আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ মরা ফুল

কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
মূল শহরের এক কোনায় এক গাদা ঘিঞ্জি বাড়ি ঘর তৈরি করা হয়েছে, টিন আর পলিথিন দিয়ে। এরা শহরের বহিরাগত। আগে এরা ছিল গ্রামবাসী, এখন এরা বস্তিবাসী। আগে যাদের ঘর ছিল মাটি আর খড়ের, এখন তাদের বাসা শুহুরে মাটি পলিথিনের।

এই বস্তির ধার ঘেঁষে রয়েছে একটা ছোট্ট বিলের মত। কচুরিপানা আর বস্তিবাসীর সবরকমের আবর্জনাতে ভর্তি। ওখানে বড় হচ্ছে একগাদা হাঁস। পাঁচটা বাচ্চা আর একটা মা হাঁস। এই হাঁস গুলোকে প্রায়ই দেখা যায়, বিলের পানিতে জলকেলি করতে।

বস্তিতে সদ্য গোঁফ গজানো কিছু ছেলের নজর সবসময়েই মা হাঁসটার দিকে থাকে। তারা প্ল্যান করে, একদিন ঠিকই এর মালিককে ফাঁকি দিয়ে হাঁসটা চুরি করবে। তাদের মনে ভাসে এসব। হাঁসগুলোর মালিক এক বিধবা মহিলা। মানুষের বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করে সে।

তার একটাই ছেলে। সেই ছেলে হাঁস গুলোকে চোখেচোখে রাখে সারাটা দিন। এই বিধবা মহিলা যে বাসায় কাজ করে, উনারা দেশের মাঝারি মানের শিল্পপতি। সেই ঘরের গৃহিনী এখন নতুন নতুন পার্টি করা শিখছেন। বাংলা মিডিয়াম থেকে একমাত্র ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়েছেন।

হাজব্যান্ড নতুন নতুন মদ খাওয়া শিখছেন। বন্ধুদের খাওয়াতে ফ্রিজেও রাখেন। মাঝে মাঝে তাদের বাসার এই বুয়ার দিকেও নজর যায় তার। একদিন ঠিকই সময় বুঝে এই বুয়াকে একদিন বুঝে নেবেন, প্রায়ই তার মনে ভাসে এসব। কিন্তু, বুয়াকে সবসময়েই চোখেচোখে রাখেন এই শিল্পপতির স্ত্রী।

কতবার বলে, এই কাপড়টা ঠিক কর। হাত এর উপরে উঠে কেন। আরও ভারি কাপড় পরবে। গরমে যখন ঘামিয়ে যাও, তখন ত সবই দেখা যায়। বুয়া মনে মনে ভাবে, নিজে একদিন কাজ করে না কেন এই মহিলা, ঘর মুছতে যেয়ে হাত উপরে উঠাতে না পারলে, রান্না করতে যেয়ে গরম না ঘামিয়ে ও কাজ করবে কীভাবে? পাতি বড়োলোকদের এসব মনে থাকে না।

গৃহিনী বয়স্ক এক বুড়ির খোঁজে আছেন। পেলেই এই বুয়াকে ছেড়ে দেবেন। মা হাঁসটা সারাদিন ওর বাচ্চাগুলোকে আগলে রাখে। সারাটা দিন। হাঁসটা বুঝে, যে ছোট্ট ছেলেটা ওদের সারাদিন পাহাড়া দেয়, সত্য বিপদে ও কোন কাজেই আসবে না।

আর ছেলেটার মনও বোধহয়, খেলতে যাওয়ার জন্য সারাদিন আঁইটাঁই করে। হাঁসের বাচ্চাগুলো খুব সুন্দর। সাদা ধবধবে। মায়ের কাছ থেকে খাবার নেয়। মায়ের বুকে মাথা ঘসে।

এখন বিল থেকেও খাওয়া শিখেছে। তবু, মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে মা আদর করে একটু খাবার দেয়। এই বাচ্চাগুলো নিয়ে বস্তির এক খুপড়িতে এই মা হাঁসের তাসের ঘর। মা হাঁসটা জানে, রাস্তার পাশের ছেলেগুলো শিকার করতে চায় ওকেই। তবু সে বাচ্চা গুলোকে আগলে রাখে।

মা তো। বুয়া আর তার এই ছোট্ট ছেলেটার খুপড়িতেই থাকে হাঁসগুলো। এদের অভাবী জীবন যুদ্ধের অবুঝ সাক্ষী এই কয়টা হাঁস। ছোট্ট ছেলেটাকে বুকে চেপে রাতে ঘুমায় তার মা। ছেলেটাকে স্কুলে দেবে দেবে করেও এখনও দেয়া হল না।

এবে সে সামনে বছরেই। ছেলেকে সে বড়লোকের ড্রাইভার বানানোর স্বপ্ন দেখে। ইংরেজি বলতে পারা, সালাম দেয়া, কালো জামা আর ক্যাপ পড়া ড্রাইভার, তা না হলে গোঁফওয়ালা পুলিশ। একসপ্তাহ হয়ে গেল, ছেলেটার পেট ব্যাথা। কালকে ভাল ভাবে খেয়াল করেছে, পেটটা যেন ফুলে গেছে একটু।

ওকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে একদিন। পাওনাদারদের কাছে প্রতি মাসে কিছু টাকা শোধ দেয় সে। তার স্বামির রেখে যাওয়া দেনা। এই মাসে আর পারবে না বোধহয়। স্বামীর চিকিৎসার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নেয়া হয়।

৩ বছরে প্রতি মাসে দেড় হাজার করে টাকা দিয়েও পোষাতে পারছেনা। তখন বিপদে পড়েই এত বেশি সুদে টাকা নিতে হয়। একবার ভেবেছিল পালিয়ে যাবে, কিন্তু মহাজনদের কাছে অনেক লোক। তারা সারা শহর খুঁজে আনবে। ছোট্ট ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আর সাহস পায়নি রাতে পালাবার।

ওর স্বামীর মৃত্যু হয় এক টিউমারের অপারেশনে। বলেছিল যে, অপারেশনের পর সবই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু, অপারেশনের ৩ দিন পরেও রোগী ব্যাথায় চিতকার করেছে। বুয়ার কাজ করা মহিলা এত কিছু বুঝে না। তখন সেও কেঁদেছ।

অনেক সাংবাদিক লোকজন এসেছিল। তারা কত কিছু বলেছে। স্বামীর নাকি ছোট অসুখ ছিল। ডাক্তার টাকা খেয়ে সবাইকে তাদের ওষুধের সাথে বাড়তি এক কোম্পানীর ওষধু দিয়েছে। এর রিএকশনে তার স্বামীর অপারেশন ব্যার্থ হয়।

এটা নিয়ে নাকি পেপারে অনেক লিখালিখি করেছেন উনারা। কিন্তু, লিখালিখি শেষে এই সদ্য বিধবার দিকে আর কেউ তাকায় নি। এক ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার গৃহিণীর। কয়েকদিন আগে একটু সমস্যা হচ্ছিল। স্বামীর নতুন স্ট্যাটাসের সাথে উনার চলতে কষ্ট হচ্ছিল।

তবে, এখন উনি মানিয়ে নিয়েছেন। এখন সুখে সংসার। ছেলেটাকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়েছেন গত বছর। আগে কথা না শুনলে মারা যেত, এখন যায় না। ছেলে বলে, “বস্তির ফকিরণীদের মত করছ কেন?” উনি চুপ হয়ে যান।

কিছু বলেন না। ছেলেকে পড়ানোর জন্য এক স্যার রাখা হয়েছ। কম বয়েসী ছেলে, কিছুটা গরীব। এই টিউশানিটা দিয়ে মেসের ভাড়া দেয় সে। ভার্সিটিতে পড়ে।

প্রতিদিন আসে। স্কুল থেকে এসেই আবার কোচিং। এর মাঝে চার ঘণ্টা বিরতি। এক ঘণ্টা যাতায়তে খরচ হয়। বাকি তিনঘণ্টার শেষ দেড় ঘন্টা এই স্যার পড়ায়।

ছেলে এরপর কোচিং এ যায়। স্যরের পড়ানো শেষ। ইদানীং, ছেলেটা চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ স্যার থাকে। গৃহিণীকে সময় দেয়। ফ্রিজে রাখা নতুন মদের বোতল একটু চাখে।

দু জনেই। রুমের জানালাগুলো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয় সে। এরপরে বেলা তিনটা পর্যন্ত উন্মত্ততা। তিনদিন পরে ডাক্তারের রিপোর্ট আসে। বুয়ার ছেলের।

টিউমার। একমাসের মাঝে অপারেশন না করলে মারা যাবে। এবার বড় ডাক্তারের কাছে নেয়া হবে ওকে। অপারেশন করানো হবে। বিধবা মায়ের এক ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলা হবে।

টানা বিশটা দিন মায়ের কান্না আর দুঃখের ঘোরের বর্ণনা দেয়ার ভাষা খুব বেশি নেই। ছেলের খাওয়া এখন বন্ধ। মা টাকা যোগাড় করতে না পেরে মাঝারি শিল্পপতির হাতে নিজেকে ধরা দেয়। তার নিস্তেজ শরীরের উপর শিল্পপতি লালা গড়িয়ে পরে। তার গলায় শিল্পপতির লোলুপ কামড় বসে।

তার বুকে কিছু নখের ক্ষতচিনহ যোগ হয়। বাকি ঘটনা সংক্ষিপ্ত। তার পোড়া কপাল আরও একটু কালো হয়। পঁচিশ হাজার টাকার দেখানো লোভার বিনিময়ে শিল্পপ্তির কাছে থেকে পাঁচ হাজার টাকা পায়। আরও আর্জির ফলস্বরূপ তাকে সেই বাসা থেকে ছুটিয়ে দেয়া হয়।

তার ছোট্ট ছেলেটা মারা যাবার পরে মহিলা আত্মহত্যা করে। তা লাশ বিলের একদম মাঝখান থেকে উদ্ধার করা হয়। বস্তির সদ্য গোঁফ গজানো কিছু ছেলে মা হাঁসটাকে জবাই করে। বাচ্চাগুলোকে এক হাঁসওয়ালার কাছে বিক্রী করে দেয় ওরা। মা হাঁসের আদরের বাচ্চাগুলো এখন হাঁসওয়ালার হাতে উলটো হয়ে ঝোলে আর জবাই হবার অপেক্ষায় থাকে।

“মাম্মি, ওই দেখ হাঁসের বাচ্চা বেঁচতেছে। মাম্মি স্যুপ খাব, মাম্মি প্লিজ। ”, ছেলের আবদার হাসি মুখেই মেনে নেন গৃহিনী। চারটা হাঁসের বাচ্চা কেনেন। হাঁসওয়ালা বলে আরও একটা নিতে বলে।

এই পাঁচটা নাকি একসাথেই এসেছিল। গৃহিণী হাসিমুখে আরো একটা নেন। সেই স্যুপ খেয়ে সবাই প্রশংসা করেছিল খুব। ছেলে, ছেলের স্যার আর ছেলের খালা বেড়াতে এসেছিলেন উনিও। শুধু মাঝারি শিল্পপতির কাছে কেমন যেন বিস্বাদ লাগে।

© আকাশ_পাগলা আরও কিছু চেষ্টা Click This Link Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।