আমার লেখা সরাসরি প্রথম পাতায় সকল পোস্ট অংশে প্রকাশিত হবে। আর সম্পাদকের বিবেচনা সাপেক্ষে তা নির্বাচিত পাতায়ও প্রকাশ হতে পারে। আমার নাম বিউটি । বাবা-মা অনেক শখ করে এই নাম রেখেছিলেন । নামের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যেই হয়তো ছোটবেলা থেকে আমি ফর্সা, প্রচলিত ভাবে যাকে বলা হয় সুন্দরী ।
এখন আমার অনেক নাম । একটা নামে আমাকে আটকে থাকলে চলবে না । আমার থাকতে হয় অনেক নাম । আমার নাম বর্ষা, আয়েশা, নদী, বকুল ইত্যাদি । ক’দিন পরপর আমার নাম বদল করি ।
নিজের নাম নিজে রাখি, খুব ভাল লাগে আমার এ কাজ করতে । তবে আমার জীবনটা আমার নামের মতো না । এ জীবন চাইলেও বদলানো যায় না । আমি হলাম নিশিকন্যা । আমি সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে দেহ দান করি।
ক্ষুধার্ত পুরুষেরা রাতে আমার দেহকে ইচ্ছেমত কাছে টেনে নেয় । তবে রাতে সবাই আমাকে কাছে টানতে চাইলেও দিনের আলোতে সবাই আমাকে ঘৃণা করে । স্কুল ফেরত বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফেরা মায়েরা আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে, দূরের রাস্তা দিয়ে সরে যায় । একবার একজনের কাছে পানি চেয়েছিলাম । পানির বোতল দিয়ে আর ফেরত নেয় নি, দ্রুত চলে গেছে ।
আমার হাসি পায় এইসব মধ্যবিত্তীও সংকীর্ণতা দেখে । এই হাসি গর্বের হাসি । আমার নিজের পেট আমার নিজেই চালাতে হয় । কারো কাছে জবাবদিহি করার জন্যে আমি বাধ্য নই । সেই সব গৃহবন্দী পরনির্ভরশীল নারীদের দেখে আমার করুণা হয় যাদের শ্রদ্ধেয় স্বামীদের নিশিকালে আমরা সঙ্গ দিই ।
বুক ফুলিয়ে আমি বলতে পারি আমি তাদের মতো গৃহবন্দী পরনির্ভরশীল নই । আমার কোনও দায় পড়ে নি কোনো পুরুষের ক্রীতদাসীর মতো জীবন কাটানোর । আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন, এটাই আমার জীবন । গর্ব করবো না কেন আমি ? অবশ্যই করবো ।
আমার দিন এখন সরল ।
সারাদিন ফেরী করে ফুল বিক্রি করি । বকুল ফুল আমার বিশেষ প্রিয় । ছোটবেলায় কতো মালা গাঁথতাম ! প্রতিদিন স্কুলে হাতে মালা পেঁচিয়ে যেতাম । বন্ধুদের মালা বানিয়ে দিতাম । সবাই খুব খুশি হতো ।
আজ আমি মালা বানাই এমনি এমনি বিলিয়ে দেবার জন্যে নয়, বিক্রি করার জন্যে । এক গাছি মালা দশ টাকায় বিকাই । বকুলের মালা অনেকেই পছন্দ করে । সেদিন রমনা পার্কে উদাসীন হয়ে বসে থাকা এক যুবক নিজেই ডাক দিয়ে আমার কাছ থেকে মালা কিনেছে । হয়তো যুবকটি কোনো এক তরুণীর প্রতীক্ষা করছিল, হয়তো সে তার প্রিয়জন থেকে দূরে আছে ।
বিরহী উদাসীন সেই যুবক আমার দিকে ভালো করে তাকায়ই নি । কতো বিচিত্র মানুষ এই পৃথিবীতে !
আমি কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করি না । হয়তো করতে পারবোও না কখনও ।
পনেরো বছর বয়সে এ রকম এক সুদর্শন যুবকের হাত ধরে বাসা থেকে পালিয়েছিলাম । সুন্দর একটা ঘর বাধার স্বপ্ন দেখিয়েছিল ঐ যুবক ।
ঘরে সৎমা ছিল, যার ভাই বাসায় থাকতো । সেই মামা আমাকে একদিন... ; থাক, এগুলো বাদ দিই । আমি তার কাছে কখনই এই ঘটনার কথা বলি নি । এই একটা কারণে সবসময় আমি তার কাছে অপরাধী ছিলাম । কাজেই সে যখন আমাকে ঢাকায় তার সাথে চলে আসার কথা বলল, রাজি না হবার কোনো কারণ ছিল না ।
ঢাকায় তার সাথে চলে আসলাম । পরদিন আমাদের বিয়ের কথা । ঢাকায় এসে এক হোটেলে উঠলাম আমরা । আমি তাকে ভালবেসেছিলাম, তার প্রতি আমার অদেয় কিছু ছিল না । স্বপ্নের মতো যেন কাটছিল সময়টা ! পরদিন উত্তরায় তার এক বন্ধুর বাসায় যাই, সেই বন্ধুর বিয়ের সব ব্যবস্থা করে রাখার কথা ।
আমাকে বন্ধুর বাড়িতে রেখে সেই যে সে বাইরে গেল, আর ফিরে আসে নি । পরে শুনলাম আমাকে সে এখানে বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে । তখন আমার বয়স অনেক কম, অনেক কিছু বুঝি না । বয়স্কা এক মহিলা এসে আমাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যায় । কিছুই করার ছিল না আমার ।
আমি সব হারিয়েছি । তারপরের ঘটনা আর সবার ক্ষেত্রে যা ঘটে, তাই । সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবন শুরু হল আমার । প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম, পরে আস্তে আস্তে সহ্য শক্তি বেড়ে যায় আমার । তারপর বেশ কয়েক বছর সেই বাড়িতে ছিলাম ।
আমার মতো আরো কয়েকজন ছিল । তাদের সবার সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল । তাদের কেউ এসেছিল কাজের সন্ধানে, কেউ আমার মতো প্রতারিত হয়ে, কেউ বা স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে । কী অদ্ভুত এক জীবন আমাদের ! এই এক ঘেয়ে জীবন এক সময় খুব বেশি অসহ্য হয়ে উঠলো । চার বছর পর মোটামুটি টাকা জমিয়ে সর্দারনীর হাতে গছিয়ে দিয়ে আমি সেই নরক থেকে বেরিয়ে আসি ।
সেই থেকে আমি মোটামুটি স্বাধীন ।
এখন আমি মালিবাগ রেললাইনের পাশের বস্তিতে একটা ছাপরা ঘর ভাঁড়া করে থাকি । দিনের বেলায় ফুল বিক্রি করি, রাতে করি দেহ । আমার মতো আরো কয়েকজন একসাথে থাকি আমরা । কেউ এসে ঘাটায় না এখানে আমাদের ।
এখানে আমরা নিরাপদ, রাত বীরাতে একা একা বের হয়ে যাই, ভয় করে না আমাদের । ভয় পাবারই বা কী আছে ? আমাদের কি আসলেই হারাবার মতো কিছু আছে ?
আমরা ভ্রাম্যমান পতিতা ! সমাজ আমাদের অচ্ছুৎ করে রেখেছে । আমরা খারাপ; নষ্টা মেয়ে, যুব সমাজের ধ্বংসের জন্যে আমরা দায়ী । আমাদের বেশ্যা, মাগী, খানকী বলে গালি দেয়া হয় । স্ত্রী বাচক ঐ শব্দগুলোর কোনো পুরুষবাচক শব্দের কথা সমাজ কখনও বলে না ।
আমরা পতিতারা কখনই “পতিত” পুরুষদের কথা সমাজকে বলতে দেখি না । আমরা যদি নষ্টা হই, তবে যারা আমাদের কাছে আসে তারা “নষ্ট” নয় কি ? নাকি সমাজ ধরেই নিয়েছে পতিতা একটি নিত্য স্ত্রী বাচক শব্দ, যার কোনো পুরুষবাচক শব্দ হয় না ?
নিজেকে নিয়ে আমি লজ্জিত নই । বরং আমি গর্বিত । আমি পরিশ্রম করে খাই । তিন-বেলা ভাত জোটানোর জন্যে আমাকে দিনের বেলা আর সবার সাথে প্রতিযোগিতা করে ফুল কুড়াতে যেতে হয় ।
কখনও রাতে একাধিক বার ক্ষুধার্ত পুরুষদের সামনে নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় । আমরা হাসিমুখে সবকিছু করি । আমাদের হাসতে হয় । চপলতা চুইয়ে চুইয়ে পড়তে দিতে হয় । অনেকে জানে এই কাজ আমরা আনন্দ নিয়ে করি ।
আসলেই কি তাই ? আর দশটা নারীর মতো আমাদেরও মন আছে । সেই মন স্পর্শ করার সাধ্য কি কারো আছে ? সেই মন সহজ, পবিত্র, কলুষতা যাকে ছুতে পারে নি । আমি কল্পনায় চলে যাই আমার গ্রামের সবুজ ধানক্ষেতে । আলের পর আল আমি খোলা বাতাসে ছুটতে থাকি । গ্রামের বহমান নদীতে নেমে পড়ি ।
বিলের শাপলা তুলতে যাই । কেউ কি পারবে আমার কল্পনাকে ছুতে ? আমার ভাবনা বেশি সময় স্থায়ী হয় না, একটু পরেই হাঁপাতে থাকা সঙ্গী টাকা দিয়ে চলে যায় । আমাদের সাথে তাদের কেউ দুর্ব্যবহার করে না । তাদেরকে আমি অসম্মান করি না । এরা শারীরিক প্রয়োজনে আসে, প্রয়োজন মিটলে টাকা দিয়ে চলে যায় ।
কোনোরূপ ছল চাতুরী নেই। তবে পুলিশ সদস্যরা আমাদের সাথে খুব দুর্ব্যবহার করে ।
আমি সুখী নই । প্রতিটা দিন শুরু হবার সময়ে আমি ভাবি দিনটা কখন শেষ হবে আর আমি একটু শান্তির ঘুম ঘুমবো । প্রতিটি দিন আমাকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় ।
এই বেঁচে থাকার মাঝে কোনো সার্থকতা নেই । আমি বাঁচতে চাই, বেঁচে থাকতে নয় । আমারও স্বপ্ন আছে, আমি স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর ঘরের, যে ঘরে আমার স্বামী ও আমার মাঝে থাকবে একটি ফুটফুটে শিশু । মাঝে মাঝেই সে জেগে উঠে আমাদের জ্বালাতন করবে, শেষ রাতটা হয়তো আমরা আর ঘুমবো না, হয়তো হাতে হাত রেখে গল্প করেই কাটিয়ে দেবো । আমার খুব ইচ্ছে হয় এমন একটা ঘরের ।
আমি এখনও তাই এমন স্বপ্ন দেখি । অন্তত এই জায়গায় কেউ আমাদের বাধা দিতে পারে না । কোনোদিন পারবেও না । আমার স্বপ্নই আজ আমার বেঁচে থাকার সঙ্গী ।
আমি খুব যত্ন করে চোখে কাজল দিই ।
পার্কের বেঞ্চে বসে থাকি । এক সময় প্রকৃতিকে বিষাদগ্রস্ত করে সূর্যটা ডুবে যায় । আলো আঁধারীর খেলায় জীবন্ত শহরের কোলাহল থেমে যায় । আলোর সাথে আমার স্বপ্নটাও আস্তে আস্তে ধুসর হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে । ঐ তো, কে যেন আমাকে দেখছে ! এগিয়ে আসছে !
আমি বাস্তবে ফিরে যাই ।
(লেখাটি পূর্বে পেঁচাতে প্রকাশিত) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।