আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিকৃত

স্যারের বাসা থেকে বের হতেই অদিতির খোলা হাত দুটোয় সূচ ফোঁটালো উত্তুরে বাতাস। ডিসেম্বরের মাঝ বরাবরই শীত জেঁকে বসেছে কলাগাছিতে। এখন সকাল আটটা বাজলেও রাস্তা ফাঁকা । রিকশাও নেই । অদিতি তাই হাঁটতে শুরু করলো।

বাতাসের চাকুতে ফালি ফালি করে কাটা কুয়াশার পরতের মাঝে হেঁটে চলার রোমাঞ্চ,হয়তো পর্বতআরোহেনের মতো। এ যেন, সাদা অন্ধকারের সুমদ্র। , তৃষাকে পথ চলতে হচ্ছে অনেকটা অন্ধের মতো, সামনে হাত বাড়িয়ে। প্রতিদিন প্রাইভেট পড়তে আসতে হয় বলে,রাস্তার বাঁক চিনতে সে ভুল করলো না। আর কিছু দুরেই ভুটভুটি ষ্ট্যান্ড।

সেখান থেকে তিন চাকার ভুটভুটিতে চেপে চব্বিশ মাইল মাত্র দশ মিনিটের পথ। অদিতি হিসেব কষে নিল,সাড়ে আটটার মধ্যে ভুটভুটি পেলে নয়টার মধ্যে বাড়ি। মা একটু বকবে,তবে ঠিকই ম্যানেজ করা যাবে। তিন অক্ষরের ওই ইংরেজি শব্দটার ধারেই অদিতি তার পথের বাঁধা কেটে আসছে। সবে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া।

বয়সটা পাটভাঙ্গা কাঁচা হলুদ রংয়ের শাড়ির মতোই উজ্জল,আবার নুনছাই উঠে যাওয়া চামড়ার মতোই সংবেদনশীল। সকালে সৈয়দ স্যারের কাছে ইংরেজি পড়ার অনুমতিটা বাবা-মায়ের সঙ্গে হাজারো যুদ্ধ করে সে আদায় করেছে। এসএসসিতে এ প্লাস থাকায় ঘরকন্নার ব্যাপারেও অদিতি অন্তত, আরও দুই বছর নিশ্চিন্ত। ভুটভুটি ষ্ট্যান্ডে একটা কাকপক্ষীও নেই। ছাতিম গাছটার নিচে জবুথবু হয়ে দাঁড়ালো অদিতি।

ঠান্ডায় তার হাতদুটো জমে বিবশ। গুটি পাকিয়ে মুখের কাছে নিয়ে ফুঁ দিয়ে গরম করার চেষ্টা করলো। তারপর এই ভেবে সেই ভেবে সে সময় কাটাতে লাগলো। কিন্তু ভুটভুটির নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। বিরক্ত হয়ে পায়চারী করতে শুরু করে অদিতি।

একটু দুরে চায়ের দোকানের দিকে এগুতেই সে ধাক্কা খায় ! দোকানটার বেঞ্চে চাদরমুড়ি দিয়ে এক লোক বসে আছে ! অদিতি বেশ অবাক। ঘন কুয়াশায় সে হয়তো লোকটিকে দেখতে পায়নি ঠিকই,কিন্তু তাই বলে লোকটার নড়াচড়ার শব্দ পর্যন্ত তার কানে আসবে না ? অদিতির মনে কেমন যেন সন্দেহ হয়। ছাতিম গাছটার তলে সে ফিরে যায়। আড়চোখে লোকটার ওপর নজর রাখার সঙ্গে মনে মনে ভুটভুটির গুষ্টিউদ্ধার করতে থাকে সে। তার সন্দেহ কে সত্য প্রমান করে লোকটা হঠাৎ ছাতিম গাছটার দিকে এগুতে শুরু করে।

অদিতির বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ে। ছাতিম গাছটার সঙ্গে সে পারলে মিশে যায়। লোকটা অদিতির সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আশে-পাশটায় ভালভাবে নজর দিয়ে নির্লজ্জের মতো অদিতির শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। লজ্জায় নিজেকে উলঙ্গ মনে হয় অদিতির। কী অসভ্য রে বাবা ! সে যতই ঘুরে দাঁড়ায়,লোকটা ঠিকই কোন বাহানা করে সামনে চলে আসে।

বিরক্ত হয়ে ছাতিম গাছটা ছেড়ে সে রাস্তায় ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু নিস্তার নেই, লোকটা আবারও অদিতির পাশে দাঁড়ায়। তার মুখে বরফশীতল শয়তানি হাসি খেলে যায়। অদিতি রাগে ফেটে পড়ে-'এমন অসভ্যের মতো তাকিয়ে আছেন কেন ?' -দেখার জিনিষ,তাই দেখছি। - একি নির্লজ্জের মতো কথা ! দয়া করে বিরক্ত করবেন না।

রাস্তা ছাড়ুন। ছাতিম গাছটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে লোকটা বলে-‌'আচ্ছা,ঠিক আছে' তারপর মুচকি হেসে রাস্তার কুয়াশার ভাঁজে মিলিয়ে যায়। অদিতি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আকাশ ফেটে কুয়াশার রেণু উড়ছে। খালি মাথা বাঁচাতে রাস্তা থেকে অদিতি ছাতিম গাছটার তলে ফিরে যায়।

সে একবার ভাবে, হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু রাস্তায় লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে মনে হতেই , দমে যায়। কিছুক্ষন পরই কী যেন ভয়ানক অসস্তি পেয়ে বসে অদিতিকে। এরকমটা কখনো আগে তো মনে হয়নি। এটা কি হচ্ছে ! কি যেন একটা ছিটকে এসে লাগে অদিতির কোমরে।

চকিতে ঘাড় ঘুরাতেই অদিতি বজ্রাঘাত ! গা-গুলোনো,ঘেন্না,রাগ,অপমান,বিষ্ময় আর যা যা হতে পারে,সব একসঙ্গে। অদিতি বিশ্বাস করতে পারছে না,সে কি এই পৃথীবির প্রথম মেয়ে,দিনেদুপুরে যার কামিজের প্রথমে পেছনে এবং ঘুরে দাঁড়াতেই সামনে,গায়ে ছিটকে এসে লাগলো একজন মধ্য তিরিশের লোকের বীর্য ?! লোকটা পরিতৃপ্তির হাসি দিয়ে ছাতিম গাছটার পেছন থেকে মিলিয়ে গেল। অতর্কিতে এত বড় আঘাত,এত চরম অপমান বিশ্বাস করতে পারছিল না অদিতি। সে কী করবে ? জোরে কাঁদবে ? লোকটাকে খুঁজে বের করে চড় মারবে ? লোকজন ডাকবে ? পুলিশে দেবে ? কিছুই ঠাহর করতে পারলো না। সে এখন নোংরা।

আঁচল পেতে অপমান,লজ্জা,ও আত্নহত্যা করতে না পারার শক্তি তো সে নিলই। কেবল শিরা-উপশিরায়া বইছে অসহ্য ঘেন্না। কেউ যেন ওর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হুল ফুটিয়ে চলেছে। এত জোরে চিৎকার করতে ওর কোনদিন ইচ্ছে হয়নি,এত রাগ ওর কোনদিন হয়নি,এত কষ্ট ও কোনদিন পায়নি। অদিতি বাড়ি ফিরে এলো।

ভুটভুটিতে আসার সময় ওর মনে হয়েছে,ভুটভুটির সবাই জানে, ওর সাথে কি ঘটেছে। প্রতিটি মানুষ ওকে দেখেছে। প্রতিটি মানুষ বোধহয় ওকে বলছে,অ্যাই মেয়ে তোমার জামায় কি লেগেছে ? আর অদিতি করজোরে বলছে,আমার অপমান। আমার নারীত্ব মন্থনে যে সঞ্জীবনি লেই উঠে আসে,তাই লেগেছে আমার জামায়। আমার আত্বায়।

অদিতি কিভাবে ঘর পর্যন্ত এসেছে ওর মনে নেই। এমন বিধ্বস্ত মুখে সে বাড়ি ফিরেছিল যে তার মায়ের মনে হয়েছে ‌'সাংঘাতিক' কিছু ঘটেছে। যে সাংঘাতিকটায় ভয় সব যুবতী মেয়ের মায়েরাই পায়। খুব ঠান্ডা গলায় অদিতি বলেছিল-‌'মা,আমার জামাটা ফেলে দিও। ' অদিতির মা আন্দাজ করে নিলেন।

কিন্তু ভুল ! অদিতি তার কামরার বাথরুমে ঢুকে সেই যে জামা পরিষ্কারের কাজে লেগে গেল,তা থামেনি আজ পর্যন্ত। সে আর ওয়াশিং মেশিন এখন একই কথা। যে কিনা যন্ত্রের মতো সবসময়ই কাপর ধুয়ে চলছে। বাড়ি ফিরেই জামা পরিষ্কার করছে। ওড়নায় একটু নোংরা দেখলে ঘেন্নায় বমি করছে।

খাতা রাখার আগে কলেজের বেঞ্চিটা পাগলের মতো ঘষছে,আর তাই দেখে হেসে কুটিকুটি হয় ছাত্র-শিক্ষকরা। আছে শুধু পরতের পর পরত কুয়াশা। দু হাতে খেদিয়ে কোনমতে পথ চলছে তৃষা। এ যেন সাদা অন্ধকারের সুমদ্রে দৃষ্টিহীনের পথ চলার মতো। ওপর থেকে দেখলে যেন, তৃষার হিলের ঠোক্কর খাওয়ার খট খট শব্দটা তার নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনাল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।