আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পকেট কলোনি

বিকট বনসাই মানুষ পকেটে পুরে দিয়াশলাই ভেবে ভুল করি। অনিকেত আঁধারে আলোক আলিঙ্গনে নিজেকে বাঁধতে গিয়ে খুঁজে পাই ভুল কার্তূজ, নিভে যাওয়া মাংস-হাড়-মজ্জা। বেমক্কা চিৎকার করে ওঠে অশোভন মানুষগুলো। তাদের প্রজ্জ্বলন অক্ষমতার কথা জানায় সকাতরে। আমি তাদের কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে অন্য পকেট থেকে দিয়াশলাই কাঠি বের করে তাদের গায়ে ঘষি, নিস্ফল।

দক্ষিণের জানলা দিয়ে অশরীরী হাওয়াগিটার বেজে চলে। বনসাই মানুষগুলো এবার উড়ে যাবার ভয়ে চিৎকার করে। তারা জ্বলতে চায় না, তারা উড়তে চায় না, শুধু পকেটনিবাসী হয়ে দিনানিপাত করতে চায়... আমি নিজেকে জাদুকর ভাবিনি কখনও। স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের মানুষকে চাদরাবৃত করে মন্ত্রপাঠ অথবা সম্মোহনচেষ্টা শেষে তাদেরকে ক্ষুদ্রকায় রূপ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব, তা কল্পনাতেও আসেনি। অথচ, কোনরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই আমার পকেটে খুচরো পয়সার মত মানুষ জমতে থাকে।

আমার এই অস্বাভাবিক, অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আমি যথেষ্ট বিব্রত এবং বিরক্ত। চোখের সামনে একজন ছয়ফুটি দামড়াকে দেখছি খিস্তিখেউর সহযোগে চা খাচ্ছে পাড়ার ভবঘুরে নিকেতনে। তাকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নব্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডাঁকাবুকো নেতার চ্যালাচামুন্ডা হবে হয়তো। বেশতো, আমার সামনেই সিগারেটটা ধরিয়ে মুখ খারাপ করলে।

চোখের শীতল চাহনিতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলে সদর্পে। তারপরেও কেন আমার পকেটের ভেতর সেঁধুতে চাচ্ছো লাথি খাওয়া পোষা কুকুরের মত অনাবিল আনুগত্যে? কীসের ভয়? কীসের নিরাপত্তাহীনতা তোমার? -ভাইজান কিছু কইবেন আমারে? চায়া রইছেন ম্যালাক্ষণ ধইরা। ক্ষ্যাপাটে তেজোল্লাস তার কন্ঠে। -না। আর আমার পকেটে সে বনসাই মানুষ, ক্ষয়াটে।

করুণামিশ্রিত আশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায়। এই শহরে আমি কোন আগন্তুক নই। এই স্নিগ্ধ কিন্তু একঘেয়ে মফস্বঃল শহরে, যেখানে এখনও দুপুরবেলায় ফেরিঅলারা সুরেলা কন্ঠে হাওয়াই মিঠাই আর কটকটির সওদা নিয়ে বেরোয়। ভাতঘুম দেয়া গৃহিনীরা ফেরিঅলার সুরেলা কন্ঠ এবং তাদের ডানপিটে ছেলেপুলের চেচামেচির যুগপৎ আক্রমণে বিরক্ত হয়ে চোখ কচলিয়ে উঠে দু-ঘা বসিয়ে দিয়ে চুড়ির দরদামে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তখন দস্যি ছেলেরা হাসে।

ঝিমুতে থাকা শহরের রোদবৃত্তের পরিধি জুড়ে হাওয়াই মিঠাই, কটকটি, খালি পা, ছেড়া স্যান্ডেল, লুটোপুটি। তাদেরকে পকেটস্থ করা যায় না। তাদের আশ্রয়হীনতার ভয় নেই, নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে না তারা, তারা বড় হয়, বেড়ে ওঠে। তাদের ক্ষুদ্রকায় প্রতিলিপির প্রয়োজন নেই। অথচ যাদেরকে নিশ্চিত নির্ভরতা ভেবে তারা বেড়ে উঠছে নিরুদ্বেগ, তারা চোরাপথে ঢুকে যায় আমার বনসাইমানব নিবাসে।

তারা হাসে, ইতস্তত করে। তারপর দাপুটে লেবাসটা, অথবা গোপন পনটা স্বাভাবিক বা তুলনামূলক বৃহৎ শরীরের চিলেকোঠা অথবা হাওয়াঘরে টাঙিয়ে রেখে সন্তর্পনে প্রবেশ করে আমার পকেটে। আমাকে তারা আগন্তুক ভাবেনি কখনই। আপনজন ভেবে হৃদ্যতা দেখিয়েছে, শত্রু ভেবে রূঢ় আচরণ করেছে, অপ্রোয়জনীয় ভেবে অবজ্ঞা করেছে। কিন্তু বনসাই হবার পরে খুব বেশি বিধিবৎ আচরণ করে তারা।

তাদের এহেন দ্বিসাত্ত্বিক বিপরীতধর্মী আচরণই আমাকে ভাবতে বাধ্য করে আমি আগন্তুক কী না। সে যাই হোক... কাপড়-চোপড় কাঁচতে গেলে মিনিয়েচার মানুষগুলোকে, ভীত বনসাই মানুষগুলোকে বের করতেই হয়। তখন তাদের সে কী কাকুতি মিনতি! খবরের কাগজে বস্তি উচ্ছেদের খবর দেখেছি। তার সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তবে পার্থক্যটা হল, বাস্তুহারা সেসব মানুষ জোট বাঁধতে পারে, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, হাঙ্গামা করতে পারে।

কিন্তরু পকেটনিবাসীরা হাপুশ নয়নে কাঁদা এবং বৃষ্টিস্নাত চড়ুইছানার মত তিরতির করে কাঁপা ছাড়া আর কোন বিকল্প খুঁজে পায়না। তারা হয়তো একে অপরকে দেখতেই পায় না। শুধু দেখতে পায় তাদের মহান আশ্রয়দাতাকে। হাহাহা! আমি এবং মহত্ব! যেচে পড়ে এসেছো, এখন নিজের আখেরটা নিজেই গোছাও না বাপু! কার অত দায় পড়েছে তোমাদের রক্ষনাবেক্ষণ করার! কিন্তু করতে হয় বৈকি! না চাইলেও করা হয়ে যায়। পকেট কলোনির সাম্রাজ্যের প্রতি কোন মোহ নেই আমার।

স্রেফ শখের বশেই দৈবক্রমে পাওয়া এই আশ্চর্য ক্ষমতাটিকে অবসরকালীন মনোরঞ্জনের জন্যে ব্যবহার করি। কিছুটা দায়িত্ববোধও কাজ করে, অস্বীকার করব না। তাই তাদের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে অদৃশ্য কালি দিয়ে লিখে রাখি পকেটিয় বনসাই দিনলিপি। জব্বার সাহেব- কম্পিউটার কম্পোজ এবং প্রিন্টিং এর ব্যবসা করেন। আমার সাথে দেখা হলে কথা বলেন না।

কখনও কখনও মাছি তাড়ানোর মত একটা ভঙ্গি করেন। তিনি বনসাইরূপে আমার পকেটে ঢুকেছেন তিন মাস আগে। কারণ: অজানা। সম্ভবতঃ প্রতিদ্বন্দ্বী তরুণদের উদার মনোভাব তার পেশাদারিত্বের অযাচিত অংশীদার হবে বলে ভয় পান। বনসাই মানবদের মধ্যে তিনি অপেক্ষাকৃত বেশি উচ্চকন্ঠ।

বাবুল সাহেব: রিকশা-ভ্যানের সবচেয়ে বড় গ্যারেজটি তার। রাস্তাঘাট নির্মাণের তদারকিও করে থাকেন। গরু-ছাগল চেনার সহজাত ক্ষমতার জন্যে প্রসিদ্ধ এবং নিন্দিত। স্থানীয় মস্তদের মধ্যে মস্তলোক কর্তৃক সমাজপ্রেমী সনদপ্রাপ্ত। বুক ফুলিয়ে হাঁটেন।

ইনিও আমাকে দেখলে কথা কন না। এবং ইনিও অজানা কারণে, সম্ভবত নিরাপত্তাঘটিত ব্যাপারেই হবে, সুরসুর করে আমার পকেটে ঢুকে গেছেন। খালিদা: চপলমতী বালিকা। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে এবং পতিপ্রয়াণে বেশ ভারিক্বি ভাব এসেছে চেহারায়। ধর্মপ্রাণ।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যে প্রার্থনা করেছেন সম্প্রতি। সম্ভবত অনুশোচনাঘটিত কারণে বনসাই হবার ইচ্ছে পোষণ করেছেন, এবং সাদরে গৃহীত হয়েছেন আমার পকেট কলোনিতে। তবে, আমার অনুমান ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশি। অন্য কোন কারণ থাকতে পারে... এরা হলেন শহরের বিগশট। যারা এত ওপরে উঠে গেছেন, যে নিচে নামতেই ভয় পান।

এরা ছাড়াও অনেক সাধারণ মানুষজন আছে আমার পকেটে। গলির মোড়ের মাস্তান, যার কথা প্রথমেই বলেছি এবং যে সাম্প্রতিকতম অন্তর্ভূক্তি। দুপুরে ভোসভোস করে ঘুমানো গিন্নীদের অনেকেও আছেন। আছেন কেরাণী ও অফিসার, সাহেব গোলাম! পানের দোকানদার, মাছের আড়ৎদার। পরিচিত, অপরিচিত মানুষজন।

অবশ্য শহরটা খুব ছোট। প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। তারা আমাকে চেনে, অথবা চেনে না। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের যুথবদ্ধ কোন ধারণা নেই। এমন কী তারা ব্যক্তিগতভাবে স্বচ্ছ ধারণা রাখে বলেও মনে হয় না।

তারা শুধু জানে চোরাপথে, সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পকেট কলোনিতে সেঁধোনোর বিদ্যে! এমন নিরাপদ আশ্রয় আর পাবে কোথায়! সমাজের চোখে অদৃশ্য কিন্তু ভীষণরকম কর্মক্ষম বনসাই অস্তিত্ব তো রইলোই একটা, এইবার অন্য অথবা আসল, মোদ্দাকথা দৃশ্যমান অস্তিত্বটা দিয়ে ফুটানি করে বেড়াও, ভয়ে কাঁপো, লাজরাঙা হও, মাস্তানি কর, যৌনাচার কর লুকিয়ে, ইনক্রিমেন্টের দুরাবস্থা দেখে হতাশ হও, ব্যবসা নিয়ে হাপিত্যেশ কর, অতঃপর আমার দ্বারস্থ হও! আমি আপনাদের মহান স্বেচ্চাসেবক হিসেবে নিয়োজিত। বনসাই মানবদের মধ্যে একতা নেই। বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক। এখানে কেউ কাউকে চেনে না। সবার জন্যে আলাদা প্রকোষ্ঠ।

কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই। এখানে মানুষ আসে কেবল, চলে যায় না কেউ। কিন্তু একদিন সেই আচানক ঘটনাই ঘটল। এক লাজুক এবং ভীত তরুণী, যার ছিলো নিরাপত্তাজনিত শংকা এবং নিরুদ্দেশ প্রবণতা, একমাত্র সেই মেয়েটিকেই আমি নিজের থেকে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলাম, এবং সে তা সানন্দে গ্রহণ করেছিলো, যার জন্যে আমি বিশেষ প্রকোষ্ঠ নির্বাচন করেছিলাম, সে চলে যেতে চাইলো। চলে যেতে চাইলো বলাটা ভুল হবে, দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল, এবং পকেট থেকে মাটিতে অবতরণের মুহূর্তেই স্বাভাবিক আকার ধারণ করল।

-যাই তবে? -কিন্তু কেন! আমি জানি, প্রতিটি মানুষই নিরাপত্তারব অভাব অনুভব করে জীবনের কোন না কোন সময়, অথবা গোপন রাখতে চায় কিছু না কিছু, অথবা গোপন থাকতে চায়... আমার এখানে নিরাপদ আশ্রয়, তুমি কেন যাচ্ছ? -কারণ...আমার আর কোন দরকার নেই। কিছুতে কিছু যায় আসে না। মানুষ বড় ভঙ্গুর পদার্থ। কাঁচের মত। গোপন নিরাপত্তার থোরাই কেয়ার করি আমি! গার্লস কলেজের সামনে সিটি বাজায় বখাটে ছেলেপিলে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে।

ওড়না টান দেয়, ধর্ষণ করে অবাধে। -যা হবার হবে, আমি যাই। আমি তোমার কাছে আসি নি, তুমি আমাকে নিয়ে এসেছো। ধরে রাখতে পারলে না, এ ব্যর্থতা তোমার। কাঁচবালিকা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে।

পরেরদিন খবরের কাগজে আমি তার ধর্ষণ এবং মৃত্যুসংবাদ পাই। তার অপূর্ণতা পূরণ করার জন্যে আমি একটা দিয়াশলাই বাক্স ভরি। এখন হবে প্রজ্জ্বলন এবং প্রতিবাদ! জাগো বনসাইমানব সকল! আমি তাড়া দিই তাদেরকে। আমার হিংস্র মুখভঙ্গি এবং রণমূর্তি দেখে তাদের ক্ষুদ্র আয়েশী শরীরগুলো ভয়ে কাঁপতে থাকে। -অনেক পোহানো হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের ওম! আর না।

আমি জানি, তারা পুড়তে ভয় পায়,উড়তে ভয় পায়। শুধুমাত্র মাথা গুঁজে থাকতে ভালোবাসে। আর তারা সবচেয়ে ভয় পায় একে অপরকে দেখে ফেলার সম্ভাবনাকে। এই ভয়টাই আমি কাজে লাগাতে চাই তাদেরকে একতাবদ্ধ করে তুলতে। -তোমরা যদি না বেরোও, তাহলে প্রত্যেককে প্রত্যেকের প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে আয়নাঘরে বন্দি করে রাখবো।

তোমরা দেখবে নিজেদের এবং অপরকে। তোমাদের প্রত্যেকের দিনলিপি প্রকাশ করে দেবো! হুমকি দিই আমি। বৃথা যায় আমার হুমকি। হুড়মুড় করে বের হয়ে যায় তারা। চোখ বন্ধ করে চোঁ চোঁ করে দৌড় দেয় দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে।

এবার আর আমার ক্ষমতা কাজ করে না। স্বেচ্ছায় যারা এসেছিলো, সবাই চলে যায়। মানব বনসাই শিল্পে এতদিনকার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এর কার্যকারণ এবং ফলাফল সহজেই বুঝতে পারি। তারা অন্য কোথাও, অন্য কারো কাছে খুঁজে নেবেই আশ্রয়, হবেই বনসাই, গড়বেই পকেট কলোনি! লুকিয়ে। আর আমি যাদেরকে স্বেচ্ছায় আশ্রয় দিতে চাইবো, তারা কখনই আসবে না, আসলেও থাকবে না।

অন্তত, এই শহরে আমি তা আশা করতে পারি না! আমার পকেটে এখন একটা দিয়াশলাই বাক্স। খামোখাই জ্বালাচ্ছি, নেভাচ্ছি ম্যাচের কাঠি।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।