১. মেডিক্যাল ভর্তিপরীক্ষা বন্ধের সিদান্ত নিয়ে চারদিকে বেশ আলোচনা-সমালোচনা, সমালোচনাই বেশি... এই সিদান্তের ফলে কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী (কিন্তু জিপিএ তুলনামুলক কম) মেডিক্যালে ভর্তি হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, যারা ভর্তি হবার সুযোগ পাবে, তারা অমেধাবী। এটা সত্য, আজকাল গোল্ডেন এ+ পাওয়া খুবই সহজ, কিন্তু তারমানে এই নয় যে যারা এ+ পাচ্ছে তারা কিছু না পড়েই পাচ্ছে। পরীক্ষার আগে দু-তিন মাস তারাও কলুর-বলদের মত পরিশ্রম করেই এ+ পাচ্ছে এবং তারা নিঃসন্দেহে মেধাহীন নয়।
২. একটু অন্যভাবে দেখি।
ধরি, পর পর দুইদিন দুটি মেডিক্যাল এডমিশন টেস্ট নেয়া হল। একই শিক্ষার্থী, তবে ভিন্ন প্রশ্নপ্রত্র। আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, ২য় পরীক্ষায় কমপক্ষে ২০-৩০% পরীক্ষার্থী উর্ত্তীণ হবে যারা প্রথম পরীক্ষায় হয়নি। তারমানে প্রথমে উর্ত্তীণ হওয়া অনেকেই বাদ পরবে। তাছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কিছু অযোগ্য শিক্ষার্থীও ঢুকে যাচ্ছে প্রতিবছর।
সুতরাং কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী, সবসময়ই মেডিক্যালে ভর্তি হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
৩. আমরা অনেকটা ধরেই নিয়েছি যে, এডমিশন টেস্ট গুলোর মাধ্যমে সঠিকভাবে মেধা যাচাই হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ভর্তি পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র কতটা স্ট্যান্ডার্ড? ... আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, একমাত্র বুয়েট ব্যতিত কোন এডমিশন টেস্টেই মেধার সঠিক যাচাই হয় না। বুয়েটের টেস্ট স্ট্যান্ডার্ড এই কারনে যে, সেখানে রিটেন এবং অবজেক্টিভ মিলিয়ে লম্বা সময় নিয়ে একটি পরীক্ষা নেয়া হয়, যা মেডিক্যালের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। বুয়েটে প্রথমে ৪টি বিষয়ের জিপিএ বিবেচনায় এনে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়।
মেডিক্যালে প্রতিবছর যে পরিমান শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়, তাদের রিটেন এক্সাম নিয়ে স্বল্প সময়ে রেজাল্ট প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র অবজেক্টিভ দিয়েও স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে স্ট্যান্ডার্ড অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্ন করার মত শিক্ষক আছে বলে আমার মনে হয় না। একটা সময় ঢাবির ‘ক’ ইউনিটের প্রশ্নপ্ত্র কিছুটা স্ট্যান্ডার্ড ছিল,কিন্তু এখন গত ১০ বছরের প্রশ্ন ভালো ভাবে সলভ করলে এবং কিছু টেকনিক প্রয়োগ করলেই বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়। এভাবে যারা টিকছে তাদের সবাই কি প্রকৃত মেধাবী?
৪. পৃথিবীর কোন উন্নত দেশে এডমিশন টেস্ট এর মত কোন সিস্টেম আছে বলে আমার সল্পজ্ঞানে জানা নেই।
এইধরনের সিস্টেম সবসময়ই কোচিং বাণিজ্যের মত অসাধু প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে। কে না জানে, কোচিং সেন্টারগুলোই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত থাকে। এছাড়াও এই বিশাল বাণিজ্য পরিবার, সমাজ ও দেশকে নানাভাবে ক্ষতি করে যা একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় । যাইহোক, বাইরের দেশে এডমিশন টেস্ট নেই তবে কিছু স্ট্যান্ডার্ডাইজ টেস্ট আছে। যেমন, আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলের জন্য USA-তে SAT টেস্টের score বিবেচনা করা হয়।
এইসব টেস্টের সাথে আমাদের এডমিশন টেস্ট-এর অনেক পার্থক্য। এসব ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের চেয়ে একজন শিক্ষার্থীর analytical power-এর উপর জোর দেয়া হয়। এইসব টেস্ট এবং একাডেমিক রেজাল্ট বিবেচনায় বাইরের দেশে ভর্তি করানো হয়। আমাদের দেশে এইধরনের কোন প্ল্যাটফরম আপাতত নেই, এবং খুব তাড়াতাড়ি হবে না, কারন স্ট্যান্ডার্ড কিছু স্বল্প সময়ে হয় না। যাইহোক, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে এডমিশন টেস্টের বিকল্প না ভাবার কোন কারন নেই।
একাডেমিক রেজাল্ট বিবেচনা করেই ভর্তি করানো যেতে পারে। আবারো বলি, এতে কিছু কম জিপিএধারী মেধাবী শিক্ষার্থী বাদ পরবে। কিন্তু সার্বিকভাবে যারা ভর্তি হবে তাদের ৮০%-ই মোটামোটি মেধাবী হবে। কোন সিস্টেমই সর্বোত্তম নয়, তবে সব কিছু বিবেচনায় যেটা বেশিরভাগ মানুষের জন্য ভাল, সেটাই ভাল। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের HSC, SSC-এর প্রশ্নপত্র এবং খাতা দেখার স্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রশ্নের ৪০% হওয়া উচিত একদম পানি, ৩০% মোটামোটি, বাকি ৩০% খুবই কঠিন... এতে করে পাশের হার কমবে না, কিন্তু মেধার মূল্যায়ন হবে...
৫. একটা কথা শুনতেছি, মেডিক্যাল এডমিশনের বেচে যাওয়া টাকা নাকি পদ্মা সেতু প্রকল্পে লাগানো হবে, সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে একটা কথা ঠিক, আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ টাকা সিস্টেমলসে নষ্ট হয়। SSC, HSC এর মত দুইটি বড় পরীক্ষা দিয়ে এসেও মেডিকেল বা ভার্সিটিতে ভর্তি করাবার জন্য যদি এত বিপুল টাকা খরচ করে এডমিশন টেস্ট নিতে হয়, তাহলে আমার চোখে তা সিস্টেম লস। এরমানে এই নয় যে আমি শুধুমাত্র পদ্মাসেতুতে বিনিয়োগ করার জন্য ভর্তিপরীক্ষা বাতিলের সিদান্ত(যদি সত্যি তাই হয়) সমর্থন করছি। আমি শুধু বলতে চাই, এই ভর্তিপরীক্ষা সিস্টেমের বিকল্প ভাবা ভুল কিছু নয়।
৬. সবশেষে বলব, আমরা যারা বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে ভাল জায়গায় অবস্থান করছি তারাই ভর্তিপরীক্ষার সমর্থনে বেশি তৎপর। কিন্তু এমন অনেকেই আছে, যাদের জিপিএ ভাল, তারা মেধাবীও... কিন্তু একঘন্টার একটা টেস্ট খারাপ হবার কারনে তাদের স্বপ্নপূরন হয়নি। ... এখন পর্যন্ত আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, এইটুকু বুঝেছি, অনেকে আছে যারা পরীক্ষা ভাল দেয়, তাই বলে তারাই মেধাবী নয়। পরীক্ষার হলে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারাই মেধার পরিচয় না। বরং মাঝারি মানের শিক্ষার্থীরা যাদের রেজাল্ট মাঝারি এবং পড়ালেখাবাদেও অন্যান্য অকাজে যারা বেশ তৎপর তারাই প্রফেশনাল লাইফ-এ ভালো করে।
তবে এটাও ঠিক, আমাদের মেধাযাচাইয়ের একটা সিস্টেম লাগবে এবং পরীক্ষা ছাড়া তা সম্ভব না। আমি শুধু এটাই বলতে চাই, সবকিছু বিবেচনা করে মেধাযাচাই-এ ভর্তিপরীক্ষার সিস্টেম থেকে SSC, HSC এর রেজাল্ট বিবেচনা করাই অপেক্ষাকৃত উত্তম। এতে করে, যারা চান্স পাবে তারা অযোগ্য হবে না। এই যোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠতেছে, সে গুলাও থাকবে না যদি SSC, HSC এর প্রশ্নের মান উন্ন্যয়ন হয়। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের implementation অবশ্যই ভাল দিক... সববিষয়ে আস্তে আস্তে সৃজনশীল প্রশ্ন শুরু করা উচিত এবং difficulty level-নিয়েও বেশ চিন্তাভাবনা দরকার।
... আর এইবছর যেহেতু আগে থেকে জানানো হয়নি সেহেতু ভর্তিপরীক্ষা নেয়া উচিত। আগামী বছর থেকে নতুন নিয়ম চালু হলে তা বেশি ethical হয় বলে আমার ধারনা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।