একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন, অসাম্প্রদায়ীক ও ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি শোষকের দলের অট্টহাসিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় মানুষগুলোর। মন্ত্রমুগ্ধ উম্মতের মত সবাই এগিয়ে যায় হাসির শব্দ অনুসরণ করে। আসলে মানুষগুলোর কখনোই ঘুম ভাঙ্গে না, এরা জেগে থেকেও ঘুমায়। পুরো জনপদের মানুষগুলোই "স্লিপ ওয়াকার", ঘুমের মধ্যে হাটে। সমস্যাটা হচ্ছে, স্লিপ ওয়াকাররা ওদের সাইকেল শেষ হলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
কিন্তু এই মানুষগুলো অনেকদিন ধরে ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে, ঘুমিয়ে থাকাটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিল। এরা খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিল। সাত চড়েও রা করত না। হাজার অন্যায়ও গা করত না। চুপচাপ দেখে যেত সবকিছু।
শুধুই দেখে যেত দূর থেকে। যেন কিছুই করার নেই, কিছুই হয়নি এমন ভাব-লেশহীন দৃষ্টিতে শুধু দেখেই যেত।
মানুষগুলো ছিল খুব সহজ সরল। বছরের পর বছর গোলামী করে এরা ধরেই নিয়েছিল গোলামীটাই নিয়তি, উঠতে বসতে শাসকদের কুর্নিশ করাটাই বুঝি নিয়ম। এর বাইরে, এর বিপরীতে কিছু করাটা বোধহয় পাপ।
কেউ ভাবতও না এর বাইরে যে কিছু করা যায়, বলা যায়, ভাবা যায়। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। অট্টহাসিদাতারা সুখে শান্তিতেই চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের অট্টহাসি, হুঙ্কার আর শোষন। আর মানুষগুলোও ঠিক প্রতিবারের মত একইভাবে ঘুম ভেঙ্গে অনুসরণ করছিল সেই হাসি, স্বীকার হচ্ছিল নিয়মিত শোষনের। শোষকের দল সবসময় রাতেই ডাকত।
রাত ওদের প্রিয় ছিল। ওরা অন্ধকারে মানুষকে ভাল বশ করতে পারে। ওরা আসলে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিত। ওরা মানুষকে অন্ধকারে রেখে বোঝাত অন্ধকারটাই বাস্তবতা। আলো বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই।
অজ্ঞ মানুষ আবার মেনেও নিত ওদের কথা। ওরা কত জ্ঞানী, অবশ্যই ওরা যা বলে তাই সঠিক, তাই সংবিধান।
মানুষগুলো সব সময় এরকম ছিল না। বার বার তারা গর্জে উঠেছিল শোষনের বিরুদ্ধে। রক্তও দিয়েছিল প্রচুর।
বিনিময়ে কিছুই যে পায়নি তা না। তবে সেটা নিজেদের ঘরে না উঠে চলে গেছে নব্য শোষকদের ঘরে। তারা ভুলে গিয়েছিল কোনকিছুর শেষ না দেখে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে গেলে তা আবার ফিরে এসে ঘাড়ে চড়ে বসে। এরা জানত কিভাবে জাগতে হয়, কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। এদের একটা স্বপ্ন ছিল।
কিন্তু কালের বিবর্তনে মহাকাল তাদের সেই বিপ্লবী সত্ত্বাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। যারা নিয়তির উপর নিজেদের ভাগ্যকে ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তাদের কোনকালেই কিছু হয়নি এই সত্যটা তারা ভুলে বসেছিল। ফলাফল ঘোরনিদ্রা। শোষকের অবিরাম শোষন, কোন প্রতিবাদ নেই, কোন গর্জন নেই, এমনকি কোন সাড়া-শব্দও নেই। ভাবটা এমন, যাই হোক তাতে আমার কি? আমি কেন প্রতিবাদ করতে যাব? আমার কি লাভ?
ওরা ভুলে গিয়েছিল ওদের অতীত ইতিহাস।
যে ইতিহাস ছিল গৌরবের, যে ইতিহাস ছিল সম্মানের। সেই ইতিহাস ভুলে গিয়ে ওরা নিজেদের সঁপে দিয়েছিল ইতিহাসের কালো চরিত্রগুলোর কাছে। উম্মত হয়েছিল ভূল নবীর, যে কিনা ঈশ্বরকে সরিয়ে নিজেই নিয়েছিল ঈশ্বরের স্থান। ইতিহাসের ভুলে যাওয়ার খেসারত তাদের দিতে হয়েছিল অনেকদিন। ঈশ্বররুপী ইতিহাস তাদের ক্ষমা তো করেইনি, বরং নয়া ঈশ্বরের আর তার উম্মত হয়ে যাওয়া জনপদের মানুষগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছিল সবকিছু।
ক্রমশ অন্ধকারে ডুবতে থাকা এই জনপদের বিপরীত চিন্তার যে কেউ ছিল না, তা না। ছিল, কিন্তু তারা সংখ্যায় এত কম ছিল যে তাদের কথা কেউ শুনত না, উল্টো তাদের পাগল ঠাওরাত। ভাবত যত্তসব পাগলের দল!!!ওরা কত শক্তিশালী, ওদের সাথে কি কেউ পারে? আবার কেউ কেউ যে ওদের কথা শুনত না তাও না। কেউ কেউ শুনত, তবে ওইশোনা পর্যন্তই। কখনো পাগল হবার সাহস করত না।
মানুষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ অনুকরণ করত শোষক দলের অট্টহাসির, নিয়মিত অনুশীলন চলত ওদের মত হবার। কেউ কেউ হয়ত পারত ওদের মত হাসতে। হয়তো কেউ কেউ ওদের দলে ঢুকেও পড়ত। কতটুকু নিজের যোগ্যতায় আর কতটুকু শোষকদের ইচ্ছায় তা জানা কিংবা বোঝা যেত না। তবে এই ব্যতিক্রমগুলো প্রায় চোখে পড়ত।
এটাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে অনেকেই চেষ্টা করত শোষক হবার। নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হত তারা।
শোষকদের দু’টো দল ছিল। জনপদের মানুষগুলোকেও তারা ভাগাভাগি করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। নির্দিষ্ট সময় পর পর এরা আসত শোষন করত।
কিন্তু এমন ভাব ধরত যেন ওরাই ওইসব অবলাদের রক্ষাকর্তা। ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো বিশ্বাসও করত ওদের কথা। ওরাই প্রবল উৎসাহের সাথে পাঠাত শাসন করতে। বোকাবাক্স নামক যন্ত্রটার ক্রমাগত প্রচারে ধন্ধে পড়ে যাওয়া মানুষগুলো নিজেদের খুব চালাক ভাবত। তারা এক দলের বদলে আরেকদলকে শোষন করার ক্ষমতা দিত।
ভাবত, নাহ এবার বোধহয় অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু ক্যান্সারের জীবানু দিয়ে কি আর ক্যান্সার ভালো হয়। ক্যান্সার সারাতে হলে ক্যান্সারের উৎসেই আঘাত হানতে হয়। বোকাবাক্সের কাছে বোকা বনে যাওয়া মানুষগুলো অবাক বিস্ময়ে দেখতে সমাজে ক্যান্সারের ক্রমাগত বিষাক্ত আগ্রাসন। কিছুই করার ছিল না তাদের।
আসলেই কি কিছু করার ছিল না?
কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়, তাই এই জনপদের অন্ধকারও চিরস্থায়ী থাকে না। এই জনপদে আবার জ্বলে বিপ্লবের আগুন। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। সেই আগুন লাগে ফসলের মাঠে, কারখানায়, শিক্ষা বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে। কারোই যেন কিছু আসে যায় না।
সবাই বেড়িয়ে আসে দলে দলে। আগুন ধরায় কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়ে থাকা শীতাতপ বিপনী বিতানগুলোতে। সকল সংস্কার কেন্দ্রে। যেখান থেকে নিয়মিত ফতোয়া আসত শোষকদের দালালী করে। এতদিন ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো যে হঠাৎ করেই জেগে উঠেছিল।
মেতে উঠেছিল ধ্বংসের হোলি খেলায়। সেই ধ্বংসের গানে রক্তাক্ত হচ্ছিল জনপদের পথঘাট। লাশের লাশের পর লাশ পড়ছিল , স্তুপ জমছিল লাশের। ব্যারাক থেকে ব্যারাকে সৈন্যরা বেড়িয়ে পড়েছিল শোষকদের বাঁচাতে। গুলি চালিয়েছিল হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠা জনস্রোতের দিকে।
ট্যাঙ্ক-যুদ্ধবিমান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল মানুষগুলোর উপর। কিন্তু তাদেরও একসময় ঘুম ভাঙ্গে। তারাও গিয়ে যোগ দেয় ঘুম ভাঙ্গা মানুষগুলোর সাথে।
জঙ্গী মানুষগুলো হামলে পড়ে আইন তৈরীর কারখানায়। যেখান থেকে নিয়মিত শাসনের ফতোয়া ছুড়ত শোষকের দল।
আর সেই ফতোয়া শিরোধার্য ধরে নিত বোকা মানুষগুলো। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না এর সম্মান। সম্মান বেশি থাকাতেই হয়তো আরো বেশি আক্রোশে ঝাপিয়ে পড়ে মানুষগুলো এই ভবনটার উপরে। শোষকের দল পাশের লেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বাঁচাতে চায়। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস যে লেকে মানুষের আনা-গোনা নিষিদ্ধ হয়েছিল অনেক বছর আগে, সেই লেকে সেই মানুষগুলো ঝাপিয়ে পরে হত্যা করে এতদিনের প্রভুদের।
রক্তাক্ত হয় লেকের স্বচ্ছ পানি।
বোকাবাক্স আর খবর বলার কাগজগুলো সব ভোল পাল্টে যোগ দেয় জনগনের দলে। কিন্তু জনগন এবার আর ভুল করে না। ওরা সেই বোকাবাক্সের কারখানাগুলোও জ্বালিয়ে দেয়। আর তাতে নে্তৃত্ব দেয় সেই সব বোকাবাক্স আর যারা এতদিন মালিকের চাহিদা অনুযায়ী খবর বলার কাগজগুলোতে গল্পের যোগান দিত সেই সব শ্রমিকরা।
মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সব কিছু যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা এর আগে আরো একবার হয়েছিল এই জনপদে। প্রেমের সাথে ইতিহাস মিলে যায়, বারুদের গন্ধের সাথে মিলে যায় ফুলের সুবাস। মিছিল আর লাশের স্তুপ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ধ্বংসের সাথে সাথে চলে আসে সৃষ্টির স্বপ্ন।
মানুষগুলো জানে এই ধ্বংস শেষ ধ্বংস।
মানুষগুলো যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখত কেউ একজন আসবেন তাদের মুক্তি দিতে। যার ডাকে তারা দলে দলে বেড়িয়ে আসবে। চূর্ণ করবে সকল শোষকের প্রাসাদ। তারা অপেক্ষায় থাকত, অপেক্ষায় থাকত সেই মহানায়কের।
সেই মহানায়ক আর আসে না। মহানায়কের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মানুষগুলোর হাড্ডি আর চামড়া এক হয়ে যায়। চোখগুলো সব বেড়িয়ে আসতে চায় শোষকের নিস্পেশনে। তবু তারা শব্দ করে না। তারা অপেক্ষা করে যায়।
হঠাৎ একদিন এক ছোট্ট বালক সবাইকে ডেকে বলল, “ওঠ আর কত ঘুমাবে, যে মহানায়কের আশায় বসে আছো তাকে এখনো চিনলে না???!!! ঘুমিয়ে থাকলে চিনবে কিভাবে???”
সবাই ধরফরিয়ে ওঠে। ভাবতে বসে বালকের কথা। একটা সময় তারা পায় সেই মহানায়কের সন্ধান। যার যার স্বীয় সত্ত্বার মাঝে, সামষ্টিক ইতিহাসের মাঝে পায় তারা মুক্তির পথের সন্ধান। তারপরই সবাই ভয় ফেলে বেড়িয়ে পড়ে মুক্তির পথে।
কৃ্ষক হাতে কাস্তে নিয়ে আর শ্রমিক আসে তার হাতুরী নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রাজনীতিবিমুখ ছাত্ররা বেড়িয়ে আসে বই খাতা ফেলে। হাতে তাদের বারুদের গন্ধ। ল্যবরেটরী থেকে উপকরণ লুট করে বানানো বোমা হাতে তারা বেড়িয়ে পড়ে। সবার যে মুক্তি দরকার।
যে সব পাগলদের তারা পাগল ভাবত তাদের দেখে আগেই বেড়িয়ে পড়েছে। ওই পাগলদের নেতৃত্বেই শুরু হয় সামষ্টিক পাগলামী। এক সাধারণ বালক কিংবা এই সকল পাগলদের কাছে এই জনপদের মানুষগুলো কৃ্তজ্ঞ থাকবে কিনা তা এদের কেউই ভেবে দেখেনি। যে মুক্তির স্বপ্ন এরা এতদিন ধরে দেখে এসেছে, তা সত্যি হতে যাচ্ছে দেখে এরা প্রবল উৎসাহে সব সংস্কার, শোষনের সব হাতিয়ার সব প্রতিষ্ঠান ভাংতে থাকে। এদের সবার চোখে-মুখেই তখন নতুন সমাজ, নতুন দিনের স্বপ্ন।
আর সেই স্বপ্নে জনপদের প্রায় সকল মানুষ আক্রান্ত। (শোষক, বিদেশী শোষক আর শোষকের হাতে গোনা কিছু তাবেদার ছাড়া সবাই)
এই ধ্বংসের অনেকদিন পরের কথা। কোন এক নদীর ধারে সবুজ মাঠে বসে এক দাদু তার নাতি-নাতনীদেরকে গল্প শোনাচ্ছেন। এক ঘুমন্ত জনপদের গল্প, যারা ঘুমিয়েছিল মাদকাসক্তের মত। যে জনপদের ঘুম ভাঙ্গিয়েছিল এক বালক, সেই জনপদকে দিয়েছিল তাদের মহানায়কের সন্ধান।
----------------------------------------------------------------------------------
জুই বিপ্লবের নায়ক তিউনিশিয়ার যুবক বুয়োজিজি, ব্যাক্তির মৃত্যু যদি কোনো জনপদের মুক্তি আনে শোষনের অবসান ঘটায় তার চেয়ে আনন্দের মৃত্যু কোথাও কি আছে?
----------------------------------------------------------------------------------
গল্পটা তো পড়লেন এবার আসুন ব্যান্ড দল লীলার নায়ক গানটা শুনি। আশা করি ভালো লাগবে।
পোস্টার আপডেটঃ
পোস্টার ক্রেডিট সহব্লগার সবাক ভাই ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।