আমি কার পক্ষে নই, আমি সেই পক্ষে, যে পক্ষে ঘুমিয়ে আছে ৩০ লক্ষ শহীদ অষ্টম শতাব্দী থেকেই ভারত, আফগান, ইরান, আরব, মধ্য এশিয় অঞ্চল থেকে মুসলিম বনিক, ধর্ম প্রচারক, আক্রমণকারী সেনাপতি-শাসকদের মাধ্যমে ধর্মশিক্ষার সূত্রপাত ঘটে। এই শিক্ষা ছিলো মূলতঃ ইসলাম ধর্মমূলক আচার-অনুষ্ঠান ও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার মূলনীতি মধ্যে সীমিত । ধীরে ধীরে মক্তব ও মাদ্রাসা গড়ে উঠতে থাকে। এগুলি ছিলো মূলতঃ মসজিদ কিংবা মসজদসংলগ্ন। বাস্তবে স্থায়ী মুসলিম রাজত্বের সূচনা হয় ১১৭৪ সালে মুহাম্মদ ঘোরীর রাজত্বকাল থেকে এবং সর্বশেষ মুঘলদের মাধ্যমে এই রাজত্ব টিকে ছিলো ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত।
এ সময়কালে পার্শী ও আরবি ভাসায় ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হতো। ধর্ম শিক্ষার সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাত্রায় গণিত, ব্যাকারন, তর্কবিদ্যা, দর্শন, আইন-কানুন, বিচার ও ন্যায়শাস্র, সম্পদ-মালিকানা ও বণ্টন ইত্যাদী বিষয় যুক্ত হয়। মুহাম্মদ ঘোরী, বখতিয়ার খিলজি, নাসিরুদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালাল উদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক, ফিরোজশাহ তুঘলক প্রমুখ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদ কেন্দ্রিক মক্তব ও মাদ্রাসা গড়ে উঠে ও সমৃদ্ধ হয়। সিকদার লোদির সময়কালে মক্তব ও মাদ্রাসায় হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি দেখা যায়। কারন তখন রাজভাষা ছিল পার্শী আর হিন্দুরা মূলতঃ রাজ কর্মচারী হওয়ার জন্য পার্শী শিখতে এই মক্তবগুলোতে আসতো।
১৫২৬ সাল থেকে মোঘল সম্রাট বাবরের রাজত্বকাল শুরু হয়। বাবর, হুমায়ূন, শেরশাহ, আকবর, জাহাঙ্গীর, আওরঙ্গজেব, বাহাদুর শাহ, হুসেন শাহ প্রমুখ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মক্তব-মাদ্রাসা যেমন সম্প্রসারিত হয় তেমনি মক্তবগুলোতে ইসলামি ধর্মশিক্ষা ও ধর্মাচরন শিক্ষার চেয়েও ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন বিষয়ও কোথাও কোথাও গুরুত্ব পেতে থাকে। রাজা হুসেন শাহ'র পৃষ্ঠপোষকতায় নদীয়ার বৈষ্ণব আন্দোলনের মধ্যে তার ছাপ পাওয়া যায়। আকবরের শাসনামলে তিনি হিন্দু-মুসলিম মিলনের সেতুবন্ধন হিসেবে 'দীন-এ-এলাহী' নামক নতুন নতুন যে ধর্ম প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন তার পরিপূরক হিন্দু-মুসলিম-সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চার উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিছক ধর্মশিক্ষার মক্তব বা মাদ্রাসা থেকে মুক্ত করে সার্বজনীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্তরে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন রাজ্য বিস্তার ও রাজক্ষমতাকে সংহত করার প্রয়োজন থেকেই।
তিনি শিক্ষার সূচিকে ''১.এলাহবিজ্ঞান-যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত দৈববিদ্যা ও নীতিশাস্র, ২.রিয়াজিবিজ্ঞান-যার মধ্যে থাকবে অংক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত গতিবিদ্যা ও ৩.তবই-ই বিজ্ঞান-যার মধ্যে থাকবে প্রকৃতি বিজ্ঞান, এই তিনভাগে ভাগ করেছিলেন।
বৃটিশ-পূর্ব সময় পর্যন্ত এইভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা চালু ছিল। তবে আধুনিক অর্থে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় নি। মসজিদ ও মাদ্রাসার পাশাপাশি সুফী মতবাদীরা বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য 'খানকা' গড়ে তোলে , এখনও তা আমাদের দেশে আছে। সুহরাবরদী, চিশতী, কলন্দরী, মাদারী, আহমদী, নকশবন্দী ও কাদিরী সম্প্রদায়ের সূফীরা এভাবে ধর্মীয় শিক্ষণ প্রসারিত করেন।
সুফিবাদিরা ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে স্থানীয় জনগনের আচার-সংস্কৃতি কোন কিছুর উপরই হস্তক্ষেপ করতেন না । হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির আদান-প্রদান ও ইহজাগতিক শিক্ষার বিসয়বস্ত প্রাধান্য যেভাবে মক্তব মাদ্রাসাগুলিতে এবং কোথাও কোথাও মাদ্রাসা বহির্ভুত সেক্যুলার স্কুল-শিক্ষা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হলেও বিকশিত হয়ে উঠেছিল, ইংরেজ শাসন শুরু থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত করে দেওয়া হলো। হিন্দু-মুসলিম ভিবাজন রেখা অংকিত হলো তীব্রভাবে এবং মাদ্রাসাকে একটা স্থায়ী একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলো। পাশাপাশি হিন্দুধর্মীয় শিক্ষাকে আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক রূপে দাঁড় করানোর জন্য সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো।
হাসান গারদেজি ও জামিল রশিদ এর সম্পাদনায় 'পাকিস্তান,ধর্ম ও দ্বন্দের রাজনিতী' বইতে লেখা হয়েছে, ''ভারতের স্যার সৈয়দ আহমেদ (১৮১৭-৯৮) ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা ও ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের এক আন্দোলন শুরু করেন যা কালক্রমে পাকিস্তান আন্দোলনের জন্ম দেয়।
এটা লক্ষ করা যায় যে দক্ষিন এশিয়ার ইসলামের মাঝে পুনুরুত্থানবাদ ও আধুনিকতার দ্বন্দের কখনোই ফয়সালা হয় নি এবং এ বিষয়টি অস্বীকার করা অর্থহীন। আধুনিকতা শব্দটির অর্থ, যে অর্থে ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিসয়সমুহ গ্রহণকে বোঝায়, তা প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারটিতে কিছু রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পুনুরুত্থানবাদ ও আধুনিকতার মধ্যকার এই দ্বন্দ পাকিস্তানের জাতীয় কবি নামে পরিচিত মোহাম্মদ ইকবালের চিন্তার মধ্যে সবচে বেশি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দদের হিন্দু ধর্মীয় পুনুরুজ্জীবনবাদী ধারায় মহাত্না গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের জোয়ারের সামনে বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, শরৎচন্দ্রের ইহজাগতিক ভাবধারা যেমন মার খেল তেমনি রাজনৈতিক খেত্রেও চিত্তরঞ্জন, সুভাষ বোসের নেতৃত্ব পরাস্ত হলো। অন্যদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ, আল্লামা সৈয়দ ইকবালের মুসলিম ধর্মীয় পুনুরুজ্জীবনবাদী ভাবধারা ধারাবাহিকতায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বের সামনে বেগম রোকেয়া, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ধারা যেমন পরাস্ত হলো তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সাম্প্রদায়িক ভাবধারামুক্ত ফজলুল হক, ভাসানী, আবুল হাশিমের রাজনৈতিক কতৃত্ত্বও মুসলিম লীগ আন্দোলনে চাপা পড়ে গেল।
এই অবস্থায় সুযোগ ইংরেজরা গ্রহন করেছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ভারত হয়েছে, এর দ্বি-জাতি তত্ত্বে পাকিস্তান জন্মলাভ করেছে ১৯৪৭ সালে। তৎকালীন পূর্ববাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঁধা পড়লো নতুন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে- পাকিস্তানী প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসনে।
বৃটিশ শাসনের অবসানের পর পরই ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর হতে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে করাচীতে ৫ দিনব্যাপী যে শিক্ষা সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল তার মূল সূর ছিলো ''পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে; তবে তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহনশীল ও ন্যায়-নীতির উপর গুরুত্ব অরোপ করা হবে। '' ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পতিত পুর্ব বাঙ্গালার জন্য কি রকম হবে তা পরিস্কার।
যদিও সেক্যুলার চেতনার বিপরীতে স্কুল-কলেজে ইত্যাদি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানী ভাবধারা নিয়ে যাওয়াই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। পাশাপাশি মাদরাসাগুলোতে ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার স্থলে নিউ স্কীম মাদ্রাসা নাম দিয়ে ইসলামী সংস্কৃতির বাতাবরণে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করা ছিল তাদের লক্ষ। তবে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ছিলো স্বৈরাচার শাসনের অনুকূলে এবং ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিপুরক ইসলামীকরণের ধাঁচে তারা গড়ে তুলতে চেয়েছে, সেজন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। তাছাড়া পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে শিক্ষার সংকোচন নীতি একই রকম থাকায় মাদ্রাসার সংখ্যা ততটা বাড়তে পারে নি।
আসছে তৃতীয় পর্ব............ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।