আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ "আমি"র কথা

জীবন থেকেই নেই, জীবন নিয়েই লিখি :)

আমার মা বাসার একমাত্র সেলাই মেশিনটা ঘুরাচ্ছেন। আমার ছোট বোনটার জন্য একটা জামা বানাবেন। কাপড় কাটা শেষ। এবার সেলাইয়ের পালা। আমি কেবল মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।

কোন রকম চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম মা বিছানায় পায়ের কাছে বসে আছেন। গত কয়েকদিন থেকে আমার ভীষন জ্বর। নিয়ম করে জ্বর আসে নিয়ম করে যায়। জ্বর আসলে ঘুমাতে পারি না। মনে হয় সমস্ত পৃথিবী আমার চোখ চিড়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।

তাকিয়ে থাকতে হয়। সামান্য চোখ বন্ধ করলেও থাকা যায় না। রাতে যখন জ্বর ওঠে তখন ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মনে হয় সমস্ত পৃথিবী আমার মাথার ভেতরে প্রবেশ করছে। আর তখনি আমি বমি করতে শুরু করি।

একসাথে বমি হয় না। প্রথম দিকে একটু একটু করে তারপর হঠাৎ শুরু হয় বমি। নাক মুখ দিয়ে বমি ওঠে। পেটে কিছু না থাকলে কষ্ট অনেক বেশী হয়। বমি করতে করতেই আমি বেহুঁশ হয়ে যাই।

কাল রাতে আমি এভাবে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম। এইমাত্র আমার ঘুম ভাঙলো। আমার মা আমার দিকে তাকালেন না। গুন গুন করে গান গাইছেন আর সেলাই মেশিন ঘুরাচ্ছেন। "আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাইগো আমারো পরানো যাহা চায়......." আমি মার মায়াভরা কন্ঠে গান শুনে যাচ্ছি।

মা এত সুন্দর করে গান গাইতে পারে ভেবে অবাক লাগছে। মা প্রায় সময়ই এভাবে গান করেন গুন গুন করে। ভালো লাগে শুনতে। আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। মাকে আর ডাক দিলাম না।

গান শুনতে শুনতে আমার চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় আলো এসে পড়েছে ;পৃথিবীতে সে আলোয় বসে কেউ বীনা বাজিয়ে ইচ্ছে করে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। আমার চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে। মা কে আমি আর দেখতে পাচ্ছি না। গভীর ঘুমে আমি তলিয়ে যাচ্ছি।

গভীর ঘুমে। ধীরে ধীরে। এরপর আমার কিছু মনে নেই। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে সম্ভবত পরের দিন। সকালের সূর্যের আলো জানালা দিয়ে চোখে এসে পড়লো।

আমি হাত দিয়ে চোখ ঢাকার চেষ্টা করছিলাম। এরপর চোখ পরিস্কার করতে করতে নাস্তা খেতে চলে গেলাম। দেখি খুব রাগ করে আছে মা। "সারাদিন খালি কাজ কাজ আর কাজ। এত ব্যস্ত হলে আমাকে কেন বিয়ে করল।

এই যে আজকেও সে আসতে পারল না। অপারেশন ছিল অপারেশন!!। সারারাত অপারেশন করা লাগে??? এত টাকার কি দরকার??? কতবার বলেছি আমাদের এত টাকার দরকার নেই তা না তার টাকা লাগবে!! কবে নিজের কি হয় কে জানে!!!!" বাবার উপর মা'র মেজাজ গরম। গতকাল প্রক্টিসে গিয়েছেন বিকেলে রাতে ফেরেননি। সে আর তার দুই বন্ধু মিলে অপারেশন করবে নাকি।

তাই আসতে পারেননি। আমার বাবা একজন চক্ষু সার্জন। এমনিতেই ডাক্তারদের লাইফ বলে কিছু থাকে না। তারউপর সার্জনদের আরো খারাপ অবস্থা। বাবার অবস্থা আরো ভয়াবহ।

গ্রামে অনেক ভাইবোনের পরিবার। একমাত্র তিনিই উঠে এসেছেন পরিবার থেকে। তাই সারাদিনই তাকে এই নিয়েই থাকতে হয়। এই কারনেই এমবিবিএস পাশ করে আর কোন ডিগ্রী নেওয়ার সুযোগ পাননি তিনি। চেম্বারে বসেছেন।

টাকার পর টাকা পাঠিয়েছেন বাড়িতে। নিজের শরীর যে ভেঙে পড়েছে সেদিকেও খেয়াল নেই। মা'র মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল যার প্রভাব পড়ল আমার ৪ বছরের ছোট বোনটার উপর। কাঁদতে কাঁদতে সে আমার রুমে আসছে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে।

আহারে। এত ছোট মানুষটার সাথে এরকম কেন করল মা? আহারে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মা'র সাথে রাগারাগি করলাম। যার রাগ তার সাথে মিটাও আমাদের সাথে কি!!! তারপর ছোটবোন টাকে নিয়ে ঘুরলাম।

রাগের মাথায় মা যে কি করে ঠিক নাই। আমার এই বোনটা এত্ত কিউট এত্ত কিউট যে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সে মেয়েরে এভাবে কেউ মারে। মনটা খারাপ লাগছে। স্কুলে গেলাম না।

বিকেলে মা আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদের ঘুরতে নিয়ে গেলেন। আইসক্রিম খাওয়ালেন। রাতে বাবা এলেন। আমরা টিভির রুমে টিভি দেখছিলাম। বাবা এসে সরাসরি মা'র সামনে দাঁড়িয়ে একটা গিফট বের করে বলে "হ্যাপি ম্যারেজ ডে"!!! মা'র চেহারা দেখার মত ছিল।

মা মনে হয় জীবনে এত বড় ধাক্কা খায় নি। আমি অবাক হওয়ার ভান করে উঠলাম,"আজকে তোমাদের ম্যারেজ ডে জানতামই না"!! বাবাকে যেমন বলেছি সে তেমনি করেছে। একটা কেক ও এনেছে। অসাধারণ একটা মুহুর্ত। মা'র মন ভাল হয়ে গেল।

সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। ভাল লাগছে খুব। রাতে ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর খুব তাড়াতাড়িই যেন ঘুম ভাঙলো। মা আমার হাত ধরে ডাকছেন "ওঠ জলদি।

তোর বাবার কি যেন হয়েছে। ওঠ ওঠ। " আমি খুব দ্রুত উঠলাম। দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। মনে হচ্ছিল যেন শ্বাস নিতে পারছেন না।

তারপর অনেক দৌড়াদৌড়ি ,হাসপাতাল,কান্নাকাটি।   সেবার বাবা বেচে গিয়েছিলেন হার্টে ব্লক নিয়ে। আল্লাহই বাঁচিয়েছেন। মা সারাদিন কাঁদতেন বাবার জন্য। বাবার জন্য মায়ের মনে এত প্রেম এত ভালবাসা আমি কখনই দেখি নাই।

কি হল বুঝলাম না রাতে ঘুম ভাঙলো । দেখি সি এন জিতে আমি। পাশে আমার টুনটুনি বসা। এক বছরের বন্ধু জীবনে এই ১ম আমাদের একসাথে কোথাও যাওয়া। - কি হয়েছে? -মাথাটা ঘুরাচ্ছিল সামান্য।

সমস্যা নেই। আমরা জিয়া উদ্যানে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে সি এন জি সিগন্যাল এ দাঁড়াল। এমন সময় ছোট একটা মেয়ে অনেক গুলো গোলাপ নিয়ে এল। -স্যার মাত্র ১০টাকা।

লইয়া যান। আমার কি মনে হল আমি ৪ টা বড় বড় গোলাপ কিনে নিলাম ১০ টাকায়। সিএনজি চলা শুরু করল। আমি আমার টুনটুনি কে গোলাপ ৪ টা দিলাম এভাবেঃ ১ম গোলাপ দিয়ে বললাম "আমি" ২য় গোলাপ দিয়েঃ "তোমাকে" ৩য় গোলাপ দিয়েঃ "ভালো" ৪র্থ গোলাপ দিয়েঃ "বাসি" টুনটুনির মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আমার হাত কাঁপছিল।

তারপরও আমি শক্ত হয়েছিলাম। মাথা নিচু করে টুনটুনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "Do you really love me???" আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি, "হ্যা আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কি আমাকে ভালবাস???" ও কোন কথা না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ও। আমাকে কি ও ভালবাসে না?? তবে জড়িয়ে ধরল ক্যান? উত্তরটা অবশ্য অনেক পরে পাই।

কিন্তু সেদিন এই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সিএনজি জিয়া উদ্যানে পৌছল আর আমরা বন্ধুত্ব থেকে নতুন এক জীবনে পা রাখি। সেদিন সারাদিন ওর সাথে ঘুরি,সন্ধ্যায় ধানমন্ডি আড়ং এর পাশের ফুচকা খাই। অসাধারণ। এরপর ওকে বাসায় পৌছে দেই। রাতে আমরা অনেক কথা বলি।

আমাদের ভবিষ্যৎ নানা পরিকল্পনা, বাড়ির নাম,বাবুর নাম,ছেলে হবে না মেয়ে এসব আলাপ করি। একটসময় ফোনে ও আমাকে ১ম বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। যে কথা শোনার জন্য আমার হৃদয়টা আকুতি জানাচ্ছিল সেই কথা শুনলাম। মনটা ভরে উঠল। হয়ত ফোনে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গেলাম।

গভীর রাতে ঘুম ভাঙলো। আমি আবছা আবছা করে দেখছি আমার পাশে একটা মেয়ে বসে কাঁদছে। আমি দেখার চেষ্টা করলাম কে এটা। না টুনটুনি না। কানে এলো কারা যেন বলছে "সেন্স ফিরেছে!! সেন্স ফিরেছে!!" কিছু বুঝলাম না।

আমি আবার ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো মোবাইলের শব্দে। একটা মেসেজ আসলো। টুনটুনি দিয়েছে। "তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই।

আমি তোমাকে কখনই ভালবাসি নাই। ১ম দিনও তোমাকে বলিনি ভালোবাসি। আই থিংক ইউ নো দ্যাট। এই কথা তোমাকে বহুবার বলেছি যেতোমার প্রতি আমার কোন ফিলিংস নেই। দ্যাট ওয়াজ অ্যান এক্সিডেন্ট!! তোমার কোন পার্সোনালিটি নাই।

আই হেট ইউ। ইউ আর অ্যা কাওয়ার্ড। " আরো অনেক কিছু ছিল। ইচ্ছা করে নাই পড়তে। ভালো না বাসলে কেনই বা ঝুলিয়ে রাখলে।

এত সহানুভূতির কি দরকার ছিল? আমি ওই মেসেজের রিপ্লাই দেই নাই। শুধু ও আমাকে এ যাবৎ যত কথা বলে কষ্ট দিয়েছে সব একটার পর একটা মনে পড়ছে। "তুমি একটা মিন মাইন্ডেড। " "তুমি আগলি। ইম্যাচিওর" "তুমি ছোটলোক একটা" নাহ এগুলো না।

তবে আরেকটা দিনের কথা মনে পড়ল তখন। এক বৃষ্টির দিনে আমি আর টুনটুনি সারাদিন রিক্সায় ঘুরলাম। খাওয়াদাওয়া পিকনিক করলাম। শেষে আমরা ফিরছিলাম। কথায় কথায় বলে উঠল, "ইউ ডোন্ট নো হাউ টু লাভ" আমি এই কথার অর্থ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়েছিলান।

তবুও খুজে পাইনি এর অর্থ কি। আমি ওকে অনেক অনেক ভালবাসি!! কিসব চিন্তা মাথায় আসছে। ওহ!!! মাথা ঘুরাচ্ছে। বারান্দায় যাই। প্রচন্ড মাথা ঘুরায়।

আমি বমি করে বেহুশ হয়ে পড়লাম। এরপর জ্বর ওঠে। সেই ছোটবেলার মত। নিয়ম করে জ্বর আসে নিয়ম করে যায়। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সমস্ত পৃথিবী চোখ চিড়ে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।

আমি সাথে সাথেই বমি করি। কানের কাছে শব্দ শুনি, "ভমিটিং!! ভমিটিং!! স্যার স্যার!!! চোখ খুলে সামান্য দেখার চেষ্টা করি। পাশে বসা মেয়েটা জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। ও আমার বোন মিলি। বোকা নাকি??? "এই মেয়ে তুমি বিয়ের শাড়ি পড়ে আছ ক্যান????" মিলি কিছু বলল না।

শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। আশেপাশে অনেক মানুষজন। কিছু মুখ চেনা,কিছু অচেনা। সমস্ত পৃথিবী যেন আমার বুকের উপর চেপে ধরা হচ্ছিল। এর কয়েকদিন পর আমার মৃত্যু হয়।

কনেপক্ষ হয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় এক দুর্ঘটনা সব কিছু ওলট পালট করে দেয়। মা বাবা স্পটেই প্রান হারান। আমি কোন রকমে বেচে ছিলাম এই কয়দিন আই সি ইউর চার দেওয়ালে আবদ্ধ হয়ে। আমার বোনটা আমার পাশেই ছিল সারাটা সময়। আমার মায়ের মত।

বোকা মেয়ে। শুধু কেঁদেই  যাচ্ছিল সেই ছোটবেলার মত। এত বড় মেয়েকে সান্ত্বনা দেই কেমনে? মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তে আমার মাকে দেখতে পাই যেন। পায়ের কাছে বসে সেলাই মেশিন ঘুরাচ্ছেন। সাদা একটা কাপড় হাতে নিয়ে সেলাই করছেন আর সেই ছোটবেলার মত গুন গুন করে গান গাইছেনঃ "আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাইগো আমারো পরানো যাহা চায়।

তুমি ছাড়া আর এই জগতে মোর কেহ নাই কিছু নাইগো, আমারো পরানো যাহা চায়..........."

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।