আহ অমরত্ব, তোমার উষ্ণ ঠোঁটে রাখি ঠোঁট, চোখ বন্ধ করে সবটুকু আনন্দ ভোগ করি। তোমার উষ্ণতায় বারেবারে বিলীন হয়ে যাই, দিতে পারিনি কিছুই, শুধু নষ্ট করে যাই। আমার এই ছোট্ট ঘরে আলো বাতাস একটু কমই প্রবেশ করে। এই ঘরটা যেন আলো বাতাসের জন্য সংরক্ষিত এলাকা। এই কক্ষটি হতে অন্ধকার দূর করার জন্য পর্যাপ্ত হলেও হৃদয় হতে অন্ধকার দূর করার জন্য যে পর্যাপ্ত নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে লিখতে বসি। খাতার মধ্যে কলম চলার মায়াময় শব্দে লেখাটা এগিয়ে যেতে থাকে। এই লেখালেখির কারনেই হয়তো এখনো জীবনকে ভালো লাগে।
পাশের রুম থেকে মায়ের কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ ভেসে আসছে। বাবার আত্মার শান্তির জন্য মায়ের প্রার্থনা চলছে।
বাবার আত্মা তাতে শান্তি পাচ্ছে কিনা জানিনা। পাওয়ার কথাও না।
আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। মুক্তির জন্য লড়াই করা এই মানুষটি জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছেন খুবই অন্যায় ভাবে। তিনি একটা স্বাধীন দেশের সপ্ন দেখতেন।
ঠিক নিজের মত স্বাধীন একটা দেশ। যেখানে স্বাধীন ভাবে কথা বলবেন, স্বাধীনভাবে গর্ব করবেন নিজের দেশ নিয়ে।
স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীন হলেন। কিন্তু বেশীদিন সেই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারলেন না। পরাধীনতার কালো আঁধারে ঢেকে যায় দেশ।
বাবা এই পরাধীনতা সহ্য করতে পারলেন না। পরাধীনতার বিরুদ্ধে আবার দাঁড়ালেন।
অবশেষে স্বাধীনতা পেলেন জীবন থেকে। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা বাবাকে হত্যা করলো। বাবা মারা গেলেন না শহীদ হলেন , এ নিয়ে দেশ মাথা ঘামায় নি।
আমি দেশকে নিয়ে কিছু লিখতে পারিনা। আমি দেশকে ভালবাসতে পারিনা। বাবা যদি যুদ্ধে মারা যেতেন, তাহলে আমার এতটা খারাপ লাগতো না। আমি গর্ব বোধ করতাম। আমার কাছে দেশ মানে এখন একটা বিভীষিকাময় জিনিস।
যে তার সন্তানদের রক্ষা করতে পারেনা।
বাবার মৃত্যুর পর আমি দেশ বলতে যা দেখেছি তার জন্য শুধু করুণাই হয়েছে, ভালোবাসা জন্মেনি।
আমি দেশ নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই মনে পরে যায়, সেই ঘৃণিত রাজাকারদের কথা। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আমার রক্ত কণিকাগুলো ফুটতে থাকে, যখন দেখি দেশদ্রোহীরা দেশের শাসন ক্ষমতায়। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই, যখন দেখি আমার বাবার যুদ্ধ লব্ধ লাল সবুজ পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে দেশদ্রোহীরা ঘুরছে।
আমি দেশকে নিয়ে লিখতে পারিনা, দেশকে ভালবাসতে পারিনা। আমি ততদিন হয়তো দেশকে ভালবাসতে পারবনা, যতদিন এই দেশে রাজাকার ঘুরে বেড়াবে।
খাওয়ার জন্য মা ডাকছেন। আমি খেতে গেলাম। মা আর আমি পাশাপাশি বসে খাচ্ছি।
" বাবা আগামীকাল কিছু দরিদ্র লোককে খাওয়াতে চাচ্ছিলাম। "
"কেন মা?"
" কাল ২৬ শে মার্চ, তোর বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতিবারই উনি এই দিনে দরিদ্র লোকদের খাওয়াতেন। "
" মা, এটা এখন আর দেশ নেই। তোমার এই দেশপ্রেম বৃথা"
মা গম্ভীর হয়ে যান। তাঁর দৃষ্টিতে আমি একটি দেশকে দেখতে পাই।
"তোর বাবা পছন্দ করতেন। "
"ঠিক আছে আমি ব্যাবস্থা করছি, কিন্তু আমি থাকতে পারবোনা। "
" ঠিক আছে। "
মা আর আমি পাশাপাশি বসে আছি । দুইটি ভিন্ন মতকে দুজন আঁকড়ে ধরে আছি।
সময় চলে যায়, শুধু রেখে যায় কিছু নিস্তব্ধতা।
আমার অন্ধকার কক্ষে আরও অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করি। আমার চোখ জলে ভরে উঠে।
আমার দুঃখবোধ জল হয়ে গড়িয়ে পরে।
দেশ আজ ঘৃণিত শকুনের নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। আমার বাবার স্বাধীনতার সপ্ন আজ শকুনদের থাবার নিচে।
প্রতিটি সপ্নই আজ লাশ হয়ে গেছে। ত্রিশ লাখ শহীদের সপ্ন আজ দেশদ্রোহী রাজাকারদের দখলে।
আর কতদিন এই সপ্ন হত্যার উৎসব চলবে?
মা দরিদ্র লোকদের খাওয়াচ্ছেন। আমি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে আসি । মা আমার চলে আসার দিকে তাকান।
আমি দেখি এই বাংলাদেশের আকাশ, বাতাস আজ পরাধীন। বাংলার প্রতিটি রাস্তা আজ পরাধীন।
আমি এই পরাধীন রাস্তা ধরে স্মৃতিসৌধের কাছে পৌছাই। আমার কাছে মনে হয় আজ এই স্মৃতিসৌধও যেন আজ পরাধীন হয়ে পড়ছে।
আমি স্মৃতিসৌধে একটি ফুল রেখে চলে আসি। আমার শ্রদ্ধাটুকু, ভালোবাসাটুকু খুবই সংগোপনে রেখে আসি এই স্মৃতিসৌধের পাদদেশে।
আমার হৃদয় তপ্ত হয়ে উঠে দুঃখের আগুনে।
আমি পরাধীন রাজপথে এসে দাড়াই, আমি চীৎকার করতে থাকি " জয় বাংলা" বলে। আমি চীৎকার করে এই পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে ফেলতে চাই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।