টেবিল থেকে কাগজপত্র সব গুছিয়ে ড্রয়ারে তালা মারলেন আলম সাহেব। দীর্ঘ দিনের অভ্যাসমত ঘড়ির দিকে তাকালেন, আটটা বাজে, অফিসের আর সবাই বের হয়ে গেছে। সবসময় তিনিই অফিস থেকে বের হওয়া শেষ মানুষ। অবশ্য এটা নিয়ে এখন আর তার তেমন কোন অভিযোগ নেই। সংসারে কেউ কেউ থাকে, বুদ্ধিমানের মত যারা অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়া শেখেনা।
আলম সাহেবও ঐ বোকা গোত্রের মানুষের মধ্যে পড়েন। কোন ঝামেলার ক্লান্তিকর কাজ যদি আর কেউ করতে রাজী না হয়,তাহলে সেটার জন্য অবধারিতভাবে আলম সাহেব আছেন, কি সেটা অফিসে হোক, অথবা পরিবারের মধ্যে।
ছাত্রজীবনে যে খুব ভাল ছাত্র ছিলেন আলম সাহেব সেরকম না। তবে পড়াশোনা নিয়ে থাকতে তার খুব ভালো লাগতো,আশেপাশে যারা পড়ালেখা শিখে অনেক বড় মানুষ হল তাদেরকে মনের মধ্যে বেশ শ্রদ্ধাই করে এসেছেন। পরিবারে আলম সাহেব ছিলেন ভাইদের মধ্যে ছোট।
তিনি যখন আইএ পাস করলেন, তার কিছুদিন পরেই বাবা স্ট্রোক করলেন, পক্ষাগাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী । আলম সাহেবের ইচ্ছে ছিল অন্তত বিএ পাস করবেন। কিন্তু সেটা আর হল না! বাবা বিছানায় পড়লেন, বড় দুই ভাই যার যার নিজের মত গুছিয়ে নিলেন। ততদিনে নিজেদের সংসার হয়ে গেছে তাদের, বাবা মা ছোট ভাইবোনের দিকে তাদের আর তাকানোর অবসর ছিল না।
আইএ পাস করে তিনি সরকারী একটা ব্যাংকে কেরানির পদে চাকুরি পেয়ে গেলেন, বিছানায় পড়ে থাকা বাবা, অবিবাহিত ছোট বোন, সবার দিকে তাকিয়ে এমএ পাস করার ইচ্ছা অলক্ষ্যে গিলে ফেলে আলম সাহেব শুরু করে দিলেন মানুষের টাকা গোনা।
তারপর কত জল বয়ে গেল, কত নদী শুকিয়ে গেল, কত কুল ভেসে গেল সময়ের প্লাবনে, আলম সাহেব আজ পঁয়ত্রিশ বছর পরে অফিসার হয়ে গেছেন, গঙ্গানন্দপুর ব্রাঞ্চের আজ তিনি সেকেন্ড অফিসার। ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছেন, নিজে বিয়ে করে ছেলেমেয়ে বড় করেছেন। নিজের যে কোন শখ আহ্লাদ বলে কোন বস্তু আছে ছিল, সবই গেছে বিস্মৃতির আড়ালে।
তবে এই জোয়াল টানার ক্লান্তিহীন ধারাবাহিকতায় একটা জিনিস হয়েছে বটে, আলম সাহেব তার ক্ষুদ্র পরিমন্ডলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবেই বিবেচিত হন। যেমন তিনি যদি অফিসে না আসেন বা অসুস্থ থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে বেশ কিছু কাজ হবেনা, বেশ কিছু মানুষ ফিরে যাবে, বেশ কিছু ফাইল পড়ে থাকবে অনড়।
আর পরিবার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও তার একই অবস্থান। ভাগ্নীর বিয়ে, গহনা কেনার টাকা আলম সাহেব দেবেন। বড় ভাইয়ের ছেলের প্রাইমারী মাস্টারের চাকুরীর জন্য টাকা লাগবে, আলমের কাছে গিয়ে ধর্না দাও। বড় চাচার মেয়ে অসুস্থ, শহরে নিতে হবে চিকিৎসার জন্য, টাকা নাই, জানাবোঝা লোক নাই। তো গিয়ে কেঁদে পড় আলম সাহেবের কাছে, যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা হবে বটে।
অফিস থেকে বের হয়ে রোজকার মত মতিনের চা এর দোকানে এসে বসলেন। মতিনকে কিছু বলতে হয়না, সে আলম সাহেবের চাহিদা জানে। মতিন একটা চা আর সিগারেট বাড়িয়ে দিল। বদভ্যাস বলেন আর টিকে থাকা কোন শখ বলেন, এই একটাই বিলাসিতা আছে আলম সাহেবের। অফিসের সব কাজ শেষ করে তিনি খুব আয়েস করে বসে এক কাপ চা এর সাথে একটা সিগারেট খান।
কোন কোন দিন চুপচাপ বসে থাকেন, এটাসেটা অর্থহীন নানা কিছু ভাবেন, আবার কোনদিন মতিনের সাথে গল্প জুড়ে দেন।
তবে আজ আলম সাহেবের বেশ তাড়া আছে, তার মেয়ে তিনবছরের নাতনী সহ বাড়ী এসেছে আজ। নাতনীকে দেখার জন্য, ওর ছোট্ট মুখটা বুকে চেপে ধরার জন্য তার বুড়ো বুকটা আকুপাকু করছে! আহা, কি মায়া! কি মায়া! তার শ্যালকের ছোট ছেলের বিয়ে, সেই উপলক্ষে মেয়ে এসেছে, জামাই আসবে দুইদিন পরে।
এখন অবশ্য আলম সাহেবের ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা অনেক কমে গেছে। ব্যাঙ্কে নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়োগ হচ্ছে, তার ব্রাঞ্চেও দিয়েছে দুইজন।
কিন্তু ওদের উপরে তো ভরসা করে সব কাজ ছেড়ে দেওয়া যায়না। নতুন চাকুরি সবার, কাজ বুঝে নিতে তো ওদের সময় লাগবে। আর পরিবারের ভারও একটু হাল্কা হচ্ছে, বর ছেলেটা চাকুরীতে ঢুকেছে ঢাকায়। আইটি, কম্পিউটার অমুক তমুক কি নিয়ে কাজ, তিনি নিজে তেমন একটা বোঝেন না। যখন চাকুরীর কথা বলল ছেলে, তিনি তেমন একটা গুরুত্ব দেননি।
ছেলে যে একটা কোথাও ঢুকে কাজ শুরু করেছে, এটাই তো অনেক। ছেলেও রওয়ানা দিয়েছে ঢাকা থেকে, আজকেই চলে আসবে।
বাসায় ফিরে দেখেন কোন সাড়াশব্দ নাই, আলো বন্ধ, বুকটা হুট করে অজানা অমঙ্গল আশঙ্কায় থমকে গেল। তিনি হৈ চৈ মুখর একটা বাসা আশা করছিলেন। পিচ্চি নাতনী গুটিগুটি পায়ে ছুটাছুটি করবে, মেয়েটাকে দেখবেন কতদিন পর।
বাসা থেকে আবার চলে যাবেন সবাইকে নিয়ে বাজারে, কেনাকাটা করবেন বেশ মজা করে। কিন্তু খালি বাসাটা যেন তার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসতে থাকে। গেট খুলে দিল নুরজাহান, তার বাসায় কাজ করে। তাকে দেখা মাত্র নুরজাহান বলে উঠলো, চাচা- ভাইজান আসছে ঢাকা থেকে, সবাইরে নিয়ে গেছে বাজারে, কেনাকাটা করবে।
আলম সাহেব বলা বেশ হতবাক হয়ে যান, তাকে ছাড়া এই বাসায় বাজার হবে, কেনাকাটা হবে, এইটা তো কখনও হয়নাই! টাকা কোথায় পেল ওরা, ছেলে তাহলে ভালো রোজগার শুরু করেছে।
পিতা হিসেবে আর সবার মতই খুশী হন, কিন্তু এই ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে তার খুব মন খারাপ লাগতে থাকে। নিজের ভেতর থেকে কেমন অভিমানের তেতো ঢেঁকুর উঠে আসছে। অফিস থেকে দেরী করে আসার জন্য কতবার গিন্নির সাথে ঝগড়া করেছেন, তিনি না থাকলে বাজারে যাওয়া হচ্ছে না, অমুক দাওয়াতের গিফট কেনা হচ্ছে না! আর আজ হন্ত দন্ত হয়ে বাসায় ফিরে দেখেন কেউ নেই।
আলো না জ্বালিয়ে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলেন গম্ভীর হয়ে, নুরজাহান ঘরে এসে আলো জ্বালিয়ে বললঃ
-চাচা কি শরিল খারাপ?
-না।
-চা কইরা দিমু? অন্ধকারে বইসা আছেন কেন?
-কিছু হই নাই, তুই যা, তর কাজ কর।
-চাচা, আম্মায় কইসে দুধ নিয়ে আসতে, বাবু দুধভাত খাইব, করিমনের মা দুধ দেয় নাই , ওদের গরু মরসে।
- তুই যা, দেখতেসি আমি কি করা যায় । ওরা কখন আসবে কিছু বলসে?
- না, তয় দেরী হইতে পারে, দেরী হইলে আপ্নারে খাইয়া ফেলতে বলসে।
কিছুক্ষন গুম হয়ে বসে থাকেন আলম সাহেব। নাতনী কে আদর করে ডাকেন বুড়ি বলে।
বুড়ি দুধ ভাত খাবে, বসে তো থাকা যায়না, কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি নিজেকে রাস্তায় আবিস্কার করলেন। বাজারে অধিকাংশ মানুষ তার পরিচিত । ব্যাংকে চাকুরি করার সুবাদে ব্যবসায়ী সবাই কমবেশী তাকে চেনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি দুধের ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাড়িতে এখন কেউ নেই, তবুও বাইরে থাকতে ইচ্ছে করলো না, বাসার দিকে রওনা দিলেন।
বাড়ি গিয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়লেন। নিজেকে অত্যাবশ্যকীয় না মনে হবার এক অচেনা অনুভূতি নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
ঘুম ভাঙ্গল তার চুল টানা খেয়ে, কি ব্যাপার? চোখ খুলে দিলেন পেতের উপরে বুড়ি বসে তার চুল ধরে টানছে!
- নানু, নানু, উথ, উথ...
মুহূর্তেই গোল জল হয়ে গেলেন আলম সাহেব, কোথায় গেল তার অভিমান, ক্লান্তি, মায়ার টুকরা টাকে কলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সজাগ হয়ে উঠলেন।
মেয়ে আসলো, কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,-
- বাবা, শুয়ে পড়েছ যে, শরীর খারাপ নাকি?
- আরে না রে মা, তোরা আসছিস, আর আমার অসুধ বুড়ি চলে আসছে, আর আমার কোন সমস্যা নেই!
ততক্ষনে গিন্নী আসছে,
- আর তোরা যখন নিজেরাই সব কিছু করতে পারছিস, আমি ঘুমিয়ে থাকলেই সমস্যা কি?
- শেষের কথাটা রিনু বুঝতে পারে যে বাবা মাকেই বলছে। তবু মেয়ে অস্তির হয়ে বলল,
- বাবা, তুমি অফিস থেকে এত ক্লান্ত হয়ে ফের যে তোমাকে আর টানিনি, আর ভাইয়াও খুব অস্থির হয়ে গেল!
ছেলে তুষার আসে, বাড়িতে আজ চাঁদের হাট! বহুদিন খুব কাছাকাছি প্রান গুলো ছড়িয়ে গিয়েছিল দূরে দূরে, আজ আবার কাছে আসার উত্তাপে টগবগ করছে সবাই! মানুষ কিভাবে বাঁচে? এত লম্বা অর্থহীন জীবনটা মানুষ কিভাবে টেনে নিয়ে যায় হাসিমুখে? এর উত্তর আজ আলম সাহেবের বাড়িতে আসলে পাওয়া যেতে পারে!
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসার আগে বুড়িকে দুধভাত খাওয়াতে বসলেন আলম সাহেব।
রুনি রান্নাঘর থেকে হাঁক মেরে বলে
- বাবা, গল্প বলতে হবে কিন্তু, গল্প না শুনে শুনে তোমার বুড়ি কিন্তু খেতে চায়না।
আলম সাহেব মহা মুশকিলে পরে গেলেন। ছোটদের গল্পতো তিনি অনেক আগেই সব ভুলে গেছেন, শুধু ছোটদের না, সব কাল্পনিক গল্পই যেন ভুলে গেছেন। কি গল্প বলবেন এখন, ইস তিনি আগে থেকে জানলে একটা ছোটদের গল্পের বই কিনে আনতেন, ওখান থেকেই তিনি তার বুড়িকে গল্প পড়ে শোনাতে পারতেন !
যাই হোক, গল্প তাও বলতেই হবে, তিনি মাথায় যা আসছে তাই বলার সিদ্ধান্ত নিলেন, দুধভাত খাওয়াতে খাওয়াতে শুরু করলেন,
- জানিস বুড়ি, এক দেশে ছিল এক রাজা, রাজার অনে ছিল অনেক দুঃখ! এটুকু বলে চুপ করে গেলেন, মাথায় আর কিছু আসছেনা, কি বানায় বললে যে বুড়ি খুশি হবে এইটা আর মনে আসছেনা।
বুড়ি একটু চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর বুঝতে পারে নানু আর গল্পে এগুচ্ছে না, সে তীব্র প্রতিবাদের তোরে চিৎকার শুরু করে, এটাকে কান্না বলা যেতে পারে।
আলম সাহেব আপোষের সুরে বললেন আচ্ছা, ঠিক আছে, চল, আমি আমার ছোট বেলার গল্প বলি, আমি তখন তোমার মতই ছোট।
তার নানু যে তার মত একসময় খুব ছোট ছিল, এইটাই বুড়ির জন্য বিশাল বিস্ময়ের ব্যপার!
- তুমি একসময় আমার মত খুউব ছোত ছিলা!
- হ্যা, বুড়ি, আমি তোমার মতই একসময় অনেক ছোট ছিলাম!
- তখন কি তুমি আমার মত দুধ ভাত খেতা?
একটু থামেন আলম সাহেব। প্রতিদিন দুধভাত খাওয়ারর সচ্ছলতা তাদের ছিল না, সেই সময় তাদের গ্রামের বেশী মানুষের এটা ছিল না!
- না আমি দুধ ভাত খেতাম না! তবে খেলায় দুধভাত বলে একটা জিনিস ছিল। বড়দের খেলায় ছোটদের স্বান্তনা দিয়ে দুধভাত বলে খেলায় নেওয়া হত, দুধ ভাত খেলোয়াড়দের খেলায় কোন ভূমিকা থাকতনা, তারা গোল দিলেও গোল হিসেব হত না,তাকে কেউ আটকাতেও যেতনা।
- তোমরা সেই সময় কি কি খেলা খেলতে?
- খেলার কি আর শেষ ছিল রে? গোল্লাছুট, গাদি, পলাপলি।
লাট্টু, ডাণ্ডাগুলো। বুড়ি-ছু আরও কত খেলা, নাম মনে আসছেনা সবগুলোর!
ছোটবেলার খেলার গল্প বলতে বলতে খাওয়া শেষ, সারাদিনের উত্তেজনায় বুড়ি আলম সাহেবের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আলম সাহেব জহিরের সাথে কথা বলতে বসলেন। গতরাতে গিন্নি ছেলের বিয়ের কথা তুলেছিল। তিনি কথা বলে বুঝতে চান জহিরের চাকুরীর কি অবস্থা, ভালো হলে তিনিও বিয়ে দিয়ে হাত পা ছাড়া হয়ে যেতে চান।
সবার সাথে কথা আলোচনা শেষ করে যখন বিছানায় ঘুমাতে আসলেন তখন সন্ধ্যের অসময়ের ঘুম পুরো চটে গেছে। বুড়িকে ছোটবেলার গল্প বলতে গিয়ে তিনি নিজেই স্মৃতির আক্রমণে পর্যদুস্ত মনে হচ্ছে। অর্থহীন, টুকরা, ছোটখাটো নানা স্মৃতি ভিড় করছে মাথায়। দুধভাতের কথা মনে পড়ে গেল। বড়রা তাকে খেলায় নিতে চাইতনা।
খুব জেদ ধরলে তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিত। খেলায় নেওয়ার সময় বলে নেওয়া হত যে ও দুধভাত। তো খেলায় নিলেও আসলে তার কোন ভূমিকা, গুরুত্ব থাকতো না। দুধভাত খেলোয়াড় গোল দিলেই কি, না দিলেই কি- কারও কোন মনোযোগ থাকতো না সেইদিকে। মাঝে মাঝে এই দুধ ভাত খেলোয়াড় হয়ে থাকতে কি যে দুঃখ লাগতো!
পরের দিন অফিসও আলম সাহেবের বরাবরের মত বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই গেল।
নিজের কাজ তো আছেই। তার সাথে নতুন ছেলে আছে দুইজন। ওদেরকেও কাজ শিখিয়ে নিতে হয়। বিকাল নাগাদ লেনদেন সব শেষ করে যখন হিসেব মেলাচ্ছেন, হুট করে তাঁর একটা কথা মনে পরে গেল, তিনি খুব জরুরী একটা কাজে ভুল করে ফেলেছেন। একটা বড় অঙ্কের পে অর্ডারে সই না করেই খামে রেখেছিলেন, পার্টি এসে নিয়ে গেছে দুপুরে।
সই ছাড়া ঐ পে অর্ডারে কোন কাজ হবে না। পার্টি পড়বে বিপদে। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের চাকুরী জীবনে এই রকম ভুল হয়নাই। প্রথমে একটু হতভম্ব ভাবে বসে রইলেন, তারপরেই উঠে পড়লেন। এই পার্টির দোকান তিনি চেনেন, এরই মধ্যে ঢাকায় রওয়ানা না হলে তিনি হয়ত তাঁর ভুলটা সংশোধন করার সুযোগ পাবেন।
কাউকে তেমন কিছু না জানিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। বাজারে এসে দেখেন দোকান বন্ধ, বাসায় থাকতে পারে ভেবে পাশের দোকান থেকে ঠিকানা নিয়ে পার্টির বাসায় গেলেন ৫ কিমি দূরে। বাসায় গিয়ে পার্টিকে পেলেন না, তবে একটা নাম্বার পেলেন যেখানে সন্ধ্যার পরে তাকে পাওয়া যাবে। আলম সাহেব আর বাসায় গেলেন না, বাজারে এসে মতিনের চায়ের দোকানে বসে রইলেন। বুঝতে পারলেন, আসলে বলা যায় অনেকটা মেনেই নিলেন যে তাঁর বয়স হয় যাচ্ছে, অবসরে যাওয়ার সময় তো চলেই আসলো, আর কয়েকটা মাস।
কিন্তু তাঁর বেখেয়াল ভুলের জন্য একজন বিপদে পড়বে, এইটা মেনে নিতে তাঁর অনেক কষ্ট হতে থাকে।
সন্ধ্যার পরে তিনি পার্টিকে ফোনে পেলেন। যেটা তিনি জানতে পারলেন তাতে তার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার কথা। পে অর্ডারে নাকি কোন ভুল হয়নি। সই ঠিকই আছে।
কিন্তু আলম সাহেব তো সই করেননি, কাউকে করতেও বলেন নি, খামে ভরে ড্রয়ারে রেখেছিলেন পার্টি আসলে দেওয়ার জন্য। সইএর নাম শুনে বুঝলেন নতুন অফিসার, তাকে তিনি বলেন নি, কিন্তু সে নিজে থেকেই তার ভুল সংশোধন করে নিয়েছে।
তার মানে নতুনরা কাজ শিখছে, ওরা দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে, আলম সাহেব না থাকলেও কাজ চলবে। রাত হয়ে আসছে, বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন। আজও বেশ দেরী হয়ে গেল।
তবে আজকের জন্য আর তেমন অস্থির তাড়া অনুভব করছেন না। তিনি বাসায় দেরিতে পৌছুলেও তেমন কিছু আটকে থাকবে না, তিনি এখন অনেকটাই ভারহীন। বাড়ি গিয়ে বুড়িকে দুধ ভাত খাইয়ে গল্প পরে শোনাবেন। কাল অফিসে একটু দেরিতে গেলেও তেমন অসুবিধা হবেনা বুঝতে পারছেন। তার ধারনা ছিল এরকম একটা দিন আসলে তার খুব শান্তি লাগবে, কোথাও আর সেদিন কোন দুঃখ থাকবেনা।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, আজ আলম সাহেবের সেই ছোটবেলার সেই দুধভাত খেলার কথা মনে পড়ছে। ছোটবেলায় যখন বড়দের খেলায় দুধ ভাত হতেন, বড় কষ্ট লাগতো তার। আজকে ছোটদের খেলায় আজ তাকে আবার দুধ ভাত হতে হচ্ছে। এইবেলা কেমন লাগবে সেই খেলা- সেইটা ভাবতে ভাবতে ফিরে চললেন ঘরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।