হিমু আমার পরিচিতদের মধ্যে একজন। হিমালয় থেকে হিমু না, শুধু ডাকনাম হিমু। কে তার এই নাম রেখেছে কে জানে তবে এই নামের কারনে সে নিশ্চিত যে হিমু হবার জন্যেই পৃথিবীতে তার আগমন। কটকটে রোদ বাইরে, বেশিক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়ানো যায় না। সে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘রঞ্জু’দা চলো হেঁটে আসি’।
‘তুই পাগল নাকি রে? এই গরমের মধ্যে কোথায় হাঁটবি?’ সে বলে-‘শহরের নীলাকাশে আজ ঝকঝকে রোদ। তোমার কি পথে পথে হাঁটতে ইচ্ছা করছে না?’। আমি বিরক্ত গলায় বলি ‘না’।
হিমুর এই অবস্থার জন্য আমিও খানিকটা দায়ী । স্কুলে থাকতে ওকে হিমুর কিছু বই উপহার দিলাম।
এরপর থেকেই অবস্থা খারাপ। সকাল বেলা বের হওয়ার সময় প্রতিদিন হিমুর বাবার সাথে দেখা হয়। ভদ্রলোক চশমার এক ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকান । সেই দৃষ্টির অর্থ হচ্ছে, ‘ফাজিল ছেলে। তোর জন্য আজ হিমুর এই অবস্থা’।
হিমুর অবস্থার কিছু বর্ণনা দেয়া যাক । জোছনা এলেই সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে সে আমার কাছে এসে বলবে, ‘রঞ্জু’দা এই জোছনা তো গৃহত্যাগী হবার মত। তোমার কি মনে হয়?’ আমি বলি, ‘আমার এমন কিছুই মনে হচ্ছে না। সামনে না তোর ফাইনাল? জোছনা বাদ দিয়ে বাসায় গিয়ে পড়তে বস’।
সে চলে যাবে। পরদিন তার বাবা এসে আমাকে বলবে, ‘রঞ্জু তুমি কি জানো টুনু কোথায়’?(টুনু হিমুর আরেকটা নাম। এই নামে তাকে খুব মানুষই চিনে)। আমাকে শীতল গলায় মিথ্যা বলতে হবে, ‘না আঙ্কেল আমাকে কিছু বলে যায় নি’। এক দু’দিন কোথায় যেন থেকে সে আবার বাসায় ফিরে আসে।
হিমু স্টুডেন্ট হিসেবে একেবারে ফার্স্ট ক্লাসেরও উপরে। স্কুলে থাকতে একবার অঙ্ক পরীক্ষায় সে কি সব অদ্ভুত নিয়মে অঙ্ক করে আসল। খাতা দিলে দেখা গেল সে পাশ মার্কও পায় নি। সে স্যার এর রুমে গিয়ে বলল -সে নিশ্চিত তার খাতায় কোন ভুল নেই। স্কুলে তুলকালাম কাণ্ড।
হেডস্যার মিটিং টিটিং ডেকে বসলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গণিতের প্রফেসরকে ডেকে আনা হল। তিনি বললেন ওর খাতায় আসলেই কোন ভুল নেই। শুধু প্রচলিত কোন নিয়মে করা হয় নি –এই যা।
একদিন গলির মাথায় রিমার সাথে দেখা।
সে হাসি দিয়ে বলল, ‘রঞ্জুদা টুনু কোথায় আছে জানেন?’(রিমা হিমুর ক্লাসমেট-দুইজন একসাথে এই পাড়াতেই বড় হয়েছে। একে অপরের খুব ভাল বন্ধু। আমার অবশ্য সন্দেহ আছে। ) আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম ‘আমি জানি না’। রিমার চোখের কোনায় বিষণ্ণতা ভর করল।
সে আমাকে ধরা গলায় বলল, ‘একটু খোঁজ নেন’। আমি তার বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সাথে সাথে আমার মনও একটু খারাপ হল। মন খারাপ হওয়ার কারণ হচ্ছে এইবার হিমু যাবার আগে আমার সাথে দেখা করে যায় নি।
লোক মারফত খবর পেলাম সে নাকি কোন এক মসজিদে থাকছে।
সারা রাত নামাজ পড়ে। একদিন তার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি তার চোখ মুখ বসে গেছে। গায়ে সেই হলুদ পাঞ্জাবী, চোখে সুরমা দেয়া, গায়ে আতরের গন্ধ। আমি তাকে বললাম, ‘বাসায় চল’।
সে বলল- ‘হুমায়ূন স্যারের অবস্থা খুব খারাপ। তাঁকে সুস্থ না করে বাসায় ফিরছি না’। আমি বললাম ‘ওনার হয়েছে ক্যান্সার, চিকিৎসাও হচ্ছে জানি। তোর দোয়ায় কি সব ঠিক হয়ে যাবে? দোয়া তো বাসায় বসেও পড়া যায়। যায় না’? সে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল ‘না’।
এক রাতে দেখলাম হিমুর বাবা হিমুকে লোক দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,‘পড়া নাই লেখা নাই- হিমুগিরি হচ্ছে। বের করছি তোর হিমুগিরি, ফাজিল কোথাকার’। হিমু কাঁপতে কাঁপতে বলছে, ‘আজকে রাতটা থাকতে দাও বাবা। স্যারের অবস্থা খুব খারাপ।
স্যারের দোয়ার খুব প্রয়োজন। শুধু আজকের রাতটা’। হিমুর বাবা মানলেন না। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে খবর এল হুমায়ূন আহমেদ আর নেই।
পরদিন ভোরে হাঁটতে বের হয়েছি।
হিমুর বাবাকে দেখলাম বারান্দায় বসে আছেন- ভদ্রলোক রাতে ঘুমাননি বোধ হয়। গলির মাথায় রিমার সাথে দেখা –তার চোখ ভর্তি জল। রাতে খুব কেঁদেছে মনে হচ্ছে। রোদ ফুটে উঠছে- ঝকঝকে রোদ। একঝাঁক পায়রা বৃত্ত তৈরি করে ঘুরছে।
সম্ভবত পায়রারা নিজেদের মধ্যে খেলছে। শুধু একটা পায়রা বৃত্তের বাইরে। সে খুব চেষ্টা করে যাচ্ছে বৃত্তের ভেতরে ঢোকার –পারছে না। সেই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে না তাকিয়ে আমি পথে পথে হাঁটতে লাগলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।