয়, নিজে দুই এক লোকমা খায়। সুখ! আহা সুখ! সোলেমান শেখের সুখ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে, বাতাসে, ক্ষেতের আলের ধারে বসা দেবশিশুটির মাঝে। অদ্ভুত ক্ষমতা এ সুখের অসুখের।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।