[অন্যর দোষ না খুঁজে আগে যদি সবাই নজের দোষটা খুঁজত তাহলে বোধহয় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত]............... [পথের শেষ নেই, আমার শেষ আছে, তাইত দ্বন্দ্ব] http://mamunma.blogspot.com/
অনেকদিন পরে , মনে ভাবনার রেণুগুলো যেন পাখা ফিরে পেয়েছে, উড়ছে শরতের হালকা বাতাসে, ঠিক সেই আগের মত।
যেদিন এখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম শেষ বিদায় পূর্ণ করে, সরু পথটার মাঝামাঝি যেতেই পেছনে ফিরে তাকিয়েছিলাম একবার , নিঃস্ব ফেলে আসা বিছানাটার মলিন মুখ মনে কষ্টের ঢেউ বইয়ে দিয়েছিল। উপস্থিত মেসের সহবাসিন্দা দু’জন সহজাত ভঙ্গিতে হাত নাড়ছিল। সরু গলিটার উপরে আকাশের যে চিলতে অংশটুকু নজরে আসছিল সেখানে সাদা গুচ্ছ গুচ্ছ শরতের মেঘ উড়ে যাচ্ছিল আমার নবযাত্রার পানে অভিনন্দন এর হাস্য ঝিলিক ছড়িয়ে।
বিছানাটা আজও খালি, মলিন আজও তার মুখ খানি যেন।
শুনলাম , নতুন যে ছেলেটি এসেছিল আমার সিটে , সে চলে গেছে গতকাল। হয়তো গেছে আমারই মত কোন উচ্চাভিলাষ মোহে অথবা ঠিক আমার মতই নয়, হতে পারে কোন ভিন্ন সুরের উচ্চতর জীবনাধ্যায়ে। কিন্তু অচেনা বন্ধু, ফিরে আসতে হয়, এই তো জীবন;ছোট ছোট বৃত্তের পরিধি।
লাফ দিয়ে বসতেই বিছানাটা কচকচ করে যেন স্বাগতম জানালো , চিনল, পুরাতন মনিবকে।
এই জীর্ণ মেসটা ছেড়ে যেদিন পূর্ণ বিদায় নিয়ে চলে গেলাম , বিয়েটা হয়েছিল তার তিন দিন আগেই, ২৮ শে আগষ্ট , ২০০৬ তারিখে।
বিয়ে হয়েছিল রুমকীদের বাসাতেই। আমার পরে লোক বলতে কেবল তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আমার। বাবা-মা তো বিয়ের আগের রাতেই মোবাইলে ফাইনাল কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এই মেয়েকে বিয়ে করলে বাড়ী আসা বন্ধ। ’ সকল হিসেব নিকেষ আর ভালবাসার সূতো ততণে এত শক্ত হয়ে উঠেছিল যে বাব মার সে প্রত্য হুমকিতে কোন ভাবান্তরই হলো না আমার।
বিয়ের ঐ দিনটির সাত আট মাস আগে শুরু হয়েছিল রুমকীর সাথে পরিচয় পর্বটা।
বিয়ের দিন ভেবেছিলাম, পরিচয় পর্ব,শেষ হয়েছে, পরিচয় পেয়েছে পূর্ণতা । কিন্তু আজ বুঝছি, পরিচয় এর প্রথম পরিচ্ছেদটাই আমার পাঠ করা শেষ হয়নি।
সেই সাত আট মাস আগে একদিন ঈষানের সাথে যেতে হয়েছিল বনানী এক হাইফাই রেস্তোরায়। ঈষান আমার তখনকার দিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। রেস্তোয়ার যাবার মুখ্য কারন ছিল ওর প্রেমিকার (নামটা মনে পড়ছেনা এই মুহূর্তে ) সাথে দেখা করা ।
সেখানেই রুমকী এসেছিল, ঈষানের প্রেমিকার বান্ধবী সে। তারপর ফোন নম্বর বিনিময়, কথা আর প্রেম। আমার তো মনে তখন বুয়েটে পড়ার অদম্য ভাব আর রুমকীর মনে ধনী কন্যার অচিন্তনীয় আবেগ। সেই পুরাতন প্রেম এর গল্প। ইতিমধ্যে ঈষান আর তার প্রেমিকা বিয়ে করে পাড়ি জমিয়েছিল অষ্ট্রেলিয়া।
ধনীর কন্যার তারপর থেকেই বিয়ের ইচ্ছা প্রবল হতে থাকে। সেই ঘোরের কালে একদিন তাই হঠাৎ জানতে বাধ্য হলাম ওর বাবা বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ এবং একই সাথে টপরেটেড শিল্পপতিও। ইনডিসিশন এ পড়ে গিয়েছিলাম। পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল আমার মতো একজন সামান্য ইস্কুল মাষ্টারের ছেলের , একজন নব্য ইঞ্জিনিয়ারের। কিন্তু সেটাই তো কাল, গুণের বদৌলতে না হয় ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই ফেলেছি তখন সদ্য, কিন্তু চাকুরীরর জন্য ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে শুরু করেছিলাম গুনটাই কোন কংক্রিট যোগ্যতা নয় চাকুরীর জগতে।
এখানে বিরাজ করে আরও অনেক হিডেন রহস্য। সম্বল ছিল কেবল দুটো বেশ রিষ্ট পুষ্ঠ টিউশনি।
হিসেব নিকেষ শুরু হয়ে গেলো গণিতে ফুটন্ত মস্তিষ্ক। লোভ , লালসা আর মোহাচ্ছন্ন এক ভালবাসা মিলিয়ে সুন্দর একটা সমীকরণ বানাতে তাই কষ্টই হয়নি।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব , শ্বশুর মশাই ও যখন কোন অমত করলেন না এই বেকার ইঞ্জিনিয়ারটিকে তার জামাই হিসেবে মেনে নিতে তখন আর পিছুপা হবার ভাবনাই কেনো জাগবে? একটা চিন্তা এসেছিল, ভেবেছিলাম ক্ষণিক, কিন্তু মনে হয়েছিল, বিয়ে নামক সাধারণ একটা বিষয় ঐ উন্নত(!) সমাজ আর সম্রাজ্যে অমত করার মত ক্ষীণ মানসিকতার ফাঁদ থেকে অনেকটাই যেন মুক্ত।
এর উল্টো ধারনাও যে সত্যি হতে পারে সেদিন কি আর তা ভাবলে বাবা মা কে ভুলে দৌড়াতে দৌড়াতে বর সেজে বসি?
আসলে শ্বশুর মশাইযের একটিই ছেলে, দেশের বাইরে পড়ছে আর অন্য মেয়েটি মানে আমার শ্যলিকা টি স্কুলে, স্ট্যান্ডার্ড সেভেনে পড়ে সবে। এত ঐশ্বর্যের পাহাড় , ব্যবসা পাহারাদিতে ঘরজামাই হিসেবে সদ্য পাশ ইঞ্জিনিয়ার হয়তো তাই তাদের জন্য ভালোই হলো। গড়ে পিঠে নেবে ভেবে থাকতে পারে। আমিও বুঝে না বুঝেই ছাল চামড়া ছাড়িয়ে সে গড়ন পিঠনের শিক্ষায় বুক পেতে দিলাম।
রুমকীর ভালবাসার কমতি ছিলনা।
দেহ মনে জুড়ে প্রচন্ড সুখ। চেনা জানা বন্ধুরা যেখানে সবে ফ্রেশার হিসেবে বড় কোন কোম্পানী জব পেতে শুরু করেছে তখন আমি নিজেকে দুই তিনটে কোম্পানীর ছোট খাট কর্ণধার ভেবে আকাশে উড়ছি। সুখপাখী তো নিঃসন্দেহে মম মনে বাসা বাধতেই চাইবে। বাবা মা মেনে না নিলেও , যখন বাড়ীতে গেলাম একদিন বুঝলাম আমার সে সুখের আবেশ তাদেরও নিরবে কম আবেশিত করেনি। জগতটাই স্বার্থপর।
ওনারা নিরব সম্মতি জ্ঞাপন করে পুনরায় বাড়িতে আসতে বললেন সময় পেলে।
মন উচাটনে পড়তে শুরু করেছিল, যখন সেই অল্প অভিজ্ঞতায় অনেক উপর থেকে ব্যবসা আর দেশিয় নানা সিস্টেমে অবর্ণনীয় দূর্ণীতি চোখে পড়তে লাগল, সদ্য ছাত্রজীবন কাটানো সদ্ভাবনায় প্রফুল্ল মন মেনে নিতে লাগল সে সব। কিন্তু পরণেই ভেবে নিল , এতো ঢেড় ভাল, অন্তত অন্য কোন জবে প্রেষনে উর্ধ্বচাপে পড়ে কোন অন্যায় করতে হচ্ছেনা। খালি দেখতে হচ্ছে। ভালই হয়েছে।
ব্যস্ততা তো বাড়ছিলই দ্রুত, ২০০৬ এর শীতকাল , দেশের রাজনীতিতে ভীষণ অস্তিরতা। শ্বশুর মশাই ব্যবসার চেয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। নিজেকে অনেক বড় কিছুমনে হচ্ছিল ব্যস্ততার মাঝে মতায়নের ব্যাপকতায়। রুমকীও বড়লোকী চাল বাড়াতে শুরু করেছিল। সুখে থাকলে ভূতে কিলায় আর কি।
কদিন পর পর বিদেশে শপিং , নতুন ছেলে বন্ধু। কিন্তু ভালবাসার কমতি ছিলনা।
অবশেষে এল সেই ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারী। দেশের রাজনীতিতে অভাবনীয় রূপান্তর।
দূর্ণিতী মুক্ত করার এক মহান ব্রত নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অবাক হলাম শ্বশূর মশাইয়ের ব্যবসাতেও মন্থরতা চলে এল। প্রথমে ভাবলাম, একি আমার মত অনভিজ্ঞর ভুলে। কিন্তু পরে বুঝতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি আসলে কোন নিয়ামকই না, কর্মীই মাত্র। দেশের পরিবর্তীত বাতাসের সাথেই ব্যবসার ধরন ধারন, জ্যামিতিক হারের প্রোফিট সব ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে যখন শুনছিলাম দূর্র্ণিতীবাজদের লিস্ট হচ্ছে। শ্বশূর মশাই খুব টেন্সড থাকতে লাগলেন। প্রথম লটেই ওনার নাম চলে এল পত্রিকার পাতায়।
মাত্র এক মাসের মধ্যেই গ্রেফতারি পরওয়ানাও। কিন্তু অবাক হলাম যখন শ্বশুর মশাইযের সাথে নিজেকেও খুঁজে পেলাম জেল খানায়।
সেই প্রথম জেলখানার সাধ পাওয়া হলো। যাক তবুও ভিআইপর জামাই হিসেবে অর্ধ ভিআইপি সম্মান পেলাম। কোন কিছূ না বলেই অবশ্য পরের দিন ছেড়ে দিয়েছিল। আসার সশয় শ্বশূর মশাই বলে দিয়েছিলেন সবাইকে দেখতে। জেল থেকে বের হয়ে পত্রিকার পাতায চোখ বুলিয়েই দেখলাম রুমকী আর ওর মার নামেও কেস করতে চাইছে সরকার ।
ওদের ব্যাংক একাউন্টেও বিপুল অংকের অর্থ পাওয়া গেছে, যার কোন ট্যাক্স দেয়া হয়নাই। রুমকীকে একদিন পরেই ছাড়ানো গিয়েছিল, কিন্তু শ্বাশূড়ীর কেস পোক্ত ছিল বেশ।
ও বাড়ীতে তখন আমি আর রুমকীই প্রধান কর্তা। খুব মন মেজাজ খারাপ থাকত। কি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম ভেবে অস্থির হতাম।
বাবাও একদিন ফোন করে খবর নিয়েছিলেন কেমন আছি। হতে পারে সেটার ও একটা এফেক্ট ছিল।
রুমকীর সাথে প্রায়ই ঝগড়া হতো। যদিও রুমকীর মন বিষন্ন জেনেও আমি প্রায়ই নিজের রাগ ঝাড়তে লাগলাম ওর উপর। শ্বশূর শ্বাশূরী দ্বয়ের নামে পত্রিকার পাতায় নিয়মিত দূর্র্ণীতির ফিরিস্তি পরতাম আর রুমকীর কাছ বিষোদগাড়ন করতাম।
ওকম যাবে কেনো। কদিন বা আমার সে সব পট পাল্টানো কথা শুনবে। আমাকেও শুনাতে লাগল কথা, খোটা দিতে লাগল দারিদ্রের। বলতে লাগল বানিয়ে বা হয়তো জেনেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে কুৎসা।
এরই মধ্যে একদিন দেখলাম কয়েকজন বিশিষ্ট উপদেষ্টা আবার পদত্যাগও করলেন।
অবাক হলাম। তবে কি রুমকী যা বলত...। দূর , তা হবে কেনো, আমি নিজেই তো কত স্বাক্ষী শ্বশূর মশাইয়ের কৃতকর্মের।
স¤পর্কটা ধীরে ধীরে তিক্ততার মধ্যে চলে যাচ্ছিল, আমারও ব্যবসা দেখতে ভাল লাগছিলনা। কিন্তু শ্বশূর মশাইকে কথা দিয়ে এসেছিলাম।
যাক এর মধ্যে রুমকীর মার কেসটা মিটআপ হয়ে গেলো হঠাৎ একদিন । মোটামুটি একটু ঠান্ডা পরিবেশ ঘরে, উনি ফিরে আসায়। খুব নামায কালাম পড়তে লাগলেন শ্বাশূড়ী।
কিন্তু বেশীদিন না , ঝগড়া টা এবার আরও বাড়লই, বিছানাটাও পৃথক হলো। হবেই না কেনো।
শ্বশূর মশাইয়ের জামিনের ব্যাপারে আমাকে কিছূ কাজ দিয়েছিলেন ওনাদের উকিল, আমি করতে সম্মত হয়নি। আমি তখনও জানতাম এত যার নামে দূর্ণাম আর কেস তার শাস্তি হবেই। জামিন তো পাবেই না। রুমকী রেগে আগুন হলো। আমাকে আর বললই না কিছু।
সে নিজেই উকিলের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করল।
অবশেষে অবাক হলাম, রাজনীতির পটে আবার নতুন মেঘ, নতুন শরতের শুরুতেই একে একে জামিন পেতে শুরু করল সব বড় বড় দূর্ণীতিবাজ নামে আখ্যায়িত ভিআইপি গণ।
শ্বশুর মশাইই বা আর বাদ যাবেন কেনো। তিনিও ভীষণ প্রতাপশালী ছিলেন। যেদনি জানলাম উনি আগামীকাল ছাড়া পাচ্ছেন জামিনে, আমিও খুশি হলাম অজান্তে।
তোড়জোড় এ লেগে গেলাম স্বাগত জাননোর জন্য। কিন্তু আগের রাতে চড়াও হলো রুমকী। ভীষণ প্তি। আমাকে চলে আসতেই হলো। যে লোকটির নামে আমি এত বদনাম করেছি, যার বিরুদ্ধ কথা বলে রুমকীর সাথে ভালবাসার বন্ধন শীথিল করেছি তার আগমনের আগেই রুমকী চাইল আমি যেন বিদেয় হই।
না হলে ওই চলে যাবে। তাই কি হয়। ওযে ভীষণ জেদি। আচ্ছা আমার কি দোষ, পত্রিকার পাতায় এত পড়ছিলাম, নিজে ও তো জানতাম অনেকটা। কিন্তু বাস্তবতা সেটাই যেটা বাস্তবে ঘটে, ভুলে যাচ্ছিলাম।
সকালে গোপনে গৃহ ত্যাগ করে ফিরে আসি পুরাতন মেসে। লজ্জায় না ােভে তা জানিনা। কিন্তু ফিরেতো আসি বহুদিন পরের আরেক শরতের সকালে।
ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতেই সম্বিত ফিরে পেলাম।
শ্বশূর মশাইয়ের নম্বর। চলে এসেছেন তাহলে বাসায়।
‘বাবাজী ব্যবসাটা যখন সুন্দর বুঝে নিতে লাগলে , ভাবলাম; ভেবে শান্তি পেলাম এই ভেবে যে অর্ধেক মনের মত একটা জামাই পাওয়া গেছে। আর আজ জেনেছি অর্ধেক না পুরাপুরি মনের মত জামাই পেয়েছি। তুমি আর দেরি করনা বাবাজী এুনি চলে এস, নির্বাচন করতে হবে না? তুমিই পারবে, তোমাকেই পাশে প্রয়োজন বাবা, তোমাকেই প্রয়োজন।
’
কিন্তু বাবা, রুমকী?
‘আরে দেখ, বলতেই ভুলে গেছি, ওতো তোমাকে ফেরাতেই রওয়ানা দিয়েছে। বাবাজী, জীবন হলো - জানতো, ছোট ছোট বৃত্তের পরিধি। জোড়া দিয়ে দিয়েই সেটাকে বৃহত্তর বৃত্তে পরিণত করতে হয়। ’
২১/০৯/০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।